বিশাল ছই বাঁধানো নৌকাটি থামলো গাঁয়ের জমিদার আফতাব উদ্দিন এর বাড়ির সামনে। গাঁয়ের সব ঘরবাড়ি বন্যায় তলিয়ে গেলেও জমিদার বাড়ির উঠোন ছুতেও পারেনি এই পানি কিন্তু যদি টানা আরো কয়েকদিন বৃষ্টি হয় তবে অনায়েসে এই বাড়ির উঠোনে পানি প্রবেশ করবে তা নিশ্চিত। বলা যায় উঁচু জায়গায় বাড়িটি হওয়ার দরুন বন্যার পানি স্পর্শ করেনি এই বাড়িটি কে। মোঘল আমলের বাড়িটি। সামনের উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা পেরুলেই ডানে বামে দুটি বড় বড় পাকা ঘর। তারপর আরো একটি দরজা পেরুলেই বড় দোতলা দালানটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাড়ির দেয়ালগুলো কেমন নিস্তেজ। রং উঠে গিয়ে কেমন সবুজাভ বর্ণ ধারণ করেছে। আফতাব চাইলে এই বাড়ি নতুন করে রং করাতে পারে কিন্তু তা তিনি করেন না। কারণ তার পূর্ব পুরুষদের চিহ্ন এই বাড়ি। তাদের ছোঁয়া আছে এই বাড়ির প্রতিটি আনাচে কানাচে। অভিজাত্যের ছোঁয়া তাই এই বাড়িতে তিনি দিতে চাননা। বৃষ্টি বাদলে দেয়াল ভিজে কালচে হয়ে যাচ্ছে তবুও বাড়ির দিকে ফিরেও তাকান না তিনি। এতে লোকে যা বলার বলুক তাতে তিনি কান দেন না।
নৌকা থেকে বের হয়ে এলো ছয়জন যুবক যুবতী। তাদের ব্যাগ গুলো মাঝিরা বের করছে। ছেলে তিনজন নৌকা থেকে নেমে আসলেও মেয়ে তিনজন আসতে পারলো না। কারণ সামনে কাদায় ভরা। এখানে নামলে নির্ঘাত আছাড় খাবে ওরা। তাই সম্পান কাঠের তক্তাটা নৌকা থেকে মাটি বরাবর রাখল। সহজেই মেয়েগুলো নেমে পড়লো। সবাই নিজেদের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ির উঠোনে আসতেই অবাক হয়ে দেখতে লাগল বাড়িটি। সত্যিই বাড়িটি অনেক পুরোনো। সদর দরজার সম্মুখে আসতেই দুজন জোয়ান লোক লাঠি হাতে সামনে দাঁড়ালো। গমগম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কারা আপনারা?কি চাই?’

নাঈম নামের ছেলেটি লোকটির কথার জবাব দিলো,’আমরা শহর থেকে এসেছি। এই গ্রামের জমিদার এনেছেন আমাদের। বন্যায় অনেক মানুষ নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই,’

কথা শেষ করতে পারলো না নাঈম তার আগেই পেছন থেকে সম্পান বলে উঠলো, ‘আরে দাদা ওনারা ডাক্তার। জমিদার বাবু শহর থাইকা আনাইছে।’
আর কথা বলতে হলো না সম্পানকে। লোক দুজন সবাইকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলো। সদর দরজা পেরিয়েই বৈঠকঘরে আসলো সবাই। তৎক্ষণাৎ একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল,’খারান বাবু পুরুষ মানুষ ভেতরে যাইতে পারবেন না। আপনেরা এইহানে বহেন আমি বড় মা’রে ডাইকা আনতাছি।’

ওদের বসতে দিয়ে মেয়েটা ছুটে ভেতরে চলে গেল। নাঈম ইশারায় সবাইকে বসতে বলে নিজে একটা কাঠের চেয়ার টেনে বসলো। শহর থেকে ছয়জন এসেছে ওরা। আরো কয়েকজন বড় বড় ডাক্তার আসবে তবে একটু সময় লাগবে। মেডিকেলের স্টুডেন্ট ওরা। নাঈম,আসিফ,শেখর, মিষ্টি,রুমি ও পালক। ওদের টিম প্রতিটি দলে ছয়জন করে ভাগ হয়ে একেক গ্রামে গিয়েছে। দেশের অবস্থা ভালো না। বন্যায় ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। সাথে সাথে অসুখ ও বাড়ছে। বিশেষ করে কলেরা,গ্রামের মানুষেরা সতর্ক থাকে না বিধায় এইসব রোগ বেশি হয় তাই ওরা এসেছে সবাইকে সতর্ক করতে এবং চিকিৎসা করতে। অবশ্য সব ধরনের ট্রেনিং করেই এসেছে। তবুও বড় ডাক্তার সামনের সপ্তাহে এসে দেখে যাবেন।

