শুভ্র মেঘ সরে গিয়ে গগনে কালো আধার নেমে এসেছে। তপ্ত গরমের প্রকৃতি মুহূর্তেই বাতাসে ভরে গেছে। রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ আর ধুলো বালি উড়ছে। এই নির্মল বায়ু তাদের কোথায় নিয়ে থামাবে তা তাদের জানা নেই। তারা শুধু ছুটছে। পরী জানালা দিয়ে তা অনেকক্ষণ যাবত দেখে চলছে। ওর জীবনটাও বোধহয় এরকম গন্তব্যহীন। ভালোবাসার পিছন পিছন সেই থেকে ছুটে আসছে সে। কিন্ত এর গন্তব্য কোথায় তা জানে না পরী। তার এসব ভাবনার মাঝেই আকাশ ভেঙে বারিধারা নেমে এল ধরণীতে। স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তাটা ভিজিয়ে দিতে লাগল। মানুষ গুলো ছুটোছুটি করে একটুখানি আশ্রয়ের জন্য। যাতে তারা এই বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচতে পারে।
জানালার পাশেই দাঁড়ানো পরী। বৃষ্টির ছিটা তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তবুও সরে দাঁড়াচ্ছে না পরী। তার বড্ড ভাল লাগছে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। পরী যদি নিজ ইচ্ছাতে না সরে দাঁড়ায় তাহলে ওকে সরানোর কেউ নেই। শায়ের ব্যতীত এই ঘরে কেউ আসে না। এমনকি নাঈম ও নয়। পরীর মুখে তার অতীত শুনেছিল যেদিন সেদিনই নাঈমের সাথে পরীর শেষ দেখা ছিল। এর পরে ওদের সাথে দেখা হয়নি। নাঈম ই সরে এসেছে। পরীর হাতের পত্র খানা ভিজে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে একটা হাত ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। হতবাক হয় না পরী। শুধু ভেজা নয়ন জোড়া মেলে ধরে শায়েরের পানে। ঠান্ডায় ভেজা ঠোঁট জোড়াও কাপছে ওর। শায়ের দ্রুত গামছা এনে পরীর শরীর মুছে দিতে দিতে বলতে লাগল,’নিজের অযত্ন কেন করছেন পরীজান? এভাবে ভিজলে আপনার শরীর খারাপ করবে। এই সময়ে একটু সাবধানে থাকবেন তো!’

শান্ত চোখে শায়ের কে দেখতে লাগল। একটা মানুষের ঠিক কত রূপ থাকতে পারে তা দেখছেন পরী। সে বলে ওঠে,’সাতাশ নাম্বার চিঠিটা আমি পেয়েছি।’
শায়েরের হাত আপনাআপনি থেমে যায়। ক্ষীণ নজড়ে পরীকে সে দেখতে লাগল। খুব গোপনে সে আর নাঈম মিলে চিঠি গুলো লুকিয়ে রেখেছিল যাতে পরীর হাতে না পড়ে। আজকে অসাবধানতার বসে পরীর হাতে তা পড়েই গেছে। দু মাস যাবত ছাব্বিশটা চিঠি পাঠিয়েছে রুপালি। যা শায়ের আড়াল করে রেখেছিল। আর আজ তাকে জবাব দিতে হবে। পরী শায়েরের বাহু আকড়ে ধরে বলল,’আমাকে কেন মেরে ফেললেন না আপনি? তাহলে তো আমাকে এত কিছু দেখতে হত না। নিজের বাবার বিকৃত রূপ টাও দেখতাম না। কিছু না জেনেই ম*রে যেতাম। খুব ভাল হত তাহলে।’

শায়ের পুনরায় পরীর শরীর গামছা দিয়ে মুছে দিতে লাগল,’আপনি মৃ*ত্যুকে সহজ ভাবলেও মৃ*ত্যু কিন্ত
এত সহজ নয়।’
-‘আমাকে মারা তো সহজ ছিল। তাহলে আমাকে কেন মারতে পারল না কেউ?’

