আজ সকাল থেকেই তন্দ্রার মনটা বেজায় খারাপ। তিনদিন থেকে আজ শুভ’রা চলে গেছে। এই তিনদিনে ওরা সারাক্ষণ একসাথেই কাটিয়েছে। ওদের সাথে খুব ভালোই সময় কেটেছে তন্দ্রার। তার পায়ের ব্যথাও বেশ অনেকটাই কমে এসেছে। এই তিনদিন সে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে ছিল। তন্দ্রা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে স্থির চিত্তে চেয়ে রইল নীলাভ অম্বরে। বিশাল অম্বর ঈষৎ কৃষ্ণাভ নীরদ আবরণে ঢেকে আছে৷ খুব করে বারিধারায় গা ভাসাতে ইচ্ছে করল নবনীর কিন্তু মেঘের যে দেখা নেই। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না তন্দ্রার। বেলকনিতে রাখা চেয়ারটায় সন্তপর্ণে বসল। কর্ণারে গ্রিলের উপর দুটো চড়ুই পাখি এসে দাঁড়িয়েছে। পাখি দুটো কিচিরমিচির শব্দ করছে। তন্দ্রা পাখি দুটোকে দেখে তার আর স্বাক্ষরের কথা আনমনে ভাবল। নিজের এমন অদ্ভুত‚ অযৌক্তিক ভাবনা চিন্তায় খুন হাসি পেল তন্দ্রার। ইদানীং স্বাক্ষরকে নিয়ে খুব বেশিই ভেবে ফেলছে সে। তিনদিন ধরে তো স্বাক্ষর তার সাথে ঠিক মতো কথাও বলছে না। এমনিতে বাসায় থাকলে তো তা-ও একটু আধটু কথা বলত‚ এখন সেটাও বলে না। কিছু হয়েছে কি-না সেটাও বুঝার উপায় নেই৷ তন্দ্রার সাথে কথা না বললেও‚ তার যত্ন বা খোঁজ নেওয়া কোনোটায় অবহেলা করেনি স্বাক্ষর৷ তার কথা মনে পড়তেই তন্দ্রার মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল।
“কিরে মন খারাপের রানী। মুখটাকে এভাবে ভার করে রেখেছিস কেন?”
ঘাড় ঘুরিয়ে তন্দ্রা বেলকনির দরজার দিকে তাকাল। ইলোরা এসেছে। তন্দ্রা গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। সেই যে পরশুদিন এসেছিল তারপর আর আসার নাম গন্ধও নেই। বলে গিয়েছিল প্রতিদিন এসে তার সাথে দেখা করে যাবে।
“তন্দ্রারানীর কী অভিমান হয়েছে? শুনলাম তোর নাকি মন খারাপ। তাই তো এই মেঘলা দিনেও তোর কাছে ছুটে এসেছি।”
“কথা নেই তোর সাথে।”
“আমার সাথেও কথা বলবি না?”
তন্দ্রা তাকিয়ে দেখল মুহিত ইলোরার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে একটা ভেংচি কে’টে বলল‚
“গার্লফ্রেন্ডকে একলা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না বুঝি?”
“যদি চুরি করে রেখে দিস তাইতো চোখে চোখে রাখি।”
“নিয়ে যা তোর গার্লফ্রেন্ডকে। ওকে দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই।”
তন্দ্রার কথায় ইলোরা খিলখিল করে হেসে উঠল। তন্দ্রার মন খারাপ দেখে স্বাক্ষরই তাকে কল করে আসতে বলল। এমনিতেও মুহিত আর ইলোরা দুজনে প্ল্যান করেছিল তন্দ্রাকে দেখতে আসবে।
“তুই যেহেতু আমার সাথে কথাই বলবি না তাহলে তোর জন্য যে ফুচকা এনেছিলাম সেটা বাড়িতে ফেরত নিয়ে যাই? এই চলো তো। আমরা এক্ষুনি চলে যাব।”
“গিয়ে দেখ না। পা ভেঙে রেখে দেব দুটোর।”
তন্দ্রার এমন গাল ফুলিয়ে কথা বলার ধরন দেখে ইলোরা আর মুহিত একসঙ্গে হেসে উঠল। তন্দ্রার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল। মুহিত বিছানার একপাশে আধশোয়া হয়ে বসল। ইলোরা একটা ফুচকায় টক পুরে তন্দ্রার মুখের সামনে ধরে ইশারা হা করতে বলল। ওমনি তন্দ্রা তা মুখে নিয়ে নিল।
“তুইও খা। আরেকটু ঝাল দিয়ে আনতে পারলি না?”
“তোর জন্য বেশি ঝাল খাওয়া বারণ।”
“কেন কেন? আবার কে বারণ করল?”
“এটা সিক্রেট।”
“হুহ্!”
বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ওরা ঘর থেকে বের হয়। রান্না ঘরে মিসেস তাহেরা বিরিয়ানি রান্না করায় ব্যস্ত। ইলোরা আসার পর পরই বায়না ধরেছিল উনার হাতের বিরিয়ানি খাবে৷ তন্দ্রাকে নিয়ে ইলোরা আর মুহিত ড্রইং রুমে গিয়ে বসল৷ মুহিত এক কোণায় বসে টিভি দেখছে। ইলোরা তন্দ্রার কানাকানি বলল‚
“কিরে তন্দ্রারানী। শুনলাম সে কথা বলে না দেখে নাকি তোর মন খারাপ।”
“এই সমস্ত ফালতু কথা তোকে কে বলে?”
“ফালতু না, ফালতু না। এটাই সত্যি তোর চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”
তন্দ্রা তার ফোনে নিজের মুখটা দেখে নেয়। ভ্রু কুচকে ইলোরার দিকে তাকায়। এদিকে হাসতে হাসতে ইলোরার পেটের অবস্থা খারাপ। তন্দ্রা মেকি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকাল তার দিকে। ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়ছেন মিসেস সাহেরা এবং মিসেস তাহেরা এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। ইলোরা আর মুহিত বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে এবং সাথে প্রশংসাও করছে। এরই মাঝে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরল স্বাক্ষর। তাকে দেখে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তন্দ্রা একবার তার দিকে তাকাল। স্বাক্ষর সোজা তার ঘরে চলে গেল। মিসেস তাহেরা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে স্বাক্ষরের কাছে যেতে নিলে তন্দ্রা উনাকে আটকাল। আর গ্লাসটা নিজেই নিয়ে নিল। এই দেখে মিসেস সাহেরা মৃদু হাসলেন। ইলোরা আর মুহিতও হেসে দিল তন্দ্রার এমন কাণ্ডে।
“তুমি আমাকে ইগনোর কেন করছ?”
স্বাক্ষর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম গুলো ইতিমধ্যেই খুলে ফেলেছে। তন্দ্রা দ্রুত স্বাক্ষরের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। আয়নার তন্দ্রাকে অন্যদিকে ঘুরে থাকতে দেখে স্বাক্ষরের ভাবনার পরিবর্তন হলো না। একটা টাওয়াল দিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। যাওয়ার আগে তন্দ্রাকে বলে গেল‚
“তুই বোস। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
তন্দ্রা পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে দিল। এরই মাঝে স্বাক্ষরের ফোনটা বার বার বাজছে। এদিকে তন্দ্রা ফোন ধরবে কী ধরবে না সেই ভাবনায় মশগুল। এক পা দু পা করে ফোনের দিকে এগিয়ে গেল। আবারও কলটা কে’টে গেল। তন্দ্রা স্বাক্ষরের ফোনটা হাতে নিল। ফোন স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা নিজের ছবিটা দেখে বেশ অবাক হলো। ছবিটা কবে তুলেছে সেটাই মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু তার সকল ভাবনা বিফলে। এই ছবিটা তার ফোনে থাকবে কী করে? এমন ছবি তো কখন সে তুলেনি। মনে হচ্ছে তারই অগোচরে তোলা হয়েছে এই ছবিটা। কিন্তু স্বাক্ষর এটা কখন তুলল? এটা তো রুবির বিয়ের দিনের। তন্দ্রার বেশ পছন্দও হয় ছবিটা।
মিনিট পাঁচেক পর স্বাক্ষর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো৷ এরই মাঝে গোসল করে ফেলেছে ভাবতেই অবাক হলো তন্দ্রা। খুব তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না? স্বাক্ষরের পড়নে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর কালো রঙের টিশার্ট। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে তন্দ্রার কাছে এসে দাঁড়াল। ঠান্ডা পানিটা খেল এক নিশ্বাসে। তন্দ্রার হাত থেকে ফোনে নিয়ে বিছানায় আয়েশ করে বসল। তন্দ্রা তার চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল‚
“পারমিশন ছাড়া কারো ছবি তুলতে নেই‚ তুমি জানো না?”
“পারমিশন ছাড়া কারো ফোনে হাত দিতে নেই, সেটা তুমি জানো না?”
স্বাক্ষরের মুখে তুমি ডাকটায় হয়তো কিছু একটা ছিল। মুহুর্তেই তন্দ্রার সর্বাঙ্গ কম্পিত হলো। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎ করেই তন্দ্রার ভীষণ লজ্জা লজ্জা পাচ্ছিল। ইচ্ছে করছে না স্বাক্ষরের সাথে দাঁড়াতে৷ আবার যেতেও ইচ্ছে করছে না। মুহূর্তেই সহস্র কথা গলায় দলা পাকিয়ে গেল। মুখে কিছুই বলতে পারছে না অথচ অনেক কিছু বলার ছিল তন্দ্রার। কম্পনরত কণ্ঠে শুধু বলল‚
“পরে কথা বলব।”
কথাটা বলেই দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল তন্দ্রা। এই মুহুর্তে স্বাক্ষরের ঐ সর্বনাশা চোখে কিছুতেই তাকানো সম্ভব না৷ ঐ চোখে কিছু একটা আছে যা তাকে বারংবার বিমোহিত করে। তন্দ্রা যেতেই স্বাক্ষর এসি অন করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই তন্দ্রার লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া মুখটা ভেসে উঠল। মুখে লেপ্টে রইল অমায়িক ক্ষীণ হাসি।
তুলি কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। বেলকনিতে বসে তন্দ্রা ফোনে তার বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করছে। আজকে সারাদিনে একবারও অনলাইনে আসা হয়নি তার। নিউজফিড স্ক্রল করছে আর হাসছে। মুহিতের একটা পোস্ট দেখে মূলত সে হাসছে। ইনবক্সে ইলোরা তাকে মেসেজ দিয়ে বলে‚
“আমার পোস্টে রিয়েক্ট দেওয়া তোর জন্মগত অধিকার।”
ইলোরার মেসেজ সিন না করেই তন্দ্রা আবারও ফেসবুকে গিয়ে লাভ রিয়েক্ট আর একটা কমেন্ট করে।
“কমেন্ট বক্সে তোকে পঁচানো আমার জন্মগত অধিকার।”
“হুহ্!”
