অফিডিয়ান | পর্ব – ৩৮

চকিতে পেছন ফিরে তাকালো রুমাইশা। উদভ্রান্তের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সাফওয়ান। ঘামে গায়ের সাদা রঙের আন্ডার শার্ট টা ভিজে জব জবে হয়ে গেছে। গায়ের সাথে লেপ্টে আছে সেটা। হাপাচ্ছে ও। হাতে ওর এক গুচ্ছ ধবধবে সাদা রঙের অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপ। চোখ দুইটা রুমাইশার মুখের ওপর নিবন্ধিত।

সোনালি পাড়ের মেরুন রঙা শাড়িতে রুমাইশা কে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ান। স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ মুখ টা দেখে মন টা শান্তিতে ছেয়ে গেলো ওর। এতক্ষনের দৌড় ঝাপে হওয়া কষ্ট টা নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো সাফওয়ানের। রুমাইশার কাজল কালো চোখ দুইটার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো ও৷ নীলচে আলোয় ঠোঁটের গ্লোজ টা চকমক করছে। স্বপ্নময়ীর মতো সুন্দর লাগছে আজ ওর রিমু কে। সাফওয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রুমাইশার দিকে।

সাফওয়ানের এই উদভ্রান্ত চেহারা দেখে হঠাৎ করেই খুব মায়া মায়া হয়ে গেলো রুমাইশার মন টা। ভ্রু দুইটা ওপরে উঠিয়ে সাফওয়ানের কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ও। তারপর ঘামে জবজবা শরীর টাকেই জড়িয়ে ধরলো ও আষ্টেপৃষ্টে। সাফওয়ানের ঘর্মাক্ত বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো ও আলতো করে। ঘাম লেগে গেলো ওর মুখের ডান পাশ টাতে।

সাফওয়ান রুমাইশার এমন হঠাৎ আলিঙ্গনে চমকে গেলো। শরীরের ঘাম টা রুমাইশার ওই সুন্দর মুখে লেগে যাচ্ছে, শাড়িতেও লাগছে হয়তো। ছোট দুইটা হাত দিয়ে সাফওয়ানের পিঠ আকড়ে ধরে রেখেছে রুমাইশা। সাফওয়ান একবার ভাবলো রুমাইশা কে ছাড়িয়ে ফ্রেস হয়ে আসবে। কিন্তু রুমাইশা যেন ওর মনের কথা টা টের পেলো, জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই মৃদু গলায় বলে উঠলো,
— ফ্রেস হতে হবে না, আপনি এভাবেই থাকুন।”
তারপর আলিঙ্গন টা আর ও দৃঢ় করলো ও।

সাফওয়ান মৃদু হাসলো রিমুর এমন কর্মকাণ্ডে। হঠাৎ ই রুমাইশার বাহু তলে হাত দিয়ে উচু করে নিজের সমান উচ্চতার করে নিলো ও৷ তারপর বাহু তল থেকে হাত সরিয়ে রিমুর কোমর টা আকড়ে ধরে, রিমুর মুখ টা নিজের মুখের কাছে নিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রাখলো। তারপর চোখ না সরিয়েই এক হাত দিয়ে রিমু কে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রেখে ফুল ধরা অন্য হাত টা দিয়ে দরজা টা ভেজিয়ে লক করে দিলো সাফওয়ান।

রুমাইশা কে ওইভাবে উচু করেই ফুল ছড়ানো বিছানায় নিয়ে এলো সাফওয়ান। এরপর নিচু হয়ে রুমাইশা কে বিছানায় বসিয়ে দিলো, মেঝেতে পা ঠেকিয়ে বিছানায় বসলো রুমাইশা।
রিমু কে বসিয়ে আবার সোজা হয়ে দাড়ালো সাফওয়ান। হাতের ফুলের তোড়া টা টেবিলের ওপর রেখে এক টান দিয়ে ঘামে ভেজা গেঞ্জি টা খুলে ফেললো এরপরে।

তারপর ফুলের তোড়া টা আবার হাতে নিলো ও। এরপর ধীর গতিতে হেটে রুমাইশার একেবারে কাছে, একদম সামনে এসে হাটু গেড়ে বসে পড়লো ও মেঝেতে।
রুমাইশা ভ্রু দুইটা উচু করে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ানের দিকে।

