প্রেমালিঙ্গণ | পর্ব – ১৩

“এভাবে কান্না করলে সবাই ভাববে আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি। এই বিয়েতে তুমি কী খুশি না? কাজী সাহেবকে বলে সব ক্যান্সেল করে দিব?”

স্বাক্ষরের এমন কথা শুনে তন্দ্রার কান্না যেন কোথাও উবে গেল। সে ফ্যালফ্যাল করে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে রইল। হয়তো কী বলবে বুঝ উঠতে পারছে না৷ বিয়ে করে এখন আবার বলছে সব ক্যান্সেল করে দিবে। লাইক সিরিয়াসলি! ভাবলেই হাসি পায় তন্দ্রার। কিন্তু বাসায় গিয়েই বা কী বলবে! যদি কেউ এই বিয়েটা না মেনে নেয় তখন সে কী করবে?

দুই ঘন্টা আগের ঘটনা….

নবীন বরণের অনুষ্ঠান শেষ হতেই স্বাক্ষর বিয়ে করার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তন্দ্রার অকপটে নেতিবাচক জবাবটা স্বাক্ষরের পছন্দ হয় না। তন্দ্রার হাতটা শক্ত করে ধরে বাইকে বসায়। এরপর ভার্সিটি থেকে বের হয়ে আসে। তন্দ্রা বুঝতে পারে স্বাক্ষর এই মুহুর্তে খুব রেগে আছে। তাই সে চুপ করেই থাকে সারা রাস্তা। এরই মাঝে স্বাক্ষর বাইক এনে থামায় কাজী অফিসের সামনে। এখানে আসতে দেখে তন্দ্রা বেশ অবাক হয়। তার কৌতুহলী দৃষ্টি স্বাক্ষরের দিকেই। এদিকে স্বাক্ষর যেন বুঝেও অবুঝ হয়ে রয়েছে।

“আমরা এখানে কেন এসেছি?”

“কাজী অফিসে মানুষ কেন আসে?”

“হেয়ালি ভালো লাগছে না।”

“আমি কোথায় হেয়ালি করলাম? যা সত্যি তাই-ই তো বললাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের। বাসায়ও যেতে হবে।”

“আমি এখানে আর এক মুহুর্তও নেই। বাড়ি যাব আমি।”

কথাটা বলে তন্দ্রা চলে যেতে নিলে স্বাক্ষর নিজের পুরুষালি রুক্ষ হাতের মাঝে তন্দ্রার কোমল হাতটা আকড়ে ধরে। তন্দ্রা অবাক হয়ে তাকে দেখল। স্বাক্ষর আ’হ’ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই চোখ যেন অনেক কিছুই বলতে চায়৷ মাঝে মাঝে চোখও মনের কথা বলে দেয়।

“আজকের দিনটা হয়তো আর ফিরে আসবে না। হয়তো তোমাকে আমার পাওয়া হবে না। এই দুটো দিন নিজের সাথে কম ল’ড়াই করতে হয়নি আমাকে। অনেক ভেবে চিন্তে আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় হয়েছি। এখন একান্ত তোমার মতামত আমার প্রয়োজন। প্লিজ আমাকে হারিয়ে দিও না। ”

তন্দ্রা কোনো কথাই বলছে না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বাক্ষরের চোখের দিকে। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে‚ কথা বলার সময় চোখ দুটি কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি স্বাক্ষর কেঁদে দিবে।

“কিছু বলছো না কেন? তুমি কী রাজি নও?”

“বাবা মায়ের দোয়া ছাড়া কোনো কাজই সুষ্ঠু ভাবে সম্পূর্ণ হয় না।”

“একবার বিয়েটা হয়ে যাক সবাই রাজি হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ রাজি হয়ে যাও।”

“……..”

