অফিডিয়ান | পর্ব – ৭০

৯২. রুনিয়া, আয়েশা আর সাথে আর ও কিছু মহিলা মিলে একসাথে সকালের খাবারের ব্যাবস্থা করছেন। অনেক রাত করে ঘুমানোয় সবারই উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আফসানা আসেনি নিচে, তার জ্বর। কপাল কেটে গেছে অনেক খানি। রক্ত ও পড়েছে ভালোই। রাফসান নিচে এসে এ খবর দিয়ে গেছে। কিভাবে কেটেছে জিজ্ঞেস করলে রাফসান বলল যে আফসানা ভোর বেলা ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে। তারপর থেকেই জ্বর তার। রাফসান সকালেই ফার্স্ট এইড করে দিয়েছে, আর ডাক্তার কে কল করেছে, হয়তো খানিক্ষন পরেই চলে আসবে৷

হলরুমে সোফায় বসে আছে সিনথিয়া, তার মা আর সাথে আর ও কিছু মহিলা। বিবাহ ম্যানেজমেন্ট আন্টিও সেখানেই আছেন৷ সিনথিয়ার মুখ খানা অন্ধকার। কারণ গতকাল সে সাদ্দাত হুসেইন নামের ব্যাক্তির সাথে বিয়ের কথা শুনে নিজের সব কাজিন মহল কে অতি আনন্দের সাথে জানিয়েছিলো, বিশেষ করে তার সেই খালাতো বোন কে, যে কিনা সাদ্দাত হুসেইনের ওপর ক্রাস খেয়ে বসে ছিলো। আর এখন সব কিছু ভেস্তে যাওয়ার পর সব কাজিন রা মিলে ওকে পচাচ্ছে। আর তার সেই খালাতো বোন তো প্রতিটা কথায় তাকে খোচা মারতে ছাড়ছে না। সিনথিয়া যা-ই বলছে তার উত্তরে কোনো না কোনো ভাবে সাদ্দাত হুসেইন নামক ব্যাক্তি টার প্রসঙ্গ টেনে আনছে সে ইচ্ছা করেই। আর এসব সহ্য করতে করতে কাল রাত থেকে সিনথিয়া ফেড আপ হয়ে আছে৷
যদিও বিবাহ ম্যানেজমেন্ট আন্টি তাকে কাল থেকেই ভরসা দিচ্ছেন, যে সাদ্দাত হুসেইনের থেকেও ভালো পাত্র সে নিজ দায়িত্বে জোগাড় করবেন সিনথিয়ার জন্য৷ কিন্তু সিনথিয়া আর ভরসা পাচ্ছে না৷

রুমাইশা রা এখনো নিচে আসেনি। রুনিয়া একবার জিজ্ঞেস করছিলেন আয়েশার কাছে, তিনি বললেন রুমাইশা আবার ছাদের কামরায় গিয়ে ঘুমিয়েছে সকালে। তাই খাবার টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় রুনিয়া ভাবলেন কাউকে দিয়ে ওদের ডাকিয়ে আনবেন৷ ঠিক তখনি ছাদের ওপর থেকে কয়েক জোড়া পদধ্বনি শোনা গেলো৷

আর তার কিছুক্ষণ পরে সাদমান আর শাহমীর কে সিড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে দেখা গেলো। তার অদূরেই, এখনো অদৃশ্যমান রুমাইশার কন্ঠে সাবধান বানী শোনা গেলো দু ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। লাফিয়ে চলতে মানা করলো রুমাইশা ওদের৷ ওদের দুজনের পরনেই চারকোল রঙা প্যান্টের সাথে মস রঙা ফুল স্লিভ টি শার্ট৷ রুমাইশা ওদের কে সবসময় একই রকম পোশাকই পরায়। এতে মানুষের মাঝে ওদের দুজনকে চিনতে কনফিউশান লেগে যায়। রুমাইশা মজা পায় খুব এতে৷

