স্তব্ধ হয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে আছেন আয়েশা, শামসুল আর রাফসানেরা। সাফওয়ান আহমেদ নাম টা শোনা মাত্রই বুক কেঁপে উঠেছে ওদের সবারই। হতচকিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে ওরা বার বার৷ রাফসানের যেন দম আটকে আসছে। ও আয়েশার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
— মা, আমি রুমির কাছে যাচ্ছি। এখন যা কিছু হয়ে যেতে পারে! কি হতে পারে সেটা আমি জানিনা! তবে আমার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে। ওইখানে রুমির বাচ্চারা আছে, ওদের কিছু না হোক!
বলেই সোফা থেকে উঠে দাড়ালো রাফসান। আয়েশা শাড়ির আচল টেনে মুখের ওপর দিলেন। যে সত্য এত গুলো বছর ধরে লুকায়িত ছিলো সেই সত্য আবার টেনে হিচড়ে বের করে এনেছে ওরা! এখন কি হবে! এখন তো অস্বাভাবিক তার মেয়ের জামাই একা না, তার মেয়েও! এ কথা মানুষ জানলে কি হবে! মানুষ গুলো তো সময়ে সময়ে অমানুষ হয়ে যায়৷ গতানুগতিক ধারায় নিজেদের কে ভাসিয়ে দেয়, ভালো মন্দ বিচার করার ফুরসত তখন তাদের থাকে না! কি হবে এখন?
রাফসান দ্রুত পা ফেলে নিজের কামরায় গিয়ে তড়িঘড়ি করে গায়ের ওপর শার্ট চড়িয়ে নিলো। তারপর কোনো রকমে গোছগাছ করে ও রুমি দের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ডাইনিং রুমে এসেই দেখে আয়েশা গায়ে বোরখা চড়িয়ে বসে আছেন৷ রাফসান বাইরে এলেই তিনি ধরা গলায় বললেন,
— আমিও যাবো। আমার মেয়েকে আমি এই অবস্থায় একা ছাড়বো না। তুই আমাকেও নিয়ে চল।
রাফসান একবার মানা করতে চাইলো৷ সেইখানের পরিবেশ পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় জানা নেই ওর৷ সেখানে মা কে নিয়ে গিয়ে সে কি করবে! কিন্তু মায়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে ও আর কিছু বলতে পারলো না। মুখে বলল,
— ঠিক আছে আসো।
শামসুল স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন সোফার ওপরে, তার শরীর টা ভালো নেই, বৃদ্ধ বয়সের নানা রোগে তাকে জর্জরিত করে ফেলেছে। চাইলেও মেয়ের এই অসময়ে সে যেতে পারছে না। আফসানা বাচ্চা দুটোকে কোলে নিয়ে সোফার ওপরে বসে তাকিয়ে আছে রাফসান আর আয়েশার যাওয়ার পানে। বুক টা দুরুদুরু করছে তার অজানা কোনো বিপদের আশঙ্কায়!
১০৮. কনফারেন্স রুমে পিনপতন নিরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। সাংবাদিক দের কলম চালানোর শব্দ ও আসছে না আর৷ আহনাফ হাসান নিজের কথা শেষ করে সাংবাদিক দের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর সাংবাদিকেরা তাকিয়ে আছে তার দিকে৷
সেই দিনের সেই সাফওয়ান আহমেদ যে আজ এত স্ট্রাগল এর পরেও হাল না ছেড়ে দিয়ে নিজের অবস্থানটা আরও আরও আরও শক্ত করে বর্তমানে বহাল তবিয়তে আছে সেটা ভেবেই ওদের চোখ কপালে উঠছে। সাফওয়ান আহমেদ কে তারা তো সবাই ভুলেই গেছিলো! সে কিডন্যাপ হওয়ার পর তো কেউ কখনোই তার নামটাও উচ্চারণ করেনি, এত বিতৃষ্ণা ছিলো তার প্রতি মানুষের! আর এই মুহুর্ত টার আগেও কারোর মনেই ছিলো না সেই ব্যাক্তি টার কথা, যাকে তারা অবহেলায় ঠেলেছিলো একসময়ে!
নিরবতা ভেঙে আহনাফ হাসান উপস্থিত সাংবাদিক দের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লেন,
— ন্যাও, ডাজ এন্যিওয়ান হ্যাভ এনি কুয়েশ্চন?
