তিতিরের ঘুম ভাঙতেই দেখলো মুগ্ধ গুনগুন করে গান গাইছে। ও বলল,
-“আপনি গান গাইতে পারেন?”
মুগ্ধ বেড়ী দিয়ে তিতিরকে আগলে রাখা হাতটা সরিয়ে নিল। তিতির আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল। তিতিরের ঘুমে জড়ানো কন্ঠস্বরটা মুগ্ধর বুকে গিয়ে লাগলো। মুগ্ধ সত্যি এবার চিন্তায় পড়ে গেল। ও তিতিরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? সর্বনাশ! তিতিরকে ভাল লেগেছে এটা ঠিক, কাল যখন বাসে ওর কাধে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন থেকেই। ভাল লাগাতে তো দোষ নেই। কিন্তু প্রেমের মত ভুল ও আর করবে না, খুব শিক্ষা হয়েছে। আর না। ও জানে ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে।
মুগ্ধ চুপ করে আছে দেখে তিতির আবার জিজ্ঞেস করল,
-“কি হলো বলুন না, আমি তো আপনাকে গুনগুন করতে শুনলাম।
-“গান কে না গাইতে পারে?”
-“আমি পারিনা। আচ্ছা, আপনি যখন গান গাইতে পারেন আমাকে একটা গান শোনান। গান আমি খুব পছন্দ করি।”
-“এখন?”
-“হুম, এখনই তো গাইছিলেন।”
-“আমি যদি গাইও সিএনজির শব্দে কিছু শুনতে পাবে না। তারচেয়ে থানচি পৌঁছে রাতে শোনাবো।”
-“আমাদের থানচি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে?”
-“অলমোস্ট।”
-“ও।”
তারপর মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তিতির, তুমি এই গুণটা কিভাবে রপ্ত করেছো একটু বলবে? আমি না রাতে ছাড়া ঘুমাতেই পারিনা। আমাকে টিউটোরিয়াল দাও। খুব দরকার।”
-“ওটা আমার জন্মগত গুণ, আর প্লিজ আমার ঘুম নিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা সরি।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। সিএনজি চলেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে দেখা গেল বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তারা ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“তুমি বলেছিলে সিলেট গিয়েছো, সিলেটের কোথায় গিয়েছো?”
-“মাধবকুন্ড, জাফলং, রাতারগুল আর সিটিতেই একটা চা বাগানে। আর মাজারে তো গিয়েছিই।”
-“সবাই এসব যায়গায়তেই যায়। আমিও প্রথম এসব যায়গাতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু নেক্সট বার সিলেট গেলে বিছনাকান্দি মাস্ট যাবে।”
-“বিছনাকান্দি কোথায়? আর ওখানে কি আছে?”
-“বিছনাকান্দি সিলেটেই। তবে যাওয়ায় একটু প্রব্লেম আছে। প্রথমে লেগুনা কিংবা সিএনজিতে করে যেতে হবে। তারপর পায়ে হেঁটে। তারপর নৌকায়। কিন্তু এত কষ্ট করে যাওয়ার পর যায়গাটা দেখে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। ওখানে আকাশ নীল, পাহাড় নীল। নদীর পানিও নীল। ইন্ডিয়ার একদম সীমান্তে। ইন্ডিয়ার একটা ঝড়নার পানি এসে ওই নদীটায় পড়ে। অনেকটা জাফলং এর মতই, পানির নিচে পাথর। তবে ডিফারেন্স হলো ওগুলো অনেক বড় বড় পাথর আর জাফলং এর পানি যেমন সবুজ, বিছনাকান্দির পানি নীল। শুধু যে নীল তাই নয় স্বচ্ছও। এত স্বচ্ছ পানি যে তুমি গলা সমান পানিতে নেমে গেলেও নিচে তাকিয়ে পায়ের পাতাটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবে। তা বলে একা একা নেমো না, স্রোত তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির স্রোত এত বেশি যে অনবরত কলকল ধ্ধনি হতে থাকে। জাস্ট স্পিচলেস!!!”
-“ধুর, আপনি খুব খারাপ! খালি লোভ দেখান।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বাইরে তাকালো।
আরেকটু সামনে যেতেই তিতির বিমোহিত হয়ে গেল রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য দেখে। দুপাশের পাহাড়গুলোই রাস্তা থেকে অনেক নিচে। বাম পাশের পাহাড়গুলো দেখতে একরকম, ডান পাশের গুলো আবার আরেকরকম। রাস্তার ধারে ফুটে রয়েছে রঙ বেরঙের বুনোফুল আর অচেনা ছোট ছোট বুনোলতা। তিতিরকে সেদিকে তাকিয়ে তাকতে মুগ্ধ বলল,
-“সুন্দর না বুনোলতা গুলো?”
-“হুম।”
-“বলোতো কেমন লাগতো এগুলো না থাকলে?”
-“মানে?”
-“আসলে এগুলো তো আগাছা! এগুলো যদি নিয়মিত কেটে ক্লিন করে রাখা হতো তাহলে কেমন লাগতো?”
