প্রেমাতাল | পর্ব – ৩৮

মুগ্ধ বাথরুম থেকে বের হয়ে নতুন কেনা টাওয়াল টা নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল। ডিভানে বসে শার্টটা খুলে ছুড়ে ফেলল ফ্লোরে। টাওয়াল টা পড়ে প্যান্ট টা খুলে সেটাও ছুড়ে ফেলল। রাগে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়লো। তান্নাকে পেলে এখন খুন করতো ও। শুধুমাত্র তান্নার জন্য আজ নিজের তিতিরকে আদর করতেও হাত কাঁপে মুগ্ধর। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মে যে পাপ করে ফেলেছে, আল্লাহ কাঁদার ক্ষমতাটা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাননি।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। তিতিরের গোসল এখনো হয়নি? ওকে ওই অবস্থায় ওভাবে ফেলে আসায় কি কষ্ট পেয়েছে? ওর ওই অবাক দৃষ্টি তো অন্তত তাই বলছিল। ও কি এখন কাঁদছে?
মুগ্ধ বাথরুমের দরজায় নক করলো,
-“তিতির? আর কতক্ষণ? আজ এত টাইম লাগছে যে? পরে ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
তিতির চোখ মুছে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
-“আসছি।”
মুগ্ধ তিতিরের গলা শুনেই বুঝলো ও কেঁদেছে। তখন ওর আরো বেশি অসহায় লাগতে শুরু করলো। কি করবে ও? ওর হাতে কি সত্যি কিছু আছে?
তিতির গোসল শেষ করে খেয়াল করলো জামাকাপড় ভেতরে আনেনি। রিসোর্টের টাওয়ালটা গায়ে পেঁচিয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘরে উকি দিল। কিন্তু মুগ্ধকে দেখতে পেল না। মুগ্ধ আবার কোথায় গেল! তখনই বারান্দায় চোখ পড়তেই মুগ্ধকে দেখতে পেল। বলল,
-“এই, শোনোনা।”
মুগ্ধ বারান্দা থেকেই বলল,
-“কি?”
-“আমি তো কাপড় আনিনি।”
-“ওহ দাড়াও, দিচ্ছি।”
-“শোনো।”
-“কি?”
-“টাওয়াল আছে ভেতরে। শুধু কাপড় দিলেই হবে।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ নতুন কেনা পোলো শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার নিয়ে দরজার সামনে এসে বলল,
-“নাও।”
তিতির হাত বাড়ালো। মুগ্ধ ওর হাতে ওগুলো দিল। কিছুক্ষণ পর তিতির বেড়িয়ে আসতেই মুগ্ধ ঢুকলো। কেউ কারো দিকে তাকালো না। তিতির চুল মুছে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হঠাৎ তিতিরের নজরে পড়লো শপিং ব্যাগ গুলোর দিকে। তিতির যখন অন্তর্বাস কিনছিল, মুগ্ধকে তখন ভাগিয়ে দিয়েছিল সেখান থেকে। ততক্ষণে মুগ্ধও কিছু কিনেছিল যা দেখেনি তিতির। ও অবশ্য গাড়িতে উঠে দেখতে চেয়েছিল কিন্তু মুগ্ধ বলেছিল,
-“তুমি কি কিনেছো আমি দেখতে চেয়েছি? যেহেতু চাইনি তুমিও আমারগুলো দেখতে পারবে না। সবারই পারসোনাল জিনিস থাকতে পারে।”
তিতির উঠে গিয়ে শপিং ব্যাগ গুলো খুলতেই দেখলো অরেঞ্জ,রেড আর এশ কালারের কম্বিনেশনের একটা জর্জেট শাড়ি ব্ল্যাক পাড়! সাথে ব্ল্যাক কালারের রেডিমেড স্লিভলেস ব্লাউজ, ম্যাচিং পেটিকোট, বাহ! মুগ্ধর বরাবরই সবদিকে খেয়াল থাকে আর পছন্দটাও ফার্স্টক্লাস। সব ইউনিক জিনিস ওর চোখে পড়ে। ঝটপট শাড়িটা পড়ে ফেলল তিতির। শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগের খারাপ লাগাটা এখন আর ওর মধ্যে নেই। কারন, মুগ্ধ বেড়িয়ে যখন ওকে এভাবে দেখবে মুগ্ধরও ভাল লাগবে।
হলোও তাই। দরজা খুলে খালিগায়ে টাওয়াল পড়া মুগ্ধ চুল ঠিক করতে করতে বেড়িয়ে এল। তিতিরকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। তিতির হাসি হাসি মুখ করে বলল,
-“সারপ্রাইজ!”