শায়ের মৃদু হাসে,’আপনাকে হত্যা করা ততটা সহজ ছিল না যতটা আপনি ভাবছেন। আপনার বাবা অন্দরে আপনাকে মা*রতে পারত না। কেননা আপনার অনুমান প্রখর ছিল। অন্দরে কোন পুরুষ পা রাখলেই আপনি তা অনায়াসে ধরে ফেলতেন। চার পাঁচ জনের সাথে লড়াই করা আপনার কাছে কিছুই না। তার চেয়ে বড় কথা হল আপনার বাবা চায়নি আপনি সব জানুন। তবে আমি সবসময় পেছন থেকে আপনাকে রক্ষা করে গেছি। সেজন্য আপনাকে মা*রাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

-‘কেন রক্ষা করেছেন আমাকে? আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই আমার।’
-‘কিন্তু আমার আপনার সাথে বেঁচে থাকার ইচ্ছা আছে।’
-‘এতগুলো চিঠি আপনার কাছে এসেছিল অথচ আপনি একটাবার আমাকে জানালেন না?’
-‘আপনার কষ্ট হবে ভেবেই জানাইনি।’
-‘এখন বুঝি আমার খুব ভাল লাগছে? আমি কি সুখে আছি খুব?’
শায়ের জবাব দিল না। আলমারি থেকে শাড়ি এনে পরীর হাতে দিয়ে বলে,’শাড়িটা বদলে ফেলুন নাহলে ঠান্ডা লাগবে আপনার।’
-‘রুপা আপা যে নূরনগর ফিরে এসেছে সেটা তো বলতে পারতেন? আমার আম্মা যে সেখানে ভাল নেই সেটা তো বলতে পারতেন? এতটা স্বার্থপর কেন হলেন?’
এবার বিন্দু বিন্দু রাগ দেখা দিল শায়েরের চোখে। কিন্ত পরীর সামনে সে প্রকাশ করল না। কেননা পরীজানের জন্য শুধু ভালোবাসা আছে। তাই সে বলে,’দুনিয়াটা এমনই,একজনের কাছে ভাল হতে গেলে অন্যজনের কাছে বেঈমান স্বার্থপর হতে হয়। আমি স্বার্থপর হয়েছি। আপনার ভালোর জন্য আমি পুরো পৃথিবীর কাছে স্বার্থপর হতে প্রস্তুত।’

রাগ বেড়ে গেল পরীর। দুহাতে চেপে ধরল শায়েরের পাঞ্জাবির কলার,’আপনার ভালোবাসা আমার কাছে এখন বিষাক্ত ধোঁয়া মনে হচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমি তো একা ভাল থাকতে চাই না। আমি সবার সাথে ভাল থাকতে চাই।’

-‘কিন্তু আমি শুধু আপনার সাথে থাকতে চাই। আপনার আর আমার মাঝে কাউকে চাইনা।’
শায়ের পরীকে জড়িয়ে ধরতে গেলে পরী ধাক্কা দিল শায়ের কে,’ভালোবাসা আপনাকে অন্ধ করে দিয়েছে। পাগল হয়ে গেছেন আপনি।’

-‘পরীজান আপনি শান্ত হন।’

-‘কি শান্ত হব আমি? ওখানে আমার পরিবার বিপদে আছে আর আমি শান্তিতে আপনার সাথে সংসার করব? আপনি ভাবলেন কীভাবে?’
-‘আপনার বাবা ওদের কোন ক্ষতি করবে না। ওদের ক্ষতি করে আপনার বাবার কোন লাভ হবে না।’

-‘আপনি বের হয়ে যান। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।’
পরীকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক ভাবে দেখে বের হয়ে গেল শায়ের। বের হতেই নাঈমদের মুখোমুখি হয় সে। নাঈম এতক্ষণ সবই শুনছিল। সে শায়ের কে বলে, ‘চিন্তা করবেন না সব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।’

বিপরীতে কথা বলে না শায়ের। নাঈম আবার বলে, ‘পরীর মতো আমারও একটা প্রশ্ন? পরীর বাবা তো ক্ষমতাশীল। এক্ষেত্রে পরীকে হ*ত্যা করা আমার মতে সহজ ছিল। আপনি পরীকে সবসময় রক্ষা করেছেন। কিন্ত বিয়ের আগে??’

