প্রেমালিঙ্গণ | পর্ব – ১১

সকাল সকাল খুব তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে তন্দ্রা। ইলোরার সাথে রাতে প্ল্যান করেছে আজ ভার্সিটি যাবে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠতেই যত দেরি। যার দরূন এখন তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। তুলির আজ স্কুল বন্ধ তাই সে ড্রইং রুমে তার প্রিয় কার্টুন দেখছে। তন্দ্রা নীল রঙের লং জামা পড়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। হিজাব করার মাঝেই‚ মিসেস তাহেরা ঘরে এলেন। তন্দ্রার দেরি হচ্ছে বলে তিনি ডাকতে এলেন। টেবিলে খাবারও বেড়ে এসেছেন ম্ব্যের জন্য।

“যেভাবে তাড়াহুড়ো করছিস মনে হচ্ছে খাবার খাওয়ার সময়টাও পাবি না।”

“রাতে ইলোরা বলল আজ নাকি কীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।”

“আচ্ছা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়।”

“হুম।”

মিসেস তাহেরা চলে যেতেই তন্দ্রা হিজাবটা ঠিক ভাবে পড়ে নিল। বার কয়েক নিজের মুখশ্রী দেখে নিল আয়নায়। সব ঠিকঠাকই আছে৷ ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। চেয়ার টেনে বসল নিজের জায়গায়। খাবার আগে থেকে বেড়ে রাখা। তন্দ্রা অল্প কিছু খাবার মুখে দিল। সকাল সকাল খেতে ইচ্ছে করে না তার কিন্তু মায়ের ভয়ে খেতে হয়! নইলে যে কপালে মায়ের উত্তম মাধ্যম লেখা থাকে। খাওয়া হয়ে এলেই তন্দ্রা তার মা আর বড়ো মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে নিলে‚ ড্রইং রুমে স্বাক্ষরকে দেখতে গেল। হয়তো তন্দ্রার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

“তুমি হসপিটালে যাওনি ভাইয়া?”

ভাইয়া ডাকটা হয়তো স্বাক্ষরের ঠিক পছন্দ হলো না। মুখে কিছু না বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। মিসেস তাহেরা তন্দ্রার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন‚

“ছেলেটা তোর জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে।”

“তন্দ্রাবতী তাড়াতাড়ি আয়।”

কথাটা বলেই হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল স্বাক্ষর।

“ভাইয়ের থেকেও বেশি কিছু হই তোমার। বেয়াদব মেয়ে, আমাকে ভাইয়া বলার শাস্তি তোমাকে পরে দেব। সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব কিন্তু সেটা অন্য উপায়ে।”

মনে মনে আরও অনেক কিছুই ভাবল স্বাক্ষর। গাড়িতে এসে বসতেই তন্দ্রা এসে তার পাশে বসল। স্বাক্ষর গাড়ি স্টার্ট দেবে তখনই সে খেয়াল করল তন্দ্রা সিট বেল্ট লাগায়নি। ধীর গতিতে তন্দ্রার খানিকটা কাছে গেল। তার তপ্ত নিশ্বাস তন্দ্রার ঘাড়ে মুখে এসে ঠেকল। তন্দ্রার মনে এক অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। দুরুদুরু বুকে স্বাক্ষরের দিকে তাকাল সে। স্বাক্ষর সিট বেল্ট লাগিয়ে সরে এসে বলল‚

“দিনকে দিন খুব অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ তন্দ্রাবতী। সিট বেল্ট কে লাগাবে শুনি?”

তন্দ্রা মেকি হাসার চেষ্টা করল। স্বাক্ষরের মুখে তুমি ডাকটা তার কর্ণকুহরে প্রণয়ের সূর তোলে। শুনতে বড়ো-ই ভালো লাগে।

“অপ্স ভুলে গেছি ভাইয়া।”

তন্দ্রার বেফাঁস উত্তরে স্বাক্ষর কিছুটা ক্ষেপে ওঠল। বার বার কেন এই মেয়ের ভাইয়া বলে ডাকতে হবে। সে তো আর টিনএজার নয়। একটা ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে বলে কয়ে কেন ভালোবাসার অনুভূতির জানান দিতে হবে। সে কী বুঝতে পারে না? অবশ্যই সে সব বুঝতে পারে। বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে যাচ্ছে। এক পলক তন্দ্রাকে দেখে নিল স্বাক্ষর। নীল রঙা জামাটা বেশ ভালোই মানিয়েছে তাকে। স্বাক্ষর গাড়ি স্টার্ট দিল মুহুর্তেই। তন্দ্রা তাকে দেখে যাচ্ছে অনেকক্ষণ যাবৎ। স্বাক্ষর জানে তন্দ্রা এখন তাকেই দেখছে তাই সে আর সেদিকে তাকায়নি। সে চায় তন্দ্রার দৃষ্টি সবসময় তার দিকেই থাকুক। স্বাক্ষরের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে তন্দ্রার বেশ ভালোই লাগছে। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে সে স্বাক্ষরের চোখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। এরই মাঝে স্বাক্ষর বেশ কয়েক চোখের পলকও ফেলেছে। তন্দ্রা তা গুনেও নিয়েছে। তন্দ্রার ভাবনার মাঝেই স্বাক্ষর ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামায়। তন্দ্রা এখন গভীর ভাবনায় মগ্ন। স্বাক্ষর সিট বেল্টটা খুলে দিল। তন্দ্রার ভাবনার সমাপ্তি ঘটল।

