সাফওয়ান বাইরে বের হওয়া মাত্রই ক্যামেরার ক্লিকের শব্দে চারদিক ছেয়ে রইলো, কোনো জনমানুষের কন্ঠস্বর সেখানে শোনা গেলো না। এই অত্যান্ত সুপুরুষ ব্যাক্তিটাকে দেখেতেই লেগে গেলো সবাই৷
সাফওয়ান অস্বস্তি তে পড়লো। সারাটাজীবন ওর মানুষের আড়ালে আড়ালে থাকার অভ্যাস, আজ এখন এই মুহুর্তে হঠাৎ করেই এত মানুষের সামনে নিজেকে এক্সপোজ করার ব্যাপারটা ওর কাছে খুবই অস্বস্তিকর৷ ওর চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো সেই অস্বস্তি আর অসহায়ত্ব। ওর চোখ জোড়া খুজে বেড়াতে লাগলো ওর ভরসার স্থল টা। নিজের আশ পাশে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর রিমু কে খুজে চলল ও, যাকে ছাড়া ওর কোনোকিছুই হয় না৷
শাফিন তার ভাইয়ের এই অস্বস্তি টের পেলো। ও দ্রুত পায়ে ভাই কে ‘আসছি’ বলে চলে গেলো মেইন ডোর ঠেলে ভেতরে। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই রুমাইশা কে নিয়ে ফিরলো ও।
সাংবাদিকেরা সাফওয়ানের ফটোশুট করতে ব্যাস্ত। সাফওয়ান কি করবে বুঝতে পারছে না! এমন সময়ে ওর ঠিক পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেলো ও, কেউ তার নরম হাত টা আস্তে করে গলিয়ে দিলো ওর ওই কর্কশ হাত টার ভেতরে৷ আর সেই হাত টা মুহুর্তের ভেতরেই শক্ত করে ধরে ফেললো সাফওয়ান। উবে গেলো ওর মুখে ফুটে ওঠা সমস্ত অস্বস্তি, হাওয়া হয়ে গেলো ওর চোখে ফুটে ওঠা সমস্ত অসহায়ত্ব! বুকের হারিয়ে যাওয়া বল টা সাথে সাথেই ফিরে পেলো সাফওয়ান।
রুমাইশা সাফওয়ানের হাত টা ধরে পেছন থেকে অল্প একটু এগিয়ে এসে দাড়ালো সাফওয়ানের গা ঘেঁষে। সাফওয়ান সোজাসুজি তাকালো এবার সামনের দিকে৷ উপস্থিত জনতার ওপর নজর ফেললো ও৷ ক্যামেরার ক্লিক হতেই আছে। সাংবাদিক দের একজন সামনে থেকে চেচিয়ে বলে উঠলেন
— ম্যাম, আপনি আর একটু এগিয়ে দাড়ান, প্লিজ!
রুমাইশা কিছুটা ইতস্তত করে সাফওয়ানের পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এসে সাফওয়ানের পাশাপাশি দাড়ালো। সাফওয়ান তাকালো এক পলক তার পাশে দাঁড়ানো রুমাইশার দিকে, ওর সে দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো অগাধ ভালোবাসার ছাপ, যে দৃষ্টি ওদের সামনে দাঁড়ানো সবাইকে বুঝিয়ে দিলো, এই লোকটা তার বউকে একটু বেশিই ভালোবাসে!
সাফওয়ানের তাকানো টা উপলব্ধি করে রুমাইশা নিজেও মাথা ঘুরিয়ে, ওর থেকে প্রায় দেড় ফুট বেশি উচ্চতার সাফওয়ানের দিকে তাকালো, চোখাচোখি হলো ওদের দুজনের, আর সাথে সাথেই সাংবাদিক দের ক্যামেরায় ক্যামেরাবন্দী হলো ওদের দুজনের এই দৃষ্টি মিলনের মুহুর্ত টা।
খানিক্ষন পর ক্যামেরার ক্লিকের শব্দ থামলো। উৎসাহী জনতার গুঞ্জনও শোনা যেতে লাগলো আস্তে আস্তে।
— স্যার, আপনাকে এই দেশ থেকে আমেরিকা তে নিয়ে যাওয়ার পর আপনার সাথে কি কি হয়েছিলো? আর আপনি সেখান থেকে বের হলেন কিভাবে।
সাংবাদিকদের পেছনের দিক থেকে একজন উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো। পাশে দাঁড়ানো রুমাইশার মুহুর্তের ভেতর মনে পড়ে গেলো হারবার্টের হাত থেকে সাফওয়ান কে কেড়ে নিয়ে আসার সেই সমস্ত দিন গুলির কথা! হঠাৎ স্মৃতি রোমন্থনের কারণে গায়ে কাটা দিলো ওর। সাফওয়ানের হাতের ভেতরে থাকা হাত টা দিয়ে কিঞ্চিৎ চাপ দিলো ও সাফওয়ানের হাতে৷
সাফওয়ান সেই সাংবাদিক টার উদ্দ্যেশ্যে শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করলে খুশি হবো।
সাংবাদিক টার হাসি মুখ খানা চুপসে ভোতা হয়ে গেলো। দমে গেলো সে পুরোপুরি। তার কিছুটা সামনে থেকে আর একজন সাংবাদিক বলে উঠলো,
— স্যার, আমি জানিনা প্রশ্ন টা আপনার কাছে ব্যাক্তিগত কিনা, তারপর ও করছি। আপনি নরখাদক দের অনেকের ওপর অস্ত্র চালিয়েছেন, এই অস্ত্র আপনি কোথায় পেয়েছেন? আর এটা যদি আপনার অস্ত্র হয় তাহলে আপনি অস্ত্র কেন রাখেন সাথে?
সাফওয়ান সাংবাদিক টার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। প্রশ্নকারী সাংবাদিক টা সাফওয়ানের এমন দৃষ্টিতে হঠাৎ ভয় পেলো যেন, সবার অলক্ষ্যে ঢোক গিলল সে একটা, আর মনে মনে স্বগতোক্তি করলো,
— ও ভাই, এইবার আমার ওপর চড়াও হইস না, তোর পায়ে পড়ি!