নাঈম সম্পূর্ণ কথাটা বলার আগেই বুঝে গেল শায়ের। সে বলে উঠল,’আমার পরীজান সে। তার গায়ে কোন আঘাত পেতে আমি এত সহজে দেব? আপনি হয়ত জানেন পরীজানের ব্যাপারে। তবে জমিদারের পূর্ব পুরুষদের নিয়ম ছিল অন্দরে যেন কোনরকম রক্তারক্তি না হয়। কিন্ত পরীর বাবা সেই নিয়ম ভঙ্গ করে নিজ মেয়েকে হ*ত্যা করতে লোক পাঠায়। কিন্ত তার জানা ছিল না যে পরীজান আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত নয়। লড়াই করার সাহস আর শক্তি দুটোই আছে। প্রতিটা পদে পদে আড়ালে আমি পরীজানের ঢাল হয়ে ছিলাম। আর এখন প্রকাশ্যে ঢাল হয়ে দাঁড়াব।’

-‘ভাগ্যের জোরে এতদিন পরীকে বাঁচিয়েছেন আপনি। আর কতদিন বাঁচাতে পারবেন জানি না। তবে আমি আপনার আর পরীর সাথে আছি।’

-‘আমাদের সাথে থেকে নিজেকে জীবন বিপদে ফেলবেন না। আপনি যতটুকু করেছেন ততটুকুই যথেষ্ট।’

-‘তাহলে আপনি এখন কি করবেন? নূরনগরের যাবেন কি?’
-‘নাহ।’
-‘দেখুন রুপালি অনেকবার করে বলেছে আপনি যেন একটাবার সেখানে যান। নিজের জন্য ডাকেনি সে। তার ছেলে পিকুলের ভাল একটা ভবিষ্যতের জন্য ডেকেছে। জমিদারের অত্যাচার ওনারা সবাই সহ্য করতে পারবেন কিন্ত ছোট ছেলেটার তো ভবিষ্যত আছে নাকি?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়ের,’আমার সন্তান পৃথিবীর আলো না দেখা পর্যন্ত আমি এক চুল ও নড়ব না। আমার কাছে সবার আগে আমার পরীজান।’

সকালে হতেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে শায়ের। গত কাল রাতে সে নাঈমের সাথে ঘুমিয়েছে। পরী বারণ করেছে বিধায় আর ওর ঘরে যায়নি। তবে সকাল হতেই পরীর ঘরে উঁকি দিতে ভোলে না সে। আশ্চর্যের ব্যাপার যে পরী ঘরে নেই। ভয়ে শায়ের কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে দ্রুত নাঈম কে ডেকে তুলল। দুজন মিলে রাস্তায় বেরিয়ে গেল তখনই। অলি গলি
খুঁজতে থাকে ওরা। পরী কখন বের হয়েছে কতক্ষণ ধরে বের হয়েছে তা অজানা। শায়ের এদিক ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে পাগল প্রায়। লোকজনের ভিড় ঠেলে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আর একেকজন কে জিজ্ঞেস করছে পরীর ব্যাপারে। নাঈম অন্যদিকে খুঁজছে।
তবে বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না পরীকে। রাস্তার একপাশে বেঞ্চিতে বসে আছে পরী। কোন টাকা পয়সার নেই ওর কাছে। তাই এখান থেকে বেশি দূর
যেতে পারেনি। তাছাড়া পরীর পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ক্লান্ত দেহটা আর টেনে নিতে পারল না। ধপ করে বেঞ্চের উপর বসে পড়ল। তার কিছুক্ষণ বাদেই শায়ের হাঁপাতে হাঁপাতে চলে এল সেখানে। অবাক হল না পরী। সে জানত এম কিছুই হবে। শায়েরের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল সে। শায়ের পরীর পাশে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল। অনেক দৌড়েছে সে। পরীর পাশে বসে সে বলে ওঠে,’চলুন।’
বলেই পরীর হাত ধরে শায়ের। কিন্ত পরী হাত টা ছাড়িয়ে নেয়। বলে,’আমার বড় বোন মারা যাওয়ার অনেক গুলো বছর পর জানতে পারি তাকে হ*ত্যা করা হয়েছিল। তারপর আমার বিন্দু খু*ন হল। সাথে সম্পান মাঝিও। কিন্ত তাদের কারো বিচার হল না। আমার রুপা আপার জীবনটাও যাতাকলে পড়ে গেছে। আর আম্মা!! ওদের সবার শান্তির নীড় একমাত্র আমি। আর আমার শান্তি আপনি। আপনি কেন বুঝতেছেন না তাহলে? আমি কেন একটু শান্তি চাই!!’
-‘কেমন শান্তি চান আপনি? আপনার শত্রুদের হত্যা করে শান্তি পেতে চান? কিন্ত এখন তা সম্ভব নয়। পরীজান আমাদের সন্তানের কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে। আপনি মা হবেন আর আমি বাবা। এই সুখের জন্য আপনি কম চোখের জল ফেলেন নি। আপনার কথা আল্লাহ শুনেছেন। এই সুখকে ফিরিয়ে দেবেন না পরীজান ফিরে চলুন আমার সাথে।’