“কিছু বলছো না যে? তোমার মতামত না থাকলে, আমি তোমাকে জোর করব না। মুখে কিছু বলতে হবে না‚ তুমি রাজি না থাকলে আমার হাতের নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে পার। এটাকেই তোমার মতামত হিসেবে ধরে নেব। আই প্রমিজ‚ এই মুখ নিয়ে আর কক্ষনো তোমার সামনে আসব না।”

তন্দ্রা স্বাক্ষরের হাতটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। যেন ছেড়ে দিলেই আর কখনো তাকে দেখতে পারবে না সে। স্বাক্ষর যেন নিজের সব উত্তর পেয়ে গেল‚ তন্দ্রার নীরব চাহুনিতেই।

তন্দ্রাকে নিয়ে স্বাক্ষর কাজী অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে৷ তন্দ্রা মাথা নিচু করে রেখেছে। একদিকে পরিবার অন্যদিকে স্বাক্ষর। দুটোই তার অধিক প্রিয়। কারো চেনা কণ্ঠে সামনের দিকে অবাক হয়ে তাকাল তন্দ্রা। ইলোরা‚ মুহিত আর আকাশ দাঁড়িয়ে আছে৷ সাথে একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেনি সে। ইলোরার তন্দ্রার কাছে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করল।

“হাওয়া খেতে খেতে আসলি নাকি?”

তন্দ্রা উত্তর দিল না। চুপটি করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে তার কথা বলার কোনো ইচ্ছে করছে না। সে বাদে ইলোরা‚ মুহিত‚ আকাশ সবাই জানত এই বিয়ের ব্যাপারে। অথচ স্বাক্ষর তাকে শেষ সময়ে এসে জানাল। তন্দ্রাকে চুপ থাকতে দেখে আকাশ স্বাক্ষরকে সন্তপর্ণে জিজ্ঞেস করে।

“কী রে তোদের আসতে এতো সময় লাগল কেন?”

“প্রেম করতে গিয়েছিলাম।”

স্বাক্ষরের এমন উত্তর পছন্দ হয়নি আকাশের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে স্বাক্ষরকে বলল‚

“তোর সাথে ফালতু বকবক করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাড়াতাড়ি কর। সব ব্যবস্থা হয়ে আছে।”

“আমরাও রেডি।”

এরপর তন্দ্রার আর স্বাক্ষরের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে যায়। ধর্ম অনুযায়ী কাজী সাহেবকে দিয়ে বিয়েটাও সম্পূর্ণ হয়ে যায় ওদের। সাক্ষী হিসেবে ছিল ইলোরা‚ মুহিত‚ আকাশ আর ঐশী। আকাশের গার্লফ্রেন্ড ঐশি। ওদের এনগেজমেন্ট হয়ে আছে খুব শীগ্রই বিয়েও হয়ে যাবে। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই তার মিশুক স্বভাব।

বর্তমান….

ইলোরা‚ মুহিত‚ আকাশ আর ঐশী ওরা ওদের বাসায় চলে গিয়েছে। এখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। স্বাক্ষরের ফোনে তার মা বারবার কল করছেন। স্বাক্ষর ছোট্ট একটা টেক্সট করে দিল তার মায়ের ফোনে। এরপর বাইকে গিয়ে বসে। তন্দ্রার দিকে হেলমেটটা এগিয়ে দিল৷ তবে সে তা নাকচ করে দিল। স্বাক্ষর এই নিয়ে কোনো জোর করল না। তন্দ্রা বাইকে উঠে বসল।

“শক্ত করে ধরে বসো।”

মুখে কিছু না বললেও তন্দ্রা স্বাক্ষরকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এমন কাণ্ডে স্বাক্ষর ক্ষীণ হাসল এবং মনে মনে খুশিও হলো অনেকটা। এটা ভেবে তার শান্তি লাগছে যে‚ এখন থেকে তন্দ্রাবতী একান্ত তার। আজ থেকে তন্দ্রাবতীকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে পিছু করবে না। দুজনের মাঝে রয়েছে এক পবিত্র বৈধ সম্পর্ক।

“এটা শুধু আলিঙ্গন নয় এটা হচ্ছে বৈবাহিক আলিঙ্গন৷ তুমি প্রতিনিয়ত আমাকে অপহরণ করছ তন্দ্রাবতী। আমি হারিয়ে যাচ্ছি তুমিময় প্রেমানুভূতিতে।”

তন্দ্রা কিছুই বলল না। সেভাবেই লেপ্টে রইল স্বাক্ষরের পিঠের সাথে৷ স্বাক্ষর আবারও বলল‚

“প্রকৃত সৌভাগ্যবান তো সে-ই‚ যাকে ভালোবাসার জন্য একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ থাকে। আমার সেই মানুষটা শুধুই তুমি।”

