সেই যে কারেন্ট গিয়েছে আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। তন্দ্রা বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে। তুলি তার বাম পাশেই শুয়েছে। বারবার বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। চৈত্র মাসের শেষ দিন গুলোতে গরম পড়েছে প্রচণ্ড। আজ বৈশাখ মাসের তিনদিন হতে চললো এখনো সেই ভ্যাপসা গরম আছেই। এই সময়টা আসলেই ঝড় তুফান আসে। আজ সকালেও আকাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে ছিল তবে সেই আগের মতোই গুমোট আবহাওয়া। বালিশের পাশে ওড়নাটাকে রেখে দিয়ে তন্দ্রা তুলির পাশে শুয়ে পড়ল। ছোট্টো তুলি গভীর ঘুমে মগ্ন। তন্দ্রারও ঘুমে চোখ ছোট হয়ে আসছে। একটা সময় সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙল তন্দ্রার। আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসল সে। কালো রঙা দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাড়ে আটটা বাজছে। এত সময় ধরে সে ঘুমিয়েছে। এমনিতে তো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে নেয়। আজ ঘুমের জন্য নামাজটা কাজা হয়ে গেল তার। রাতে গরমের মধ্যে খুব একটা ঘুম হয়নি। বসে থেকেই তুলিকে ডাকতে থাকল সে। বার কয়েক ডাকার পর তুলির ঘুম ভাঙল। হাই তুলতে তুলতে বলল‚
“গুড মর্নিং আপু।”
“গুড মর্নিং পিচ্চি। এখন উঠ। স্কুলের জন্য লেট হয়ে যাবে।”
“আরে আপু তুমি কী ভুলে গেছো আজ শুক্রবার?”
“ওহ তাই তো। দেখেছিস আমার মনেই ছিল না।”
“আমি আরেকটু ঘুমাই?”
ছোটো বোনের ঘুমোনোর আবদারটা তন্দ্রা আর ফেলতে পারল না। প্রত্যুত্তরে কিছু না বললেও ছোটো বোনকে মুচকি হাসি উপহার দিল তন্দ্রা। তুলি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ল।
দু’বোনের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল দশটা বেজে গেল। তন্দ্রা উঠেই ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তুলি তার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। গত দিনের মতো আজও আকাশটা মেঘলা করেছে। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখতে পেল অ্যালভিন তার ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। সে আজ মনে সাহস যুগিয়ে অ্যালভিনের কাছে গেল। কিছুটা মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখল। বিড়ালটা আসলেই খুব কিউট। তন্দ্রার উপস্থিতি টের পেয়ে অ্যালভিন তার দিকেই তাকায়।
“মিয়াও!”
“ও বাবা গো।”
ঝটপট উঠে দাঁড়াল। খুব ক্ষিধে পেয়েছে তন্দ্রার। তাই সে অ্যালভিনকে তার ঘরে রেখেই রান্নাঘরে চলে এলো। স্বাক্ষর সকাল সকাল হসপিটালে ছুটেছে। সপ্তাহিক কর্মসূচির অবসান হওয়ায় মি. ইলিয়াস মাহমুদ আর মি. ইউসুফ মাহমুদ আজ বাড়িতেই রয়েছেন। তন্দ্রা আর তুলি বাদে বাকিরা আগেই নাস্তা করে ফেলেছে। সে নিজেই তার আর তুলির জন্য খাবার প্লেটে বেড়ে এনেছে। এরপর তুলি আসতেই একসাথে খাবার খেতে শুরু করল দুজনে। তুলি এই সেই কথা বলছে আর খাবার মুখে তুলছে।
গরমের প্রবনতা যেন দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। গরমের জন্য বাইরে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে উঠছে। তার উপর কিছুক্ষণ পর পর লোডশেডিং। সূর্যের উত্তাপে পুরো বাসাটায় যেন গরমে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তন্দ্রা মাত্রই গোসল করে বের হয়েছে। সাদা রঙের লং জামা পড়নে তার। চুল গুলো টাওয়াল দিয়ে প্যাচানো। ঘরে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় দুহাত মেলে শুয়ে আছে তুলি। টাওয়াল দিয়ে লম্বা চুল মুছতে মুছতে তন্দ্রা তুলিকে বলল‚