সাফওয়ান সাংবাদিক টার দিকে চোখ রেখেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো,
— অস্ত্র টা আমারই, আর আমি আমার সাথে অস্ত্র টা রাখি আমার আর আমার পরিবারের সেইফটির জন্য।
অন্যপাশ থেকে আর একজন পাকনা সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসলো,
— আপনি তো চাইলেই সেইফটির জন্য পুলিশ মোতায়েন করতে পারতেন, নিজের সাথে অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কি প্রয়োজন?
সাফওয়ান সাথে সাথেই কড়া গলায় তাকে উত্তর দিলো,
— পুলিশ একবার মোতায়েন করেছিলাম, আজ থেকে বারো তেরো বছর আগে, কিন্তু তারা কি করতে পেরেছে সেটা আপনারাও জানেন, আমিও জানি। আমি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না, আপনারা এখন আসতে পারেন।
বলেই সাফওয়ান রুমাইশার হাত খানা ধরেই পা চালিয়ে মেইন ডোর গলিয়ে চলে গেলো ভেতরে। ওদের দেখা দেখি শাফিন ও চলে গেলো পেছন পেছন। প্রশ্নকারি সাংবাদিক টা আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। বাকি সাংবাদিক গুলো কটমট করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। পাশ থেকে একজন সাংবাদিক তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
— এত বা*পাকনা কেন তুই? কি প্রশ্ন করবি খুজে পাস না, না?
প্রশ্নকারী সাংবাদিক টা হতাস গলায় বলল,
— আরে, আমি কি জানি এই প্রশ্ন করলে বড় ভাই চেতে যাবেন তা! জানলে কি আমি প্রশ্ন করতাম?
এটার ওপর ক্ষুব্ধ হলো সবাই। তারপর আস্তে আস্তে নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়লো আহমেদ ভিলার সামনে থেকে। কালকের নিউজ পেপারের জন্য এখন সুন্দর করে প্রতিবেদন টা ছাপাতে হবে তাদের, ফেইসবুক টা এখন গরম করতে হবে, অনেক কাজ।
উৎসুক জনতাও আস্তে আস্তে ভিড় কমিয়ে যে যার নিজের বাড়ি চলে গেলো৷ আহমেদ ভিলার সামনেটা একসময় ফাকা হয়ে এলো পুরোপুরি।
১০৮. বিকাল বেলা একটা জব্বর ঘুম দিয়ে উঠলো শাফিন। ঘুম ভাঙার পর বিছানায় গড়াগড়ি করলো কিছুক্ষণ। সানিয়া এখনো ঘুমুচ্ছে৷ গড়াগড়ি শেষ হলে ফোন টা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকলো ও৷ ঢুকতেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো শাফিনের৷ তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসলো ও৷
পুরো ফেইসবুক জুড়েই সাফওয়ানের ফটো। নিউজ চ্যানেল গুলো তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হয়তো দুপুরের পরপরই, এর মধ্যেই সাফওয়ানের ফটো তে ফেইসবুক সয়লাব হয়ে গেছে৷ নরখাদক দের হাতে নিহত হওয়া অনেকের কাছের মানুষ জন গুলো সাফওয়ান কে নিয়ে পজিটিভ স্ট্যাটাস দিয়েছে। অনেক সোসাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ও সাফওয়ান কে নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। আর মেয়ে গুলো সব সাফওয়ানের ফটো পোস্ট করে হেডিং দিয়েছে, ‘নিউ হ্যান্ডসাম ইন টাউন’, কেউ কেউ আবার লিখেছে ‘নিউ ক্রাশ আনলকড’!
কেউ কেউ সাফওয়ান আর রুমাইশার একে অপরের দিকে তাকানোর সেই মুহুর্ত টার ফটো আপলোড দিয়ে লিখেছে, ‘এইভাবে ভালোবাসতে শিখো প্রিয়!’
শাফিন শুধু ফেইসবুক স্ক্রল করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে। একা একা আর যুৎ হচ্ছে না দেখে সানিয়া কে গুতিয়ে গুতিয়ে উঠাতে লাগলো ও৷
— এই সানি, সানি! উঠো তো! দেখো কি!
সানিয়া ঘুম ভেঙে উঠে মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
— ষাঢ়ের মতো চেচিয়ে কি দেখানোর জন্য ডাকছো তুমি আমাকে? রাত নাই দিন নাই, ঘুমালেই ডেকে তোলো, সমস্যা কি তোমার?
শাফিন ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই অতি উৎসাহের সাথে বলল,
— আরে, পঁচা কাজ করার জন্য ডাকছিনা। দেখো আমার ভাইয়ের ফটো দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা, সবখানে চলে গেছে!
শাফিনের কথা শুনে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো সানিয়ে, তারপর শোয়া থেকে উঠে বসে শাফিনের ফোনের দিকে তাকালো৷ তাকিয়েই সানিয়া খুশিতে আটখানা হয়ে গেলো, আনন্দ মিশ্রিত গলায় ও বলল,
— আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই শাফিন। ভাইয়াকে সবাই পজিটিভলিই নিয়েছে! এখন আর ভাইয়া কে লুকিয়ে থাকতে হবে না! সদর্পে ভাইয়া এখন নিজের পরিচয়ে রাস্তায় বের হবে, মানুষের সাথে মিশবে! এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!
শাফিনের চোখে পানি চলে আসলো! এই দিন টা দেখার অপেক্ষায় অর্ধেক জীবন পার করে দিলো ও, ওর বাবা মা বৃদ্ধ হলো, শেষ বয়সে এসেও যে এই দিন দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়েছে তার জন্য শাফিন শুকরিয়া আদায় করলো আল্লাহর কাছে।
শাফিন কোনো কথা বলছে না দেখে সানিয়া তাকালো ওর দিকে। তাকিয়েই দেখলো শাফিনের চোখ জোড়া পানিতে টইটুম্বুর হয়ে আছে। সেটা দেখে ওর নিজেরও চোখের কোণায় পানি জমলো!