-“দিলে তো আমার সারপ্রাইজ টা নষ্ট করে।”
-“নষ্ট হয়নি। আমি সারপ্রাইজ পেয়েছি। তাইতো ইচ্ছে হলো তোমাকেও দেই।”
মুগ্ধ তিতিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-“সত্যি সারপ্রাইজড হয়েছি।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”
তিতিরের মাথায় শয়তানি ঘুরঘুর করছিল। খুব ইচ্ছে করছিল মুগ্ধর পড়নের টাওয়ালটা একটা টান দিয়ে খুলে ফেলতে। বেশ হতো। কিন্তু একাজ ও করতে পারবে না। ভাবতেই লজ্জা লাগছে। মুগ্ধ সরে গিয়ে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করলো। প্যান্ট পড়তে পড়তে বলল,
-“ভাল হয়েছে শাড়ি পড়েছো। চলো সিলেট সিটিটা আজ ঘুরে ফেলি।”
-“হুম চলো।”
-“আর রিসোর্টের ভেতরেও কিন্তু অনেক কিছু আছে। এটার অনেক বড় এরিয়া।”
-“অনেক কিছু বলতে?”
-“ইকো পার্ক, সুইমিংপুল আরো কি কি যেন।”
-“আর কালকের প্ল্যান কি?”
-“কাল সকাল সকাল আমরা একবারে বেড়িয়ে পড়বো। বিছনাকান্দি ঘুরে দুপুরেই রওনা দিব। রাতের মধ্যে ঢাকা। রাত হলেই তো তোমার বাসায় খোঁজ পড়বে, তাই না?”
-“হ্যা।”
মনটা সামান্য খারাপ হলো তিতিরের। সুন্দর সময় কেন এত তারাতারি চলে যায়? আনমনে ভাবছিল ও। এমন সময় মুগ্ধ আচমকা তিতিরের চুল মুছে দিতে শুরু করলো। বলল,
-“চুলগুলো আজও মুছতে শিখলে না।”
তিতিরের চোখে পানি এসে গেল। অনেক কষ্টে কান্নাটাকে হজম করে নিল। ইশ, আজীবনের জন্য তিতির মুগ্ধর এই টুকরো টুকরো ভালবাসা গুলো হারিয়ে ফেলবে একসময়। মুগ্ধ হয়ে যাবে অন্য কারো স্বামী, তিতির হয়ে যাবে অন্য কারো স্ত্রী! তার আগেই যদি জীবনটাকে থমকে দেয়া যেত? ইশ এমন করলে কেমন হয় আজ তিতির কোনো একটা বিষ কিনে নিয়ে আসবে লুকিয়ে লুকিয়ে, তারপর সেই বিষ গোপনে রাতের খাবারের সাথে মিশিয়ে মুগ্ধকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে পড়ে থাকবে এখানে। ওদের ভালবাসার হ্যাপি এন্ডিং হবে। আইডিয়াটা কিন্তু বেশ। কিন্তু বিষ কোথায় পাওয়া যায়? ওষুধের দোকানে কি পাওয়া যায়?
-“এই তিতির? কি হলো? কি ভাবছো?”
তিতির ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এল। বলল,
-“তেমন কিছুনা। আমাদের প্রথম পরিচয়ের কথা ভাবছিলাম।”
-“ওহ। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি শাড়ি পড়া শিখতে গেলে কেন?”
-“তো? প্রত্যেকবার মায়ের কাছে যেতে ভাল লাগে নাকি?”
