এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা | পর্ব – ৩

যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহায় যার ভয়ে আম্মুকে বলে ডাক্তার দেখানোর নামে মিথ্যা বুলি আওড়ালাম সেই বিহান ভাই এর সাথেই রাস্তায় দেখা।বাধ্য হয়ে আবার ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেই এলাম।আমার জীবনের সব থেকে বড় সমস্যার নাম বিহান ভাই যাকে মনে মনে সহস্রবার গালি বকা দিয়েছি অথচ সে আমার সামনে এলে আমার রিতীমত হাঁটু কাঁপাকাপি শুরু হয়।সেই ছোট বেলা থেকে এই যন্ত্রণা নিয়ে বেড়ে উঠেছি।বিহান ভাই এর এটিটিউড কি বাবাহ কেউ উনার ইগোতে আঘাত করতে আর জীবনে তার সাথে কথা বলেন না।আগ বাড়িয়ে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে যান না। সোস্যাল মিডিয়াতে এক্টিভ না।আর এক্টিভ থাকলেও একান্তই নিজের পারসোনাল কাজে।ফ্রেন্ড লিস্টে আজাইরা কেউ নেই।উনার লিস্টে এড থাকা জনগন উনাকে কোনো পাব্লিক গ্রুপ বা মেসেঞ্জার গ্রুপে এড দিলে সাথে সাথে ব্লক, উনার মেসেঞ্জারে অযাচিত কল দেওয়া যাবে না মোট কথা উনি মানুষ টায় অদ্ভুত। কিন্তু উনার সমস্যা আমাকে নিয়ে আমাকে বিরক্ত করাটা কে উনার জন্মগত অধিকার বলে মনে করেন।আমাদের কাজিন গুষ্টির সবাই বিহান ভাই এর বিশাল বড় ফ্যান।বিহান ভাই এর হ্যা তে হ্যা মিলাবে না তে না মেলাবে।
বাসায় ঢুকে দেখি আম্মুর রান্না প্রায় শেষ, বিভোর ভাই, রিয়া, রিয়ার পিচ্চি একটা বোন আছে আমাদের সবার আদুরে আয়রা তিনজনে টিভি দেখছে।আয়রা সারাদিন পাকা পাকা কথার বুলি আওড়াতে থাকে।বিহান ভাই এর ভীষণ ভালবাসার একটা অংশ জুড়ে আছে আয়রা।আয়রা ছুটে গিয়ে বিহান ভাই কে জড়িয়ে ধরলো। বিহান ভাই আয়রা কে কোলে তুলে নিয়ে একটা চকলেট দিলো হাতে।
আমি বাসায় ঢুকতেই আম্মু বলে কিরে দিয়া ডাক্তার দেখিয়েছিস।রিয়া যায় নি দেখে আমি বিহান কে বলেছিলাম আসার সময় তোকে যেনো নিয়ে আসে আর সাথে করেই যেনো ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসে।কারণ তুই তো নিজের সমস্যা ঠিক ভাবে গুছিয়ে বলতে পারিস না।
বিহান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফুপ্পি তোমার মেয়ের যে অসুখ সেটা এসব ছোট খাটো ডাক্তারে সারবে না।
ক্যানো বিহান দিয়ার কি হয়েছে?