বড়সড় ঘোমটা টেনে বৈঠক ঘরে এলেন মালা। সাথে একটু আগে আসা মেয়েটি ও। মালা নিচু স্বরে বললেন,’কুসুম হেগোরে নাস্তা পানি দে।’

সাথে সাথে কুসুম সবাইকে শরবত আর পিঠা দিলো। শরবত খেয়েই সবাই ক্ষ্যান্ত হলো আর খাবে না ওরা। মালা কুসুমকে দিয়ে ছেলেদের বৈঠক ঘরের পাশের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। আর মেয়েদের নিয়ে ঢুকলেন মহিলা অন্দরমহলে। মালা ওদের নিয়ে পরীর ঘরেই বসালো। তারপর আবার রান্নাঘরে চলে গেল কাজে।
পরী এখনও আসছে না দেখে চিন্তিত মালা। ঘরে তিনজন নতুন পুরুষ এসেছে না জানি মেয়েটা কোন অবস্থাতে ঘরে এসে ঢোকে। তাই তিনি আগেভাগেই কুসুমকে পাঠিয়ে দিলেন নৌকা ঘাটে। কুসুম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইল পরীর অপেক্ষায়।

কিছুক্ষণ পরেই দুইটা নৌকা ভিরল পারে। জুম্মান হাতে এক মুঠো শাপলা নিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। লতিফ আর দেলোয়ার বাকি শাপলা নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সবশেষে বের হলো পরী। ওর হাতে একগুচ্ছ শাপলা। শাপলা দিয়ে একটা মালা বানিয়ে গলায় জড়িয়েছে সে। কুসুম দৌড়ে গিয়ে পরীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’পরী আপা তাড়াতাড়ি ঘরে চলেন। বড় মা কইছে আপনের ঘরে যাইতে। আর বাইর হওয়া যাইবো না। ঘরে তিনজন নতুন পুরুষ আইছে। আহেন আমার লগে।’
পরী নিজের ঘাগড়া উঁচু করে ঝারছিল। কুসুমের কথায় হাত আপনাআপনি থেমে গেল তার। বুঝতে বাকি রইল না যে এই সেই মেহমান যার কথা সকালেই ওর আম্মা বলেছিলো। পরী বলল,’ক্যান??আম্মা ঘরে ঢুকতে দিলো??’

কুসুম গলা ঝেড়ে বলল,’ক্যান দিবো না। শহরের ডাক্তার তারা। রোগী দেখতে আইছে। থাকতে তো দিবোই।’
কুসুম আর কথা বলতে পারলো না। তার আগেই ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি নেমে এসেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। জুম্মান আগেই ঘরে ঢুকে পড়েছে। পরী আর কুসুম একসাথে দৌড় লাগালো। হাতের শাপলা গুলোর পাপড়ি ঝরে পড়তে লাগলো মেঝেতে। বৈঠক ঘরের উঠোন পাকা করা। পরীর কর্দমাক্ত পা ফেলার দরুন পায়ের ছাপ সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সাথে শাপলার পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। নাঈম নিজের ঘরের বারান্দায় বসে বসে নিজের জুতো পরিস্কার করছিল। আসার সময় কাদা লেগে গেছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে উঠোনের দিকে তাকালো। দুজন মেয়ে দৌড়ে চলে গেল। তারমধ্যে একজনকে নাঈম চেনে। সে হলো কুসুম এই বাড়ির কাজের মেয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় জনকে সে চিনলো না। ওড়নাটা বোরখার নেকাবের ন্যায় পড়ে আছে বিধায় মুখটাও দেখতে পারলো না সে। মেঝেতে তাকিয়ে এক দৃষ্টিতে পরীর পায়ের ছাপ আর শাপলার পাপড়িগুলো দেখতে লাগল। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না সে পায়ের ছাপ। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মুছে গেল। নাঈম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর নিজ ঘরে চলে গেল।