সাফওয়ান সেই ধবধবে সাদা গোলাপের তোড়া টাকে দুই হাতে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলো রুমাইশার দিকে, তারপর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলে উঠলো,
— আমার দিকে দেখো রিমু, আমি জংলি; বন্য আমি। আমি এক রাত নিজের বিছানায় কাটাই, অন্য রাত টা কাটে আমার জঙ্গলের স্যাতস্যাতে ঠান্ডা মাটিতে, নয়তো নদীর পাড়ের কাদামাটিতে। আমার জীবনের সমস্ত অলিগলিতে এক বিন্দু পরিমানও কোমলতা নেই। আমার এই পাথুরে হৃদয়ের ভেতরে কোথাও যদি কোনো মোলায়েম অংশ থেকে থাকে তাহলে সেটা তোমার জন্য।
তুমি এই পৃথিবীতে আসার পর জীবনে প্রথম যেদিন তোমাকে আমি ছুয়েছিলাম সেদিন আমি নিজেও জানতাম না যে এই ছোয়া টা সারাজীবনের জন্য বাধা পড়ে যাবে৷
আমি যেদিন এই দেশ ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রেখেছিলাম সেদিন এই সমস্ত পৃথিবীর মাত্র দুইটা মানবীর জন্য আমার বুকের ভেতরে দহন সৃষ্টি হয়েছিলো, আমার জন্মদায়িনী মা আর তুমি! আমি কখনোই আমার এই জীবনের সাথে তোমাকে জড়াতে চাইনি! কিন্তু সেদিন রাতে আমি যখন তোমাকে মেরে ফেলতে বসেছিলাম, সেদিন তোমার ওই অসহায় চাহনির ভেতর কিছু একটা দেখেছিলাম আমি, দেখেছিলাম আমার এক মাত্র আশ্রয়স্থল; যার কাছে আমি নির্দ্বিধায় নিজের সমস্ত শরীর, মন, প্রাণ সপে দিতে পারি। আমি জানিনা আমার কেন ওমন মনে হয়েছিলো! কিন্তু সেদিন আমার মন টা আমাকে বার বার ডেকে বলছিলো যে এই মানবী টা সম্পুর্নই আমার, অন্য কারো না। একে আমি যা ইচ্ছা করতে পারি, চাইলে মেরে ফেলতে পারি, চাইলে বাচিয়ে রাখতে পারি, বা চাইলে ভালোবাসতে পারি অনেক অনেক!

সাফওয়ান আর ও একটু এগিয়ে এলো রিমুর কাছাকাছি, এগিয়ে এসে রুমাইশার হাত টা ধরে গোলাপের তোড়া টা ওর হাতের মুঠিতে দিয়ে দিলো। রুমাইশা যন্ত্র মানবীর মতো হাতে নিলো সেটা, চোখ দুইটা ওর এখনো আটকে আছে সাফওয়ানের মুখের দিকে। সাফওয়ান ওর মনের কথা গুলো কখনোই খোলশা করেনি ওর সামনে এখনো অব্দি। আজ নিজে থেকেই ভেতরের সব কথা বের করে দিচ্ছে ও। রুমাইশা মুখিয়ে আছে সেগুলো শোনার জন্য।

রুমাইশা ফুল টা নেওয়ার পর সাফওয়ান দুই হাতে রিমুর কোমরটা জড়িয়ে ধরে রিমু কে নিজের দিকে আর ও টেনে নিয়ে এসে মাথাটা স্বযত্নে রাখলো ওর উরুর ওপর। তারপর ধরা গলায় বলে উঠলো,
— আমার জীবনের একমাত্র স্নিগ্ধতা তুমি! আমাকে দেখো একবার। আমি অস্বাভাবিক! মরুভূমি আমি, আর সেই মরুর বুকে তুমি এক পশলা বৃষ্টির মতো, যার বর্ষন হতে হতে এখন মরুর বুকে কানায় কানায় পানি পুর্ণ স্থায়ী ঝিলে পরিনত হয়েছে।
আমার রুক্ষ জীবনে তুমি তোমার সমস্ত কোমলতা ঢেলে দিয়েছো। আমার এই রুক্ষতার একমাত্র সমাধান তুমি! আমার সমস্ত সমস্যার অবসান তুমি। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এই মস্ত পৃথিবীতে তুমি আমার এক টুকরো শান্তি যা অন্য কোথাও আমি কখনো পাবো না। আমার ঘর তুমি, আমার গন্তব্য তুমি।
সারাজীবন আমার একমাত্র সুখের উৎপত্তিস্থল হয়ে কাছে থেকো আমার, তোমাকে নিরাশ করবো না কখনো! আমার আদর, ভালোবাসার, দায়িত্ব কর্তব্য, শ্রদ্ধা; কোনোটার কোনো কমতি অনুভব করতে দিবো না তোমাকে কখনোই। যদি কখনো বিন্দু মাত্র কমতি অনুভব করো, আমার ওপর কখনো যদি অসন্তুষ্ট হও তাহলে চাইলে আমাকে সেদিন সেখানেই মেরে ফেলে দিও, কিন্তু কোনো কারণে কখনো আমাকে ছেড়ে যেতে চেয়ো না। তোমার বিরহে মৃত্যুর চেয়ে তোমার হাতে, তোমার কোলে মৃত্যুবরণ করতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো।

