পরীর সামনে দিয়ে কেউ একজন ঢুকলো ঘরটাতে। হাতে থাকা ব্যাগটা থেকে ছোট ছোট কতগুলো ছুরি বের করে লম্বা টেবিলে রাখলো। তার পর কতগুলো বড় বড় ছুরি রাখে। পরী ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটিকে দেখতে লাগল। কালো মুখশধারী লোকটা ঠিক পরীর স্বপ্নের মতো। অস্ত্র গুলো ও সেরকম লাগছে পরীর। কিন্ত শায়েরের জায়গায় পরী নিজে বসা। হঠাৎই শায়েরের কথা ভীষন মনে পড়ল পরীর। আজ যদি সে মারা যায় তাহলে শায়ের বাঁচবে কীভাবে? সেও কি পাগল হয়ে যাবে রাখালের মতো? করুন অবস্থা হবে শায়েরের!!ভাবতেই অস্থিরতা কাজ করছে পরীর ভেতর। মৃত্যু নিয়ে তার ভয় নেই কিন্ত শায়ের কে নিয়ে সে চিন্তিত।
-‘স্বাগতম জমিদার কন্যা পরী। আপনাকে তাসের ঘরে স্বাগতম।’
আবারও পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলে পরী। কবির এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে নওশাদের পাশে বসলো। পরীকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে সে বলে উঠল,’ভয় পেলে নাকি পরী? ভয় পেয়ো না। তোমাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারবো না। শুধু শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলবো ব্যস। বেশি কষ্ট তোমার হবে না।’
কবিরকে থামিয়ে নওশাদ বলে,’আরে ভাই থামো। আগে পরীকে সব সত্য জানাতে দাও। মরার আগে সব জানা পরীর দরকার তো।’
নওশাদ পরীর দিকে তাকিয়ে হাসলো বলল,’আমি যেন কি বলছিলাম হ্যা সম্পান!! না থাক,শুরুটা শুরু থেকেই করি তাহলে?’
লম্বা শ্বাস নিলো নওশাদ তারপর বলতে শুরু করে, ‘শুরুটা হোক ফুলমালাকে নিয়ে মানে তোমার মা। তোমার কাকা তোমার মায়ের সাথে আদৌ কি করেছে তা আমার জানা নেই তবে এটা জানি সে মোটেও ভালো কাজ করেনি। আসলে বলো তো কি,নারীর সৌন্দর্য সব থেকে বেশি আকৃষ্ট করে পুরুষ কে। যেমনটা ফুল আকর্ষিত করে নারীকে। দুটো একই হলো। তোমার বাবা তোমার মায়ের ওই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বিয়ে করে ঘরে তোলে। ভোলা ভালা মেয়েটাকে যেভাবে ঘোরাতো ঠিক সেভাবেই ঘুরতো। তোমার মায়ের এই সৌন্দর্য তার কাল হয়ে দাঁড়াল। সেই কাল আর কেউ নয় স্বয়ং তোমার কাকা। কিন্ত মানতে হবে তোমার মা ঠিকই নিজেকে বারবার বাঁচিয়ে নিয়েছিল। এটা তোমার আর রুপালি ভাবির চোখে না পড়লেও সোনালীর চোখে ঠিকই ধরা পড়তো। তখন তোমরা ছোট ছিলে বিধায় কিছু বুঝতে না। তবে সোনালী বুঝতো। তাই সে বারবার আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতো।
এমনকি তোমার কাকাকে অনেক বার মারার চেষ্টাও করেছিল। আর তোমার বাবা সব জেনেও এর কোন প্রতিবাদ করতে পারতো না। কেননা তারা দুজনেই মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে আছে। সেটা পরে বলব। এখন আসি সোনালীর কথায়। কোমল মেয়েটার মৃত্যুটা যে ভয়ানক ছিল পরী।’
নওশাদ কে এবার কবির থামিয়ে দিলো। সে হেসে বলল,’আমার সোনালীর গল্প টা আমিই বলি তুই থাম।’
চমকালো পরী, আমার সোনালী বলতে কি বোঝাতে চাইছে কবির তা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্ত সে বুঝতেই পারছে না। পরীকে চিন্তিত দেখে কবির বলে,’আরে পরী এতো ভাবছো কেন? আমি তো সব বলছি। আমার সোনালী বলেছি কেন জানো? কারণ সোনালীর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল তোমার বাবা। কিন্ত সে তো পালিয়ে গেলো। মনটা আমার ভেঙে গিয়েছিল তখন। সোনালীর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল এই বুকে।’
বুকে হাত দিয়ে কান্নার অভিনয় করে কবির। ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো পরী। বলল,’আসল রূপ টা যখন প্রকাশ্যে এনেই ফেলেছেন তাহলে এতো ভনিতা না করে সব বলে ফেলুন।’
-‘ঠিকই বলেছো। তবে কি বলোতো সোনালী না বড্ড বোকা ছিল। তাইতো ধরা পড়ে গেল। তার পর কি হলো জানো পরী? রাখাল কে ইচ্ছা মতো মারলো তোমার বাবার গোলামরা। সাথে আমিও ছিলাম। আমার মনের মানুষ কে আমার থেকে যে কেড়ে নিলো তাকে কীভাবে এমনি এমনি ছেড়ে দেই? সোনালীকে তোমার বাবা’ই নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করেছিল সেদিন। আমি আর নওশাদ হাত পা চেপে ধরেছিলাম শুধু। তারপর আমার আর নওশাদের উপর দায়িত্ব পড়ে সোনালীকে কবর দেওয়ার। রাখাল কে জীবিত রাস্তার ধারের কদম গাছের সাথে বেঁধে রাখি। ওর তখনও জ্ঞান ছিলো। তবে মারার ফলে নেতিয়ে পড়েছিল রাখাল। সোনালী কে ওর চোখের সামনেই হত্যা করা হয়। ছেলেটা অনেক বার অনুরোধ করেছিল যেন সোনালীকে ছেড়ে দিতে। তাহলে ও অনেক দূরে চলে যাবে। কখনও সোনালীর ছায়াও মাড়াবে না। কিন্ত এতো ভালোবাসা তো সহ্য হলো না তোমার বাবার। তাই মেরে দিলো।
তবে মানতে হবে পরী,সোনালী অসম্ভব রূপবতী ছিলো। রুপালির থেকেও সোনালী বেশি সুন্দর ছিলো। এমন সৌন্দর্যে ডুব না দিলে কি হয় বলো!!