সাংবাদিক দের থেকে কোনো উত্তর এলো না। ওরা সবাই এখনো ব্যাপার টা হজম করতে ব্যাস্ত। আহনাফ হাসান প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সাংবাদিক দের একজন মুখ খুললো, বলল,
— স্যার, সাফওয়ান আহমেদ এখন কোথায় আছেন সে বিষয়ে আপনি কিছু জানেন? আর আপনি যদি জেনে থাকেন তবে আমরা কি জানতে পারি? আমরা তার সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই এই ব্যাপারে।
আহনাফ হাসান একটু ভড়কালেন যেন৷ এতক্ষন সব ঠিকঠাকই এগোচ্ছিলো, কিন্তু এখন এরা সাফওয়ানের ঠিকানা জিজ্ঞেস করছে! জনগনের মনের অবস্থা কি সেটা এখনো বোঝার উপায় নেই। তারা এই ব্যাপার টা কিভাবে গ্রহন করেছে, বা আহনাফ হাসানের কথা বিশ্বাস করেছে কিনা সেটাও ঠাহর করা যাচ্ছে না এইমুহূর্তে।
আহনাফ হাসান নিজের মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন একটা রিস্ক নেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন,
— সাফওয়ান আহমেদ এখন তার পৈতৃক নিবাস, আহমেদ ভিলাতেই আছে, তার পরিবারের সাথে। আপনারা চাইলে সেখানে গিয়ে তার সাথে কথা বলতে পারেন, যদি সে অনুমতি দেয় তবে৷
সাফওয়ান সহ অন্য সবাই মিলে এতক্ষন টেলিভিশনের সামনেই বসে ছিলো। সাংবাদিক রা সাফওয়ানের সাথে কথা বলতে চায় শুনেই সাফওয়ান রুমাইশার দিকে এক পলক তাকিয়ে বসা থেকে উঠে চলে গেলো ছাদের দিকে, ওর চিলেকোঠার কামরার উদ্দ্যেশ্যে। যাওয়ার আগে বলে গেলো ও কারো সাথেই এইসব বিষয়ে কথা বলতে চায় না, ওকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
রুমাইশা চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু ওর যাওয়ার পানে, আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সাফওয়ান কিছুই ভোলেনি সেইসব দিনের কথা! সেই সময়ে সে এই দেশে না থাকলেও রুমাইশার থেকে সে সবই শুনেছে। আর সেসব ঘটনা গুলো তার মনে দাগ কেটে গেছে! হারিয়ে যাওয়া রুমাইশা কে পর্যন্ত তখন এরাই খুজতে দেয়নি, ভেসে যেতে দিয়েছে! সেই আবেগে গা ভাসানো, কোনো কিছু বিবেচনা না করে স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে চলা লোকগুলোর প্রতি সাফওয়ানের তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণা কে কিভাবে প্রশমিত করা যায় তা তার জানা নেই৷
রুমাইশা মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখের সামনে ওর ভাসছে সেইসব দিন গুলোর স্মৃতি৷ সাফওয়ান কে হারবার্টের লোকজনের তুলে নিয়ে যাওয়ার সেই অভিশপ্ত দিন টার কথা মনে পড়লেও ওর গায়ে কাটা দেয় এখনো! সাফওয়ান চলে যাওয়ার পর এই দেশের মানুষের করা কটুক্তি গুলো এখনো তার কানে বাজে!
ওরা আমাজনে চলে যাওয়ার পর এখানে শাফিন টা বের হতে পারতো না ঘর থেকে! লোকজম রাস্তায় দেখা হলেই আজেবাজে কথা বলতো ওকে। বন্ধুরা ওকে জানোয়ারের ভাই বলে ডাকতো! ইশতিয়াক আহমেদ এতসব চিন্তা, টেনশনের কারণে স্ট্রোক পর্যন্ত করলেন, কিন্তু তখনও পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় রুমাইশা রা এসবের কিছুই জানতে পারেনি!
আর এরপর সাদমান শাহমীর পেটে থাকা কালিন আমাজনের ভেতর একাকি থাকার সেই সমস্ত ভয়ঙ্কর দিন গুলো! সেসবের কথা কিভাবে ভোলা যায়!