তন্দ্রা তার মাথার ভরটা স্বাক্ষরের পিঠে ঠেকাল। নিজেকে আজ খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মানুষটা তাকে কতটা ভালোবাসে! তাকে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে। তন্দ্রা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। না জানি বাড়িতে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। এই ভেবে তন্দ্রার কিছুটা দু’শ্চি’ন্তাও হয় বটে। কিন্তু স্বাক্ষরের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। সে নিজের মতো বাইক চালাতে ব্যস্ত৷ আসল চিন্তা তো ছিল তন্দ্রাকে নিয়ে। সে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়-ই নাকি! এই সমস্ত প্রশ্নই আজ সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে।

প্রায় আধ ঘন্টার মাঝে স্বাক্ষর তন্দ্রাকে নিয়ে বাড়িতে এলো। কলিং বেল চাপতেই মিসেস সাহেরা হুড়মুড় করে এসে দরজা খুলে দিলেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিলেন না তিনি। তন্দ্রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বাক্ষরের পাশে। ড্রইং রুমে সবাই তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সবাই দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। সবার মুখেই গম্ভীরতা বিরাজ করছে। ইউসুফ মাহমুদ কাটকাট গলায় বললেন‚

“তন্দ্রাকে তুমি পছন্দ কর এই কথা আমাদের আগে বললেই পারতে।”

“ছোট আব্বু আমি তো..”

“থাক হয়েছে। নিজের হয়ে আর সাফাই গাইতে হবে না। তোমরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তাই বলে বিয়ের করার সিদ্ধান্তটা একাই নিয়ে নিবে। তন্দ্রাকে তো আগে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল‚ তখন তো কিছু বলল না।”

ইউসুফ মাহমুদ এর কথায় ফোড়ন কে’টে মিসেস সাহেরা বললেন‚

“আহা ভাই। ছেলে মেয়ে দুটো মাত্রই বাড়িতে ফিরল। ভেতরে তো আসতে দাও। তাহু গিয়ে মিষ্টি আর পানি নিয়ে আয়। আমার ছেলে আর ছেলের বউকে বরণ করে নিতে হবে তো। নাকি?”

ইউসুফ মাহমুদ চুপ করে সড়ে গেলেন। মিসেস তাহেরা ছুটলেন রান্না ঘরের দিকে। মি. ইলিয়াস মাহমুদ কোনো কথাই বলছেন না। উনার রাগ সম্পর্কে অবগত স্বাক্ষর। একটু পরেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। স্বাক্ষর তন্দ্রার হাতটা এখনো ধরে আছে। তার কোমল হাতটা মৃদু কাঁপছে। হয়তো ভয়টা পুরোপুরি যায়নি। তন্দ্রার অহেতুক ভয়ে স্বাক্ষর বেশ উপভোগ করছে। পরিস্থিতি বরাবরই স্বাভাবিক। তুলি অ্যালভিনকে কোলে করে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। এতোক্ষণ সে ঘুমিয়ে ছিল। স্বাক্ষর তন্দ্রার বিয়ের ব্যাপারে একমাত্র সেই কিছুই জানে না। সবাইকে সিরিয়াস মুডে দেখে‚ সে ড্রইং রুমে গিয়ে তার বাবার পাশে বসল। ইউসুফ মাহমুদ এর কানাকানি বলল‚

“বড়ো আব্বুর কী হয়েছে আব্বু?”

“কিছু হয়নি মা।”

সাহেরা মাহমুদ তন্দ্রা আর স্বাক্ষরকে বরণ করে ঘরে তুলে নেন। উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে এখানে উপস্থিত সবার চাইতে বেশি খুশি তিনিই হয়েছেন। এতোদিনে উনার মনের আশাটা পূরণ হয়েছে। বরণ শেষে তন্দ্রা আর স্বাক্ষরকে তিনি ওদের ঘরে পাঠিয়ে দেন। সবাই ওদের বিয়ে নিঃশব্দে মেনে নিলেও ইলিয়াস মাহমুদ কিচ্ছুটি বলছেন না। তবে মনে মনে ঠিকই সব মেনে নিয়েছেন। উপরে উপরে নিজের গম্ভীরতা বজায় রেখেছেন।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।