দুজনের লাফালাফির শব্দে হলরুমে উপস্থিত লোক গুলো ফিরে তাকালো সেদিকে৷ সিনথিয়াও তাকালো। এরা যে সাদ্দাত হুসেইনের কাচ্চা বাচ্চা তা সে কালকে রাতেই জেনেছে৷ বাচ্চা দুটো দেখতে একদম বাপের মতো।
ওরা হলরুমে নেমে আসার কয়েক মুহুর্ত পরেই দোতলার সিড়িতে পা রাখলো সাফওয়ান আর রুমাইশা। সাফওয়ানের কোলে বসে আছে রাশা, পিট পিট করে তাকাচ্ছে সে চারদিকে।

কিন্তু রুমাইশা আজ আর কালচারাল ড্রেস পরে নেই। তারা ফ্যামিলি শুদ্ধ সবাই আজ একই রকমের পোশাক পরেছে। রুমাইশার পরনে একটা শ্যাডো রঙা ব্যাগী প্যান্ট আর আর কফি রঙা ফুল স্লিভ টি শার্ট। স্লিভ দুটো কনুই এর কাছে গুটিয়ে রাখা সাফওয়ানের স্টাইলে৷ টি শার্ট টিতে রুমাইশার দেহের অবয়ব খুব অল্পই বোঝা যাচ্ছে৷ গাঢ় মেরুণ রঙা লম্বা চুল গুলো উচু করে ক্লাচার দিয়ে বেধে রাখা। কয়েক টা বেবি হেয়ার সামনে বেরিয়ে আছে৷
আর সাফওয়ানের পরনে ছেলেদের সাথে মিলিয়ে চারকোল রঙা প্যান্ট আর হারবর রঙা ফুল স্লিভ টি শার্ট। সে নিজেও স্লিভ দুইটা কনুইয়ের কাছে গুটিয়ে রেখেছে।
আর রাশাকে একটা সাদা রঙা ট্রাউজার আর গোলাপি রঙা ফতুয়া পরিয়ে দিয়েছে রুমাইশা, যেন গরমে ও কষ্ট না পায়।

ওদের এমন ম্যাচিং ম্যাচিং ড্রেস দেখে সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে। রুমাইশা কে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। তবে তাকে দেখে কেমন যেন মাফিয়া মাফিয়া ফিল আসছে। চোখ মুখ তেমনি করে রেখেছে ও৷ চোয়াল ও শক্ত হয়ে আছে।

সিনথিয়া সহ ওর আর ও কিছু কাজিন রা সিড়ি বেয়ে নামা রুমাইশার দিকে তাকালো। গতকাল রাতের শাড়ি পরা মেয়েটার সাথে এই মেয়েটার কোনো মিল পাচ্ছে না ওরা। এই মেয়েটা যেন কালকের ওই মোলায়েম মেয়েটার মতো নয় একদমই৷ খুবই শক্ত গোছের কেউ একজন। হাটা চলা দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটি স্পেশাল ফোর্সের কোনো সদস্য, এখনি প্যান্টের পেছনে টি শার্টের নিচে গুজে রাখা রিভলবার টা বের করে তাক করে ধরে সামনের যে কাউকে শ্যুট করে দিবে।

আর সাফওয়ানের দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না ভয়ে। কালকের পাঞ্জাবি পরা, স্মিত হাস্যমুখ ওয়ালা পুরুষ মানুষ টা যেন রাতারাতিই পুরোটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাদামী রঙা, তীক্ষ্ণ চোখ জোড়ার ওপর কালো, ঘন ভ্রুজোড়া কুচকে আছে আজ বরাবরের মতোই। চোয়ালদ্বয় শক্ত। জ্ব লাইন টা ধারালো হয়ে ফুটে আছে মুখের ওপর৷ বাহু দ্বয়ের পেশী গুলো স্লিভের ওপর দিয়েই দৃশ্যমান হয়ে আছে।

