অন্ধকার কুঠুরির সামনে মেঝেতে বসে আছে মুসকান। তার দৃষ্টি শেকলে বন্দি পুরুষটির দিকে। ধুলো বালি ওর গায়ে মাখছে তবুও তার হুস নেই। সে শায়েরের দিকে বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে। শায়েরের মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না আদৌ সে সব বলবে কি না? মুসকান নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি পরীকে খুব ভালোবাসেন তাই না? সেই ভালোবাসার সাথে কি এমন হয়েছিল? আপনি কি খু*ন গুলো সত্যিই করেছেন?’
-‘একটা আওয়াজ,যা আমার কানে সবসময় বাজে। একটা চেহারা যা আমার চোখে সবসময় ভাসে। একটা সময় ছিল যখন সেই মানুষ টা আমার খুব কাছে ছিল। এখনও আছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই তাকে দেখতে পাই।’
-‘দয়া করে বলুন না অতীতের সেই ঘটনা? আমি আপনাদের ভালোবাসার স্বাক্ষী হিসেবে থাকতে চাই।’
-‘আমি আপনাকে বলব সব। কিন্ত একটা কথা আপনাকে দিতে হবে। কাউকে কোনদিন সত্যিটা বলতে পারবেন না আপনি।’
-‘কথা দিলাম আমি কাউকে কিছু বলব না। আপনি বলুন।’
শায়ের দৃষ্টি মেলে সামনের রঙ ওঠা কালচে দেয়ালের দিকে। কত যত্নহীনে এই দেয়াল টা এরকম হয়েছে তা বেশ বুঝেছে সে। তার অতীতের মতো এই দেয়ালের অতীত ও যে ভাল কাটেনি। সে তার রঙহীন অতীতে ডুব দিল,
বৈঠকে হন্তদন্ত হয়ে আসল সিরাজ। আফতাবের জরুরি তলবে তার আসতে হলো। জমিদার বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ মনে করে না সে। এখানে থাকলে নওশাদের মতো সেও গায়েব হয়ে যেতে পারে। কেননা এখন পর্যন্ত তার কোন খবর পাওয়া যায়নি নওশাদের। প্রথমত সবাই ভেবেছিল পরীর ভয়ে সে জমিদার বাড়ি ত্যাগ করেছে। কিন্ত যখন সবাই জানতে পারে যে নওশাদ নিজ বাড়িতেও যায়নি তখন সবার সন্দেহ বাড়ে। কাজটা কি পরী করেছে? তার যথাযথ কোন প্রমাণ পায়নি কেউই। শায়ের যেহেতু রাতে পরীর সাথেই ছিল সেহেতু পরীর দিকে আঙুল তোলা অসম্ভব। শায়ের বাদেই ওরা গুরুত্বপূর্ণ সভা বসিয়েছে। শায়ের কে কিভাবে হ*ত্যা করা যায় সেই পরিকল্পনার করছে সবাই। সিরাজ গম্ভীর গলায় আফতাব কে বলে,’এই মুহূর্তে শায়ের কে মা*রা কি ঠিক হবে? আমাদের মুখোশ খোলার হা*তিয়ার কিন্ত একমাত্র শায়েরের কাছে আছে। ও ম*রে গেলেও কিন্ত আমাদের জেলে যেতে হবে! সেই ব্যবস্থা কিন্ত শায়ের করেই রেখেছে।’
আফতাব জবাব দিলো না বিধায় আখির বলে উঠল, ‘পরের টা পরে দেখা যাবে। শায়ের বেঁচে থাকলে আমরা পরীর হাতে ম*র*ব। ভাই কথা বলেন আপনি।’
-‘তা ঠিক। পরী এখন হিং*স্র হয়ে উঠেছে। যাকে সামনে পাবে তাকেই থাবা মা*রবে।’
সিরাজ বলে উঠল,’আর রুপালি?’
-‘রুপালি আবার কি? সে পরীর মতো আমাদের মা*রতে আসবে না। মায়েদের সাথে ও বেঁচে থাকুক। কিন্ত যেদিন দেখব রুপালিও পরীর মতো সেদিন সেও শেষ হবে। ওরা মেয়ে হয়ে যদি বাপকে মা*রতে চায় তাহলে আমিও ওদের অস্তিত্ব রাখব না।’
-‘জুম্মানকে কি করবেন ভাই?’