-“না মানে, তুমি যদি না শিখতে তাহলে আমি সেই ছোটবেলার মত আবার পড়িয়ে দিতে পারতাম।”
তিতির কোমরে হাত দিয়ে এক টানে কুচিগুলো খুলে ফ্লোরে ফেলে দিল। তারপর বলল,
-“ইচ্ছে করলে যেমন কোন কাজ শেখা যায়, ইচ্ছে করলে তেমন কোন কাজ ভোলাও যায়। আমি ভুলে গেছি কিভাবে শাড়ি পড়তে হয়।”
মুগ্ধ হেসে শাড়িটা তুলে নিল। পড়াতে পড়াতে বলল,
-“তুমি ইদানীং অনেক দুষ্টু হয়েছো।”
-“তোমাকে না পেয়ে না পেয়ে।”
মুগ্ধ আর কিছু বলল না। মনোযোগ দিয়ে শাড়ির কুচি দিতে লাগলো। কুচি দেয়া শেষ করে হাটু গেড়ে বসে কুচিগুলো কোমরে গুঁজে দিয়ে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“পৃথিবী গোল, কিছু কিছু ঘটনার রিপিটেশন তো হতেই পারে, তাই না?”
তিতির অন্যদিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা লাজুক হাসি দিল। মুগ্ধ তিতিরের নাভির ডানপাশে চুমু খেল। তিতির হাসতে হাসতে পিছিয়ে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“এত হাসির কি হলো?”
-“সুড়সুড়ি লেগেছে।”
-“বাহরে! এমনই বুঝি হয়? প্রথমবার তো হাসোনি, সুড়সুড়ি তখন কোথায় ছিল?”
-“আরে তখন তো বুঝেই উঠতে পারিনি কি হচ্ছে!”
মুগ্ধ উঠে দাঁড়ালো। তিতির কাছে এসে মুগ্ধর বুকের লোমের মধ্যে নাক ঘষলো, গাল ঘষলো আর তারপর ঠোঁটও ঘষলো। মুগ্ধ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সবটা অনুভব করছিল। তারপর তিতির সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতদুটো মুগ্ধর বুকের ঠিক মাঝখানটায় মেলে রাখলো। তারপর মাথা উঁচু করে মুগ্ধর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার যখন অন্য কারো সাথে বিয়ে হবে তখন এরকম খালিগায়ে তাকে বুকে নেবে না। নিতে হলে কিছু একটা পড়ে তারপর নিবে।”
-“আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। করলে এতদিনে করে ফেলতাম।”
-“তবুও, করতে হতেও পারে তাই বলছি সব করতে পারো কিন্তু তাকে খালি বুকে হাতও রাখতে দেবে না। চুমুও দিতে দেবে না বুকে। এটা শুধু আমার রাজত্ব করার যায়গা।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির বলল,
-“হেসোনা, হাস্যকর লাগতে পারে কিন্তু আমার এরকম কিছু কথা রাখতে হবে তোমাকে।”
-“ওকে রাখবো। বাকীগুলো কি?”
-“তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে পারবে না।”
-“ওকে দিবনা, তারপর?”
-“হাঁস বার-বি-কিউ করে খাওয়াবে না।”
-“ওকে, স্পেসিফিকলি হাঁস বললে তাই জিজ্ঞেস করছি তাহলে কি মুরগী বার-বি-কিউ করে খাওয়ানো যাবে?”
-“যাবে।”
-“আচ্ছা আচ্ছা, ওকে। তারপর?”
-“তার ভেজাচুল মুছে দিতে পারবে না।”
-“ওকে দিবনা, নেক্সট?”
-“তার সাথে লিপকিস করার সময় আর যেখানে ইচ্ছা সেখানে হাত রাখতে পারো কিন্তু এক হাত কোমরে আরেক হাত কানের নিচে রাখবে না।”
মুগ্ধ মুখ টিপে টিপে হেসেই চলেছে। বলল,
-“আচ্ছা, তারমানে লিপকিস করা যাবে?”
-“হ্যা, যাবে। কিন্তু হাত সাবধান।”
-“আচ্ছা, তারপর?”
-“তাকে কক্ষনো কোলে নিতে পারবে না।”
-“ওকে নিবনা, আর?”
-“কখনো ওর কপালে কিস করবে না।”
এবার একটু বেশিই হাসলো মুগ্ধ। বলল,
-“আচ্ছা করবো না। তারপর?”