টেলিভিশন বন্ধ হওয়ার পর ও সবাই ওইভাবেই বসে আছে৷ কেউ একচুলও নড়েনি নিজের জায়গা থেকে৷ সবার দৃষ্টিই মেঝের দিকে। সাদমান শাহমীর বসে আছে তাদের মায়ের দু পাশে, রাশা বসে আছে রুমাইশার কোলের ভেতর, ওরাও চুপচাপ। কি হচ্ছে সেটা বুঝতে না পারলেও গুরুতর কিছু যে হচ্ছে সেটা ঠিকই বুঝতে পারছে ওরা!
খানিক্ষন পর হঠাৎই বাইরে শোরগোল শোনা গেলো। অনেক মানুষের সমস্বরে বলা কথাবার্তা কানে আসতে লাগলো রুমাইশার। চমকে উঠলো ও৷ আতঙ্কিত চোখে শাফিনের দিকে তাকালো একবার, শাফিন ওর এই দৃষ্টি লক্ষ্য করে সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে আপু? তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
শাফিনের কথায় বাকিরাও রুমাইশার দিকে ফিরে তাকালো। রুমাইশা শাফিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
— কারা যেন আসছে শাফিন! এক সাথে অনেক লোক, পায়ের শব্দ শুনছি আমি ওদের, ওদের কথাও শোনা যাচ্ছে। ওরা এদিকেই আসছে!
রুমাইশার কথাতে গলা শুকিয়ে আসলো রুনিয়ার। তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে তিনি সাদমান আর শাহমীরের কাছে এগিয়ে এলেন, তারপর ওদের দুজনের হাত ধরে আতঙ্কিত গলায় শাফিন কে বললেন,
— শাফিন, তুই বাচ্চা দের কে নিয়ে তোর রুমে যা, সানিয়া কেও নিয়ে যা তোর সাথে। মোটেও বাইরে বেরোবিনা। পরিস্থিতি কি হয় বলা যায় না, এখনি যা৷ একটুও দেরি করিস না!
শাফিন মায়ের উদ্বেগ টা বুঝলো। ও বসা থেকে উঠে সোফায় বিধস্ত হয়ে বসে থাকা রুমাইশার কোল থেকে রাশা কে নিলো, তারপর সাদমানের হাত ধরে সানিয়া কে বলল শাহমীর কে নিয়ে ওপরে আসতে, বলেই ও সিড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে দোতলায় উঠে গেলো। সানিয়াও তড়িঘড়ি করে গেলো ওর পেছন পেছন। রুমাইশা মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁত মুখ শক্ত করে বসে রইলো৷ রুনিয়া কে বলল,
— ফুপ্পি, তুমি ফুপ্পা কে নিয়ে ঘরে যাও, আমি এখানেই আছি। দরজা দিয়ে দিও ভেতর থেকে।
রুনিয়া কিছু বলার আগেই ইশতিয়াক ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠলেন,
— আমিও এখানেই থাকবো। আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না৷ ওরা যদি কোনো আঘাত করে তবে সেটা যেন আমার গায়ে এসেই আগে পড়ে। আমার এমনিতেও দিন ফুরিয়ে এসেছে। আমার বড়ছেলেটার জন্য আমি কখনোই কিছু করতে পারিনি। শেষ বয়সে এসে অন্তত কিছু একটা করে যাই! তাহলে হয়তো আমার ছেলে টা কোনো না কোনো দিন বলতে পারবে যে আমার বাবা আমার জন্য কিছু একটা করেছে! আমি এইখানেই থাকবো রুনিয়া। আমার ছেলের শরীরে আঘাত করার আগে ওদের কে আমার শরীরে আঘাত করতে হবে৷
রুমাইশার চোখ জোড়া লোনা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। দুফোটা গড়িয়ে পড়লো চোয়াল বেয়ে। ইশতিয়াক আহমেদের কথার পরে ও আর কোনো কথা বলল না। রুনিয়া ধীরগতিতে এগিয়ে এসে আবারও বসলেন রুমাইশা আর ইশতিয়াকের মাঝখানে। তারপর রুমাইশা কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে ওর কপালে ঠোঁট ছোয়ালেন, এরপর ধরা গলায় বললেন,
— তুই অনেক ভালো মেয়ে রে মা! আমার ছেলেটা জন্মের পর থেকে এখনো অব্দি কোথাও শান্তি পায়নি, একমাত্র তোর কাছে ছাড়া! তুই ছাড়া আমার ছেলে কে আর কেউ বোঝেনি, আমিও না! আমার ছেলেটাও তোকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না! আমার ছেলেটাকে এত সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার জন্য তোর কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো রে মা!