-“কি জানি! সেরকম তো আর দেখিনি কখনো। এইতো প্রথম দেখছি।”
-“ভাল লাগতো না। মেঘালয়ে এসব আগাছা নিয়মিত কেটে রাখা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ ফিট উপরে কিন্তু সব পাকা রাস্তা। সব কিছু হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। এই ২৮০০ ফিট উপরের সাধারণ বুনো সৌন্দর্যই আমার কাছে বেশি ভাল লাগে।”
-“ও।”
মুগ্ধ তিতিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“যা ন্যাচারাল তা সব আমার ভাল লাগে।”
তিতিরের কেমন যেন লাগলো বুকের ভেতর। তিতির বুঝলো না!
দরজায় টোকা পড়ল। তারপর ভাবীর গলা পাওয়া গেল।,
-“তিতির, এই তিতির.. ওঠো, আজ না তোমার ৮:৩০ এ ক্লাস। এখনো যে উঠছো না? দেরী হয়ে যাবে তো বাবা।”
তিতির চোখ মুছে পানি খেয়ে গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
-“ভাবী আমি উঠেছি, তুমি যাও.. আমি আসছি।”
মুগ্ধর পাঠানো অডিওটা শুনতে শুনতে মনে পড়ে গিয়েছিল ওদের প্রথম পরিচয়ের সেই বান্দরবান ট্রিপের কথা। আজ ৫ বছর পরেও চোখে ভাসে সব। ওসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত পার হয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে ও টেরই পায়নি। ফ্রেশ হয়ে এসে চেঞ্জ করলো। ক্লাসে যেতে হবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চোখ পড়লো বাঁশের পেনহোল্ডার টার দিকে। এই পেনহোল্ডার টা ও নিলগিরিতে উল্টেপাল্টে দেখেছিল কিন্তু কেনেনি। ওর পছন্দ হয়েছিল বুঝে মুগ্ধ কখন যেন কিনে নিয়েছিল। অনেক পরে ঢাকায় আসার পর ওকে দিয়েছিল। জিনিসটাকে আজও খুব যত্নে রেখেছে ও। মুগ্ধর দেয়া প্রতিটা জিনিস, মুগ্ধর সাথে কাটানো প্রতিটা ছোট ছোট স্মৃতিগুলাওকে খুব যত্নে রেখেছে ও। শুধু মুগ্ধকেই রাখতে পারেনি!
সেদিন দুপুরের দিকে ওরা নিলগিরি পৌঁছেছিল। সিএনজি পার্কিং এ রেখে ওরা টিকেট কেটে ঢুকলো। তিতির মুগ্ধর ঠিক পাশে পাশে হাঁটছে না। একটু পিছন পিছন হাঁটছে। ছেলেদের পাশাপাশি হাঁটতে ওর অস্বস্তি হয়। তিতিরের যায়গাটা ভাল লাগলো না। সবার মুখে শুনেছে নিলগিরি সুন্দর নিলগিরি সুন্দর। কিন্তু এখানে এসে ওর কাছে মনে হচ্ছে কোনো ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে এসেছে। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াগুলো যেমন সুন্দর সাজানো গোছানো থাকে সেরকমই। ও জানে নিলগিরি আর্মিদের যায়গা তবু পাহাড়েও ক্যান্টনমেন্টের মত হবে ভাবেনি। এখানে ভালই ভীর। ওদের মতই অসংখ্য লোকজন এসেছে নিলগিরি দেখতে। প্রায় প্রত্যেকটা দলই মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত। একজনের ছবি তোলা হচ্ছে তারপর পালাক্রমে সেটা দলের সবাইকে দেখানো হচ্ছে। সবাই আবার সেই ছবি এনালাইজ করছে। অথচ কোথায় এসেছে সেটা দেখছেই না! অল্প কয়েকজনকেই দেখা গেল ঘুরে ঘুরে দেখতে। মুগ্ধ ঠিকই বলেছিল।
ওরা পাথরের বানানো সিড়ি দিয়ে একটা কিনার ধরে উপরে উঠছিল। বাম পাশে একটু নিচুতেই খাবার আর পাহাড়ীদের হস্তশিল্পের দোকান। উঁচু পাহাড়টা ছিল ডান পাশে। উঠেই দেখতে পেল পাহাড়ের কিনারে কিনারে পাথর দিয়ে বেশ কয়েকটা চেয়ার টেবিলের মত বানানো। তার পাশে রেলিং দেয়া। পাহাড়ের উপরে চার পাঁচটা কটেজ দেখা যাচ্ছে। কটেজগুলো পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু যায়গার কিনারে কিনারে বানানো। মাঝখানে চারকোণা একটা যায়গায় টাইলস বসিয়ে ড্রইংরুমের মেঝের মত করা হয়েছে। বামপাশে দেখলো বান্দরবানের একটা ম্যাপ যেখানে সব ইম্পরট্যান্ট যায়গাগুলো চিহ্নিত করা আছে। এই একটা জিনিসই শুধু ওর ভাল লাগলো।
তিতির মুখে কিছু না বললেও মুগ্ধ বোধহয় ওর ভেতরকার রিয়াকশনটা বুঝতে পেরেছিল। মুগ্ধ বলল,
-“ভাল লাগছে না না? সব প্লাস্টিক সৌন্দর্য বলে মনে হচ্ছে?”