শিকারী দৃষ্টিতে সে একবার হলরুমের সোফায় বসা আন্টিমহলের দিকে তাকালো। আর সাথে সাথেই তার দিকে তাকিয়ে থাকা সেখানের সবগুলো কি এক অদ্ভুত ভীতিতে চোখ নামিয়ে নিলো দ্রুত। যেন ওই চোখ জোড়ায় তাকালেই কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে এখুনি।

মেয়েকে কোলে নিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়েই সাফওয়ান নেমে ভারী ভারী পা ফেলে সোজা চলে গেলো কিচেনে রুনিয়ার কাছে। আর রুমাইশা গিয়ে আন্টিমহলের বিপরীত দিকের একটা খালি সোফায় বসলো। তারপর টিভির রিমোট টা নিয়ে নিউজ ছেড়ে দিলো।

ও এসে বসার সাথে সাথেই আন্টিমহল আর সিনথিয়ার কাজিন মহল পুরাই চুপ মেরে গেলো। কেউ আর কোনো কথা বলছে না। সবাই রুমাইশার অগোচরে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখতে থাকলো ওকে৷

রুমাইশা নিউজ ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো, তারপর শাফিনের কাছে কল লাগালো। শাফিন এখনো রুম থেকে বের হয়নি। নতুন বউ নিয়ে সে সেই যে ঘরে ঢুকেছে এখনো তার বের হওয়ার নাম নেই। দুতিন বার রিং হওয়ার পর শাফিন কল রিসিভ করে বলল,
— হ্যা আপু বলো, কিছু লাগবে তোমার?

রুমাইশা মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি রে, তুই বেরোচ্ছিস না কেন রুম থেকে? লোক জন বউ দেখতে আসবে এখনি, অলরেডি হয়তো আসা শুরু করেছে, আর তুই বউ নিয়ে সেই যে কাল রুমে ঢুকেছিস আর বেরোনোর নাম নিচ্ছিস না! নাকি আজ বেরোবিনা বলে ঠিক করেছিস!

শাফিন লজ্জা পেলো, কোনো রকমে একটু শুকনো হেসে বলল,
— আপু বের হতাম অনেক আগেই, কিন্তু মা রাতের বেলাতেই একটা শাড়ি দেখিয়ে সকালে পরতে বলেছিলো সানিয়া কে। কথা ছিলো আফসানা ভাবি এসে পারাবে, কিন্তু পরে শুনলাম ভাবির নাকি শরীর খারাপ, আবার মা ও ব্যাস্ত! আর তোমাকে কল করলাম কয়েকবার তা নট রিচেবল দেখালো। এদিকে এ বেচারি শাড়ি পরতে পারেনা, তাই দুজন মিলে চেষ্টা করছি অনেক ক্ষণ ধরে, কিন্তু পারছিনা।

রুমাইশা সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
— আচ্ছা, আমি আসছি দাড়া।

বলেই কল কেটে দিয়ে ও দোতলার দিকে এগুলো। ও উঠে যেতেই সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। এতক্ষন ওরা দমও নিচ্ছিলো আস্তে, যেন দম নিতে একটু বেশি জোরে শব্দ হলেই সামনের এই অসাধারণ আর অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা তাদের কে গলা ধরে বলবে, শব্দ করলি ক্যান, উত্তর দে!

.

সাফওয়ান কিচেনে ঢুকেই রুনিয়া আর আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
— আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে, প্রাইভেটলি।

সাফওয়ান এ কথা উচ্চারণ করা মাত্রই বাকি মহিলা গুলো যে যার কাজ ফেলে তড়িঘড়ি করে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেলো৷ কিচেনে রইলেন শুধু রুনিয়া আর আয়েশা। সাফওয়ান কিচেনের দরজাটা কিঞ্চিৎ ভেজিয়ে দিয়ে রুনিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল
— মা, আমি আমাদের ফিরে যাওয়ার টিকেট কেটে ফেলেছি৷ কাল পরশুর ভেতরেই আমরা দেশ ছাড়বো।