কথা গুলো বলে রুমাইশার একটা হাত নিয়ে তাতে শব্দ করে চুমু খেলেন রুনিয়া। তারপর রুমাইশার মাথাটা টেনে নিজের কাধের ওপর রাখলেন। অপেক্ষায় রইলেন সেই শোরগোল টার কাছে চলে আসার। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে শোরগোল টা বাড়ির গেইটে এসে পৌছালো।
শাফিন সানিয়া আর বাচ্চাদের কে রুমের ভেতরে রেখে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজা দিয়ে দ্রুত পায়ে নেমে এলো আবার হলরুমে। নেমে এসে সেও শুনতে পেলো শোরগোলের শব্দ। আর কিছুক্ষণ পরেই মেইন গেইট খোলার শব্দ পাওয়া গেলো।
রুনিয়া রুমাইশার হাত টা আর ও শক্ত করে চেপে ধরলেন। শাফিন ইশতিয়াকের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো বদ্ধ থাকা মেইন দরজার দিকে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই সব শোরগোল থেমে গেলো। বাইরে টা নিরব হয়ে গেলো। টুকটাক কথা ভেসে আসছে সেখান থেকে। আর এরপরেই বাইরের কলিং বেল টা টুংটাং শব্দ করে বেজে উঠলো। শব্দ শোনা মাত্রই রুনিয়ার কাধ থেকে মাথা তুললো রুমাইশা।
শাফিন এগিয়ে যাচ্ছিলো দরজা খুলে দিতে। কিন্তু রুমাইশা থামিয়ে দিলো ওকে।
— আমি গিয়ে খুলছি, তুই ফুপ্পির পাশে বস।
বলে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো রুমাইশা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। এরপর বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সৃষ্টিকর্তার নাম দিয়ে খট করে দরজার লক খুললো ও। তারপর দুহাতে দরজার হাতল ধরে নিজের দিকে টান দিয়ে খুলদ দিলো দরজাটা।
দরজা খুলতেই ওর চোখে পড়লো প্রৌঢ় এক মহিলা কে, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে। তার পেছনে উৎসুক নারী পুরুষের ভিড়, ইতিউতি করে চেয়ে দেখেছে রুমাইশা কে। রুমাইশা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো, মহিলা টাকে জিজ্ঞেস করলো,
— জ্বি, বলুন! কাকে চাই?
সামনে এমন সুন্দর গড়নের মেয়েটিকে দেখে মহিলা একটু চমকালেন, তারপর আগের মতো হাসিমুখেই বললেন,
— আমাদের বাসা আশেপাশেই। শুনলাম সাফওয়ান বাবা বাসায় এসেছে নাকি! তাকে আমরা সেই ছোট্ট বেলায় দেখেছি, এরপর আর দেখিনি, তাছাড়া, সে কখনো কারো সামনেও আসতো না, আজ এতদিন পর সে এই বাড়িতে এসেছে শুনে আমরা দেখতে এলাম! কিন্তু তুমি কে গো মা?
রুমাইশা মুখের ওপর থেকে কাঠিন্যতার ছাপ সরিয়ে নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করে বলল,
— আমি সাফওয়াম আহমেদের স্ত্রী, রুমাইশা কাদের!
ভদ্র মহিলা টি ঝিলিক দিয়ে হাসলেন এবার, তারপর রুমাইশার ডান হাতটা ধরলেন নিজের হাতে, তারপর পেছনে থাকা প্রতিবেশী দের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
— আরে, দেখো, আমাদের সাফওয়ানের বউ, কত্ত সুন্দর দেখতে! মা শা আল্লাহ!
প্রতিবেশিদের ভেতর রুমাইশা কে নিয়ে ছোটখাটো শোরগোল পড়ে গেলো। রুমাইশা ল্যাব থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ওকে খোজার জন্য যখন পুলিশ লাগানো হয় শুধুমাত্র তখনই এলাকাবাসী টের পেয়েছিলো যে সাফওয়ান বিয়ে করেছে, তার বউ আছে। এর আগে কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি। আর সাফওয়ানের বউ দেখার সৌভাগ্য ও কারো হয়নি।
শাফিনের বিয়ের পর সানিয়া কে সবাই দেখতে আসলেও সাফওয়ানের বিষয়ে কেউ কোনো কথা উচ্চারণও করেনি সেদিন। এতগুলো বছরের হারিয়ে যাওয়া ছেলের কথা মনে করিয়ে কেউ আর রুনিয়া কে কষ্ট দিতে চায়নি ওই আনন্দ পূর্ণ মুহুর্তের মাঝে৷
ভদ্রমহিলা আবার রুমাইশার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস কিরলেন,
— তোমার শাশুড়ী মা কোথায় মাগো?
