স্টিলের গ্লাসটা সশব্দে পড়ে গেল হাত থেকে। নড়েচড়ে ভিত চোখে তাকালো শেফালির পানে। তারপর পড়ে যাওয়া গ্লাসের দিকে তাকালো। তখনই একটা বিড়াল মিঁয়াও বলে সামনে দিয়ে দৌড় দিলো। ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠল নওশাদের। সে খেয়াল করলো তার গলা শুকিয়ে এসেছে আর ঘামছে। শেফালি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত সবাই তার দিকে তাকিয়ে। আফতাব বললেন,’শরবতে বিষ!! কে বলল তোকে?’

শেফালি কাচুমাচু করে সামনে এসে দাঁড়াল,’বড় কর্তা আমি কুসুম রে দেখছি বিষ মিশাইতে।’

-‘দেখছেন ভাই আপনার মেয়ে এখনই আমাদের মা*রার পরিকল্পনা সেরে ফেলছে। শেফালি না বললে তো আমরা শরবত খেয়েই ম*রে যেতাম।’

আখির কথাটা আফতাব কে উদ্দেশ্য করে বলে। এতে চুপ থাকে আফতাব। কিছুক্ষণ ভেবে বলে,’সত্যি তো শরবতে বিষ মেশানো আছে?’

শেফালি চটপচ উত্তর দিলো,’হ,আমি নিজের চোক্ষে দেখছি। পরী আপার কথায় তো কুসুম এই কাম করছে। আপার যেই রাগ। কথা না হুনলে আমাগো মা*ইরা ফালাইতে পারে। কি করমু কন?’

-‘তুই এখন যা।’
-‘বড় কর্তা আমি আপনাগো কইছি আপা যেন না জানে। তাইলে আমারে জানে মাইরা ফালাইব।’

-‘আচ্ছা বলব না। তুই যা,আর পরী যা করে সব এসে আমাদের বলবি।’

শেফালি মাথা নেড়ে চলে গেল। আফতাবের মুখ গম্ভীর। সে একজন রক্ষিকে দিয়ে শায়েরের কাছে খবর পাঠালো।

-‘ভাই তাড়াতাড়ি পরীর একটা ব্যবস্থা না করলে হবে না।’

-‘ভুলটা আমারই হয়েছে। সেদিন সোনালীকে না মা*রলে এসব হতো না। পরীও এত ভয়ানক হয়ে উঠতো না।’

-‘কিন্ত ভাই সোনালী তো আপনাকেও মারতে চাইতো।
তাহলে আজ পরী আর সোনালী এক হয়ে আমাদের আ*ক্র*ম*ণ করতো।’

আফতাবের মাথা কাজ করছে না। সত্য লুকানো খুবই কঠিন। দশ হাত মাটির নিচেও যদি সত্য কে লুকিয়ে রাখা হয় একদিন না একদিন সবার সামনে আসবেই। সে চেয়েছিল নিজের সব অপকর্ম লুকিয়ে রাখতে। কিন্ত লুকাতে পারে না। সর্বপ্রথম জানতে পারে মালা। তখন সোনালী দুই বছরের শিশু। স্বামীর অপকর্মের কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়েন তিনি। অনুরোধ করে আফতাব যেন এই অপকর্ম থেকে ফিরে আসে। কিন্ত খারাপ মানুষের ভালো হওয়া কি সহজ? যেখানে আফতাবের পূর্ব পুরুষদের রক্তে মিশে আছে খা*রাপ কাজ। আফতাব ও পারেনি ফিরে আসতে। তাকে কালো ব্যবসা শিখিয়েছিলেন তার দাদা। ছোট থেকেই হাতে ধরে ধরে সব শেখাতেন। ছোট বয়সেই নর্তকিদের সামনে হাজির করাতো। তখন থেকেই লালসা আফতাবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। তবে পরিবার পরিচালনার জন্য বিয়ে করতে হয় তাকে। মালার সৌন্দর্য দেখেই আফতাব মুগ্ধ হয়েছিল। তারপর বিয়ে। ভালোই কাটছিল সব, কিন্ত যখন মালা সব জেনে গেল তখনই আফতাবের অবহেলা দেখতে পেল মালা। একে একে মুখোশ উন্মোচন হলো সবার। তখন মালার পাশে দাঁড়িয়েছিল আবেরজান। তিনি মালাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
কিন্ত কেউই প্রতিবাদ করেনি। বহুবছর পর সোনালী বাবার করা অ*ন্যায়ের প্রতিবাদ করে। বাবা হলেও সে অ*প*রা*ধী। শাস্তি তার প্রাপ্য। তবুও সে বাবাকে বারণ করে। ফিরে আসতে বলে এসব অপকর্ম থেকে।
আফতাবের কোন হেলদোল নেই। তবুও সোনালী চুপ ছিল। কিন্ত আফতাব যখন রাখালের সাথে তার সম্পর্ক জানতে পেরে রাখালের দিকে হাত বাড়ায়। তখন সোনালী হুমকি দেয় আফতাব কে,যে সে সব সত্য সবাইকে বলে দেবে। মূলত সোনালী রাখালের সাথে আগে পুলিশের কাছে যেতে চেয়েছিল তারপর ওরা পালিয়ে যেতো। কিন্ত বিপত্তি ঘটে যায় পথেই।