-“তোমরা দুজন কখনো একসাথে গোসল করবে না।”
-“এই এই, ওয়েট ওয়েট.. এতক্ষণ তুমি সেসবই নিষেধ করেছো যা যা আমি তোমার সাথে করেছি। কিন্তু এটা কি বললে? আমি তুমি তো কখনো একসাথে গোসল করিনি। তাহলে এটা না করলে কেন?”
-“আমার ইচ্ছে!”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“ওকে, তিতিরপাখি! বিয়েই তো করবোনা। তবু যদি কোনদিন করি তো তুমি যা যা নিষেধ করলে তার সব আমি মনে রাখবো।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
বিকেলটা রিসোর্টের মধ্যের ইকো পার্ক আর শহরের মধ্যেই একটা চা-বাগানের আশেপাশে ঘুরে কাটালো ওরা। ভেতরে ঢোকার পারমিশন পেল না। তারপর সন্ধ্যা হতেই ওরা মাজারে গেল। আর তারপর মাজার থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠেই মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“বলোতো এখন কোথায় যাচ্ছি আমরা?” পাশে বসে তিতির আনমনে চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে আচড়াচ্ছিল। মুগ্ধর প্রশ্ন শুনে বলল,
-“কোথায়?”
-“সুরমা নদীতে একটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে। স্টাইল করে বলতে গেলে বলতে হবে ওটা একটা ছোট জাহাজ। কিন্তু আসলে একটা লঞ্চ।”
তিতির হাসলো। বলল,
-“রেস্টুরেন্টে গিয়ে কি হবে?”
-“খাব।”
-“ডিনার না রিসোর্টে করবে বললে?”
-“এটা প্রি-ডিনার। সন্ধ্যার নাস্তা।”
-“পারোও তুমি।”
-“অবশ্যই পারি। এক যায়গায় এসেছো সেখানকার স্পেশাল খাবার গুলো খাবে না?”
-“তুমি খাও।”
রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে মুগ্ধ বলল,
-“তোমার কপালে একটা মাঝারী সাইজের কালো টিপ থাকলে ভাল লাগতো।”
-“ও হ্যা, তুমি তো টিপ আর কাজল পছন্দ করো। কিন্তু সাজ পছন্দ করো না এই ব্যাপারটা আমার মাথায় সেট হয়ে গেছে। তাই সাথে কিছুই রাখা হয় না।”
-“থাক, এটা নিয়ে আবার আফসোস করতে বসোনা যেন।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“এইযে তুমি শুধু স্যুপ নিলে আমি অন্যকিছু খেতে জোড় করলাম না কেন বলোতো?”
-“কেন?”
-“কারন, এখান থেকে বেড়িয়ে আমরা আরেকটা রেস্টুরেন্টে যাব। এখানে কম খেলে সেখানে ভাল করে খেতে পারবে তাই।”
তিতির হেসে বলল,
-“মানে কি? কি ঢুকেছে তোমার পেটে আজ?”
-“আমি অনেক খেতে পারি, সেটা তুমি তো জানোই। আসলে আমি যেটা খেতে বেড়িয়েছি এখানে সেটা নেই তাই আরেকটাতে যেতে হবে।”
-“সেটা কি?”
-“সাতকড়া গরুমাংস।”
-“সাতকড়া কি?”
-“অস্থির জিনিস। অনেক স্বাদ, অনেক।”
-“কিন্তু সেটা কি বলবে তো?”
-“একটা ফল, দেখতে লেবুর মত। যেটা দিয়ে গরুমাংস রান্না করা হয়। কিযে স্মেল রে ভাই। এটা সিলেটের স্পেশাল জিনিস। সিলেট ছাড়া আর কোথাও পাবে না।”
-“ওহ। তোমার বলার ধরণ দেখে খেতে ইচ্ছে করছে।”
-“অবশ্যই খাবে।”
-“খেতে পারবো কিনা কে জানে!”
-“কেন?”
-“ঠোঁট জ্বলছে। কত জায়গায় কেটেছে কে জানে!”
-“ইশ, আসলেই? কেটে গেছে?”
-“কামড়ালে কাটবে না?”
-“শুধু জ্বলছে না ব্যাথাও করছে?”