ফুপ্পি তোমার মেয়ে বই না পড়ার অজুহাতে অসুখের ভান ধরেছে।ডাক্তার বলেছে ওর কিছুই হয় নি।
আম্মু বলে আমার ও সন্দেহ হচ্ছিলো হঠাত ওর অসুখ অসময়ে কিভাবে এলো।
ডাক্তার না দেখিয়েই আম্মুকে ডাহা মিথ্যা বলে দিলো বিহান ভাই।মিথ্যা বলে মিটমিট করে হাসছেন।উনার হাসিতে তো আবার কোনো সাউন্ড নেই।
রাগ করে নিজের রুমে গিয়ে ইচ্ছা করছিলো সব ভেঙে ফেলি।কিন্তু কিছু ভাঙলে বিহান ভাই কি আস্ত রাখবেন আমায়।কিভাবে রাগ মেটানো যায়। এই মুহুর্তে আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।হঠাত বিহান ভাই এর দেওয়া নেলপালিশ এর দিকে নজর গেলো।রিমোভার না পেয়ে ব্লেড দিয়ে নেলপালিশ তোলার চেষ্টা করলাম।উনার প্রতি রাগ উনার জিনিস তুলেই শোধ নিবো।
হঠাত করে সো সো গতিতে রুমে প্রবেশ করলেন বিহান ভাই।উনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল ভাবে দেখলাম আমি।রুমের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়িয়েছেন।উনার পারফিউম থেকে অসম্ভব সুন্দর ঘ্রান আসছে।উনার সব পারফিউম ইউনিক থাকে।কোথাও গেলে নিজেকে ভীষণ পরিপাটি ভাবে করে নিয়ে যান।মানুষ টাই পরিপাটি আর গোছানো।
দুই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন।কপালে কয়েক টা ভাজ পড়ে গিয়েছে। ভ্রু বাকিয়ে বলেন,’কি করছিস।’
মাথা নিচু করে বললাম,”বিশ্রি হাতে এত সুন্দর কালার ঠিক মানাচ্ছে না তাই।
‘নেলপালিশ তোর বাপ দাদার সম্পত্তি বেঁচে কেনা না বুঝলি।আমার জমানো টাকা থেকে কিনেছি।আমার টাকা মানে হালাল টাকা।তোর বংশের মতো সুদ, ঘুষের বাটপারির টাকা নয়।তাই যদি নেল পালিশ তুলিস তাহলে আঙুল গুলো রাখার দরকার নেই।ক্যান আই হেল্প ইউ।তোর এই মুরগীর বাচ্চার মতো নরম তুলতুলে আঙুল ব্লেড দিয়ে কুঁপিয়ে ও কেটে ফেলা যাবে।’
উনার মুখ থেকে কথাটা বেরোতেই পিলে চমকে উঠলো আমার।এখানে এসছেন নিশ্চয়ই কোনো মতলবে এসছেন।ব্লেড টা দ্রুত জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম।কারণ রাগের বশে হাত কেটেও দিতে পারে বলা যায় না।
উনার কথার উত্তর না দিয়ে বিরক্ত ভাব নিয়ে তাকালাম।
উনি এবার খানিক টা এগিয়ে এসে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন,,
নীল পরী নীলাঞ্জনা নামের আইডির স্ট্যাটাসের অত্যাচারে ফেসবুকে তো প্রবেশ করা যাচ্ছে না দিয়া।”১৭ বছর কাটিয়ে দিলাম সিঙ্গেল অবস্হায় আমি কি নোবেল পাবো না।”