শাফিনের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে ও নিজের ভাইয়ের কথা বা রুমি আপুর কথা বলেনি এমন একটা দিন ও যায়নি! সাফওয়ান বা রুমি কে শাফিন যে কতটা ভালোবাসে তা একটু হলেও জানে সানিয়া। স্মিত হেসে ও শাফিন কে বুকে টেনে নিলো, তারপর বলল,
— পাগল ছেলে! কাদতে আছে? বুড়ো হয়ে গেছো তুমি! এখন কাদবে তোমার বাচ্চা কাচ্চা, তা না, তুমি কাদছো! ভাইয়াদের জন্য দুয়া করো শুধু, যেন এমন শান্তিতেই বাকিটা জীবন পার করে দিতে পারেন তারা৷
শাফিন সানিয়া কে আকড়ে ধরে ফুপিয়ে উঠলো নিঃশব্দে। সানিয়ার চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়লো দুফোটা। সন্তর্পনে মুছে নিলো ও সেটা। তারপর শাফিনের চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে দিয়ে বলল,
— চলো, নিচে চলো, মা আর বাবাকে এই খবর টা দিয়ে আসি! ওনারা কত খুশি হবেন বলো তো! চলো, উঠো এক্ষুনি।
শাফিন সানিয়া কে ছেড়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে নাক টানলো, তারপর বলল,
— দাড়াও, যে মেয়েটা লিখেছে নিউ ক্রাশ আনলকড তার সস নিয়ে রুমি আপুকে দিই! সেই সুন্দর মজা হবে!
সানিয়া হেসে উঠলো শাফিনের কথাতে, বলল,
— তুমি কোনোদিন ভালো হবা না, হ্যা! কোথায় আনন্দ ফুর্তি করবা, তা না এখনো রুমি আপুকে জ্বলানোর ফন্দি আটছো! চলো!
শাফিন সস টা নিয়ে রুমাইশা কে সেন্ড করলো হোয়াটসঅ্যাপে। তারপর সানিয়া কে নিয়ে হলরুমের দিকে পা বাড়ালো।
ফোনের টুংটাং শব্দ হতেই রুমাইশা ফিরে তাকালো সেদিকে। একটু আগেই ঘুম ভাঙলো ওর। এখনো বিছানা ছাড়েনি। পাশেই সাফওয়ান ঘুমিয়ে আছে রাশা কে বুকে নিয়ে। সাদমান আর শাহমীর রুনিয়া আর ইশতিয়াকের সাথে ঘুমিয়েছে নিচে৷ সাফওয়ানের ঘুমন্ত মুখখানার দিকে সন্তুষ্ট চিত্তে এক পলক তাকিয়ে ফোন হাতে নিলো রুমাইশা। আর এরপর হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকেই চোখ কপালে উঠলো ওর৷ শাফিন দুটো তিনটে সস দিয়েছে ওর কাছে, তাতে সাফওয়ানের ছবি, ওপরে সাফওয়ান কে নিয়ে মেয়েদের বিভিন্ন স্ট্যাটাস!
সস গুলোর ওপরে শাফিন লিখেছে,
— হ্যান্ডসাম বর পাওয়ার অসুবিধা সমূহঃ
আর সস গুলোর শেষে লিখেছে,
— থ্যাংক মি লেটার!
এসব দেখেই রুমাইশার মেজাজ বিগড়ে গেলো। পাশে শুয়ে থাকা সাফওয়ানের দিকে তাকালো ও আবার৷ কিন্তু এবার তাকালো ভ্রু কুচকে। ফোন টা ধাম করে বিছানায় রেখে সাফওয়ান কে হাত দিয়ে একটা গুতা দিলো ও৷ রুমাইশার গুতা খেয়ে সাফওয়ান চোখ মেললো, এরপর ঘুম ঘুম চোখে রুমাইশার দিকে ফিরে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় ও বলল,
— গুতাচ্ছিস কেন? কি সমস্যা? খুলে বল।
রুমাইশা ভ্রুকুটি করে বলল,
— কোনো সমস্যা না, ইচ্ছা হয়েছে তাই মেরেছি। কোনো অসুবিধা?
সাফওয়ান ফিক করে হাসলো। বলল,
— নাহ, কোনো অসুবিধা না। এখন আমাকে ঘুমুতে দাও৷
বলেই পাশ ফিরে আবার ঘুমানোর পায়তারা করতে লাগলো সাফওয়ান৷ রুমাইশা ভ্রুকুটি করে আবার ক্যাটক্যাট করে বলল,
— অ্যাই, তুমি আবার ঘুমাচ্ছো কেন? উঠো, সন্ধ্যা হয়ে গেলো! এতক্ষন ঘুমিয়েও হয়নি তোমার?
সাফওয়ান সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে রুমাইশা কে দেখলো, বউ তার কোনো কারণে ভয়ানক বিরক্ত৷ মনে মনে ক্যালেন্ডারের তারিখ হিসাব কিরতে লেগে গেলো ও৷ নাহ, এই সময়ে তো রিমুর মুড সুইং হওয়ার কথা না, আর ও দিন বাকি আছে, তাহলে?
সাফওয়ান কে ওর দিকে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে আরও বিরক্ত হলো রুমাইশা। বলল,
— হা করে তাকিয়ে দেখছো কি? বাড়ি এসে শুধু খাওয়া আর ঘুম! উঠো এক্ষুনি, উঠে ফ্রেস হও। আমার কিন্তু মোটেই ভাল্লাগছে না বলে দিলাম!
এমন সময়ে সাফওয়ানের ফোনে টুং করে মেসেজ আসলো কিছু। সাফওয়ানের ঘুম এমনিতেও উড়ে গিয়েছে। ফোন টা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো ও। শাফিনের মেসেজ, ও লিখেছে,
— রুমি আপু চেতেছে নাকি ভাইয়া?