এই পুরুষটির সামনে নিজের কঠোরতা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না পরী। অশ্রুজলে ভাসে কপোলদ্বয়। যে পুরুষ ঠকায় তাদের চোখে অদ্ভুত মায়া আছে যা নারীরা সহজে কাটাতে পারে না। শায়েরের চোখে ঠিক তেমনি মায়া আছে যা পরীর কঠোরতা ভাঙার জন্য যথেষ্ট। কিন্ত শায়ের তো ঠকানোর পরেও পরীকে সমানতালে ভালোবেসেছে।
আজকে দ্বিতীয়বারের মতো ওর অনাগত সন্তানের কাছে হেরে গেছে পরী।
তাই তো সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সে শায়েরের সব কথা মেনে নিয়েছে। সব কিছু মেনে সে নাঈমের বাসায় থেকেছে। মনের সব কষ্ট চেপে সে হাসিমুখে জন্ম দিল এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের। অবিকল মায়ের মতোই হয়েছে সে। শায়েরের ইচ্ছা অনুযায়ী সন্তান তুলে দিল ওর হাতে। পুত্রের কানে আযান দিল শায়ের। খুশিতে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল তার। পদ্ম পাতার জলের ন্যায় ক্ষণস্থায়ী হলো সে খুশি। শোভনের বয়স চার মাস হওয়ার পরই বুয়ার কাছে শোভন কে রেখে পরী আবারও হারিয়ে গেল অজানায়। বুয়ার কাছে একটা চিঠি দিয়ে গেল। সে যেন চিঠিটা শায়ের কে দেয়।

বহুদিন পর নূরনগরে পা রাখে পরী। কিন্ত এখনও আগের মতোই আছে গ্রামটা। কিছুই পরিবর্তন হয়নি। পথে রাস্তার ধারের কদম গাছের দিকে তাকাল সে। সুখান এখনও সেখানেই বসে আছে। সোনালীর কবরের দিকে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে পরী সামনের দিকে এগোয়। প্রতিটা পদে পদে পরীর অতীত মনে পড়ছে। পশ্চিম জঙ্গলের দিকে তাকাতেই সেই লৌহমর্ষক ঘটনার কথা মনে পড়ল। বিন্দুকে পরী কোনদিন ভুলবে না। সম্পান মাঝি খারাপ ছিল কিন্ত সেও ভালোবেসেছিল বিন্দুকে। ভালোবাসা খারাপ মানুষকেও ভাল পথে নিয়ে আসে। কিন্ত মালা?? মালা ব্যর্থ হয়েছে নিজ ভালোবাসায় স্বামীকে আটকাতে।
পরী ভাবছে আর হাটছে। না জানি কোন অবস্থাতে বাড়ির সবাই রয়েছে? পথে যেতে যেতে অনেক পরিচিত মুখ ভেসে আসে। সম্পানের মা রাঁখি কেও দেখল। কেমন পাগলের মত চেহারা খানা হয়েছে তার। ক্ষেতের ভেতর থেকে শাকপাতা তুলছে সে। ইন্দু কেও দেখল মহেশের হাত ধরে বাজার থেকে ফিরছে। লখা পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলা করছিল।বাবা আর দিদিকে দেখে সেও ছুটল। পরী ভাবল সবাই কি পেছনের কথা ভুলে গেছে? মনে থাকলে এত হাসিখুশি সবাই থাকতে পারত কি? কিন্ত পরী তো কিছু ভুলতে পারছে না! ভাবতে ভাবতে পরী পৌঁছে যায় জমিদার বাড়ির সামনে। ভেতরে ঢুকতে বুক কাঁপে না পরীর। একটুও মৃত্যুর ভয় সে না করে বিনা বাক্যে প্রবেশ করে সে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।