-‘ও থাকুক বাগান বাড়িতে। যেদিন ও পুরোপুরি সব কাজ শিখে যাবে তখন নাহয় আসবে।’
-‘তাহলে আজকে শায়ের কে বাগান বাড়িতে নিয়ে যাই? তারপর নাহয় মে*রে ফেললাম।’
-‘সিরাজ,তুমি শায়ের কে নিয়ে আজ রাতেই বাগান বাড়িতে যাবে। তারপর আমরা যাব।’
সভা ওখানেই শেষ হলো। তবে শায়ের জানতেই পারল না যে ওর বিরুদ্ধে কত বড় ষ*ড়*য*ন্ত্র করা হয়েছে। তবে সব কথা শেফালির কানে চলে গেছে।
পরীর আদেশে শেফালি সর্বদা বৈঠকে নজর রাখে। তাই সে খবরটা পরীকে জানিয়ে দিল। খা*রা*প স্বামীকে বাঁচানোর জন্য পরী মরিয়া হয়ে উঠল। শেফালি তা বুঝতে পেরে বলল,’আপনি শায়ের ভাইরে অনেক ভালোবাসেন তাই না আপা? হেয় খা*রাপ কাম করলেও কিন্ত আপনেরে অনেক ভালোবাসে। হের লাইগাই আপনের এতো টান।’
-‘খু*ন করে সে পাপ করেছে শেফালি কিন্ত এই পাপের ক্ষমা আল্লাহ করবেন যদি সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। আল্লাহ বলেছেন তুমি যদি বিচার করো তাহলে আল্লাহ তার বিচার করবে না। এজন্য আমি তাকে শা*স্তি দেব না। আমি চাই তার বিচার আল্লাহ করুক। আমি শুধু তাকে ভালোবাসব। সেই ভালোবাসায় সে নিজেকে সুধরাবে।’
চলে যাওয়ার আগে পরী আবারও পেছন ফিরে বলে,’আজকেও তোকে সব কাজ করতে হবে। পারবি তো?’
শেফালি মাথা নাড়ল। সে বুঝলো আজকে ভ*য়ানক কিছু হতে চলেছে। পরী শায়ের কে বাঁচানোর জন্য কিছু একটা তো করবেই। কিন্ত তারপর পরীর কি হবে তা ভেবে ভয়ে আছে শেফালি।
পরী রুপালি ঘরে গেল। পিকুল কে নিয়ে বসে আছে সে। কালবিলম্ব না করেই পরী বলে,’সিরাজ কে মা*রবে না আপা? আজকে সে সময় এসে গেছে।’
রুপালির চেহারায় ভয় দেখতে পেল পরী। নওশাদ কে মা*রা*র সময় ভয় পেয়েছিল। এখনও সেই ভয়ের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। পরী রুপালির মনে রাগ জন্মানোর জন্য বলে,’এতো সহজে তাকে ছেড়ে দেবে? যে তোমাকে মিথ্যা ভালোবাসার জালে আটকিয়েছিল! যে তোমাকে শশীলের হাতে তুলে দিয়েছিল। ভাবতে পারো সেদিন আমি না থাকলে তোমার কি হতো? কবিরকে তো আমি শেষ করেই দিয়েছি। এখন সিরাজ কে তুমি ছেড়ে দিবে?’
রুপালির মনে পড়ে গেল জঘন্য অতীতের কথা। পরী না থাকলে সেদিন শশীল তার ই*জ্জ*ত হরন করতো। বেঁচে থাকতে পারত না সে। আর সিরাজ ওকে ধোঁকা দিয়েছে একথা মাথায় আসতেই রাগে জ্বলে ওঠে সে। র*ক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকে সারা শরীরে। এতো কিছুর পর সিরাজ কে ছাড়া যাবে না। কিছুতেই না। পরীর দিকে তাকিয়ে সে ইশারা করল। পরী মুচকি হেসে চলে গেল।
সূর্য ডুবতেই সকল দিক থেকে সবাই তৈরি হতে লাগল। ওদিকে আফতাব আখির আর সিরাজ পরিকল্পনা করছে আর এইদিকে পরী। পরী শায়ের কে তলব করে এবং শায়ের সাথে সাথেই চলে আসে।
তবে এবার পরী শায়ের কে সোনালীর ঘরে নিয়ে যায়। শায়ের পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। পরী কাঠের চেয়ার টেনে শায়ের কে বসতে দিলো। বসলো শায়ের।
-‘এই ঘরেই নওশাদ কে মেরেছি আমি!’