সাফওয়ান চকিতে একবার রুমাইশা কে দেখে নিয়ে আবার ফোর দিকে তাকিয়ে কীপ্যাড টিপে শাফিন কে মেসেজ করলো,
— হেব্বি চেতেছে, তুই কিছু করছিস নাকি? কি করছিস, বল এখনি।
শাফিন ফিরতি উত্তর দিলো,
— ফেইসবুকে ঢুকো, তাহলেই বুঝবা তোমার বউ কেন চেতেছে। আর নিচে আসো, আমরা সবাই বসে আছি এখানে৷ আপু কেও নিয়ে আসো।
সাফওয়ান আবার রুমাইশা কে একপলক দেখে নিলো। রুমাইশা বিছানায় বসে দুই হাত বুকে বেধে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে ওর মহাবিরক্তির ছাপ।
রুমাইশা কে দেখে নিয়েই সাফওয়ান ফেইসবুকে ঢুকলো, ঢুকে নিজেই হা হয়ে গেলো ও৷ ঢোক গিলে ফোন টা সুইচ টিপে, সন্তর্পণে সেটা রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলের ওপর। তারপর রুমাইশার দিকে তাকিয়ে ও বলল,
— ফ্রেশ হয়ে আসো, চলো নিচে যাই! খিদে পায়নি তোমার? বাইরে খেতে যাবে?
রুমাইশা তাকালো না। নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে চাপাচাপি করতে থাকলো, আর সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলল,
— খিদে পায়নি, তোমার পেলে তুমি খেয়ে আসো।
সাফওয়ান কিছু বলল না৷ ফোন টা উঠিয়ে শাফিন কে মেসেজ দিয়ে বলল,
— রিমুর কাছে কল কর, করে মায়ের কাছে ধরিয়ে দে, দিয়ে বল মা যেন ওকে নিচে যেতে বলে।
কিছুক্ষণ পরেই রুমাইশার ফোনে কল এলো শাফিনের৷ রুমাইশা রিসিভ করলো, ওপাশ থেকে রুনিয়া বলে উঠলেন,
— এই নিচে আয়, মচমচা নাস্তা হয়েছে, খাবি। তাড়াতাড়ি আয়, সাদমান শাহমীরের সাথে মিলে শাফিন আর সানিয়া কিন্তু সব শেষ করে দিলো।
রুমাইশা ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
— আসছি ফুপ্পি, তোমরা খেতে থাকো।
বলেই কল কেটে দিলো রুমাইশা। তারপর বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এলো। রাশা ঘুম থেকে উঠে গেছে ততক্ষণে। পোশাক আশাক টা ঠিক করে নিয়ে রাশা কে কোলে তুলে সাফওয়ানের দিকে একপলক তাকিয়ে নিচে চলে গেলো ও৷
সাফওয়ান ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। রুমাইশা রুম থেকে বের হয়ে যেতেই সাফওয়ান বলে উঠল,
— ইয়া আল্লাহ, কোনো দোষ না করলেও শাস্তি দেওয়ার এই ব্যাপার টা আমার বউ এর মাথা থেকে তুমি চিরতরে উঠিয়ে দাও, আমিন!
.
সাফওয়ান যখন গোছগাছ করে নিচে আসলো ততক্ষনে সবার নাস্তা প্রায় শেষের দিকে। যদিও রুনিয়া সাফওয়ানের জন্য আলাদা করে তুলে রেখেছিলেন, সাফওয়ান কে দেখেই তিনি নাস্তা নিয়ে হাজির হলেন হলরুমে। সোফার সামনে রাখা টি টবিলের ওপর নাস্তা রেখে সোফায় বসলেন তিনি।
সাফওয়ান এসে বসলো মায়ের পাশে। ইশতিয়াক আহমেদ অন্য পাশের সোফায় বসে শাহমীরের সাথে খেলছেন। সাদমান শাফিনের সাথে কুস্তিগিরি করছে, সানিয়া ওদের রেফারি৷ আর রুমাইশা রাশা কে কোলে নিয়ে ওকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছে। মুখ খানা ওর থমথমে। এরকম সিলি বিষয় নিয়ে যে এখনো কিশোরী মেয়েদের মতো ওর মন খারাপ হচ্ছে সে ব্যাপার টা চিন্তা করে নিজেরই রাগ লাগছে ওর৷ কিন্তু সাফওয়ানের ওপর থেকে ওর রাগ টা মোটেই কমছে না৷
সাফওয়ান নাস্তার প্লেট টা নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে রুনিয়া আর শামসুল কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— মা, বাবা, পরশু আমাদের ফ্লাইট, রাতের নয়টায়। আমরা দুপুরের আগেই বেরিয়ে যাবো এখান থেকে।
রুনিয়া সাফওয়ান কে পানি দিচ্ছিলেন, সাফওয়ানের কথা শুনে পানির গ্লাসে পানি ঢালা থামিয়ে তিনি সাফওয়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— আর কটা দিন থেকে গেলে হতো না? এখন তো কোনো সমস্যাই নেই আর৷ আর একটা সপ্তাহ থেকে যা অন্তত!
সাফওয়ান খেতে খেতে বলল,
— মা, লিন্ডা ওখানে একা আছে, ওকে আমি আর রিমু ছাড়া কেউ সামলে রাখতে পারে না। জোনাস যা একটু ওর কাছে যায়, বাকিরা কেউ ভয়ে ওর ধারে কাছেও ঘেঁষে না। আর সাদমান শাহমীরের স্কুল আছে। বেশ কিছুদিন গ্যাপ গেলো ওদের। তাছাড়া, আমার বিজনেস আছে ওখানে৷ ওরা আর কত সামলাবে বলো! এইকয়েকদিনে কত শতবার ফোন দিয়েছে ওরা আমাকে তার হিসাব নেই। তবে তুমি চিন্তা করো না। আমরা দুতিন মাস পর পরই দেশে এসে ঘুরে যাবো, আর এবার আসলে একটু বেশি দিন থাকার প্রস্তুতি নিয়েই আসবো। আর এর পরেরবার এসে তোমাকে আর বাবাকে আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। তাই মন খারাপ কোরো না! এখন তুমি রাশা কে সামলাও, আমি রিমু কে নিয়ে একটু ঘুরে আসি বাইরে থেকে।
রুমাইশা সাফওয়ানের কথা শুনছিলো এতক্ষন, শেষের কথা টা শুনেই ও সাফওয়ানের দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো,
— আমি কোথাও যাবো না!