এখন আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছে পরী। কিন্ত পরী সোনালীর থেকেও ভয়ানক। র*ক্ত যেন ওর নেশা। শায়ের আসতেই সবার দৃষ্টি সেদিকে গেল। আফতাব বললেন,’তোমার কথা রাখা কঠিন শায়ের। পরী আজ আমাদের মারতে চেয়েছিল। এখন তুমিই বলো কি করবে?’

শক্ত কন্ঠে শায়ের জবাব দিলো,’আমার পরীজানের কিছু করতে আপনারা পারবেন না। যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে।’

-‘তাহলে আমরা মরব নাকি?’
-‘আল্লাহ যেভাবে যার মৃ*ত্যু লিখেছেন তার মৃ*ত্যু সেভাবেই হবে। এতে ঘাবড়ানোর কি আছে? নিজেদের রক্ষা করতে শিখুন।’

-‘তোমার যুক্তি তোমার কাছেই রাখ শায়ের। আমরা আর বসে থাকব না। দেখি পরীকে তুমি কীভাবে বাঁচাও?’
আফতাব উঠে চলে গেল। শায়ের কিছু না বলে বৈঠকে নিজের বরাদ্দ ঘরটাতে চলে গেল। তার একটুও ভাল লাগছে না। কাল সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। পরীকে ছাড়া এই প্রথম রাত তার। শ্বাস রুদ্ধকর লাগছে ওর। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। সকাল থেকে তাই শায়ের চুপচাপ ছিল। বুকের তৃষ্ণা বাড়ছে,পরীকে একবার সে চোখভরে দেখতে চায়। খোদা যেন ওর কথা শুনেছে। শেফালি এসে বলে গেছে পরী তাকে অন্দরে যেতে বলেছে।
দেরি করে না শায়ের। বহুক্ষণের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যায় অন্দরে। পরীর ঘরে গিয়ে হাপাতে লাগলো সে। শায়ের কে দেখে পরী পালঙ্ক থেকে নেমে পড়ল। সম্মুখীন হলো স্বামীর। এক রাতেই কেমন শুকিয়ে গেছে শায়ের। পরী এটা হঠাৎই আবিষ্কার করে। আলতো করে গালে হাত বুলায় শায়েরের। চোখের পলক ফেলে না শায়ের। পরী বলল,’আমার খুব ঘুম পাচ্ছে মালি সাহেব আপনার বুকে একটু জায়গা দিবেন? কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি।’

করুন কন্ঠ পরীর। শায়ের আরও কাছে এগিয়ে আসে পরীর,’আপনি চোখ বন্ধ রাখবেন পরীজান? আপনাকে মন ভরে দেখব। কেন জানি আপনার চোখের দিকে তাকালে নিজেকে আরো বড় অ*পরাধী মনে হয়।’

তাই করে পরী। আর শায়ের তার পরীজান কে চোখ ভরে দেখে। তার এ দেখার শেষ নেই। চক্ষু মুদন করার ইচ্ছা নেই শায়েরের। পরীর কপালে গাঢ় চুম্বন করে সে। পরী চোখ মেলে তাকায়,’আপনি কেন এতো নিষ্ঠুর হলেন? কেন এতো পাপ করলেন? কি দরকার ছিলো? একটু ভালো হলে কি হতো? যুদ্ধ তো হতো না!! র*ক্তা*র*ক্তি ও হতো না। তাহলে আপনি এমন হলেন কেন? আর যদি খারাপই হতেন তাহলে আমাকে কেন এতো ভালোবাসলেন?’