আইডির মালিক কে কি সত্যি নোবেল দিতে হবে।এত মহৎ একটা কাজ করেছে নোবেল রবীন্দ্রনাথ নয় তাকেই দিতে হবে কি বলিস।রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তার থেকে গুন সম্পন্ন ব্যাক্তিকে দেখতে পেতেন আর নোবেল টা উৎস্বর্গ করতেন।
শুধু এটুকু না আরো আছে দিয়া
“বালক এই চোখে তাকিও না সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
আইডির মালিকের যে এত ভয়ানক প্রেম তৃষ্ণা পেয়েছে তার ফ্যামিলির কেউ কি জানে।সেই তথাকথিত পোস্ট এ আবার তোর ক্লাসমেট নেহাল কমেন্ট করেছে এক কাজল চোখের মাইয়া তীর মারলো কলিজায়।আচ্ছা এই আইডির মালিক কি তাহলে কলিজায় তীর মারছে।নেহাল এর নাম্বার যেনো কি দিয়া,ওয়েট কল দিয়ে শুনি আইডি টা কার।আমার এলাকার ছেলের কলিজায় তীর মারলো কে সে মহৌয়সী নারী।
আমার দিকে ঝুঁকে আমার মুখের উপর মুখ রেখে বিহান ভাই কথা বলছেন।ঠোঁট কাঁপছে আমার।ভয়ে কাঁপাকাঁপা ঠোঁট নিয়ে বললাম, নেহাল এর নাম্বার নেই।
বিহান ভাই আবার ও ভ্রু কুচকে বললেন,আচ্ছা দিয়া আমার যদি ভুল না হয় আমি কি গেজ করবো আইডি টা কার।বলেই পকেট থেকে ফোন বের করে উনার ফেসবুক ব্রাউজারে দেখালেন আইডি টা উনার ফোনেই লগ ইন।
হৃদপিন্ড চমকে উঠলো আমার উনি আমার ফেইক আইডির নাম কিভাবে জানলেন।ভয়ে ভীতহরিনীর মতো কাঁপছি তাহলে কি সব কমেন্ট ও পড়েছেন।আমি এখনি কেঁদে দিবো দিবো ভাব।উনি আমার আইডি হ্যাক করলেন কিভাবে।বিহান ভাই আমাকে মেরেই ফেলবেন। চোখ বন্ধ করে যত সূরা,দোয়া মনে মনে পড়ছি এ বারের মতো যেনো বেঁচে যায়।
বিহান ভাই রেগে আছেন কিন্তু প্রকাশ করছেন না,আবার বললেন,,
“আমি পনেরো দিন পরে ফেসবুকে প্রবেশ করে দেখি এই আইডি মাত্র পনেরো দিনে ৮ হাজার ফলোয়ার।আমি অবাক হয়েছি আমার আট বছরের আইডি তে আট টা ফলোয়ার নেই আর পনেরো দিনে ৮ হাজার ফলোয়ার।এমাজিং ব্যাপার তাইনা দিয়া।
আবার সানি লিওনির পেজে লাইক দেওয়া।কি রুচি।সেখানে বিভিন্ন কমেন্ট করে ব্লা ব্লা ব্লা।আইডির মালিক এর আম্মুর কাছে খবর টা পৌছাতেই হচ্ছে।তার মেয়ে এখন মডেল হিসাবে সানি লিওনিকে ফলো করছে।”
আম্মু জানলে আমাকে মেরে ফেলবে।বিহান ভাই এর মতিগতি ভাল মনে হচ্ছে না।
“ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বললাম বিহান ভাই সরি আমি আর কোনদিন ফেইক আইডি খুলবো না।প্লিজ! আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ।ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম।”
“উনি আরো ঝুঁকে বললেন,কি ভয় লাগে তাইনা? খুব ভয়।”
“আমি কেঁদেই যাচ্ছি।”
“এত ভয় যখন তোর নির্দিষ্ট আইডি থাকতে আরেক টা ফেইক আইডি খুলেছিস কেনো?”