সাফওয়ান রুমাইসজার কোমর টা আর ও শক্ত করে আকড়ে ধরলো। রুমাইশা সাফওয়ানের দেওয়া ফুল গুলো পাশে রেখে ওর চুল গুলোতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে, দুই হাত দিয়ে সাফওয়ানের চোয়াল ধরে মুখ টা তুলে নিজের দিকে ফিরালো। তারপর আলতো করে ওর কপালে নিজের কোমল ঠোঁট জোড়া ছোয়ালো। সাফওয়ান চোখ বুজে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা।

কপাল থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে সেখানে এবার নিজের কপাল ঠেকিয়ে রুমাইশা বলে উঠলো,
— আপনার এই অস্বাভাবিকতাই আমাকে বার বার আপনার কাছে ছুটে আসতে বাধ্য করে। আপনার ওই উজ্জ্বল চোখ দুটোতে কি আছে আমি জানিনা, ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালেই আমার শরীর শিউরে উঠে। বার বার আপনার প্রেমে পিছলে পড়ে যেতে বাধ্য করে ওরা আমাকে! আপনার এই রুক্ষতাই আমার শক্তি, আপনার ওই জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা আমার দুর্বলতা। ওই চোখে তাকিয়ে আমি সমস্ত বাধা পেরিয়ে আপনার কাছে ছুটে চলে আসতে পারি। আপনার এই শক্ত হাতের বন্ধনি আমার অহংকার! এ বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কারো নেই। হবে ও না কখনো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বন্ধন কখনো আলগা হতে দেবো না আমি।
আপনার প্রতিটা পদক্ষেপই আমার কাছে আপনার ভালোবাসা, আদর, শ্রদ্ধা। আপনার জংলি পনা আপনার সত্তা। আপনার মতো করেই আপনার জংলি পনা কে আপন করে নিয়েছি আমি। আপনার জংলি পনা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই আমার!
আমি আপনার পুরোটাকেই চাই সবসময়, কোনো অংশ বাদ দিয়ে আপনাকে আমি কল্পনাও করতে পারি না। আপনার এ বুনো স্বভাব আমার কাছে আপনার ভালোবাসারই বিশাল বড় একটা অংশ, এই বন্য স্বভাবের জন্য আপনি অনুশোচনা করলে সেটা হবে আমার ভালোবাসার প্রতি আপমান! আমি আপনার এই পুরো আপনি টাকেই ভালোবাসি, আর আমার ভালোবাসার কোনো অংশ নিয়ে কেউ অনুশোচনা করলে সেটা মোটেও ভালো হবে না, এই কথা টা মাথায় রাখবেন, আমার ব্যাক্তিগত জংলি পুরুষ।

সাফওয়ানের ঠোটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো, চোখের কোন টাতে চিকচিক করছে সুখের তরল! রুমাইশার হাত দুইটা নিজের হাতের মুঠির ভেতর নিয়ে শক্ত করে ধরে গাঢ় করে চুমু খেলো হাতের উপরিভাগে। তারপর মেঝে থেকে ধীর পায়ে উঠলো ও। অর্ধ নগ্ন দেহের ঘাম গুলো শুকিয়ে এসেছে প্রায়।

হেটে হেটে ওর স্টাডি টেবিলের উপরে ডান পাশে রাখা নেভি ব্লু রঙা ছোট খাট লেদারের ব্যাগ টা হাতে নিয়ে আবার ফিরে আসলো রুমাইশার কাছে। অত:পর হাতের ব্যাগ টা রুমাইশার ডান হাতের মুঠিতে ধরিয়ে দিলো সাফওয়ান। তারপর বলল,
— দেনমোহর পরিশোধ।