রুনিয়া রুমাইশার এমন কণ্ঠস্বর শুনে চমকালেন, আজ পর্যন্ত কখনো রুমির এমন কণ্ঠস্বর তিনি শোনেননি। পাশে বসা সাফওয়ানের দিকে একটু ঝুকে গিয়ে তিনি ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— হ্যা রে? কি হয়েছে ওর?
সাফওয়ান নিজেও মায়ের মতো করে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো,
— তোমার বউমা রাগ করেছে, ওকে একটু আমার সাথে বাইরে বেরোতে রাজি করিয়ে ফেলোতো মা!
রুনিয়া আবার সোজা হয়ে বসলেন, তারপর গলা খাকারি ফিয়ে বললেন,
— কি রে রুমি? যাবি না কেন? দে, রাশা কে আমার কাছে দে, দিয়ে তুই রেডি হয়ে আয়৷ আর কবে দেশে আসবি তার ঠিক নেই, একটু ঘুরে আয়, ভালো লাগবে৷
বলে তিনি সোফা থেকে উঠে রুমাইশার কোল থেকে রাশা কে নিলেন। রুমাইশা সবার অলক্ষ্যে সাফওয়ানের দিকে কটমট করে তাকালো। রুনিয়া বললেন,
— সন্ধ্যা হয়ে গেলো, তাড়াতাড়ি উঠ, উঠে রেডি হয়ে নে। সকাল সকাল ফিরে আসিস।
রুমাইশা রুনিয়ার কথায় বাধ্য মেয়ের মতো সোফা থেকে উঠে সিড়িতে উঠলো, তারপর চলে গেলো ছাদের দিকে। রুমাইশা চোখের আড়াল হতেই রুনিয়া সাফওয়ানের দিকে ফিরে চোখ টিপ মারলো। শাফিনের সাথে কুস্তিরত সাদমান বলে উঠলো,
— মাম্মাম তাহলে শুধু দাদিমার কথা শোনে! এখন থেকে মাম্মাম আইসক্রিম খেতে দিতে না চাইলেই তোমার কাছে ফোন দিবো দাদিমা! তুমি মাম্মাম কে বলে দিবে আমাদের আইসক্রিম দিতে। বাবা বললে মাম্মাম শোনে না।
.
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামার পায়তারা করছে৷ সাফওয়ান ড্রাইভ করছে একমনে। পাশে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে রুমাইশা। পরণে ওর কালো সাদা মিশেলের মসলিনের সালওয়ার কামিজ। ওড়না টা বুকের ওপর দিয়ে কাধের দুপাশে তুলে দেওয়া। মেরুন রঙা চুল গুলো বেনি করে ছেড়ে দেওয়া পিঠের ওপর৷ হাতে দু গাছি চুড়ি, চুড়ির স্টোন গুলো চকমক করছে। কানে ছোট ছোট এক জোড়া ঝুমকা। ঠোটে সামান্য ভেজলিন ঘসে দিয়েছে৷
সাফওয়ান ড্রাইভ করছে আর মাঝে মাঝে আড়চোখে রুমাইশা কে দেখছে। রুমাইশা ওর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। নিরবতা ভেঙে সাফওয়ান জিজ্ঞেস করলো,
— রিমু, কোথায় যাবে তুমি? বলো আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।
— যে জোর জবরদস্তি করে বাইরে নিয়ে এলো সে জানেনা কোথায় নিয়ে যাবে তা?
জানালার দিকে মুখ করেই কাটাকাটা উত্তর দিলো রুমাইশা। সাফওয়ান ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর হাকিয়ে নিয়ে চলল গাড়ি দড়াটানার দিকে।
দড়াটানায় পৌছে গাড়িটা পার্কিং স্পটে রেখে গাড়ি থেকে বের হলো সাফওয়ান, তারপর অন্যপাশ থেকে রুমাইশা কে হাত ধরে বের করে আনলো ও৷ তারপর রুমাইশা কে বলল,
— আমার বউ এর কি হেটে হেটে রাতের শহর দেখতে কোনো অসুবিধা আছে?
রুমাইশা সাফওয়ানের সে প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। সাফওয়ানের দিকে এক পলক তাকিয়ে হাটা ধরলো সামনের দিকে। ঠোঁট চেপে হেসে সাফওয়ানও গেলো ওর পেছন পেছন।
সে রাতে সমস্ত দড়াটানা বাজার ঘুরলো ওরা। বাজারের ভেতর যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মন ভালো হয়ে গেলো রুমাইশার। সমস্ত অলিগলি ঘুরে দেখলো দুজনে। চোখের দেখায় যেটাই ভালো লাগলো কিনলো রুমাইশা। সাফওয়ান ফুল কিনলো ওর জন্য অনেক অনেক গুলো। বাসার সবার জন্য হালকা পাতলা নাস্তা আর ছোটখাটো গিফট নিলো ওরা। রাতের খাবার টা বাইরেই খেয়ে নিলো দুজনে।
এরমধ্যে আবার ওদের কে চিনতে পেরে বাজারের লোকজন ভিড় জমালো ওদের কে ঘিরে। কথা বলতে আসলো ওদের সাথে অনেকে, অনেকে সাফওয়ানের সাথে সেলফি নিলো। তখন সাফওয়ানের মুখ খানা দেখার মতো ছিলো। রুমাইশা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো সাফওয়ানের এই নাকানিচুবানি খাওয়া অবস্থা দেখে৷
রুমাইশার স্মিত হাসি একসময় খিলখিল হাসিতে রূপ নিলো৷ দুজনে মিলে বাজার ঘাট সব চষে এসে, হাসি আড্ডা দিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে, ঘুর ঘুর করে আবার গাড়িতে করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
১০৯. আজ ওদের ফ্লাইট। কাল রাতে সব ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়েছে ওরা৷ চিলেকোঠার কামরায় রুমাইশা আর সাফওয়ান রেডি হচ্ছে। সাদমান আর শাহমীর আগে ভাগেই রেডি হয়ে নিচে চলে গেছে। বাড়ির অন্যরা সবাই নিচে আছেন। ও বাড়ি থেকে সবাই এসেছে ওদের বিদায় দিতে।