সাফওয়ান এখনো রুমাইশা কে আফসানার ওই ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। যতদ্রুত সম্ভব আমাজনে ফিরে গিয়েই রুমাইশা কে সব জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও৷ নইলে রিমু যে মেজাজি, দেখা যাবে রাগের বসে গুরুতর কিছু করে ফেলেছে। এ ব্যাপারে একমাত্র শাফিনের সাথেই কথা বলারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।
সাফওয়ানের চলে যাওয়ার কথা শুনে রুনিয়ার বুক টা ধক করে উঠলো, তার বুকে ফেরা মানিক আবার তাকে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে শুনেই তার বুক টা যেন খালি হয়ে গেলো নিমিষেই। ধরা গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
— এত তাড়াতাড়ি কেন যাবি তুই? কয়েকটা মাস থেকে তারপর যা না! গত বারো টা বছর তোদের কে আমরা কাছে পাইনি। নাতি নাতনিদেরকে মন ভরে একটু আদর করতে পারিনি। আর তোরা গত পরশু এসে বলছিস কাল পরশুর ভেতরেই চলে যাবি! এটা কি মায়ের মন মেনে নিতে পারে, বল আমাকে একটু!

কথা শেষ করেই রুনিয়া চোখ মুছলেন। সাফওয়ান মায়ের কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমরা আর ও বেশ কিছুদিন থাকার প্লান করেই এসেছিলাম মা, কিন্তু কিছু সঙ্গত কারণে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আর তাছাড়া আমার ল্যাব আছে সেখানে জানোই তো! আমাকে একটা বিজনেস সামলাতে হয়, আমি যদি বেশিদিন অনুপস্থিত থাকি তবে আমার কোম্পানির ক্ষতি হবে মা, বোঝার চেষ্টা করো। আর তাছাড়া লিন্ডা সেখানে একা আছে। সে রিমুর সান্নিধ্য ছাড়া খাবার খেতে চায় না! যদিও তাকে কোনো রকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে এসেছি। কিন্তু আমরা বেশি দিন বাইরে থাকলে সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে৷

আয়েশা রুনিয়া দুজনেই একসাথে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
— লিন্ডা কে?

সাফওয়ান মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
— ওহ, তোমাদের কে তো বলাই হয়নি! সেখানে আমাদের একটা পোষা পাইথন আছে। তার নাম লিন্ডা। আমি তার কথাই বলছি। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত তোমাদের জানিয়ে দিয়ে গেলাম, যেন তোমরা আগের থেকেই নিজেদের কে প্রস্তুত করে নাও আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্য। তবে চিন্তা করোনা, আমরা আবার আসবো, বছর ঘোরার আগেই।

সাফওয়ানের কথার মাঝেই রাশা কে সাফওয়ানের কোল থেকে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন আয়েশা। তারপর সাফওয়ানের কথা শেষ হতেই বললেন,
— তোমরা ফিরে যাওয়ার আগে একবার ওবাড়ি থেকে ঘুরে এসো। তুমি আমাদের জামাই হওয়া সত্বেও তোমাকে এখনো সেভাবে জামাই আদর করতে পারলাম না! এবার গেলে মনের মতো করে তোমাকে জামাই আদর করবো। আর সাদমান শাহমীরের ও নানু বাড়ি দেখা হবে।

সাফওয়ান আয়েশার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল,
— জ্বি মামি, ফিরে যাওয়ার আগে আপনাদের ওখানে যাবো অবশ্যই, নইলে রিমু আমাকে আস্ত রাখবে না।