“আ আ আপনি কিভাবে জানলেন আমার আইডি।”
“তোর ফোন নাম্বার আমার ল্যাপটপে কন্ট্রোল এ থাকে।ফোন নাম্বার দিয়ে কখন কি করছিস অল নটিফিকেশন আমার কাছে চলে যায় বুঝলি।এর জন্য আমাকে আলাদা কষ্ট করা লাগে নি।ইউ নো দিয়া ফেসবুক থেকে একটা একাউন্ট রিমুভ করা কোনো ব্যাপার নাহ।এই আইডি রিমুভ হয়ে যাবে কিন্তু তোকে তো শাস্তি দিতে হবে।”
“কি শাস্তি। ”
“যে কদিন আমি বাড়িতে থাকবো তুই আমাদের বাড়ি থাকবি আমার যাবতীয় কাজ গুলো তুই করবি তা না হলে ফুপ্পি কে এখুনি বলবো।”
“চোখ মুখ কালো করে বসে রইলাম।এই মুহুর্তে উনার কথায় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই”
বিহান ভাই এখনো আইডি নিয়ে শান্ত হন নি।
“আচ্ছা দিয়া সানি লিওনির ফেভারিট গান কোনটা তোর।”
“লীলা মুভির গান।”
“আই সি আমার তো মনে হয় অন্য কিছু।”
“কি।”
“এটা কানে কানে বলতে হবে।”
“ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।”
“বিহান ভাই কানে মুখ দিয়ে এক ভয়ানক গানের কথা বললো।যেটা আদেও কোনো গান কিনা আমি জানিনা।সেটা নাকি আবার সানি লিওনি স্পেশাল গান।মানুষ এত অশ্লিল কথা কিভাবে বলতে পারে।উনার কথা শুনে রিতীমত ভড়কে গেলাম।এই মানুষ টা এত ভয়ানক কথা কিভাবে বললো।”
“আমি বিহান ভাই কে বললাম,মোটেও না। আমার নামে অপবাদ দিচ্ছেন।”
“গান টা কি গেয়ে শুনাবো।”
“ওটা আবার গাওয়া যায় নাকি।”
“হ্যাঁ যায় তো, তোর শুনতে ইচ্ছা করছে জানি দিয়া।”
“মোটেও না আপনার গাইতে হবে না।”
“ওকে গান আমি গাইলাম না,তবে এটা বল তুই তোর এই ঠক বাজ বংশের মতো মানুষ ঠকানো কবে শিখলি।”
“আমি কিভাবে মানুষ ঠকালাম।”
“এই যে তুই সিঙ্গেল না হয়েও, ফেইক আইডি খুলে ইয়াং ছেলেদের হার্ট ভেঙে দিচ্ছিস।এটা তো মানুষ ঠকানো।রিতীমতো দূর্নিতী।”
“আমি সিঙ্গেল না তাইলে কি আমি?”
“তুই নিজে নিজেকে সিঙ্গেল ভাবলেও আমি তো আর তোকে সিঙ্গেল ভাবি না।”
“তাহলে কি ভাবেন আমাকে?বিবাহিতা। ”
এবার বিহান ভাই ঝুঁকে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ালেন,বিছানায় চিৎ হয়ে সুয়ে পড়লেন বালিস ছাড়া।
সুয়ে সুয়ে ঝুলন্ত ফ্যানের দিকেএ তাকিয়ে বলেন,
“সেটা মন্দ বলিস নি,তুই তো সাংঘাতিক মহিলা।সাংঘাতিক আকারের ভয়ানক মহিলা।”
“আবার কি করলাম আমি।”
“ভয়ানক না হলে আম্মুর এই হ্যান্ডসাম ছেলেকে ঠকাতে পারিস।”
“দেখুন একটা ফেইক আইডির জন্য কত কি বলছেন।একটা ফেইক আইডির জন্য কত সমস্যার কথা বলছেন।”
“সমস্যা আইডি তে নয় দিয়া তোর ওই সিঙ্গেল সিঙ্গেল স্ট্যাটাস এ।”
” তাতে আপনার বউ বা শ্বশুরের কোনো সমস্যা।”
“এইবার মেইন পয়েন্টে এসেছিস।সমস্যা এখানেই।শ্বশুরের মেয়ে তার জামাই কে রেখে ছেলেদের বুকে তীর মারছে এটা একটা সমস্যা।দ্বীতীয় সমস্যা বউ তার জামাই কে রেখে ছেলেদের বুকে তীর মারছে সমস্যা কিন্ত এই একটায়।দু দিকেই লস আমার ই”
“উনার কথার আগা মাথা না বুঝে বললাম, এত ঘুরিয়ে বলেন কেনো কথা।উনার কথা যদি বিশ্লেষণ করতে যায় আবার কথা ঘুরিয়ে দিবেন”
“সহযে বললে আমাকে সহযে পেয়ে যাবি।আমি কি তোর গুষ্টির মতো সস্তা।আমি বিহান মনে রাখিস।আমাকে বুঝতে হলে তোর এই ছোট মাথা বড় করতএ হবে। বলেই আমার রুম ত্যাগ করলেন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।