“পাখি! যা গোসল করে আয়।”
“একটু পরে যাচ্ছি আপু।”
“এক্ষুনি যেতে বলেছি তোকে।”
অগত্যা তুলি জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। আর এদিকে তন্দ্রা ভেজা চুল গুলো ছেড়ে ধুয়ে রাখা কাপড় গুলোকে বেলকনিতে মেলে দিল। ড্রইং রুম থেকে স্বাক্ষরের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো হসপিটাল থেকে ফিরেছে। তন্দ্রা ঘর থেকে বের হলো। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে স্বাক্ষর তার ঘরে চলে যায়। মিসেস সাহেরা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জুস গ্লাসে ঢেলে তন্দ্রার হাতে দিয়ে বললেন‚
“স্বাক্ষরকে এটা দিয়ে আয় তো মা।”
“আচ্ছা বড়ো মা।”
তন্দ্রা জুস নিয়ে স্বাক্ষরের ঘরে আসে। পুরো ঘরটা যেন শুভ্রতায় মোড়ানো। ঘরের পর্দা গুলোও সাদা নেটের। বিছানার পাশের টেবিলটার ফুলদানিতেও সবগুলো সাদা রঙের আর্টিফিশিয়াল ফুল। তন্দ্রা মাঝে মাঝে ভেবে পায় না এই লোকটার সাদা রঙটা কেন এতো পছন্দের! স্বাক্ষর ঘরে নেই। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। তন্দ্রার চোখ যায় দক্ষিণ দিকের দেয়ালে। সেখানে স্বাক্ষরে একটা ছবি বড় করে টানানো। সে কিছু সময় ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাঁটু সমান ঘন লম্বা চুল গুলো থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে মেঝেতে।
“তোকে না একদিন বলেছিলাম সাদা জামা পড়ে আমার সামনে আসবি না।”
স্বাক্ষরের গলার আওয়াজ পেয়ে তন্দ্রা পেছন ফিরে তাকাল। এরই মাঝে লোকটা গোসলও সেরে ফেলেছে! এতোক্ষণ তন্দ্রা ঘরটাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। স্বাক্ষরের ঘরে তার খুব একটা আসা হয় না। একেবারেই যে আসা হয় না তা না‚ মাঝে মাঝে আসে।
“বড়ো মা পাঠালো। জুসটা খেয়ে নিও।”
তন্দ্রার কথায় কোনো ভাবান্তর নেই স্বাক্ষরের মাঝে। সে নিজের মতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুল গুলো মুছছে। আয়নায় এক দুবার তন্দ্রার দিকে তাকিয়েছে কিন্তু অগোচরে। স্বাক্ষর একই ভাবে আয়নার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল‚
“আমি খেয়ে নিবো। তুই এখন ঘরে যা।”
“হুম।”
তন্দ্রা আর কথা বাড়াল না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্বাক্ষর এবার পেছন ফিরে তাকিয়ে ক্ষীণ হাসল। বিছানার কাছে কয়েক ফোটা পানি পড়ে আছে৷ দেখে বোঝা যাচ্ছে এগুলো তন্দ্রার চুল থেকে ঝরঝরিয়ে পড়েছে।
“কাঠগোলাপ যেমন সাদার মায়ায় জড়ানো‚ তুমিও ঠিক তেমনটাই। তন্দ্রাবতী! তুমি পুরোটাই শুভ্রতার প্রতীক। এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ঘিরে রেখেছে তোমাকে। তাই-তো সাদা রঙটা আমার এত্ত পছন্দের। তোমার লম্বা চুলগুলো যে আমার দূর্বলতা। গোটা তুমিটাই আমার দূর্বলতা। যার মাঝে আমি হারিয়ে যাই বারংবার। যাকে দেখলে ভালোবাসা প্রকাশ করতে ইচ্ছে হয়। আমার তন্দ্রাবতী।”
আনমনেই কথা গুলো ভেবে মুখে এক চিলতে হাসি ফোটায় স্বাক্ষর৷ টেবিল থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকেই পুরোটা জুস খেয়ে নেয়। তন্দ্রা স্বাক্ষরের ঘর থেকে ড্রইং রুমে এসে দেখল মি. ইলিয়াস মাহমুদ আর মি. ইউসুফ মাহমুদ মিলে স্পোর্টস চ্যানেলে খেলা দেখছেন৷ খুবই মনোযোগ সহকারে দুজনে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন। এখন আপাতত টিভি দেখাটাই উনাদের জন্য মূখ্য। ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেল তুলিও উনাদের পাশেই বসে আছে। তার হাতে একটা চিপসের প্যাকেট। সে চিপস খাচ্ছে আর তার বাবার পাশে বসে টিভি দেখছে। সেই সুযোগে তন্দ্রাও গিয়ে উনাদের পাশেই বসে পড়ল।