এরপর রুনিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
— আমি এখন একটু বেরোবো মা, শাফিন কেও সাথে নিয়ে যাবো। দুপুরের আগেই চলে আসবো। সকালের খাওয়া টা বাইরেই খেয়ে নেবো। তুমি সাদমান আর শাহমীর কে দেখে রেখো একটু! ওদের আম্মাজান তো বহুবছর পর নিজের বাড়ি ফিরে খুব আনন্দে আছে, তার এসব দিকে আপাতত খেয়াল থাকবে না।

রুনিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সাফওয়ান কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। ফোন টা বের করলো শাফিন কে কল লাগানোর জন্য। কিন্তু কল করার প্রয়োজন হলো না। সাফওয়ান হলরুমে এসে দাড়াতেই শাফিন দোতলার সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো।
ওকে দেখে সাফওয়ান এদিকে ওদিক তাকিয়ে রুমাইশা কে খুজতে থাকলো। শাফিন ভাইয়ের চাহনি দেখেই বুঝে ফেললো তার ভাই আসলেই কাকে খুজছে৷ ও এগিয়ে সাফওয়ানের কাছে এসে বলল,
— আপু আমার রুমে আছে ভাইয়া, সানিয়া কে শাড়ি পরাচ্ছে৷

সাফওয়ান শাফিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে প্যান্ট শার্ট পরে রেডি হয়ে এসেছে৷ সাফওয়ান বলল,
— আমি তোর কাছেই কল করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তুই এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?

শাফিন শার্টের হাতা গোছাতে গোছাতে বলল,
— বাইরে যাবো একটু, রুমি আপু কিছু বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে, সেগুলোই কিনতে যাবো৷ খেয়েই বের হবো।

সাফওয়ান ওকে বলল,
— আমিও বেরোচ্ছি, বাসায় খাওয়ার দরকার নেই, চল দুজনে বাইরে কিছু খেয়ে নিয়ে, কিছুক্ষণ ঢু মেরে চলে আসবো।

শাফিন তো এক পায়ে খাড়া, সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলো। নিউজ চ্যানেল তখন ও চলছিলো। সংবাদ পাঠিকা বলছেন,
— গতকাল রাতে ঝিনাইদহ থেকে গুম হয়েছেন আর ও দুই তরুনী। পুলিশ তাদের কে রাত থেকেই খুজছে, কিন্তু এখনো তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ এর আগে যারা গুম হয়েছেন তাদের কাউকেই এখনো খুজে পায়নি পুলিশ। তবে তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের সহকারী পুলিশ সুপার কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, যারা এই কাজ করছে তারা খুবই দক্ষতার সাথে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে যাতে তাদের কে সহজে ধরা না যায়। আর সন্ত্রাসী রা যে লোকসংখ্যায় অনেক সেটাও জানিয়েছেন তিনি। এই নিয়ে গত ছয় মাসে খুলনা বিভাগে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা দুশো তেরো জনে এসে দাড়ালো।

সাফওয়ান এতক্ষণ টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এরপর শাফিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
— কি রে! এত মানুষ গুম হচ্ছে কেন?

শাফিন সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
— বাইরে চলো, গাড়িতে যেতে যেতে বলবো।

সাফওয়ান ওর কথা শুনে টিভি স্ক্রিনের দিকে আর ও একবার তাকিয়ে মেইন ডোর দিয়ে বাইরে চলে গেলো।

৯৩. দুপুর বেলা গোসল শেষে একটা ট্রাউজার আর কামিজ পরে ভেজা চুল গুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে, হাতে এক গাদা বই নিয়ে রুমাইশা দোতলায় এলো। বিয়ের আগে রুমাইশা যে কামরায় থাকতো সেখানে রাফসান আর আফসানাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। রুমাইশা সে কামরার দরজায় নক করলো।

দরজা খোলাই ছিলো। ভেতর থেকে আফসানা জোর গলায় বলে উঠলো,
— এসো!