-“আসলে আমার আফসোস হচ্ছে, এত সুন্দর পাহাড়টাকে কেটে কেটে এরকম ইট পাথরের কটেজ বানানোর কি দরকার ছিল? আবার দেখুন না, ওই যায়গাটাকে পুরো ড্রইংরুম বানিয়ে ফেলেছে।”
মুগ্ধ হেসে ফেলল। তিতির বলল,
-“আপনি বলছিলেন না বুনোলতাগুলো কেটে ফেলায় মেঘালয়ের পাহাড়ী রাস্তাকে আপনার ভাল লাগেনি। আমারও তেমন। যদিও আমি আগে এখানে আসিনি তবু মনে হচ্ছে এগুলো না থেকে স্বাভাবিক একটা পাহাড় হলেই বেশি ভাল লাগতো। এই যায়গার জন্য মানুষের এত লাফালাফি! আমি তো হতাশ হলাম।”
-“তিতির চোখ বন্ধ করো।”
-“কেন?”
-“অপরিচিত হওয়া স্বত্তেও আমাকে এতটা বিশ্বাস করে আমার সাথে এতদূর আসতে পেরেছো, আর এখন একটু চোখ বন্ধ করতে পারবে না?”
তিতির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নিজের চোখ বন্ধ করল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরলো। তিতির চোখ খুলে ফেলল। মুগ্ধ তিতিরের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-“এতক্ষণে ভয় পেয়ে হোক আর যাই হোক, তুমি অলরেডি আমার হাত ধরে ফেলেছো। আরেকবার ধরলে আশা করি কোন ক্ষতি হবে না। আর অনেস্টলি স্পিকিং আমার মনে কোন দোষ নেই।”
তিতির ওর ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসিটা বজায় রেখে নিজেই মুগ্ধর হাত ধরলো। তারপর চোখ বন্ধ করলো। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির অজান্তেই হাঁটছিল যেদিকে মুগ্ধ ওকে হাঁটাচ্ছিল। তারপর এক যায়গায় থামলো। তিতিরের পেছনে দাঁড়ালো মুগ্ধ। তিতিরের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বলল,
-“এবার চোখ খোলো।”
তিতির চোখ খুলতেই দেখতে পেল, ওর সামনেই অনেক অনেক নিচে অনেক অনেক পাহাড়। কাছের গুলো বড়, দূরের গুলো ছোট। দূরে যেতে যেতে পাহাড়গুলো যেন একেকটা পিঁপড়ার সমান হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছে এতক্ষণ যে রাস্তা থেকে পাহাড় দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল তা নিতান্তই কাছে ছিল। পাহাড়গুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ অনেকগুলো ট্রায়াঙ্গল একটার ওপর একটা এঁকেছে। তারপর সবুজ রং করে দিয়েছে। কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা হালকা সবুজ। এ এক অদ্ভুত সবুজের খেলা। বান্দরবানের একমাত্র নদী সাঙ্গু সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে সেই পাহাড়ের বুক ছিঁড়ে। শেষ প্রান্তটা কোথায় যে শেষ হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। তিতিরের চোখের সামনে যা ছিল তার এক-চতুর্থাংশে ছিল এই পাহাড়! বাকি তিন- চতুর্থাংশ ছিল আকাশ। ছোটবেলায় ছবি আঁকার সময় হালকা আকাশী কালারের আকাশের উপর যে গোল গোল সাদা সাদা বাবলসের মত মেঘ আঁকত ঠিক তেমন মেঘ ছিল সে আকাশে। এমন আকাশ আর এমন মেঘ ও কোনদিনও দেখেনি। এত এত বিশালতা আর এত এত স্বচ্ছতা যেন তিতিরের চোখ, মুখ, নাক, কান এমনকি ওর শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপ দিয়ে ঢুকে ওর ভেতরের সব ক্লান্তি, গ্লানি, দুক্ষ, কষ্ট, আক্ষেপ, অভিমান আর না পাওয়াগুলোকে ছেঁকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ও কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, কিভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছুই তখন ওর খেয়াল ছিলনা। একটা কথাও বলতে পারলো না কখন ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তা ও নিজেও টের পেলনা। ঠোঁটে ছিল বিস্ময়ের হাসি। থরথর করে কাঁপছিল। মুগ্ধ দেখলো এ দৃশ্য, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। মুগ্ধ বেশ লম্বা তাই তিতিরের পেছনে দাঁড়িয়েও নিচে তাকিয়ে ওর মুখ দেখতে কোন সমস্যা হলোনা। তিতির ভারসাম্য হারিয়ে ওর বুকের উপর ঢলে পড়েছে। মুগ্ধ দুই হাত দিয়ে তিতিরের দুই হাত ধরে নিজের বুকের সাথে ওর পিঠ ঢেকিয়ে ধরে রেখেছে ওকে।