রাশা কে একটু আগে সানিয়া এসে নিয়ে গেছে রেডি করে দিতে। রুমাইশা এখন চুল বাধছে। ফুল স্লিভ টি শার্টের সাথে ব্যাগি প্যান্ট পরনে ওর, তার সাথে চুল গুলো মাথার ওপরে মেসি করে খোপা করে নিলো। মুখে মেকআপের হালকা আবরণ দিয়ে নিলো ও। সাফওয়ানের পরনে একটা আর্মি রঙা শার্ট, তার সাথে চারকোল রঙা প্যান্ট। রেডি হয়ে ও বসে আছে বিছানায়, রুমাইশার রেডি হওয়ার অপেক্ষায়।
রুমাইশার হয়ে গেলে চিলেকোঠার কামরার দরজা টা লক করে দুজনে একসাথে বেরোলো ওরা। লাগেজ আর ব্যাগ গুলো শাফিন আগেই গাড়িতে তুলে দিয়ে এসেছে। গাড়ি নিয়েই আবার ফিরবে ওরা৷
সাফওয়ান আর রুমাইশা নিচে পৌছালে সবাই ওদের দিকে তাকালো। দুজন কে একসাথে দেখলেই যেন চোখ জুড়িয়ে যায়! রুমাইশা এগিয়ে গেলো আয়েশার কাছে, গিয়ে আয়েশার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলল,
— আমরা আবার আসবো মা, কিছু দিন পরেই। তুমি মোটেও মন খারাপ করো না। আর বাবার দিকে খেয়াল রেখো। আর নিজেও ওষুধ গুলো ঠিকমতো খেয়ো। আমি ফোন করবো এখন থেকে নিয়মিত।
আয়েশা মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখ মুছলেন শাড়ির আচলে। বিনিময়ে রুমাইশা তার মাকে এক চিলতে হাসি উপহার দিলো। এরপর শামসুল, রাফসান আর রাফসানের বাচ্চাদের থেকে বিদায় নিয়ে রুমাইশা গেলো রুনিয়ার কাছে, গিয়ে বলল,
— ফুপ্পি, তুমি আমার ফুপ্পির চাইতেও অনেক বেশি কিছু। তুমি আমাকে আমার মায়ের মতোই ভালোবাসা দিয়েছো সবসময়, তোমার এ ভালোবাসা কখনো শোধ হবার নয়। নিজের খেয়াল রেখো, বাবাকেও দেখে রেখো। আর আমাদের জন্য একদম চিন্তা করো না। আমি রোজ ফোন দিবো, ভিডিও কল করবো। মন খারাপের কোনো কারণ নেই। আর আমরা খুব শিগগিরই আবার ফিরবো। তখন অনেক গুলো দিন থেকে যাবো, কেমন?
রুনিয়া চোখের কোণে পানি নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়ালেন। রুমাইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— তুই সারাজীবন সুখে থাকিস রে মা! আমার ছেলে টাকে আগলে রাখিস আগের মতো করেই। আমার ছেলেটা তোকে ছাড়া কিছুই বুঝে না৷ আর বাচ্চাদের সাথে আমার কথা বলিয়ে দিবি রোজ! এতগুলো দিন ওরা আমার সাথে ছিলো! ওদের কে ছেড়ে আমি এখন কিভাবে থাকবো!
বলতে বলতে ফুপিয়ে কেদে উঠলেন রুনিয়া৷ সাদমান আর শাহমীর দাদিমার কান্না শুনে সোফা থেকে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রুনিয়া কে, তারপর শাহমীর বলল,
— দাদিমা, তুমি একটুও চিন্তা করোনা! আমি আর শাহমীর প্রত্যেকদিন তোমার আর দাদুর কাছে ফোন করবো, রাশার সাথেও কথা বলিয়ে দেবো। তোমার মনেই হবে না যে আমরা অতো দূরে আছি, একদম কাছে কাছে থাকবো। কেদোনা তুমি দাদিমা!
রুমাইশা আর সাফওয়ান দুজনে এক অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ সাফওয়ান বিদায় নিতে গেলো আয়েশা শামসুলের কাছে। শামসুল তাকে বললেন,
— সাফওয়ান, বাবা! আমার মেয়েটা তোমার কাছেই সবচেয়ে বেশি ভালো থাকবে আমি জানি, তারপর ও বলছি, ওকে তুমি যত্নে রেখো! আমার মেয়েটা যদি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কাউকে ভালোবেসে থাকে, বিশ্বাস করে থাকে, তবে সেটা তুমিই। ওর সে ভালোবাসা, বিশ্বাসে কখনো আচড় লাগতে দিও না। আর নিজের খেয়াল রেখো!
সাফওয়ান শামসুলের কথায় মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল,
— জ্বি মামা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে আপনি যতটা যত্নে রাখতেন তার চাইতে আমি বেশি বৈ কম রাখবো না! এ বিশ্বাস আপনি আমার ওপর রাখতে পারেন।
শামসুল সাফওয়ানের কথাতে সন্তুষ্টচিত্তে মাথা নাড়ালো। শাফিন আর সানিয়ার সাথে কিছুক্ষণ খুনসুটি করে, সবার থেকে আবার ও বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ওরা। ওদের পেছন পেছন এলো বাড়ির সকলে।
সাদমান, শাহমীর কে গাড়ির পেছনের সিটে বসিয়ে, রাশা কে ওদের মাঝখানে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো সাফওয়ান৷ তারপর রুমাইশা কে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজেও এসে বসলো ড্রাইভিং সিটে। অতঃপর সবার থেকে আবারও একবার বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লো ওরা৷
১১০.