রুমাইশা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রাফসান বাড়িতে নেই। আফসানা বিছানায় শুয়ে আছে। স্যালাইন চলছে ওর। মাথার কাছ টাতে ব্যান্ডেজ করা। মুখের বা পাশ টা ফোলা ফোলা। চোখ মুখ ছলছল করছে ওর। রুমাইশা কে দেখেই কেমন যেন মিইয়ে গেলো ও। রুমাইশা ভেতরে এসে মিষ্টি করে হেসে আফসানার পাশে বিছানায় বসলো, তারপর বলল,
— সকালেই শুনেছিলাম যে তুমি পড়ে গিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছো, কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে তখন আর তোমাকে দেখতে আসতে পারিনি। আর ও একটা কারণ ছিলো, তোমাকে কয়েকটা বই উপহার দেওয়া। তাই ভাবলাম বই গুলো হাতে পেয়ে তবেই তোমার সাথে দেখা করবো। তা তুমি ওয়াশ রুমে গিয়ে পড়লে কীভাবে বলতো! আর পড়লে পড়লে, মাথা টাও ফাটালে! সেটাও এতটা গভীর ভাবে যে দুইটা সেলাই দেওয়া লাগলো!

আফসানা আমতা আমতা করে বলল,
— কি বলবো বলো! ঘুমের ঘরে ওয়াশরুমের ফ্লোরে পা দিয়েছি, সেখানে যে সাবান পানি ফেলানো ছিলো সেটা আমি খেয়াল করিনি একদম। পা দিতেই পড়ে গেছি। মাথায় আঘাত লেগেছে ফ্লোরের সাথে। ওইখান থেকে কোনোরকমে এসে তোমার ভাইয়াকে ডেকেছি৷ তারপর তোমার ভাইয়া উঠে আমার কাটা জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে!

রুমাইশা অবাক হয়ে বলল,
— কি বলো! তুমি এসে ভাইয়া কে ডেকেছো! তুমি পড়ে গেছো তা ভাইয়া টের পেয়নি একদম? তোমার ক্ষতের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে বেশ জোরে সোরেই আঘাত পেয়েছো! শব্দও তো ভালোই জোরে হওয়ার কথা! আর ওয়াশরুম ও তো বেডের একদম কাছেই! ভাইয়া তো একটু শব্দ হলেই ঠেলে উঠে! আর তুমি পড়ে গেছো, ও একটুও টের পায়নি! গাধা টা খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে আর কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে, ও আসুক আজ, ওকে আমি কি ঝাড়াটা ঝাড়ি তুমি শুধু দেইখো!

আফসানা ইতস্তত করে বলল,
— আরে না, কিছু বলার দরকার নেই৷ এখন আর বলে কি হবে বলো! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে!

রুমাইশা আফসানার দিকেই তাকিয়ে ছিলো, কিছুক্ষণ খেয়াল করে তাকিয়ে বলল,
— তোমার মুখে কি হয়েছে ভাবি? বাম পাশ টা কেমন যেন ফোলা ফোলা লাগছে! পড়ে গিয়ে তুমি মুখেও বাড়ি খেয়েছো নাকি? কিন্তু তোমার কপাল যেখানে কেটেছে সেখানে বাড়ি খেলে তো মুখের ওপাশে আঘাত লাগার কিথা না! নাকি দুই বার পিছলে পড়েছো?

রুমাইশার কথায় যেন স্পষ্ট ব্যঙ্গের আভাস পেলো আফসানা৷ গলা টা শুকিয়ে আসলো ওর৷ কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না ও৷ আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে গেলো ও। কিন্তু রুমাইশা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— থাক, তুমি অসুস্থ মানুষ অতো কথা বলতে হবে না। এখন আমি তোমাকে যা দিতে এসেছি তাই দিয়ে যাই।

বলে মিষ্টি হেসে রুমাইশা বিছানার ওপর রাখা, কাগজে মোড়ানো বইয়ের বান্ডিল টা আফসানার দিকে এগিয়ে দিলো। আফসানার এক পলক সেদিকে তাকিয়ে বলল,
— কি বই এনেছো আমার জন্য? আমি তো বই তেমন পড়িনা, পড়া হয়না! তাও আবার অতোগুলো!