ততক্ষণে শাফিন ও এগিয়ে এসেছে রুমাইশার পেছনে৷ ও এসেই বলল,
— সালমা কাকি! আপনি এইসময়ে, এইখানে!
সালমা বললেন,
— তোমার ভাইকে দেখেতে এসেছি আমরা! তাকে একটু ডাকো! তোমাদের রহিম কাকা আমাদের সবাইকে ডেকে ডুকে নিয়ে এসেছেন, সাফওয়ান কে দেখার জন্য। তাকে একটু আমাদের সামনে আসতে বলো তো বাবা! ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, তাকে একবার চোখের দেখা দেখে যাই! নাকি আজকেও সে আসবে না!
রুমাইশা শাফিনের দিকে চকিতে এক পলক তাকালো। কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না ও। সাফওয়ান স্পষ্ট করে বলে গেছে কেউ যেন ওকে ডিস্টার্ব না করে, কারো সাথে ও কোনো রকম কথা বলতে চায় না! তাহলে এখন কি করবে!
রুমাইশা ভেবে চিনতে কিছু একটা বলবে, তার আগেই রাস্তা থেকে শো শো করে কয়েকটা গাড়ি এসে দাড়ালো মেইন গেইটে৷ তারপর সে গাড়িগুলো থেকে সাংবাদিক দের একটা বিশাল দল নেমে এলো হুড়মুড়িয়ে। আর তার পেছনেই এলো একটা পুলিশের গাড়ি, সেখান থেকে নামলেন আহনাফ হাসান, কবির হোসেন সহ আর ও বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। সাফওয়ানের পরিবারের ওপর কোনো ধরনের অ্যাটাক হলেই সেটাকে প্রতিরোধ করার সবরকম প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন তারা৷
গাড়ির শব্দ শুনে প্রতিবেশির দলটা পেছনে ফিরে তাকালো। এতগুলো সাংবাদিক দের দেখে তারা তাদের আসার জন্য রাস্তা করে দিলো। আর এত গুলো গাড়িকে আহমেদ ভিলাতে যেতে দেখে আর ও যেসব লোক আশেপাশে বাকি ছিলো তারাও হুড়মুড়িয়ে আহমেদ ভিলার দিকে ছুটে আসতে লাগলো কি হয় দেখার জন্য।
মেইন গেইটের ভেতরে এক ধরনের হুড়োহুড়ি বেধে গেলো। আহনাফ হোসেন তার সাথে আসা কন্সটেবল গুলোকে আদেশ দিলেন পরিস্থিতি সামলাতে। তার এসে উৎসুক জনতাকে একপাশে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো, কিন্তু লোকজন গুলো সব সাফওয়ান আহমেদ কে দেখার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে৷ কনস্টেবলদের হাকাহাকি, চিৎকার কোনোকিছুই তাদের কানে পৌছাচ্ছে না।
সাংবাদিক দের কয়েকজন ভিড় ঠেলে রুমাইশা আর শাফিনের কাছে পৌছালো। তারপর বলল,
— আমরা সাফওয়ান আহমেদের সাথে কথা বলতে চাই। তাকে যদি একটু বাইরে আসতে বলতেন!
রুমাইশা শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— তিনি এখন কারো সাথেই কথা বলবেন না। শুধু এখন কেন, কোনো সময়েই বলবেন না। ভালো হয় আপনারা তাকে বিরক্ত না করুন। যা জানার, যতটুকু জানার আপনারা জেনেই গেছেন, এখন তার সাথে নতুন করে কথা বলার কিছুই নেই।
সাংবাদিক দের অন্য আর একজন বলল,
— প্লিজ ম্যাম, স্যার কে একটা বারের জন্য আমাদের সাথে কথা বলতে বলুন, আমরা শুধু কয়েক টা প্রশ্ন করবো আর কিছু শট নিবো, প্লিজ ম্যাম!