বৈঠক ঘর পেরিয়ে মহিলা অন্দরে ঢুকতেই বৃষ্টির তোড় যেন বাড়ালো। বড় উঠোন পেরিয়ে খোলা বারান্দায় আসতে আসতেই ভিজে গেছে পরী। হাতের শাপলা গুলো মেঝেতে রেখে হাত পা ঝাড়লো সে। কুসুম ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছে। বাড়িতে মেহমান এসেছে রান্না করতে হবে তো! ভেজা জামাকাপড় ছাড়বে বলে পরী আবার দৌড় দিলো। ধুপধাপ শব্দ এলো পরীর পায়ের। কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেল সে। নিজের ঘরে অচেনা গন্ধ পেয়ে। রুমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পালক আর মিষ্টি ব্যাগ খুলে কিছু খোজায় ব্যস্ত। কারো আগমনের আভাসে দু’জনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। পরীকে দেখে চিনলো না ওরা। পরী নিজ কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলল,’কারা আপনারা আমার ঘরে কি করেন??’

ওরা দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। কার ঘরে মালা ওদের রেখে গিয়েছে তা ওরা জানে না। যেখানে ওদের থাকতে দেওয়া হয়েছে ওরা সেখানেই থাকছে। পরী আরেকটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবার একই প্রশ্ন করতেই মিষ্টি জবাব দিলো,’আমরা শহর থেকে এসেছি। এই গ্রামের জমিদারের গিন্নি মানে মালা বেগম আমাদের এই ঘরে থাকতে বলেছেন।’

সঙ্গে সঙ্গে পরীর রাগ আসমান ছুঁয়ে গেল। যেখানে নিজের জিনিস পত্রে কারো হস্তক্ষেপ সে পছন্দ করে না সেখানে একই ঘরে এই মেয়েদের নিয়ে সে থাকবে কিভাবে?সাথে সাথেই পরী গলা ফাটিয়ে মালাকে ডাকতে শুরু করে দিল,’আম্মা,আম্মা, আম্মাজান এট্টু এদিকে আহেন??’
কিন্তু মালার পরিবর্তে ঘরে এসে হাজির হলো আবেরজান বেগম। লাঠিতে ভর দিয়ে এসে তিনি বললেন,’মাইয়া মানুষ এতো গলা বাজাস ক্যান তোরে না করছি না?এতো চিল্লাস ক্যান বারবার?’
পরী দ্রুত পদে দাদির নিকটে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,’আমারে না জানাইয়া আমার ঘরে অন্য মানুষ ঢুকতে দিলা ক্যান?’

আবেরজান পান চিবুতে চিবুতে বলল,’অহনই তো আইলো ওরা। একটু জিরাইতে দে?তোর মায়ের মেলা কাম এহন। পরে ওগোরে অন্য ঘরে দিয়া আইবো। তুই ভিইজা গেছস কাপড় বদলা।’
লাঠির ভরে চলে গেল আবেরজান। মিষ্টি আর পালক লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে। প্রথম দিনেই এতো বড় অপমান মেনে নিতে পারলো না ওরা। মেয়েটা কিভাবে সামনাসামনি কথাগুলো বলে ফেলল? রুমি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল,পরীর চিল্লানোর ফলে ধড়ফড়িয়ে ওঠে সে। পরবর্তী কথাগুলো ওর কানে যেতেই লজ্জাবোধে মাথা নিচু করে ফেলে। এখন ওদের মনে হচ্ছে এই গ্রামে আসাটাই ভুল হয়েছে ওদের।
পরী কথা না বলে সামনে পা বাড়ালো। কাঠের সাথে লাগানো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকটা দেখতে ড্রেসিং টেবিলের মতো। তার সামনে কয়েকটা কৌটা আর কতগুলো রং বেরঙের ফিতা। এতক্ষন ধরে মুখে ওড়না বাঁধা থাকলেও এখন সেটা এক টানে খুলে ফেলল পরী। তারপর চুল থেকে ফিতার বাঁধন খুলতে ব্যস্ত হলো।
মিষ্টি আর পালক চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতে পারলো না। কিন্তু রুমির ধাক্কায় সেদিকে দু’জনে তাকালো। রাগ জড়ানো কন্ঠে পালক বলল,’কি হয়েছে ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?’

রুমি হা করে সামনের দিকে চোখ রেখে বলে উঠলো,’হ্যা রে এটা কি মেয়ে নাকি কোন মোমের পুতুল? একটু কি ছুঁয়ে দেখব?’