-“ব্যাথাও করছে।”
-“আহারে, সরি।”
-“সরি বলোনা। শোধ করে দিব রাতেই।”
মুগ্ধ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
-“রিয়েলি? আমি চারপায়ে খাড়া।”
-“তোমার পা দুটো।”
-“হ্যা, তোমার দুটো সহ বলেছি।”
হাসলো তিতির। মুগ্ধও সে হাসিতে তাল মেলালো।
ওখান থেকে ওরা চলে গেল নবান্ন রেস্টুরেন্টে। সাতকড়া গরুমাংস আর পরোটা অর্ডার করলো। মুগ্ধকে অবাক করে পরপর তিন প্লেট গরুমাংস নিল তিতির। সাথে চারটা পরোটাও শেষ। মুগ্ধ হেসে বলল,
-“কি বলেছিলাম না?”
তিতির খেতে খেতে বলল,
-“একটু ঝাল বেশি কিন্তু পৃথিবীতে এত মজার কিছু থাকতে পারে আমার জানা ছিল না, জাস্ট ওয়াও। স্মেলটাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তারপর সাতকড়ার টুকরাগুলোও খেতে খুব মজা”
-“পৃথিবীতে এর চেয়ে মজার জিনিস অবশ্যই আছে। আসলে এধরণের জিনিস আমরা সচরাচর খাই না তো। তাই হঠাৎ খেলে অনেক ভাল লাগে। আর এটা ঝাল কিছু না। রান্নাটাও ঝাল হয়নি, তোমার ঠোঁট কেটে গেছে তাই ঝাল লাগছে।”
-“হুম, আচ্ছা.. এগুলো কিনতে পাওয়া যায় কোথায়?”
-“বাজারে অভাব নেই। আর রাস্তার পাশেও ঝুড়ি ভরে নিয়ে বসে থাকে দেখোনি লেবুর মত?”
-“খেয়াল করিনি। যাই হোক, যাওয়ার দিন আমি নিয়ে যাব।”
-“আচ্ছা। রান্নার সিস্টেম জানোতো?”
-“না, আলদা কোনো সিস্টেম আছে নাকি? ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরা করে মাংসের মধ্যে দিয়ে দেব।”
-“আজ্ঞে না। শুধু খোসাটাই রান্না করতে হয়। ভেতরের অংশটা খেতে হয়না ফেলে দিতে হয়, ওটা তিতা।”
-“ও।”
-“আর মাংসটা যেভাবে ইচ্ছা রান্না করে নামানোর ২০-৩০ মিনিট আগে দিয়ে রান্না শেষ করতে হবে। শুরুতেই দিলে তিতা হয়ে যাবে। খুবই সেন্সেটিভ জিনিস।”
ওর কথা শুনে কতক্ষণ হাসলো তিতির। বলল,
-“সত্যি, তোমার সাথে ছাড়া আমি কোথাও গেলে শুধু সেখানে যাওয়া হবে আর আসা হবে। সেখানকার কিছুই জানা হবে না, পাওয়া হবে না। সব কিছুই ঝাপসা থাকবে অথচ আমি বুঝবোও না।”
-“আমিও প্রথমে কিছুই জানতাম না তিতির। আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে জেনেছি। যেখানে যাবে সেখানকার রাস্তাঘাট, মানুষজন, পরিবেশ সবকিছু খেয়াল করলে আপনাআপনি সব জেনে যাবে।”
যখন ওরা রিসোর্টে ফিরলো তখন ৯ টা বাজে। রুমে ঢুকে চেঞ্জ করার জন্য কাপড় নিল তিতির। মুগ্ধ বলল,
-“পড়ে থাকোনা শাড়িটা।”
তিতির হেসে বলল,
-“আচ্ছা। এই চলোনা বারান্দায় গিয়ে বসি। বারান্দাটা অনেক সুন্দর।”
-“তুমি যাও, আমি চেঞ্জ করে আসছি।”
বারান্দায় গিয়ে তিতিরের চোখে পড়লো ফ্লোরে মুগ্ধর জামাকাপড় পড়ে আছে। ওগুলো তুলে রুমে ঢুকতেই মুগ্ধ বলল,
-“হায় হায়, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওগুলোর কথা। দাও আমাকে দাও, ধুয়ে দেই তারাতারি, না শুকালে ঝামেলায় পড়ে যাব।”
-“না, আমি ধুয়ে দিচ্ছি।”
-“আরে আমি ধুতে পারবো তো।”
-“জানি, আমিও ধুতে পারবো। আমি থাকতে তুমি ধোবেই বা কেন?”