এরপর নিজের ইস্পাত-দৃঢ় দুই হাতের পাঞ্জার ভেতরে রুমাইশার ফোলা ফোলা নরম চোয়াল দ্বয় আলতো করে ধরে নরম গলায় বলল,
— এখন আমাদের নতুন জীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করতে হবে৷ তিনি চেয়েছেন বলেই আজ আমরা আমাদের সম্পর্ক টাকে আমরা হালাল করতে পেরেছি। উঠ।

এরপর হেটে গিয়ে রুমের ডান পাশের দেয়াল থাকা কাভার্ডের ভেতর থেকে দুইটা জায়নামাজ বের করলো সাফওয়ান। সাথে একটা কালো রঙা লং হিজাব। এগুলো সেই কবেই কিনে রেখেছিলো ও৷ তখন ও ভাবেইনি এত দ্রুত এগুলো কাজে লাগবে!

সাফওয়ান জিজ্ঞেস করলো রুমাইশা কে ওর অজু আছে কিনা, রুমাইশা হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো। সাফওয়ান জায়নামাজ দুইটা আর হিজাব টা রুমাইশার হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে গেলো ওজু করতে।

সাফওয়ান ওজু করে বের হয়ে এসে কাবার্ড থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি বের করে পরে নিলো।
সাফওয়ান জায়নামাজের পাটি পাতলে তার পেছনে পাটি পাতলো রুমাইশা৷ তারপর দুজনে দু রাকাত নফল নামাজ পড়লো।

নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত শেষ করে সাফওয়ান পেছনে বসা রুমাইশার দিকে বসা অবস্থাতেই ঘরে বসলো। তারপর ওর মাথা থেকে হিজাব টা খুলে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দুয়া পড়লো কিছু, দুয়া পড়া শেষ হলে ফু দিলো রুমাইশার কপাল বরাবর।

এরপর রুমাইশার দুই গাল ধরে প্রেমময় কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমার ছোট খাট, চোক্ষু শীতল কারিনী, সুন্দরী বউ। আমার তোমাকে দেখার এ দৃষ্টি যেন আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা কখনো পরিবর্তন না করেন, আমিন!

রুমাইশা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,
— সুম্মা আমিন!

রুমাইশা বসা থেকে উঠে পড়লে সাফওয়ান জায়নামাজ দুইটা আবার ভাজ করে কাবার্ডে রাখতে গেলো।
রুমাইশা গিয়ে দাড়ালো সাফওয়ানের স্টাডি টেবিলের পাশে রাখা ফুল ভিউ মিররের সামনে।
নিজের কানে থাকা দুল টা খুলতে কানে হাত দিতে নিলেই পেছন থেকে সাফওয়ান এসে থামিয়ে দিলো তাড়াতাড়ি। তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
— আমার বউ, আমি আনবক্সিং করবো। তুই মোটেও হাত দিবি না।

রুমাইশা হেসে উঠলো সাফওয়ানের বলার ধরনে। সাফওয়ান সে হাসি কে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর মুখে রুমাইশার কানের দুল দুইটা খুলে রাখলো টেবিলে। তারপর ঘাড়ের কাছে আলতো করে ছুয়ে দিয়ে গলার ভারি নেকলেস টা খুলে দিলো। তারপর রুমাইশার দুই হাত থেকে একে একে সমস্ত চুড়ি গুলো খুলল। এরপর কাধের ওপর ভাজ করে রাখা শাড়ির আচলের পিন খুলে দিয়ে শাড়ির অন্যান্য পিন গুলোও খুলে দিলো একে একে৷
এবার মৃদু গতিতে রুমাইশা কে নিজের দিকে ঘোরালো ও।

শাড়ির ভাজ করা আচল টা বুকের ওপর মেলে গিয়েছে, গহনা খোলার পর কাজল কালো চোখে রুমাইশা কে এখন অন্যরকম সুন্দর লাগছে। সাফওয়ান মগ্ধতার সাথে রুমাইশার মুখ পানে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষন। সাফওয়ানের এমন দৃষ্টিতে রুমাইশা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিলো।