রুমির কথার মানে ওঁরা দুজনের বুঝতে পারলো না। রুমির দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই ওদের দৃষ্টি স্থির হলো সামনের আয়নাতে। আয়নার প্রতিবিম্বে যেন একটা পরীর আগমন ঘটেছে। পুরো পুতুলের মতোই লাগছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে। গাঁয়ের রং টা উজ্জ্বল ফর্সা। তার উপর পানির ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে। এই প্রথম মেয়ে হয়ে কোন মেয়ের উপর চোখ আটকে গেছে ওদের। ঘোর থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না ওরা। চুল থেকে বেগুনি রঙের ফিতাদুটি খুলে রেখে ওড়না হাতে পিছনে ঘুরতেই তিনজন যুবতীকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরী কপাল কুচকালো। তবে কিছু বলল না। কাঠের তৈরি আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করে ঘর থেকে বের হতে নিলে পালকের ডাকে থমকে দাঁড়ায় পরী। পালক জিজ্ঞেস করে বসে,’নাম কি তোমার?’

পরী পেছনে না ফিরেই উওর দিলো,’পরী।’
অতঃপর ঘরে ছেড়ে বের হয়ে গেল। এবার ওদের কাছে সব পানির মতো পরিস্কার হয়ে গেল। এই মেয়ের কথাই বিন্দু আর সম্পান বলাবলি করছিল। বিন্দুকে সাথে করে নিয়েই ওরা শাপলা বিলে আসে। কিন্তু তার আগেই লতিফ আর দেলোয়ার ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। কিছুতেই ওদের এদিক দিয়ে যেতে দিবে না ওরা। সম্পানের অনেক অনুরোধে ও লতিফের মন গলল না। কারণ জমিদার কন্যা পরীর কড়া‌ হুকুম সে থাকা কালীন শাপলা বিলে কোন পুরুষের আগমন ঘটতে পারবে না। শাপলা বিলে সাঁতার কাটার জন্য কথাটা পরী বলেছিল কিন্তু তবুও তার সাঁতার কাটা হলো না। শেষে বিন্দু পরীর নৌকায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে শলা পরামর্শ করে অনুমতি নিলো। তারপর সম্পান নৌকা নিয়ে অনায়াসে শাপলা বিলে বৈঠা ফেলল। পালক ভেবেছিল জমিদার কন্যা না জানি কেমন হবে? কিন্তু সামনাসামনি দেখল এতো একটা পুঁচকে মেয়ে। বয়স চৌদ্দ কি পনের হবে। এই মেয়ের রূপের যেমন তেজ মেজাজের তেমন ঝাঁঝ। সব মিলিয়ে আগুন বলা যায়।
মিষ্টি বড় একটা দম ফেলে বলল,’এটা মেয়ে নাকি বিছুটি পাতা? এভাবে কেউ কারো সাথে কথা বলে?শহর থেকে এসেছি মেহমান ই তো ওদের। সেজন্য এভাবে কথা বলবে?’

তবে মিষ্টির কথা কেউ কানে তুলল না। রুমি চোখ কচলে বলল,’এতো সুন্দর মেয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম।’

‘হবেই তো। দেখলি না এই পরীর মা কত সুন্দর। যৌবন কালে ওই মহিলার ও তার মেয়ের মতো রূপ ছিল। মায়ের মতোই হয়েছে মেয়েটা।’
পালকের কথায় রুমি খাট থেকে নেমে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ছেলে হলে এই মেয়েটাকে এখুনি বিয়ে করে ফেলতাম।’
হাসলো পালক,’তোর মতো সাধারণ মেডিকেল স্টুডেন্টের কাছে জমিদার তার মেয়ের বিয়ে দিতো বুঝি?’

‘জমিদার,রাজকুমার,রাজা হওয়ার একটা সুবিধা আছে জানিস? রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী রমণী তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে।’