“ভাবনা শেষ হলে‚ যেতে পারেন। এই তো আসার আগেই কত তাড়াহুড়ো করছিলেন।”

“যাচ্ছি।”

“হুম।”

তন্দ্রা নেমে যায় গাড়ি থেকে। ভার্সিটির ভেতরে ঢুকলে স্বাক্ষর সেখান থেকে চলে গেল। তন্দ্রাকে দেখা মাত্রই ইলোরা আর মুহিত এগিয়ে এলো। ইলোরা গদগদ করে তন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরল। তন্দ্রা ভার্সিটি আসার পর বুঝতে পারল তার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা ঠিক কী! ইলোরা তাকে আসার জন্য এতো তাড়া কেন দিয়েছে! তন্দ্রা কপাল চাপড়ে‚ কপট রাগ দেখিয়ে ইলোরার দিকে তাকাল।

“রাগ করছিস কেন?”

“নবীন বরণ হবে ভালো কথা‚ তাই বলে তুই ফাংশনে আমার নাম কেন দিয়েছিস?”

“কারণ তুই ভালো নাচতে পারিস৷”

“তুই কী ভুলে গেছিস সপ্তাহ খানিক আগে আমার পায়ের গোড়ালিতে ফ্র‍্যাকচার হয়েছিল! তোর কী মনে হয় সে আমাকে ফাংশনে নাচতে দেবে? যেখানে বাড়িতেই আমাকে ধীর পায়ে ছোট বাচ্চাদের মতো হাঁটতে হয়।”

“আমি এতো কিছু ভেবে দেখিনি। চল তোর নাম কে’টে দিয়ে আসি।”

“হুম।”

অডিটোরিয়ামে কয়েকজন মিলে নাচের রিহার্সাল করছে। সবাই তাদের ক্লাসমেট। ওদের রিহার্সাল দেখে তন্দ্রারও নাচতে ইচ্ছে করল কিন্তু পায়ে তার হালকা চিনচিনে ব্যথা এখনো আছে। এ কথা কাউকে সে বলেনি। বললে দেখা গেল‚ ভার্সিটিতেই আসতে দেবে না। একটা চেয়ারে বসে বন্ধুদের নাচ করা দেখছে। ইলোরা আর মুহিত একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতে নাচবে।

আরও তিন ঘন্টা নাচের রিহার্সাল করে ওরা বাসায় ফিরে এলো। তন্দ্রার খুব ক্লান্ত লাগছে তাই সে এসেই গোসল করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ভেজা চুল গুলো পর্যন্ত শুকায়নি। এমনকি দুপুরের খাবারটাও খায়নি। খোলা চুলে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ঘুমে চোখ টলমল করছে। কিছু সময় যেতে ঘুমিয়েও পড়ল সে। মিসেস তাহেরা তুলিকে একবার পাঠিয়েছিলেন তন্দ্রাকে ডাকার জন্য কিন্তু সে ওঠেনি। তুলি নিজেও তন্দ্রার পাশে শুয়ে পড়ল। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ আগে তন্দ্রার ঘুম ভাঙল। সময় দেখে খুব অবাক হলো সে। এতো সময় কী করে ঘুমাল। হয়তো ক্লান্ত লাগায় ঘুম বেশি হয়েছে। ভেজা চুলে ঘুমোনোর জন্য তার ঠান্ডা লেগে গেছে। বারবার হাঁচি আসছে। এতো সময়ে চুলও শুকিয়ে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বেনী গেঁথে নিল তন্দ্রা। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলো। নিজের জন্য আদা দিয়ে কড়া করে চা বানাল। ঠান্ডা লাগার কারণে মাথাটাও খুব ধরেছে। চা বানিয়ে তন্দ্রা ঘরে যাচ্ছিল এমন সময় স্বাক্ষর বাড়ি এলো। তার হাতে একটা প্যাকেট। মিসেস সাহেরা আর মিসেস তাহেরা ড্রইং রুমেই বসে আছেন। স্বাক্ষর প্যাকেটটা মিসেস তাহেরার হাতে দিল। এরপর নিজের ঘরে চলে গেল। মিসেস তাহেরা রান্না ঘরে গেলেন। তন্দ্রা গিয়ে সাহেরা মাহমুদ এর পাশে গিয়ে বসল। বারবার নাক মুছতে মুছতে নাকটা লাল হয়ে গেছে তন্দ্রার।