মরে যাওয়ার পর সোনালী যেন আরো আবেদনময়ী হয়ে উঠেছে! তাই আর লোভ সামলাতে পারলাম না।
নিজের ইচ্ছা মিটিয়ে নিলাম সোনালীর থেকে। তাও রাখালের সামনেই। কিন্ত সে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। বেচারা রাখাল,তবে নওশাদ ও কিন্ত সেদিন সোনালীকে ছাড় দেয়নি! যাকে এতো ভালোবাসালো তাকে না পাওয়ার বেদনায় সে পাগল হয়ে গেল রাখাল। তারপর রাখাল কে পদ্মার ওপারে রেখে এলাম যাতে সবাই এটা জানতে পারে সোনালী রাখালের সাথে পালিয়ে গেছে। কিন্ত রাখাল পাগল প্রেমিক হয়ে মরা মেয়েটার টানে ফিরে এলো। তবে ওর চেহারা চেনার উপায় নেই। জঙ্গলে ভরে গেছে পুরো মুখে।’
কবির আর নওশাদ হাসছে। পরীর চোখ থেকে জল পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে রাগ দমন করার চেষ্টা করছে সে। হাতের বাঁধন এই মুহূর্তে খোলা থাকলে সে এখুনি দুটোকে শেষ করে দিতো। পরক্ষণেই মনে হলো ওর পা দুটো তো খোলাই রয়েছে। তাই সর্বশক্তি দিয়ে নওশাদের বুক বরাবর লাথি মারতেই চেয়ার থেকে সে পড়ে গেল। কিন্ত কবিরকে লাথি মারা ধরতেই কবির পরী পা ধরে ফেলে এবং দড়ি দিয়ে পরীর পা দুটো ও বেঁধে ফেলে। নওশাদ কে টেনে তুলে আবার চেয়ারে বসায়। পরী চিৎকার করে বলে,’কাপুরুষের দল,একটি মেয়ের সাথে লড়াই করার জন্য এতো মানুষ এসেছিস। ভয়ে তার হাত পা বেঁধে রেখেছিস। সাহস থাকলে হাত পা খুলে দে।’
রাগে ফুসছে পরী। জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস উঠানামা করছে ওর। খুনের নেশা ধরে গেছে। নওশাদ চেয়ারে বসে বলল,’শালির দম আছে। ইচ্ছে করছে সব ঝাল মিটিয়ে দেই। আমাদের জন্য বিপদজনক বলেই জমিদার ওকে মারতে বলেছে। একটু পর কথা বলার মতো অবস্থায় থাকবে না।’
রাগটা নওশাদেরও বেড়ে গেল। কিন্ত কবির ওকে থামিয়ে বলল,’তুই থাম,পরীকে তো একটু পরেই পাওয়া যাবে।’
-‘যদি পুরষত্ব দেখাতে হয় তাহলে আমার হাত খুলে দেখা।’
কবির আদুরে স্বরে বলে,’নাহ,বাঘীনিকে সবসময় খাঁচায় বন্দি করে রাখতে হয়। নাহলে যে আক্রমণ করে বসে। তুমি জানো না বুঝি?’
মুখ ফিরিয়ে নিলো পরী। ওর চোখভরা ঘৃণা। আজকে যদি পরী কোনরকম বেঁচে ফেরে তাহলে এদের একটাকেও ছাড়বে না। নিজের জীবন যায় যাক। অন্তত দু চারটাকে শেষ করে শান্তি পাবে তো?