-“আরে! মেয়ে বলে কি? তুমি কি আমার কাপড় ধোয়ার জন্য আছো নাকি?”
-“আমার ইচ্ছে, আমি ধোব। সরো তো।”
তিতির জোড় করে কাপড়গুলো ধুয়ে দিল। মুগ্ধ খালি গায়ে সাদা রঙের একটা হাফ প্যান্ট পড়ে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিল। তিতির কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে ঘরে এসে মুগ্ধর কোলের মধ্যে শুয়ে পড়লো। বলল,
-“টিভিটা বন্ধ করোনা।”
মুগ্ধ টিভি বন্ধ করে বলল,
-“তুমি পাশে ছিলে না তাই দেখছিলাম।”
-“ভাল করেছো, এখন তো আমি চলে এসেছি।”
মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“তাই তো দেখছি।”
-“তুমি আবার খালি গায়ে? কিছু একটা পড়ো।”
-“আমি তো বাসায় খালিগায়েই থাকি, অভ্যাস।”
-“এসব দেখে দেখে আমার নজর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
-“সিরিয়াসলি তিতির তোমার কথাবার্তা শুনলে মনে হয় কি ছেলেদের বুকের লোম যেন অতি বিশেষ কিছু। কিন্তু আসলে কিছুই না। অতি সামান্য জিনিসকে তুমি মহিমান্বিত করেছো।”
-“আমার কাছে অতিসামান্য না।”
-“আচ্ছা বুচ্ছি কিন্তু হঠাৎ শুয়ে পড়লে যে? এখনি শোধ করবে নাকি?”
তিতির লজ্জা পেয়ে বলল,
-“জানিনা।”
মুগ্ধ বলল,
-“প্লিজ শোধ করে দাওনা।”
-“আমি পারবো না।”
-“তখন তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে।”
তিতির লজ্জা পাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“এখনো ব্যাথা করছে ঠোঁট?”
-“হুম।”
-“এসো, বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করে দিই।”
তিতির সরে গিয়ে বলল,
-“ইশ না। অনেক ব্যাথা।”
-“আচ্ছা, আলতো করে।”
এবার আর তিতির সরলো না। তারপর মুগ্ধ তিতিরের ঠোঁটে আলতো করেই চুমু খেতে লাগলো।
তার মধ্যেই তিতিরের ফোনটা বেজে উঠলো। বাবা ফোন করেছে, উঠে বসে ফোনটা ধরলো তিতির,
-“হ্যা, বাবা বলো।”
-“কী অবস্থা মা তোর? কেমন আছিস?”
তিতির হেসে বলল,
-“সকালেই তো মাত্র এলাম বাবা, ভাল আছি।”
-“ও হ্যা তাই তো। তুই কোথাও গেলে ঘর অন্ধকার হয়ে থাকে। তা কি করছিস?”
-“প্রজেক্ট ওয়ার্কটা করছিলাম বাবা, এখন একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। একটু পর আবার করবো। যেভাবেই হোক, দুদিনের মধ্যেই কম্পলিট করতে হবে।”
-“হুম, কাল কখন আসবি?”
-“বাবা, আমি কাল নাও আসতে পারি। প্রজেক্ট ওয়ার্ক টা কম্পলিট হলেই আসব। নাহলে আসব না। পরশু আসবো।”
-“সেকী!”
-“রুপাদের বাসাতেই তো আছি বাবা, টেনশান কিসের? নাকি বিশ্বাস হচ্ছে না? আন্টির সাথে কথা বলবে?”
-“না না ছি ছি, আন্টির সাথে কেন কথা বলবো? আর টেনশান না। আসলে তোকে না দেখলে ভাল লাগে না তো। তুই লাগলে থাক কালকেও সমস্যা নেই।”
-“ওকে বাবা। ডিনার করেছো?”