-‘আমি কি আপনাকে কলঙ্কিত করলাম পরীজান?’

কথা বলে না পরী। শায়ের আবার বলে,’আপনি চাঁদ আর আমি কলঙ্ক। কলঙ্ক ছাড়া চাঁদ যেমন অসুন্দর তেমনি আমি ছাড়া আপনিও বেমানান। সেহরান নামক কলঙ্ক পরীজানের গায়ে আজীবন থাকবে।’

শায়েরের বুকে মাথা রাখে পরী। কালবিলম্ব না করে শক্ত করে পরীকে জড়িয়ে ধরে সে। বলে,’আপনার আমার ভালোবাসা হয়তো কোন ইতিহাস গড়বে না পরীজান। পৃথিবীর কেউ জানবে না আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি। তবে এই ভালোবাসা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারবেন না।’

-‘আমি কেন আপনাকে চেয়েও শাস্তি দিতে পারছি না? কেন বারবার আপনার কাছে আসতে ইচ্ছা করে?’

এর জবাব শায়ের ও জানে না। সে গভীর আলিঙ্গনে ব্যস্ত তার পরীজান কে। সারা রাত্রি দুজনেই বিনা নিদ্রায় পার করেছে। এখন কাছাকাছি হয়ে দুজনেই একটুখানি শান্তির নিদ্রায় যেতে চায়। তাই শায়ের পরীকে নিজ বক্ষে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

রুপালি রন্ধনশালায় গিয়ে দেখল মালা খাবার বাড়ছে জেসমিনের জন্য। আজ কতদিন হলো সে বিছানায় পড়ে আছে। নড়াচড়া করতে পারে না। পুরো শরীর প্রচন্ড ব্যথা। একটু নড়লেই ব্যথায় কাতরায়। এই কষ্ট দেখতে পারে না রুপালি তাই জেসমিনের ঘরে সে যায় না। মালা খাবার নিয়ে চলে যেতেই রুপালি কুসুম কে বলে,’আজকের কাজটা ঠিকমতো করেছিস কুসুম?’

-‘হ আপা। পরী আপা যা কইছে তাই করছি।’

-‘ঠিক আছে। অন্দর থেকে তুই বের হবি না। শেফালি কোথায়?’
-‘পরের কাম করতে গেছে।’
-‘আমার মনে হয় ওরা শেফালিকে বিশ্বাস করেছে। তবে এই বিশ্বাস আরো জোরালো করতে হবে। পরী কি নিজের ঘরে?’

কুসুম মাথা নাড়ে। রুপালি পরীর ঘরে যায় কিন্ত ওদের দুজনকে একসাথে ঘুমাতে থেকে বের হয়ে আসে। মনে মনে হাসে রুপালি। পরী শায়ের কে অনেক বেশি ভালোবাসে। কিন্ত ওর জীবনটা ভিন্ন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। সিরাজ ওর সাথে বেঈমানি করেছে। তা সে মালার কাছ থেকেই জেনেছে। সব জানার পর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে মনটা। তবে রুপালি নিজেকে সামলে নিয়েছে। পরীকে দেখে শক্ত হতে শিখেছে সে।
অনেক ধোঁকা খেয়েছে। আর পারছে না। এবার সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর। এবার চুপ থাকলে অন্যায় হবে ভেবেই রুপালি রুখে দাঁড়িয়েছে। ওদের প্রথম পরিকল্পনা হলো সবার বিশ্বাস অর্জন করবে শেফালি। তারপর পরবর্তী পরিকল্পনা করবে।