রুমাইশা আফসানার দিকে তাকিয়ে আবার মিষ্টি হাসলো, তারপর বলল,
— পড়োনা, কিন্তু তোমার তো এবার পড়তেই হবে। আর এখানে কি কি বই এনেছি সেটা বলবো, তবে তার আগে তোমাকে একটা গল্প শুনতে হবে। নইলে এই বই গুলোর মর্ম তুমি বুঝবে না৷

আফসানা ভাবলো সে শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছে। রুমাইশা সেসবের কিছুই জানে না! তাকে দেখে এইরকম মিইয়ে গেলে সে এবার সত্যিই সন্দেহ করে বসবে। ঢোক গিলে সে বলল
— কি গল্প?

রুমাইশা বিছানার ওপর নড়ে চড়ে বসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, নরম গলায় বলা শুরু করলো,
— ভাইয়া হয়তো তোমাকে আগেই বলেছে যে আমি বা সাফওয়ান, আমরা দুজনের কেউই স্বাভাবিক মানুষ নই। আজ থেকে বারো বছর আগে আমার সাফওয়ান কে যখন বিদেশি এক সন্ত্রাসী তুলে আমেরিকাতে নিয়ে গেছিলো, তখন তার কয়েকমাস পরে সাফওয়ান কে তাদের হাত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি নিজেও আমেরিকা পাড়ি জমাই। প্রথম যেদিন আমি সাফওয়ান কে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিলো সেখানে লুকিয়ে অনুপ্রবেশ করি, সেদিন প্রায় সারাটা রাত আমি ওর সাথেই ছিলাম।
সাফওয়ানের দেখা শোনার জন্য সেখানে একজন নার্স নিযুক্ত ছিলো, অ্যাশলি নাম তার। তো সেদিন রাত দুইটার দিকে ওই অ্যাশলি মেয়েটা হঠাৎ সাফওয়ানের রুমের দরজায় নক করে। আমরা দুজন তখন গল্প করছিলাম। দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সাফওয়ান আমাকে ওর বিছানার সাদা রঙা বেডশিটের নিচে লুকিয়ে রাখে। তারপর গিয়ে দরজা খুলে আবার বিছানায় চলে আসে। তখন এই অ্যাশলি মেয়েটা কি করে জানো?

বলে আফসানার চোখের দিকে তাকালো রুমাইশা। রুমাইশার সে দৃষ্টি দেখে আফসানার বুক কেপে উঠলো। শিকারী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে রুমাইশা। ওর চোখে যেন কি এক হিংস্রতা ফুটে উঠেছে এই মুহুর্তে। আফসানা সেদিকে তাকিয়ে রইলো। নিজেকে স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বলল,
— কি করে?

রুমাইশা আফসানার চোখের দিকে তাকিয়ে, ধীর গতিতে কঠিন গলায় বলল,
— ওই মেয়েটা বিছানার ওপর উঠে আমার সামনেই আমার সাফওয়ানের দিকে এগিয়ে এসে ওর শার্টের বুকের বোতাম খুলতে থাকে সাফওয়ানের সাথে ইন্টিমেট হওয়ার জন্য। আর তখন আমি কি করি জানো?

বলে আবার ও বিরতি দিলো রুমাইশা। ওর চোখ মুখ এখন ভয়ানক রকম শক্ত। আফসানা ভয় পেলো প্রচন্ড, চোখে মুখে ওর অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো নিদারুণ ভাবে৷ রুমাইশার করা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো সাহস করে উঠতে পারলো না ও। গলা থেকে ওর আওয়াজ বের হচ্ছে না। কিন্তু রুমাইশা ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
— আমি ওর চুলের মুঠি ধরে, ওকে মেঝের সাথে গায়ের জোরে বাড়ি দিতে দিতে দিতে দিতে ওর মাথা টা ফাটিয়ে ঝাঝরা করে দিলাম। আর তারপর ওর চুল ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গিয়ে বাইরের মেঝের ওপর আবার মাথা ধরে আছাড় দিলাম, দিতেই থাকলাম, দিতেই থাকলাম, ওর জান বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওর মাথা টা আমি মেঝের সাথে আছাড় দিলাম! এরপর কি হলো জানো? মেয়েটা মরে গেলো! আফসোস!