এবার তন্দ্রা মনে মনে ভাবল একবার স্বাক্ষরের প্রোফাইল দেখে আসা উচিত। ইংরেজিতে স্বাক্ষর মাহমুদ লিখে সার্চ দিতেই কাঙ্ক্ষিত প্রোফাইলটা সামনে চলে এলো। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো‚ সে তো স্বাক্ষরকে এড পাঠায়নি তাহলে ফ্রেন্ড লিস্টে আছে কী করে! যাক ভালোই হলো। স্বাক্ষরের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস এ দেওয়া “ইটস কমপ্লিকেটেড” তন্দ্রা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নিকনেম “গম্ভীর মহারাজ” দেওয়া। তন্দ্রা খুব হাসি গেল নামটা দেখে। এই নামটা সেই-ই দিয়েছিল। তবে সেটা স্বাক্ষর জানলো কী করে? স্বাক্ষরের বেশ কয়েকটা ছবি তন্দ্রা নিজের ফোনের স্যাভ করে রাখল। এরপর ফোনের ডাটা অফ করে দিল। গ্যালারিতে আসতেই সামনে স্বাক্ষরের তেরোটা ছবি দেখতে পেল। দ্রুত সে ছবি গুলোকে একটা ফোল্ডারে লুকিয়ে রাখল। জুম করে তন্দ্রা স্বাক্ষরের একটা ছবি দেখতে থাকে৷ গৌরবর্ণের মুখশ্রীতে খোঁচাখোঁচা চাপ দাঁড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা৷ গায়ে সাদা শার্ট জড়ানো। স্বাক্ষরকে শুভ্র রঙেই যেন বেশি মানায়। বুকের ভেতর অনুভূতি উথাল-পাতাল ঝড়ে ক্রমশ কাবু করছে তন্দ্রার ছোট্টো হৃদয়। ঘোর জড়ানো দৃষ্টিতে স্বাক্ষরের ছবির তাকাল সে। লাল আভা ছড়ানো কপোলদ্বয়ে হাত রেখে মনে মনে বলল‚
“এত্ত কিউট কেন তুমি? এই কালো ফ্রেমের চশমাতে তোমাকে দারুণ মানায়। আচ্ছা তোমার আমার যদি প্রণয়ে পরিণয় হয় তাহলে আমি তোমাকে কোথায় লুকিয়ে রাখব? যদি কারো নজর লেগে যায়। আমি তোমাকে নিয়ম করে নজর ফোটা লাগিয়ে দেব কেমন?”
কথা গুলো ভাবতেই আনমনে হেসে উঠল তন্দ্রা। গোলাপের পাপড়ির ন্যায় উষ্ণ অধরে লেপ্টে রইল সলজ্জ হাসি। স্বাক্ষরকে নিয়ে ভাবতে তার ভালোই লাগে। কেমন একটা লজ্জা লজ্জা অনুভূতি ঘিরে রাখে তাকে। দু’হাতে মুখ লুকাল তন্দ্রা। স্বাক্ষরের পাশের ঘরটাই তার। দুই ঘরের বেলকনি পাশাপাশিই। স্বাক্ষরের ঘরের বেলকনিটা তন্দ্রার সব থেকে বেশি পছন্দের। এতো পছন্দ হওয়ার একটাই কারণ‚ তা হলো সেখানে তার প্রিয় ফুলগাছ দুটো আছে। সাথে একটা দোলনাও আছে। দুজন বসে থাকার মতো স্পেস। সকল ভাবনার মাঝেই গিটারে সূর কর্ণগোচর হলো তন্দ্রার। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলে বুঝতে পারল স্বাক্ষরের বেলকনি থেকেই আসছে। তবে কী সে এখন জেগে আছে? সে তো লেট নাইট জেগে থাকা পছন্দ করে না। পারে শুধু জ্ঞান দিতে। গম্ভীর মহারাজ তার উপর ডক্টরও বটে। সব ভাবনাকে সাইডে ফেলে রেখে তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে মুহুর্তটা উপভোগ করল। স্বাক্ষর গানের সূর কর্ণগোচর হতেই শরীরে যেন এক শীতল স্রোত বয়ে গেল।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঘুম ছুয়ে যায় তোমায় ভালোবেসে