এবার রুমাইশার মাথায় উচু করে বাধা খোপাটা এক টানে খুলে ফেললো সাফওয়ান। হুটোপুটি করে চুলগুলো অভিকর্ষের টানে নিচের দিকে ছুটে গেলো, নিতম্ব ছাড়িয়ে আর ও খানিক নিচে চলে গেলো লালচে রেশমি চুল গুলো।

সাফওয়ান হতভম্ব দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো রুমাইশার এই চোখ ধাধানো সৌন্দর্য। অপলকে তাকিয়ে থেকেই রুমাইশার কোমর টা ধরে আলতো করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ও।
রুমাইশার লজ্জায় নিচু হয়ে যাওয়া মুখ টা চিবুক ধরে উচু করে নিজের চোখের সামনে নিয়ে এলো সাফওয়ান। আর তারপর প্রেয়সীর এই অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই গেয়ে উঠলো,
— আমি তোমার দ্বিধায় বাচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাচি, তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে তোমায় চেয়েছি পুরোটাই!

রাত দুইটা। নীলচে আলোয় ভরা ছিমছাম কামরা টা এখন অস্বাভাবিক ভাবে লন্ডভন্ড হয়ে আছে। বিছানার চারপাশে থাকা বেলি ফুলের মালা গুলো ছিড়েখুঁড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিছানায় ছড়ানো গোলাপের পাপড়ি গুলোর অর্ধেক টা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর বাকি গুলো সাদা রঙা বিছানায় পিষ্ট হয়েছে।

মেঝেতে ফুলের সাথে সাথে লুটিয়ে আছে রুমাইশার গায়ের মেরুন রঙা শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আর সাফওয়ানের সাদা রঙা পাঞ্জাবি টা। মশারীর একটা স্ট্যান্ডের এক মাথা ভেঙে পড়ে আছে বিছানার এক পাশে, মেঝেতে।

বিছানার ওপর এলোমেলো বালিশে সাফওয়ানের বুকে মাথা রেখে সাফওয়ানেরই একটি ওভার সাইজ টি শার্ট গায়ে দিয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে আলুথালু বেশী রুমাইশা। সমস্ত মুখ জুড়ে ওর তৃপ্তির ছোয়া। কাজল লেপ্টে চোখের চারপাশে ছড়িয়ে গেছে। চোখের পাশে কান্না গুলো শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে৷

সাফওয়ান এক হাতে রিমু কে জড়িয়ে রেখে অন্য হাত মাথার নিচে দিয়ে বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ঘুম নেই ওর চোখে। রুমাইশার প্রতিটা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস, প্রতিটা হৃৎস্পন্দন অনুভব করছে ও। অদ্ভুত রকমের এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে ওর বুক।
মাঝেই মাঝেই ফিরে ফিরে রুমাইশার ঘুমন্ত ছোট্ট সুন্দর মুখ টা দেখছে ও।

হঠাৎই নিজের অতীতের কথা স্মরণ করে হাসি হাসি মুখটা নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেলো ওর। ফুরফুরে মাথা টা ভারি হয়ে গেলো আকস্মিক ভাবে। রুমাইশার মায়া ভরা মুখ টার দিকে আরও একবার তাকালো সাফওয়ান।
ওর রিমু যখন জানবে ওর সেই কালো অতীত তখন কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে ওর রিমু! রিমু কি ওকে ছেড়ে দিতে চাইবে? রিমু কি থাকতে চাইবে তার মতো খুনির সাথে? রিমু কি মেনে নেবে তার অতীত কে! যদি মেনে না নেয় তাহলে কি হবে? রিমু চলে যেতে চাইবে ওকে ছেড়ে? অন্য কারো হতে চাইবে?

না কখনোই না, ওর প্রাণ থাকতে রিমু কে ও অন্য কারো হতে দেবে নে। ও যদি হয় এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রানী তারপর ও রিমু কে ওর কাছেই থাকতে হবে। কোথাও যেতে দেবে না ও।

গম্ভীর মুখ টা কে আর ও গম্ভীর করে দুই হাত দিয়ে বুকের ওপর শুয়ে থাকা রুমাইশা কে নিজের সাথে আর শক্ত করে জড়িয়ে নিলো সাফওয়ান। কোনো মুল্যেই রিমু কে ও হাতছাড়া করবে না। পৃথিবী উলটে গেলেও না।