রুমাইশা তাকিয়ে রইলো আফসানার ওই ভয়ার্ত মুখের দিকে৷ চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে আফসানার। চোখের পলক পড়ছে না ভয়ে। হাত পা কাপছে ওর থর থর করে। মৃত্যু ভয় ওকে গ্রাস করে ফেলেছে এই মুহুর্তে।

কিন্তু রুমাইশা কথা গুলো বলেই হাসলো অদ্ভুত ভঙ্গিতে, তারপর আবার নিজের স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফিরে গিয়ে কাগজ দিয়ে মোড়ানো বই গুলো খুলতে খুলতে বলল,
— হ্যা, যা বলছিলাম! তো এই বই গুলো তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি৷ এইগুলো পড়া তোমার জন্য খুবই জরুরি।
তুমি আমার আপন ভাইয়ের একমাত্র বউ। এখন তুমি যে পরিবার থেকে এসেছো সে পরিবার ঠিক কেমন সেটা তো আর আমি জানিনা, তাদের সাথে আমার দেখাও হয়নি, আর কখনো হবে কিনা সেটাও জানিনা৷
তারা তোমাকে কত টুকু কি শিক্ষা দিয়েছে সে ব্যাপারেও আমার কোনো ধারণা নেই। তবে তাদের শিক্ষায় হয়তো কোনো ঘাটতি থেকে গেছিলো, বা তোমার গাফিলতির কারণে সে শিক্ষাটা তুমি তাদের থেকে নিতে পারোনি! তো সেই শিক্ষাটা যেন তুমি এখন পাও সেই বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্যই এই বই গুলো তোমাকে দিয়ে গেলাম। এখানের বই গুলোর বিষয়বস্তু হচ্ছে একটা মেয়ের তার স্বামী সন্তান ও পরিবারের প্রতি কি কি দায়িত্ব আছে, বা সে কিভাবে তার নজর আর চরিত্রের হেফাযত করবে, কিভাবে পরপুরুষ দের থেকে নিজেকে দূরে রাখবে, কিভাবে নিজের স্বামীর প্রতিই সন্তুষ্ট থাকবে, এইসব! তো এইগুলো তুমি ভালো ভাবে, মন দিয়ে পড়বে। একদম মুখস্ত করে ফেলবে। আমরা খুব দ্রুতই দেশ ছাড়ছি। তবে বছর খানেক পর আমরা আবার ফিরবো, তখন কিন্তু আমি টু দ্যা পয়েন্টে তোমাকে এই বই গুলো থেকে প্রশ্ন করবো, যদি ঠিকঠাক উত্তর না দিতে পারো তবে তোমার ঠিক কি করবো তা আমি এখনো ভেবে দেখিনি। পরে ভাববো। ঠিক আছে? এখন আমি যাই, কেমন? ভালো থাকো তুমি, আর দ্রুত সেরে ওঠ।

এ কথা গুলো বলেই রুমাইশা বিছানা থেকে নেমে গটগট পায়ে হেটে চলে গেলো বাইরে। আফসানার দিকে ফিরেও তাকালো না। আর আফসানা ভয়ে, অনুশোচনায় বিছানার সাথে ফিট হয়ে রইলো। চোখের সামনে তার এখনো রুমাইশার সেই আগুন ঝরা চোখদুটো ভাসছে, কিছুতেই সে দৃশ্য কে সামনে থেকে সরাতে পারছে না ও৷

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।