অবাক হলো না শায়ের,’আপনি নওশাদ কে মেরেছেন এটা আমি সেই রাতেই টের পেয়েছি।’
-‘কিভাবে টের পেলেন? আমি তো সাবধানে ঠান্ডা মাথায় ওকে মারলাম?’
-‘র*ক্তে*র গন্ধের সাথে যে আমি পরিচিত পরীজান।
তাছাড়া সকালে শেফালি আর কুসুম কে উঠোন লেপতে দেখেই আমার সন্দেহ সত্যি হয়। ওরা রক্তের দাগ ঢাকতেই এটা করেছে। আপনি আমার চোখে কিছুই ফাঁকি দিতে পারবেন না।’
পরী হেসে শায়েরের দিকে এগিয়ে গেল। হাতে একটা দড়ি নিয়ে শায়েরের হাত চেয়ারের সাথে বাঁধতে বাঁধতে বলতে লাগল,’প্রথমে এইভাবেই নওশাদ কে চেয়ারের সাথে বেঁধেছিলাম। তারপর ওর মুখের ভেতর গামছা ঢুকিয়ে ছিলাম যাতে ও শব্দ না করতে পারে। তারপর ওর দুটো আঙুল কে*টে*ছিলাম।’
-‘তারপর কি করলেন?’
পরী এবার শায়েরের পা দুটো বাঁধতে লাগল,’তারপর
ওর বুকে ছু*রি চালিয়ে ছিলাম তারপর উঠোনের কোণে জীবিত পুঁতে দিয়েছি। আর তারপর আপনাকে অন্দরে ডেকেছি।’
-‘আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। তা এখন আমাকেও সেভাবে মারবেন নাকি?’
শায়েরের কথা শুনে হাসল পরী। গামছা টা হাতে নিয়ে বলল,’নাহ,আপনি এখানে চুপটি করে বসে থাকবেন আর আমি বাগান বাড়িতে গিয়ে সিরাজ কে মে*রে চলে আসব।’
কথাটা শোনা মাত্রই শায়েরের চেহারার ভাবভঙ্গি বদলে গেল। সে বিনয়ের স্বরে বলে,’ওখানে যাবেন না পরীজান। আপনার বিপদ হবে। আমার হাত খুলে দিন। দয়া করে যাবেন না।’
পরী শায়ের কে আর কথা বলতে দিলো না। গামছা দিয়ে ওর মুখ বেঁধে দিলো। মাথা নেড়ে শায়ের পরীকে যেতে নিষেধ করে বারবার কিন্ত পরী সেসবে পাত্তা না দিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে চলে যায়। শায়ের ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্ত কোন লাভ হচ্ছে না। শক্ত করেই বেঁধেছে পরী। মুখ বাঁধা থাকায় কাউকে ডাকতেও পারছে না। নিজ কক্ষে গিয়ে পূর্বের ন্যায় পোশাক পড়ে নিল পরী। মুখটাও কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল। রুপালিও পরীর মতো পোশাকে নিজেকে তৈরি করেছে। পরী কুসুমের হাতে ওর ত*লো*য়া*র দিয়ে অন্দরে ঢোকার দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। যদি কেউ জবরদস্তি করে ভেতরে আসতে চায় তাকে যেন আঘাত করে। কুসুম জানে সে এটা করতে পারবে না তবুও সাহস করে দাঁড়িয়ে রইল। রিতিমত কাঁপতে লাগল সে।
রুপালি আর পরী ছাদে চলে গেল। আম গাছ বেয়ে দুজনেই মাটিতে নামল। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল বাগান বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাগান বাড়িতে চারজন রক্ষি আছে শুধু। আর সবগুলো জমিদার বাড়ি পাহারা দেয়। কারণটা অবশ্য পরী। কখন কি হয়ে যায় সেজন্য আফতাব এতো পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
অন্ধকারের পথ ধরে জমিদার বাড়ির দিকে আসছে সিরাজ। পথে হুট করেই শেফালি এসে দাঁড়াল। সিরাজ চমকে গেল শেফালিকে দেখে। সে বলে উঠল,’তুই এতো রাতে এখানে কি করস?’