রুনিয়া রান্না ঘরে সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছেন সকাল বেলা। ইশতিয়াকের নয় টায় অফিস। শাফিনের ও কোচিং আছে। ওরা দুজনেই বেরিয়ে যাবে নয়টার সময়। রুটি বেলে তাওয়ার ওপর দিচ্ছেন তিনি একটা একটা করে। অন্য চুলায় সবজি রান্না হচ্ছে। মাঝে মাঝে সেটা নাড়িয়ে দিচ্ছেন রুনিয়া।

এমন সময় রান্না ঘরের দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেলেন তিনি। রুটি বেলা থামিয়ে পেছনে ঘুরে তাকালেন। রুমাইশা দাঁড়িয়ে আছে। আধা ভেজা চুল গুলো দুই ভাগ করে বুকের দুপাশে ছেড়ে দেওয়া। মেরুন রঙা শাড়িটা কাচা হাতে গায়ের ওপর জড়ানো। মুখ টা স্নিগ্ধতায় ছেয়ে আছে। কালকে দেওয়া কাজলের কিঞ্চিৎ আভা চোখে লেগে আছে এখনো। শাড়ির আচলের খুট টা হাতে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত মুখে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইশা। মাথা ওর নিচের দিকে।

রুনিয়া হাসলেন মনে মনে। শাড়ি পরার অভ্যাস নেই রুমাইশার, কোনো রকমে কুচি টুচি করে গায়ে জড়িয়ে নিচে চলে এসেছে৷ গ্যাসের সুইচ টা অফ করে হাত টা ধুয়ে এগিয়ে আসলেন তিনি। রুমি কে রান্না ঘরের ভেতর নিয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,
— শাড়ি খোল, আমি পরিয়ে দিচ্ছি ভালো করে৷

রুমাইশা আচল সরালো না নিচের থেকে শাড়িটা খুলে দিলো শুধু। রুনিয়া রুমির এমন আচরণে কিছুটা অবাকই হলেন, কাল ও তো শাড়ি পরিয়েছেন তখন তো এমন করেনি রুমাইশা। নাকি হঠাৎ করেই লজ্জা বেড়ে গিয়েছে ওর!

রুনিয়া বেশি কিছু না ভেবে শাড়ি পরাতে শুরু করলেন। শাড়ির এক কোণা কোমরে গুজে দিয়ে কুচি করে দিলেন সুন্দর করে। পুরোটা সময় রুমাইশা শাড়ি দিয়ে প্রাণপণে পেট টা ঢেকে রাখার চেষ্টা করলো।
কিন্তু তারপর আচল টা ঠিক করে দেওয়ার জন্য রুমাইশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচল ধরে টান দিলেন রুনিয়া।

সাথে সাথেই থতমত খেয়ে গেলো রুমাইশা। এদিকে আচল সরিয়ে রুনিয়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। রুমাইশা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো।

শাড়ির ব্লাউজ টা একটু বড়সড় গলা দিয়েই বানিয়ে দিয়েছিলেন রুনিয়া। কিন্তু রুমাইশার অবস্থা দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন উনি। সমস্ত গলা, আর বুকের দৃশ্যমান জায়গা জুড়ে লাভবাইটে লাল লাল হয়ে আছে।

রুনিয়া এবার রুমাইশার সামনের পরে থাকা চুল গুলো হাতে করে ঘাড়ের ওপর থেকে পেছনে সরিয়ে দিলেন। একি! সবখানে একই অবস্থা।
ছেলের ওপর ভয়ানক রাগ হলো তার। ছোট মেয়েটার ওপর এমনে অত্যাচার চালিয়েছে ছেলেটা! ক্ষেপে গেলেন রুনিয়া সাফওয়ানের ওপর। আচল টা ঠিক ঠাক ভাজ করে রমাইশা কে রান্না ঘরে থাকতে বলে তিনি গেলেন দোতলায় রুমাইশার রুমে রাখা ফাউন্ডেশন টা আনতে।
আর যাওয়ার আগে সাফওয়ানের উদ্দ্যেশ্যে ধমক দিয়ে রুমি কে বললেন,
— কাল থেকে তুই তোর রুমে ঘুমাবি। ও অসভ্য টা আগে ম্যানার শিখবে, তারপর বউ পাবে। তার আগে না।

(আগামী কাল গল্প দিবো না, মেলা কাজ কালকে 🤭)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।