সেই অনুযায়ী শেফালি ওদের গিয়ে বলেছে যে রুপালি সিরাজের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আর সিরাজকে সে শীঘ্রই হ*ত্যা করবে। এবং সেটা খুব তাড়াতাড়ি করবে। ওনারা সবাই যেন সতর্ক হয়ে যায়। এই কথা শুনে সিরাজ সহ সবাই সতর্ক হয়ে গেল। পরীর জন্য অন্দরে ঢুকতে পারছে না কেউ। শুধু শায়ের কেই পরী ঢুকতে দিচ্ছে। কিন্ত শায়ের তো
ওদের কথা শুনবে না। এজন্য আফতাব বেশ চিন্তায় আছে। শায়ের ওনার কথা শুনলে এতদিনে পরীকে শেষ করে দিতো। কিন্ত এখন সব উল্টো হয়ে গেল।

নওশাদ ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। কাউকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ টা তার পঙ্গুত্ব। এর আগে যখন সে সুস্থ ছিল তখন এতো ভয় ওর করেনি। এখন অনেক বেশিই ভয় করছে ওর। এমন সময় শেফালি ওর সামনে এলো। এক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’পানি নেন ভাই! দেইখা মনে হইতাছে আপনে ভয় পাইতাছেন।’

নওশাদ ছোঁ মেরে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিল। সত্যিই তার খুব ভয় লাগছে।

-‘আমি একখান কথা কই ভাই। পরী আপা আপনেরে আগে মারব কইছে।’
কথাটা নওশাদের ভয় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো। সে কপালের ঘাম মুছতে লাগল।

-‘আপনে যদি বাঁচতে চান তো পরী আপারে আগে মা*রেন। তাইলেই হইব। আমি আপনেরে সাহায্য করমু আপারে মা*রার।’
বাঁচার তাড়নায় সে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।সে বলল,’তুই কীভাবে সাহায্য করবি?’

-‘আমি কমু না। আগে আপনে কন আমারে মা*রবেন না তাইলে কমু।’

রাগন্বিত হলো নওশাদ,’তুই বল,আমি তোকে বাঁচাব।শুধু তাই না অনেক টাকাও দেব।’
শেফালি এমন ভান করলো যেন সে ভিশন খুশি, ‘তাইলে তো তো আরও ভালা। হুনেন তাইলে,আপনে আমারে ঘুমের ওষুধ আইনা দেন। পরী আপারে খাওয়াই দিমুনে। আপা আমারে মেলা বিশ্বাস করে। তারপর রাইতে আপনে অন্দরে যাইয়া আপারে মা*ইরা ফালাবেন। তয় একটা কথা কই,আপনের আমার কথা কাউরে কইবেন না। তাইলে এক কান দুই কান কইরা পরী আপার কানে চইলা যাইবো। আর আপনে যদি কাজটা করতে পারেন তাইলে বড় কর্তা খুব খুশি হইব।’

-‘ঠিক বলেছিস তুই। কাউকে বলা যাবে না। তাহলে শায়েরের কানেও কথাটা চলে যেতে পারে। আচ্ছা তোকে আমি ঘুমের ওষুধ এনে দেব।’

নিজের কথা শেষ করে চলে গেল শেফালি। মনে মনে হাসল ও। কারণ নওশাদ ওর জালে ফেসে গেছে। এখন শুধু অন্দরে আসার পালা। সে দৌড়ে গিয়ে পরীকে সব বলে দিল। পরী হেসে বলে,’শিকার ফাঁদের দিকে এগোচ্ছে এখন শুধু ফাঁদে পড়ার পালা।’

নওশাদ শেফালিকে ঘুমের ওষুধ এনে দিলো। সন্ধ্যার পর শেফালি নওশাদ কে জানালো যে সে পরীকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। রুপালিকেও খাইয়ে দিয়েছে যাতে সে টের না পায়। শেফালির বুদ্ধির তারিফ করলো নওশাদ। রাত যখন গভীর হয় তখন সবার চোখের আড়ালে নওশাদ টোকা দিল অন্দরের দরজায়। শেফালি যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। দরজা খুলে তাড়াতাড়ি নওশাদ কে ভেতরে ঢোকালো। নওশাদ তার লাঠির সাহায্য দোতলায় উঠতে লাগল। শেফালি সোনালীর ঘরটা দেখিয়ে বলেছে ওখানেই পরী থাকে। তাই নওশাদ সেদিকেই যাচ্ছে। শেফালি নওশাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,’আইজ তোর এমন মরণ হইব যা তুই চিন্তাও করস নাই।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।