রুমাইশার পেছন থেকে শাফিন বলে উঠলো,
— আমার ভাই এখন কারো সাথেই কথা বলবেন না, আপনারা এখানে সারাদিন বসে থাকলেও না। এখন আপনারা আসতে পারেন।
শাফিনের বাক্য শেষ হতেই রুমাইশা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলো, তার আগেই সাংবাদিক টা বলে উঠলো,
— ম্যাম, ম্যাম, দুটো কথা বলি, প্লিজ!
এরপর সে পেছনে ফিরে ফিসফিস করে তার অন্য সঙ্গি টাকে বলল,
— আহনাফ স্যার কে ডেকে নিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি।
তারপর আবার সামনে তাকিয়ে বলল,
— আপনার পরিচয় টা জানতে পারি ম্যাম, আপনি সাফওয়ান আহমেদের কে হন?
রুমাইশা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেললো, তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
— আমি ওনার স্ত্রী।
সাংবাদিক টার মুখে যেন লাইট জ্বলে উঠলো, সে অতি উৎসাহের সাথে বলল
— প্লিজ ম্যাম, স্যার কে একটাবারের জন্য একটু আমাদের সাথে কথা বলতে বলুন, আমরা শুধু অল্প কয়েক টা প্রশ্ন করবো! না, প্রশ্নও করবো না, স্যার কে শুধু চোখের দেখা দেখে কয়েকটা পিকচার নিয়েই চলে যাবো, প্লিজ ম্যাম, প্লিজ!
এমন সময়ে আহনাফ হাসান এগিয়ে এলেন সাংবাদিক দের কাছে। তারপর রুমাইশা কে প্রশ্ন করা সাংবাদিক টার দিকে এক পলক তাকিয়ে রুমাইশার দিকে তাকালেন তিনি, তারপর বললেন,
— এরা খুব আগ্রহ নিয়ে এসেছে সাফওয়ানের সাথে কথা বলতে। ওকে একটু আসতে বলো। ওর কথা গুলো শুনতে চায় সবাই। ও কিছু না বলুক, অন্তত একটু দেখা দিয়ে যাক!
রুমাইশা আহনাফ হাসানের কথায় চকিতে একবার শাফিনের দিকে দেখলো, তারপর আবার আহনাফ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ঠিক আছে আমি দেখছি, কি করা যায়!
তারপর দরজা থেকে সরে এসে ও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো, তারপর শাফিনকে বলল,
— আমি দেখে আসি, তোর ভাইয়া কি করছে। তুই ফুপ্পির কাছে বস, আর ফুপ্পা কে বল চিন্তা না করতে, সবকিছু ঠিকঠাকই আছে।
শাফিন কে এ কথা গুলো বলেই রুমাইশা ছাদের দিকে পা বাড়ালো৷
সাফওয়ান চিলেকোঠার কামরায় ওর পড়ার টেবিলের চেয়ার টনে তাতে বসে আছে। হাতে ওর ফোন, তাতে রুমাইশার আর ওর একটা পিকচার, আমাজনের ভেতরে তোলা, সাফওয়ানের খুবই প্রিয় একটা জায়গাতে। সাদমান শাহমীর চার বছরে পড়লে একদিন বাচ্চাদের কে জোনাসের জিম্মায় রেখে ও ঘুরতে গেছিলো রুমাইশা কে নিয়ে জঙ্গলের গভীরে। ফটো টা সেখানেই তোলা। অনেক অনেক গুলো নীল আর সবুজ রঙা উড়ন্ত প্রজাপতির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে সাফওয়ান। ওর পরনে শুধু একটা ট্রাউজার। গায়ের টি শার্ট টা পাশেই খুলে মাটিতে রাখা, আর রুমাইশার পরণে একটা মেরুণ রঙা ক্রপ টপ আর ছাই রঙা ঢোলা প্যান্ট। সাফওয়ানের জ্বলজ্বলে চোখ জোড়া ক্যামেরার দিকে। কিন্তু রুমাইশার ক্যামেরার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ও প্রজাপতি দেখতে ব্যাস্ত। ওর মাথা, হাত, কাধ, গায়ের পোশাক সব জুড়েই প্রজাপতি বসা, আর ওর মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি, চোখে মুখে আনন্দের ফোয়ারা৷ রুমাইশার এমন প্রাণবন্ত হাসি সাফওয়ান খুব কম দিনই দেখেছে, এই দিন টা সেই দিন গুলোরই একটা। আর সেই অসাধারণ মুহুর্ত টাই ক্যামেরায় বন্দি করে রাখা৷ সাফওয়ান খুব মনোযোগ দিয়ে রুমাইশার ওই হাসি মুখ টা দেখছে, ওর কানে বাজছে সেদিনের সে হাসির খিলখিল শব্দ টা। নিজের ভারী হয়ে থাকা মাথাটা হালকা করতে রুমাইশার এই চেহারাটাই ওর জন্য যথেষ্ট।
এমন সময়ে কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো রুমাইশা। সাফওয়ান মাথা তুলে দেখলো ওকে। তারপর হাতের ফোন টা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে দিলো ও। রুমাইশা এসে ওর পেছনে, ওর গা ঘেঁষে দাড়ালো। তারপর নিজের ডান হাতের আঙুল গুলো সাফওয়ানের ঝাকড়া চুল গুলোর ভেতরে চালনা করে দিতে দিতে ধীর কণ্ঠে, নরম গলায় বলল,
— তোমার একবার যাওয়া উচিত সাফওয়ান। বাইরে অনেক লোক এসে দাড়িয়েছে, তোমকে এক পলক দেখবে বলে!