ড্রইং রুমে সবাই একসাথে বসে আছে। মি. ইলিয়াস মাহমুদ এবং মি. ইউসুফ মাহমুদ অফিসে থেকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। স্বাক্ষর আসার সময় সিঙ্গারা আর জিলাপি নিয়ে এসেছিল। মিসেস সাহেরা কল করে এগুলো আনতে বলছিলেন৷ স্বাক্ষর বাইরের খাবার একদমই পছন্দ করে না। বাড়ির খাবারই তার জন্য পারফেক্ট। স্বাক্ষর একপাশে সিঙ্গেল সোফায় বসেছে। কোলে অ্যালভিন বসে স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে মিয়াও মিয়াও করছে। তন্দ্রা আর তুলি একসঙ্গে। সন্ধ্যা থেকে তন্দ্রার দু কাপ চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। নিজের জন্য তখন আদা দিয়ে কড়া করে চা বানিয়েছিল‚ এরপর মিসেস তাহেরা সবার জন্য দুধ চা আর স্বাক্ষরের জন্য আলাদা করে কফি বানিয়েছিলেন। এখন সবাই চা‚ সিঙ্গারা আর জিলাপি খেতে খেতে খুশগল্পে ব্যস্ত। মি. ইলিয়াস মাহমুদ তন্দ্রা আর তুলিকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। স্বাক্ষর বিরক্ত হয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। লক্ষ্মী মেয়ের মতো তন্দ্রা তুলিকে নিয়ে ঘরে এসে দরজা আটকে দিল। কৌতূহল মেটাতে দরজা কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করল‚ সেখানে কী কথা হচ্ছে।

“আমার বন্ধু জাহিদ তার ছেলের জন্য তন্দ্রাকে পছন্দ করেছে।”

মি. ইলিয়াস মাহমুদের কথায় স্বাক্ষরের মনে এক অজানা ভয় জেঁকে বসল। তার তন্দ্রাবতীকে সে হারিয়ে ফেলবে না তো। বুকটা ভারী হয়ে এলো। ভেতরটা কাঁপছে ক্রমাগত। স্বাক্ষর একবার তার মায়ের দিকে তাকাল। ছেলের চাহুনিতেই যেন মিসেস সাহেরা কথা সব বুঝে গেলেন।

“কিন্তু তন্দ্রা তো এখনো পড়াশোনা করছে। অনার্সটা না-হয় শেষ করুক।”

“বিয়ের পরেও ওরা পড়াশোনা করাবে। ছেলে তার বাবার ব্যবসা সামলায়। ব্যবহারও খুব ভালো। আমি আর ইউসুফ গিয়েছিলাম তো ওখানে।”

“ভাবী আমার কাছে ভালোই লেগেছে জোভানকে। তন্দ্রার জন্য আমরা যেমন ছেলে চাই তেমনই। কিন্তু আমাদের আগে জানতে হবে মেয়ের কাউকে পছন্দ আছে কি-না!”

“আমার মনে হয় না তন্দ্রার পছন্দের কেউ আছে বলে।”

মিসেস তাহেরার ফোড়ন কা’টা জবাবে মিসেস সাহেরা খুবই বিরক্ত হলেন। এই মেয়েটা কী মেয়ের অনুভূতির কথা কখনোই বুঝবে না। মিসেস সাহেরা প্রতিবাদী স্বরে বললেন‚

“তারপরও ওকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার।”

আবছা হলেও তন্দ্রা বেশ ভালো ভাবেই কথা গুলো বুঝতে পেরেছে। অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে ভাবতেই তন্দ্রা বুকটা কেমন ধক করে উঠল! আজ হয়তো বুঝতে পারছে সে স্বাক্ষরকে পছন্দ করে। হয়তোবা ভালোও বাসে।

স্বাক্ষর অ্যালভিনকে কোলে নিয়ে তার ঘরে চলে গেল। তার কিছুই ভালো লাগছে না। বারবার শুধু মনে হচ্ছে তন্দ্রাকে সে হারিয়ে ফেলবে। বাসায় কী করে বলবে‚ তন্দ্রাকে সে ভালোবাসে! কেউ কী আদৌও মেনে নেবে এই সম্পর্ক?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।