ড্রইং রুমে মি. ইলিয়াস মাহমুদ আর মি. ইউসুফ মাহমুদ এর মুখটা বেশ থমথমে হয়ে আছে। খেলা দেখার মাঝখানে আবারও লোডশেডিং হয়েছে। দুজনেই চুপটি করে পাশাপাশি বসে আছেন। তুলির এতক্ষণে দুটো চিপস খেয়ে দৌঁড়ে তার ঘরে চলে গেছে। এক জায়গায় ঘাপটি মে’রে বসে থাকতে পারে না‚ ছোটাছুটি তার করতেই হবে। তন্দ্রা তার চুলগুলোকে হাত খোপা করতে করতে ড্রইং রুম থেকে প্রস্থান করল। ঘরে এসে দেখতে পেল বিছানার উপর একটা শপিং ব্যাগ আছে। কাছে গিয়ে সেটা হাতে তুলে নিল‚ ভেতরে কী আছে তা দেখার জন্য! ভেতরে একটা মেরুন রঙা গাউন আছে স্টোনের কারুকাজ করা। জামাটা একবার দেখাতেই খুব পছন্দ হয়ে গেল তন্দ্রার। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে সে জামাটাকে। সাথে একটা ছোট্টো কাগজও আছে। যেখানে স্পষ্ট করে লেখা ‘তোমার জন্য’ তন্দ্রা ভেবে পায় না‚ গিফটটা আসলে কে দিয়েছে! কোন উপলক্ষে গিফট পেল‚ আগামী চার পাঁচ মাসের আগে তো তার জন্মদিনও নেই। আবার মুহুর্তেই ভেবে নেয় হয়তো তার বাবা অথবা মা তাকে এনে দিয়েছে, সারপ্রাইজ দেবার জন্য। জামাটাকে পুনরায় প্যাকেটে করে আলমারিতে তুলে রাখল তন্দ্রা।
“তৈরি হয়ে নে তন্দ্রাবতী।”
সবে আধঘন্টা হলো সে পড়তে বসেছে। কারো গম্ভীর কণ্ঠ শুনে বইয়ের দিক থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল তন্দ্রা। দরজায় হেলান দিয়ে বুকে দু’হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে স্বাক্ষর। তন্দ্রা বইটা বন্ধ করে রেখে দিয়ে বলল‚
“কোথাও যাবো কী‚ ভাইয়া?”
“হ্যাঁ একটু বের হব।”
কথাটা বলেই স্বাক্ষর বাইরে চলে গেল। তন্দ্রা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হাত খোপা করে রাখা লম্বা চুলগুলো বেনী গেঁথে নিল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর ওড়না গলায় পেচিয়ে ঘর থেকে বের হলো। এই সময়ে সবাই খাবার খেয়ে নিজেদের ঘরে শুতে চলে গিয়েছে। ড্রইং রুমে স্বাক্ষর তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তন্দ্রা এগিয়ে যেতেই স্বাক্ষর উঠে দাঁড়ায়।
“চল।”
“হুম!”
মেইন ডোর লক করে দুজনে বের হয়ে এলো। স্বাক্ষর হেলমেটটা পড়ে বাইকে বসেই তন্দ্রার দিকে আরেকটা হেলমেট এগিয়ে দিল। তন্দ্রাও তা পড়ে স্বাক্ষরের পেছনে উঠে বসে। কিছুটা দূরত্ব রেখেই সে বসেছে।
“ভালো করে ধরে বোস।”
বাইক স্টার্ট দিতেই তন্দ্রা হুমড়ি খেয়ে স্বাক্ষরকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে। স্বাক্ষর গম্ভীর স্বরে বলল‚ “এভাবেই ধরে থাকবি।”
স্বাক্ষর স্বাভাবিক গতিতে বাইক চালাচ্ছে। গতিবেগ অনুযায়ী শীতল সমীরণ এসে গায়ে মাখছে। তন্দ্রা চোখ বন্ধ করেই বাতাসটা অনুভব করছে। রাতের যানবাহনহীন শহরটা তার বেশ ভালোই লাগছে। মাঝে মাঝে স্বাক্ষর মিররে এক দু’বার তাকে আড়ালে আবডালে দেখে যাচ্ছে। মুখে তার লেগে আছে অমলিন হাসি। এই হাসিটা সম্পূর্ণ তন্দ্রার দৃষ্টির অগোচরে।
প্রায় ঘন্টা খানেক স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরল। বাইরের তাজা হাওয়ায় এখন খুব ফ্রেশ লাগছে তন্দ্রার। তাকে পাশে পেয়েই যেন স্বাক্ষরের সব ক্লান্তি গ্লানি উধাও হয়ে গেছে। কিছুটা একাকীত্ব চেয়েছিল সে। তাই তো হুট করে তন্দ্রাকে নিয়ে বেরিয়ে আসা।