কিন্ত এখান থেকে বাঁচবে কীভাবে পরী? মনে মনে সে প্রার্থনা করতে লাগল আল্লাহ যেন এই শয়তানের শাস্তি দিতে ওকে বাঁচিয়ে রাখে। কবির নিজের চেয়ার টাতে বসে পড়ল। পরীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,’এটুকুতে উত্তেজিত হলে চলবে পরী? আরো অনেক কিছু শোনা বাকি তোমার। রুপালির কথা তো এখনও বললামই না।’
কবির নিজের চেয়ার টা টেনে পরীর আরেকটু কাছে গিয়ে বসে। তারপর বলে,’রুপালির জন্যই তো তুমি শশীল কে মেরেছিলে। তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্ত শশীলের হাতে রুপালিকে তোমার কাকা তুলে দিয়েছিলো। তিনিই চিঠি পাঠিয়েছিল রুপালির কাছে। তিনি খুব ভাল করেই রুপালি আর সিরাজের সম্পর্কের কথা জানতেন। তাই শশীলের সাথে চুক্তি করেই তিনি সব করেছিলেন। আর তারপর তোমার হাতে সব শেষ। আমরাই শশীলের লাশটা গায়েব করেছিলাম। অন্দর থেকে যেহেতু মহিলাদের বের হওয়া নিষেধ তাই তোমার দুই মা আর কাজের লোকেরা আমাদের চিনতো। কিন্ত তোমরা তিন বোন চিনতে না আমাদের কে। তোমার কাকা আখিরের হাত আছে এই কথাটা তুমি জানতে পারলে রুপালি আর আমার বিয়ের দিন। এবং সেদিনই তুমি তাকে আঘাত করে বসলে। মরতে মরতে সে বেঁচে গেলেও তোমার জহুরি নজর থেকে সে বাঁচলো না। বারবার তুমি তাকে মারার পরিকল্পনা করলে। কিন্ত বরাবরের মতই ব্যর্থ হলে। সেজন্যই এখন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা আর যাবে না। মরতে তোমাকে হবেই। সাপকে যতোই দুধ কলা খাওয়াও না কেন সে ছোবল দিবেই। তোমার বাবা বেশ বুঝেছে যদি তুমি কোনদিন জানতে পারো যে সোনালীর মৃত্যুর কারণ তিনি তাহলে তাকে মারতে তোমার দ্বিধাবোধ হবে না। এজন্য বারবার তোমাকে মারার পরিকল্পনা সে করেছে।’
-‘আর বিন্দু??বিন্দুকে কে মেরেছে সত্যি করে বলুন?’
এবার নওশাদ বলে উঠল,’সে তো তোমাকে প্রথমেই বললাম। তোমাদের প্রিয় সম্পান মাঝি তোমার প্রিয় বিন্দুকে মেরেছে।’
-‘আমি বিশ্বাস করি না। বিন্দুকে একজন নয় অনেক গুলো লোক মেরেছে। আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম সেদিন ওই জঙ্গলে। অনেক লোকের উপস্থিতি আমি সেদিন পেয়েছিলাম।’
নওশাদ হো হো করে হেসে উঠল। বিশ্রী সেই হাসি দেখে গা গুলিয়ে ওঠে পরীর। হাত পা ছুটোছুটি করেও বাঁধন ছিড়তে পারে না।
-‘চোখের সামনে যা দেখো তা কি সব সত্য পরী? তুমি হয়তো জানো না ওইদিন বিন্দুর সাথে তোমাকেও মারার পরিকল্পনা ছিলো। যাই হোক শুরু থেকেই বলি। নাহলে তূমি কিছু বুঝতে পারবে না। কানাইকে মনে আছে তোমার? মনে করে বলতো?’
-‘হুমম,বন্যার সময় আমাদের বাড়িতে চুরি করতে এসেছিল,,,,’
পরীকে বাকিটা বলতে না দিয়ে নওশাদ বলে,’আর তুমি তাকে ধরেছিলে। শুধু তা’ই নয়, কানাই কে চুরির সাজা থেকে বাঁচিয়ে ছিলে। কিন্ত পরী এখানেও তুমি বোকার পরিচয় দিয়েছো। কানাই সেদিন চুরি করতে না, তোমাকে খুন করার জন্য গিয়েছিল। তোমার বাবা ওকে পাঠিয়েছিল। কিন্ত তুমি তাকে ধরে ফেললে। এবং তোমার বাবা বিচারের নাটক সাজালো। তারপর তুমি এসে কানাইকে বাঁচালে। আহ কি বুদ্ধি তোমার!! তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয় পরী। এবার আসি সম্পানের কথায়। শুধুমাত্র তোমাকে মারার জন্য তোমার প্রাণপ্রিয় সখির সাথে ভালোবাসার নাটক করেছে সম্পান। ওহ পরী তোমাকে তো আসল কথা বলাই হয়নি।’
নওশাদ কিছুক্ষণ ভাবার অভিনয় করে বলল,’শেখর কে সরিয়ে তোমাকে শায়েরের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কেন জানো? শুধুমাত্র তোমাকে খুন করার জন্য। কিন্ত শায়ের তো ভীষন ধূর্ত। সে তোমাকে হত্যার পরিবর্তে ভালোবেসে সংসার শুরু করে দিলো!!’