-“নাহ, এখন করবো।”
-“আমিও।”
-“ঠিকাছে মা। আমি তাহলে রাখছি। তান্না ফোন করলে ধরিস না। কাল আসবি না শুনলে আবার কি না কি বলবে তোকে। আমি ওর সাথে কথা বলে নেব।”
-“আচ্ছা বাবা। তুমি যা বলবে।”
ফোন রেখে মন খারাপ করে বসে রইল তিতির। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো?”
-“বাবাকে কতগুলো মিথ্যে বললাম!”
-“হুম, তাই দেখলাম আর অবাক হলাম।”
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার জন্য আমি সব পারি।”
-“শুধু ফ্যামিলির অমতে আমাকে বিয়েটা করতে পারো না।”
-“এটা করলে আমার বাবা মরে যাবে। বিশ্বাস করো শুধুমাত্র বাবার জন্যই আমি এটা পারি না।”
-“আচ্ছা বাদ দাও, এসব ভেবে মন খারাপ করার কোন মানে হয়না। কিন্তু এটা বলো বাবাকে কেন বললে কাল ফিরবে না।”
-“ও হ্যা, আরেকটা দিন থাকতে ইচ্ছে করছিল খুব, তাই আরেকটা দিনের পারমিশন নিলাম।”
-“আর বললে যে আন্টি মানে রুপার আম্মুর সাথে কথা বলিয়ে দেবে। এটা বললে কোন সাহসে?”
তিতির হেসে বলল,
-“জানি বাবা কথা বলবে না তাই বলেছি। জানি এটা অন্যায়। কিন্তু বাবা যদি ছেলের কথা না শুনে একটা বার সব যাচাই করে দেখতো। জেদ না ধরে থেকে তোমার আমার বিয়েতে রাজী হতো তাহলে তো আজ আমাকে এতবড় মিথ্যেবাদী হতে হতোনা। আর আমাকে নকল মিসেস তিতির মেহবুব হতে হতোনা। আসল মিসেস তিতির মেহবুবই হতাম। তখন আজ যা করছি তা অন্যায় বা খারাপ হতো না।”
মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে টেনে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বলল,
-“তুমিই একমাত্র আসল মিসেস তিতির মেহবুব। সেদিনই কনফার্ম হয়েছিলে যেদিন আমি লাভ ইউ বলার পর তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।”
তিতির হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“আচ্ছা, শোনো।”
-“বলো।”
-“তালগাছে উঠবে?”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“কি? তালগাছে উঠতে যাব কেন? আর আমি গাছে উঠতে পারিও না।”
-“ছোটবেলায় কখনো বাবা তোমাকে পায়ের তলায় ঠেকিয়ে উপর উঠিয়ে দোলায়নি?”
হঠাৎ মনে পড়ে গেল তিতিরের। বলল,
-“হ্যা হ্যা। বাবা এরকম করতো, ভাইয়াও করতো। পায়ের তলাটা আমার পেটের সাথে ঠেকিয়ে আমাকে উঁচু করে ফেলতো। আমি উপুর হয়ে থাকতাম। বাবা বলতো এটা তালগাছ। উফ কি যে মজার ছিল ছোটবেলাটা।”
-“সেটার কথাই বলছি। উঠবে?”
-“তুমি ওঠাবে?”
-“হ্যা।”
-“কিন্তু আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি। বাবা তো নিতো সেই ছোট থাকতে। যখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি।”
-“আমার কাছে তুমি এখনো ছোটই, এসো তো। তোমাকে তালগাছে উঠাই।”
মুগ্ধ তিতিরকে তালগাছে উঠিয়ে হাতে হাত ধরে রাখলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো তিতিরের। ও জানে মুগ্ধর সাথে সারাটা জীবন থাকলে পার্থিব সমস্ত সুখগুলো মুগ্ধ ওর পায়ের কাছে এনে রাখতো যা পৃথিবীর আর কেউ পারবে না। তিতির খিটখিট করে হাসছে। আর মনে মনে হাজার ফোটা চোখের জল জমিয়ে ফেলছে পরে ফেলার জন্য। এখন ফেলা যাবে না। মুগ্ধ কত সখ করে ওকে তালগাছে উঠিয়েছে। কাঁদলে কষ্ট পাবে না?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।