দীর্ঘ আটারো ঘন্টার জার্নির পর ওরা এসে পৌছালো ওদের আবাসস্থল, আমাজনের গভীরে অবস্থিত বিলাসবহুল বাড়ি, এস এস আর প্যালেসে।
সবুজ গাছপালা ঘেরা বিরাট এরিয়ার ভেতরে, বিশাল আকারের এক ঝাক জেনারেল শারম্যান ট্রি এর ঠিক মাঝ বরাবর অবস্থিত বিশাল বাড়িটির চারপাশে একটা বিশাল এরিয়া নিয়ে ওয়াল তুলে দেওয়া, বন্য প্রাণীর হঠাৎ উপস্থিতি থেকে বাচার জন্য।
ওরা যখন পৌছালো তখন প্রায় শেষ বিকেল। আন্ডার গ্রাউন্ড লেন দিয়ে ওরা পৌছালো ওদের বাড়িতে। প্রাচীরের ভেতরেই নিজেদের স্পেশাল কিছু পোষা প্রাণি রাখার জন্য প্রাচীর টা এতো বড় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো রুমাইশা।
প্রাচীরের ভেতর থাকা জঙ্গলের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে হরেক রকমের বন্য বিড়াল, বেশ কয়েকটা জাগুয়ারের বাচ্চা, কতকগুলো ক্যাপিবেরা। কয়েক প্রজাতির বানরের বাচ্চা লাফালাফি করছে গাছের ডালে ডালে, কিছু অ্যান্ট ইটার আর স্লথ ও আছে সেখানে। আর বন্য পাখির তো কোনো শেষ নেই। তাদের কলকাকলীতে মুখোরিত হয়ে আছে আশপাশ টা।
প্রাচীরের ভেতরে, বাড়ির পেছন দিকে, পূর্বপাশের বেশ অনেক খানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান করেছে রুমাইশা, তাতে ফুটে আছে জানা অজানা হরেক রকমের ফুল। অধিকাংশই ওর সংগ্রহ করা ফরেস্টের ভেতর থেকেই, আর বাকি গুলো শহর থেকে সাফওয়ান নিয়ে এসেছে৷
ফুলের বাগানের অন্যপাশে ফলের বাগান করা৷ সেখানেও নাম না জানা ফল গাছের ছড়াছড়ি। রুমাইশার হাতের ছোয়ায় একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে এ গুলো।
আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার রাস্তা দিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠে একে একে প্রবেশ করলো ওরা। প্রথমেই ঢুকলো রুমাইশা, ওর পেছনে বাচ্চারা, তার পর সাফওয়ান, সাফওয়ানের কোলে রাশা।
মাটির ওপরে থাকা মেটালের দরজা টা ঠেলে উঠে এলো রুমাইশা। আর উঠতে না উঠতেই দূর থেকে ভেসে এলো এক হিংস্র হিস হিসে গর্জন। সে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে লিন্ডা’ বলে ডাক দিলো রুমাইশা। আর মুহুর্তেই সড়সড় শব্দ করে সেই দূর থেকে ছুটে আসতে থাকলো বিশালাকৃতির লিন্ডা। এত গুলো বছরে তার আকার আর শক্তি দুইটাই বেড়ে গেছে বহুগুণে।
ততক্ষণে বাচ্চারা আর সাফওয়ান ও উঠে এসেছে ওপরে। লিন্ডা এসেই কুন্ডুলি পাকিয়ে রুমাইশা কে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে, তারপর রুমাইশার মুখের সাথে মাথা ঘষে জানান দিলো নিজের তীব্র ভালোবাসার। এরপর রুমাইশা কে ছেড়ে সাফওয়ানের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো ও৷ এরপর বাচ্চাদের সাথে কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করলো।
রাশা অনেক ছোট বলে ওর ব্যাথা পাওয়ায় ভয়ে লিন্ডা ওকে মোটেও স্পর্শ করে না। তবে রাশার সেইফটির ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকে সে।
লিন্ডার সাথে সাক্ষাৎ শেষে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো ওরা৷ সাদমান আর শাহমীর রাশা কে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। রুমাইশা গেলো ওর আর সাফওয়ানের বেডরুমে আর সাফওয়ান ফ্রেশ না হয়েই চলে গেলো ল্যাবে। ওদিকে কি অবস্থা সেটা দেখা খুবই জরুরি৷
রুমে ঢুকে পরণের পোশাক বদলে রুমাইশা পরে নিলো একটা ঢোলাঢালা ট্রাউজার আর একটা হাফ হাতা ওভার সাইজ টি শার্ট। তারপর ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কিচেনে ঢুকলো।
সাদমান শাহমীর এত লম্বা সময়ের জার্নির পর ও ক্লান্ত হয়নি, নিজেদের রুমে রাশা কে নিয়ে খেলছে ওরা আর হৈ-হুল্লোড় করছে। রুমাইশা চাইল্ড মনিটর ক্যামেরায় দেখছে ওদের আর রান্না করছে। অল্প সময়ের ভেতরেই রাতের খাবার প্রস্তুত করে ফেললো ও৷ সাদমান শাহমীরের জন্য এক খাবার, রাশার জন্য এক খাবার আর ওর আর সাফওয়ানের জন্য এক খাবার।
রান্না শেষ হতে না হতেই কলিংবেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো। রুমাইশা সিকিউরিটি ক্যামে দেখে নিলো সাফওয়ান এসেছে, ক্লান্তিতে চোখ জোড়া ছোট হয়ে এসেছে ওর৷ খাবার দাবার গুলো ওভাবে রেখেই ও চলে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই ক্লান্তিতে বিধস্ত সাফওয়ান এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো রুমাইশা কে৷ এটা ওর রোজকার অভ্যাস।
রুমাইশা সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরেই আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর সাফওয়ান কে ওভাবে নিজের সাথে জড়িয়েই হেটে চলল ও ভেতরের দিকে৷ তারপর বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে সাফওয়ান কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বসিয়ে দিলো সোফায়৷ তারপর হাওয়ার গতিতে চলে গেলো বাইরে৷
সাফওয়ান বসে বসে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো একটা একটা করে। কিছুক্ষণ বাদেই রুমাইশা আবার এলো হাতে একটা ট্রে তে করে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবু পানির মিশ্রণ নিয়ে। সাফওয়ানের সামনে সেটা রেখে দিয়ে সাফওয়ানের আধা খোলা শার্টের বাকি বোতাম গুলো খুলে দিয়ে শার্ট টা সাফওয়ানের গা থেকে খুলে নিয়ে রেখে দিলো ও বিনে৷ তারপর সাফওয়ানের ঝাকড়া চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
— ফ্রেশ হয়ে আসো এখনি, খাবার দিচ্ছি আমি। খেয়ে সকাল সকাল ঘুমাতে হবে আজ৷
সাফওয়ান তাকালো রুমাইশার দিকে বাচ্চাদের মতো চোখ করে, নিচের ঠোঁট টা আস্তে করে ফুলিয়ে দিলো। রুমাইশা সেদিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলে উঠলো,
— ওসব পরে হবে, আগে রেস্ট করো! মাথায় শুধু আজে বাজে জিনিস ঘুরে সবসময়৷
বলেই মুখ ঝামটা মেরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো রুমাইশা। সাফওয়ান ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো।
.