-‘একখান কথার আপনেরে কইতে আইছি। নওশাদ রে পরী আপার খু*ন করছে। আমি নিজের চোখে দেখছি।’
-‘একথা আগে বললি না কেন? আর এখানে এসেছিস কেন তুই?’
-‘পরী আপার ডরে কই নাই। বড় কর্তা আপনারে বাগান বাড়ি যাইতে কইছে। শায়ের ভাইরে নিয়া হেরা বাগান বাড়িতে চইলা গেছে। তাই আমারে পাঠাইছে আপনেরে খবর দিতে। আপনে অহনই যান।’
সিরাজ কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে শেফালির দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল,’আমি জানি না আপনেরে ক্যান যাইতে কইছে। আমি গেলাম।’
দ্রুতপদে শেফালি প্রস্থান করল। সিরাজ ওখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল ওর আসতে দেরি বিধায় হয়তো শায়ের কে নিয়ে ওনারা চলে গেছে। তাই সিরাজ বাগান বাড়ির পথ ধরে। কিন্ত আফতাব আর আখির যে এখনও সিরাজের অপেক্ষা করছে তা সিরাজ জানতেই পারল না। বাগান বাড়ির বাইরে দুজন পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় দূরের ঝোপের ভেতর থেকে শব্দ ভেসে আসে। কিন্ত হচ্ছে তা দেখার জন্য একজন সেখানে যায়। সাথে সাথেই তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল পরী আর রুপালি। মাথায় আঘাত করে জ্ঞানহীন করে দেয়। এবং দাড়ি দিয়ে বেঁধে দেয়। দ্বিতীয় জন প্রথম জনের খোঁজে যেতে তাকেও একই অবস্থা করে ফেলে রাখে। তারপর দুজনে একসাথে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। পরী সাবধানে পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেই ঘরটাতে যায় যেখানে পরীকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্ত সেখানে গিয়ে পরী অবাক হয়। কেননা সেখানে জুম্মান বসা। মাথা নিচু করে জুম্মান বসে আছে। একজন রক্ষি ওকে খাবার খাওয়ার জন্য বলছে কিন্ত সে খাচ্ছে না। কাঁদছে আর বলছে সে মায়ের কাছে যাবে। বছর তেরোর ছেলেটা আর কি বুঝবে? পরী আর রাগ ধরে রাখতেই পারে না হনহন করে ভেতরে ঢুকে পড়ল। পরীকে দেখে চমকে গেল লোকটা তবে চিনতে পারে না। তবে জুম্মান ঠিকই চিনে ফেলে পরীকে। সে বলে উঠল,’পরী আপা! আমারে এইহান থাইকা নিয়া যাও। আমি থাকমু না।’
লাঠি নিয়ে তেড়ে এলো লোকটা পরীর নাম শুনে। কিন্ত পরী কায়দা করে তার লাঠি কেড়ে নিল এবং তাকেই আঘাত করে বসে। কিন্ত পরমুহূর্তে পেছন থেকে কেউ পরীকে লাঠি দ্বারা আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তাকিয়ে দেখে রক্ষি এসে পড়েছে। সে আবার পরীকে মারতে যাওয়ার আগেই তার রক্ত ছিটকে এসে পরীর মুখে পড়ে। কারণ রুপালি তাকে আঘাত করে বসেছে। বড় একটা ছুরি লোকটার পিঠে গেঁথে দিয়েছে। লোকটা সাথেই মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে। অন্যজন ভয়ে গুটিয়ে যায়। বুদ্ধি করে ওরা চারজন কে কাবু করে ফেলেছে। এখন শুধু সিরাজের আসার পালা।