পালক আর রুমির দুষ্টুমি পছন্দ হলো না মিষ্টির। মেয়েটার নাম মিষ্টি কিন্তু কথায় ঝাল মেশানো থাকে সবসময়। মুল কথা হলো পরীর সৌন্দর্য ওর পছন্দ হয়নি। ওরাও সুন্দর,ফর্সা গায়ের রং কিন্তু পরীর মতো অতো নয়।
দুপুরে খাওয়ার ডাক পড়তেই সবাই একসাথে খেয়ে নিলো কিন্তু খাওয়ার সময় ওরা পরীকে দেখতে পেলো না। ছেলেদের আগে খেতে দেওয়া হলো এবং মেয়েদের পরে। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হলো ওরা। ঘাটে ওদের জন্য নৌকা বাধাই আছে। ব্যাগপত্র নিয়ে দ্রুত নৌকায় চেপে বসে সবাই। এখন ওরা গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রে যাবে। সেখানে শতাধিক মানুষ আছে। অর্ধেকের বেশি অসুস্থ। সেখান থেকে ওরা জমিদারের বাগান বাড়িতে যাবে। সেটিও বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করেছে আফতাব। নৌকায় বসে পালক আর রুমি ফিসফিস করে কথা বলছে আর হাসছে। ওদের কান্ড দেখে নাঈম জিজ্ঞেস করল,’কি রে তোরা নিজেদের মধ্যে কি বলছিস?আমাদের কেও বল শুনি?’
শেখর তাতে তাল মিলিয়ে বলল,’বোধহয় বিয়ের পর হানিমুন বাচ্চা গাচ্চার প্ল্যান করছে।’
বলতে বলতে হাসলো শেখর। পালক শেখরের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল,’জ্বী না মশাই। আমরা জমিদারের মেয়ে পরীর কথা বলছি। জানিস মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর একদম পুতুলের মতো। নাম পরী আর দেখতেও পরীর থেকে কম নয়। আমি কখনো রাজকন্যা দেখিনি। কিন্তু রাজকন্যারা বোধহয় এই পরীর মতোই দেখতে।’
কৌতূহল হয়ে পালকের কথা শুনতে লাগলো শেখর নাঈম আর আসিফ। তবে পুরোপুরি হয়তো কথাটা বিশ্বাস হলো না ওদের। আসিফ ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বলল,’ফাজলামো করছিস?গ্রামের এরকম নোংরা পরিবেশে এতো সুন্দর মেয়ে!!’

ধমকে উঠলো রুমি,’চুপ থাক। একটা মেয়ে কখনোই আরেকটা মেয়ের রূপের বর্ণনা দেয় না দিতে চায় না। কিন্তু আমি না দিয়েও পারছি না। আসলেই মেয়েটা খুব সুন্দর।’

নাঈম ওদের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে তো দেখতে হচ্ছে মেয়েটাকে। দেখি কেমন সুন্দর?’
‘তা দেখবি কিভাবে? অন্দরমহলে তো পুরুষ ঢুকতে দেওয়া হয় না।’
রুমির দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকালো নাঈম। সত্যি তো!! তাহলে কি পরীকে দেখা হবে না?
‘যদি পরী বাইরে আসে তাহলে দেখবো।’

পালক ভেংচি কাটলো নাঈমের দিকে তাকিয়ে বলল,’অতো সোজা না বাবু। ওই মেয়ে বাইরে বের হয় কিভাবে দেখোনি? আজকে শাপলা বিলে তো নৌকায় ওই পরীই ছিলো। বাবা কতো জোর করে আমরা আসতে পারলাম।’

নাঈমের মুখে চিন্তার রেশ দেখা গেলো। পালক আর রুমি যেভাবে মেয়েটার বর্ণণা দিলো,একবার না দেখা পর্যন্ত ও ক্ষ্যান্ত হবে না। শেখর দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,’তাহলে আমরা রাতে চুরি করে অন্দর মহলে ঢুকব কি বলিস তোরা?আমি কিন্তু পরীকে না দেখে শহরে ফিরছি না।’

শেখরের কথায় সবাই হাসলো শুধু মিষ্টি বাদে। ও ছইয়ের বাইরে বের হয়ে চারপাশ দেখছে। নাঈম শেখরের কথা ভেবে দেখল মন্দ না। সে বলল,’তাহলে আজ রাতেই মিশনে নেমে পড়া যাক? কি বল?’
এবার আসিফ ও সায় দিল। ও দেখতে চায় কেমন সুন্দর মেয়ে!পালক ওদের কথা শুনে মাথা নেড়ে বলল,’পাগল তোরা সব। ধরা খেলেই বুঝবি। জমিদার মশাই তোদের গর্দান নিবে দেখিস। আহারে এসেছি ছ’জন যেতে হবে তিনজন।’
কথাটা আফসোসের সুরে বলল পালক। নাঈম বলল,’আমারা ধরা খেলে তোদের নাম বলব। তোরাই তো লোভ দেখালি। মেয়েটা এতো সুন্দর!গর্দান গেলে সবার যাবে।’

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।