খাওয়া দাওয়া সেরে, সাদমান, শাহমীর আর রাশা কে নিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে এলো ওরা। বাচ্চারা বায়না ধরেছে কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর ঘুমাবে৷ তাই বেজার মুখে সাফওয়ান বাচ্চাদের কে নিয়ে এলো ওদের রুমে।
রুমাইশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিলো, আর সাফওয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুমাইশার দিকে।
বিছানায় আগে উঠে বালিশ টা কাত করে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো রুমাইশা। সাদমান আর শাহমীর হুটোপুটি করে উঠে এলো বিছানায়। এসেই মায়ের বুকের দুপাশ দখল করে নিলো দুজন৷
দুইভাই কে এমন হুটোপুটি করতে দেখে সাফওয়ানের কোলে থাকা রাশা আনন্দে দুই পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে মুখ দিয়ে আনন্দ সূচক ধ্বনি বের করতে লাগলো। নিজেও বিছানায় গিয়ে হুটোপুটি করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো মায়ের দিকে। সাফওয়ান হতাশ দৃষ্টিতে রুমাইশার দিকে একবার তাকিয়ে রাশা কে নামিয়ে দিলো কোল থেকে৷ রাশা দ্রুত পায়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে মায়ের পেটের ওপর গিয়ে উঠে বসলো।
সাফওয়ান মুখ অন্ধকার করে বলল,
— এবার আমি কোথায়?
রাশা মায়ের পেটের ওপর বসে বসে বাবাকে আঙুল দিয়ে জায়গা দেখিয়ে দিলো৷ রুমাইশা সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বলল,
— ওই দেখো, তোমার মেয়ে জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছে, আসো, আমার পায়ের ওপরে!
সাফওয়ান বিছানায় উঠে রুমাইশার পেটের ওপর থেকে রাশা কে নিয়ে নিজের বুকে রাখলো তারপর রুমাইশার উরুর ওপর মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ও৷ রুমাইশা সাফওয়ানের চুল গুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে সাদমান আর শাহমীর কে দুহাতে জড়িয়ে নিজের বুকে চেপে ধরলো।
সাদমান আর শাহমীর মা কে জড়িয়ে ধরে গল্প বলার জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলো৷ রুমাইশা ভ্রু তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমার এখন কথা বলতে মোটেই ইচ্ছা করছে না! তোমাদের বাবাকে বলো গল্প বলতে!
সাদমান শাহমীর এবার সাফওয়ান কে ধরলো গল্প বলার জন্য। সাফওয়ান রাশা কে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো, বউ এর এ কূটকচালে চোখ খুলা তাকালো ও। তারপর সাদমান আর শাহমীর কে বলল,
— আমি তো গল্প পারিনা বাবা রা! তোমাদের মাম্মাম পারে, সব ধরনের গল্প৷
রুমাইশা হেসে সাদমান শাহমীর কে ডেকে বলল,
— তাহলে গান গাইতে বলো তোমাদের বাবাকে, তিনি এত সুন্দর গাইতে পারেন, কিন্তু আমাদের কখনো শোনান না!
তারপর সাফওয়ান কে গুতা মেরে বলল,
— গল্প না পারো গান তো গাইতে পারবে, পারবে না?
সাফওয়ান গা কাপিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। সাদমান শাহমীর এবার বাবাকে পিড়াপিড়ি করতে লাগলো গান গাওয়ার জন্য। সাফওয়ান ওদের কে বলল,
— গাইতে পারি, তবে গান গাওয়ার পর তোমাদের বোন কে নিয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে যেতে হবে, ডিল?
সাদমান শাহমীর অতি উৎসাহের সাথে নেচে বলে উঠলো
— পাক্কা ডিল!
সাফওয়ান রুমাইশার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো, বিনিময়ে রুমাইশা ওকে ফেরত দিলো কটমটে চাহনি।
সাফওয়ান গান ধরলো,
— এই আলো হাওয়ার মায়া কাটিয়ে
এই জগৎ বাড়ির মায়া কাটিয়ে,
চলে যাবো ভাবতেই,
চোখ ভরে আসে।
এই ভালো মন্দেও ভালো থাকা,
প্রিয় মুখগুলো বুক জাপটে রাখা,
ফেলে যাবো ভাবতেই
চোখ ভরে আসে।
মৃত্যুই সারসত্য জেনে,
শিখেছি জীবন ভালোবাসতে।
অপ্রাপ্তি বৃত্ত মেনেই,
ব্যথাটা লুকায় পারি হাসতে।
এই ভালো মন্দেও ভালো থাকা,
প্রিয় মুখগুলো বুক জাপটে রাখা,
ফেলে যাবো ভাবতেই চোখ ভরে আসে।
রেখে যাবো সংসার এ গান,
এই পিছুটান, কি করে ছাড়বো?
ছেলেটাকে বুকেতে জড়ায়,
গাল ভরে চুমু কি খেতে পারবো?
এই পথভ্রমণ পাঠ সরবে,
বিস্মৃতির অতল গর্ভে,
হারাবো ভাবতেই,
চোখ ধরে আসে।
#সমাপ্ত
( আপনাদের সাথে সাফওয়ান রিমুর পথচলা এখানেই শেষ। গল্পটার মাঝে থাকা ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, খাপছাড়া হওয়া অংশ গুলো একটু মানিয়ে নিবেন। প্রথম থেকেই যারা গল্পটার সাথে ছিলেন তাদের জন্য সাফওয়ান রিমুর তরফ থেকে এত্ত এত্ত ভালোবাসা। 💙💙💙)