সাফওয়ান কিছুই বলল না, রুমাইশাও চুপ রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার বলল,
— ওরা একবার ভুল করেছে, কিন্তু ওরা এখন ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে। বুঝেছে বলেই আজ তোমাকে দেখার জন্য নিচে হুড়োহুড়ি করছে! তোমার প্রতিবেশিরাও এসে ভিড় জমিয়েছে। তোমার একবার নিচে যাওয়া উচিত সাফওয়ান! ওদের কে তোমার বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে তুমি কোনোভাবেই হার মানার পাত্র নও, শত বাধা বিপত্তির পরও তুমি এখনো সদর্পে দাঁড়িয়ে আছো নিজের পায়ে! বিশাল বটগাছের মতো করে তোমার পরিবারের ওপর তুমি ছায়া বিছিয়ে আছো! ওদের কি বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে তোমাকে এ পৃথিবীর কেউ দমাতে পারবে না কখনোই। তোমাকে হাজারবার দমিয়ে রাখতে চাইলেও তুমি ঠিকই আবার মাটি ফুড়ে ওঠা আগ্নেয়গিরির মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আসবে! ঘৃণা টা পুষে রেখোনা সাফওয়ান। নিজের মন টা হালকা করো!
রুমাইশার কথা শুনে সাফওয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর নিজের পেছন থেকে রুমাইশা কে টেনে এনে ও নিজের কোলের ওপর বসালো৷ এরপর রুমাইশার পা দুইটা নিজের কোলের দুপাশে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো ওকে। রুমাইশার ফর্সা, নরম গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ও বলল,
— আমার এ ঘৃণা জমতে জমতে এখন আর আমার হাতে নেই রিমু! আমি জানিনা এ ঘৃণা আমি কিভাবে আমার মন থেকে দূর কিরবো! কখনো পারবো কিনা সেটাও জানিনা। তবে আমি চেষ্টা করবো রিমু! আমি সবাইকে ক্ষমা করতে চেষ্টা করবো!
.
সাংবাদিকেরা অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে৷ ক্রমান্বয়ে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিছুক্ষণ আগে আরও কিছু টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা এসে পৌছেছে৷ সবাই সাফওয়ানের বাইরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের সাথে সাথে দাঁড়িয়ে আছে ইশতিয়াক আহমেদের প্রতিবেশি রা সহ বাড়ি ভর্তি উৎসুক জনতা।
লোকসংখ্যা অল্প অল্প করে বাড়তেই আছে। বাড়ি এখন কানায় কানায় ভর্তি৷ তাদের শোরগোলের কারণে বাড়ি সামনে টাকে এখন কোনো জনসভার ন্যায় মনে হচ্ছে। আহনাফ হাসান ফোন করে আর ও কয়েকগাড়ি পুলিস ফোর্স পাঠাতে বলেছেন, পরিস্থিতি বিগড়ে গেলে যেন তিনি কারো কোনো ক্ষতি ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পারেন৷
এমন সময়ে আহমেদ ভিলার মেইন দরজা খট করে খুলে গেলো। দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে আসলো শাফিন৷ তাকে দেখে বাইরের শোরগোলরত জনগনের শোরগোল স্তিমিত হয়ে এলো। আর এরপর সে শোরগোলের বাকি রেশ টুকুকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়ে শাফিনের পেছন থেকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহী, অত্যান্ত সুদর্শন এক সুপুরুষ!