কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। শাফিন ভ্রু কুচকে দেখার চেষ্টা করলো, আসলেই সেখানে কিছু আছে, নাকি তার চোখের ভুল!
আর ও কিছুক্ষন খেয়াল করে দেখার পর শাফিন বুঝলো যে এটা তার চোখের ভুল নয়, সত্যি সেখানে কিছু একটা, বা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে৷ আপাদমস্তক কালো পোশাকে নিজেকে আবৃত করে, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সেটা।
শাফিন ভড়কালো। সাফওয়ান কে যারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে তাদেরই কেউ নয়তো! ঢোক গিলল শাফিন৷ চোখ দুটোকে ওই কালো পোশাকে আবৃত অবয়ব টার দিক থেকে চাইলেও ফেরাতে পারছে না৷ অবয়ব টাও যে ওকেই দেখছে, শুরু থেকেই, সেটাও বুঝতে আর বাকি রইলো না শাফিনের৷
হঠাৎ করেই সেই অবয়ব টা ওকে হাত উঁচু করে ইশারা করলো নিজের কাছে আসার জন্য৷ শাফিন ভয় পেলো। ছাদের রেলিঙের ওপর থেকে নেমে ও সরে গেলো পেছন দিকে৷ বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে ওর। অবয়ব টা ওকে কেন ডাকছে! ওটা অন্য কোনো কিছু নয়তো!
দ্বিধান্বিত পায়ে শাফিন আবার ও এগিয়ে এলো সামনের দিকে। অবয়ব টা আর হাত উঁচু করে নেই। কিন্তু অবয়ব টা কিছু একটা করছে, তার মুভমেন্টে বোঝা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরেই অবয়ব টা তার চোখের ওপর থেকে কিছু একটা সরালো, আর তারপরই বেরিয়ে এলো অবয়বটার উজ্জ্বল সবুজাভ-হলদে চোখদ্বয়, যার উজ্জ্বলতা অসম্ভব রকম চোখে পড়ার মতো। যেন চোখের উজ্জ্বলতা ঠিকরে পড়ছে অবয়বটার মুখের ওপর। চোখের আশপাশ টাও সেই উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে আছে যেন।
কিন্তু মুখ টা ঢাকা থাকায় সে কে তা কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছে না। শাফিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে টের পেয়েই অবয়ব টা সাথে সাথেই আবার নিজের চোখ দুইটা ঢেকে নিলো।
কিন্তু শাফিন এক দেখাতেই বুঝে গেলো অবয়ব টা কার। ওর ম্লান মুখটাতে হঠাৎ করেই প্রচন্ড খুশির ঝলক দেখা গেলো। উত্তেজনায় কি করবে কোনদিকে যাবে বুঝতে পারলো না ও৷ ছাদের ওপরেই কিছুক্ষণ বেখেয়ালি ভাবে এদিকে ওদিক ছোটাছুটি করলো ও৷ তারপর হুশে আসতেই ছুটে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে, হলরুম পার হয়ে সোজা বাড়ির মেইন গেইট দিয়ে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটলো ও৷
এক ছুটে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে দাড়ানো অবয়ব টার নিকট এলো ও। হঠাৎ এমন দৌড় দেওয়ায় শাফিনের হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে গেছে। তাই এসেই নিজের হাটুতে ভর দিয়ে হাপাতে থাকলো ও৷ কিন্তু অবয়ব টা ওকে একটুও জিড়াতে দিলো না। খপ করে ওর হাতটা ধরে নিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে চলতে শুরু করলো কোথাও৷
অবয়ব টা ছোটা শুরু করতেই শাফিন অবাক হয়ে গেলো, কিন্তু তার থেকে বেশি পেলো ভয় ও৷
অবয়ব টা যেন বুলেটের গতিতে ছুটছে সামনের দিকে, আর তার হাতে ধরে রাখা শাফিনকে যেন সে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷
এক ছুটে কালো পোশাকে আবৃত অবয়ব টা ওকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরের সেই ভাঙা কুড়েঘর টার সামনে এসে দড়ালো। পনেরো মিনিটের রাস্তা দুই মিনিটেই পার করে ফেলেছে ওরা৷
এত দ্রুত গতিতে ছুটে আসায় শাফিনের মাথার ভেতর টলতে লাগলো৷ অবয়ব টা ওর হাত ছেড়ে দিলে শাফিন টাল সামলাতে না পেরে হঠাৎ পড়ে যেতে নিলো।
কিন্তু অবয়ব টা ওকে পড়ে যেতে দিলো না। ওর শার্টের কলারের কাছ টা দুম করে ধরে ফেলে শাফিন কে আবার নিজের পায়ে দাড় করিয়ে দিলো।
শাফিন নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো,
— আপু, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন! আমরা তোমাকে কত জায়গায় খুজেছি, কতশত বার, তবুও তোমাকে পাইনি। তুমি এখন কই থেকে আসলে? নাকি তুমি সেই প্রথম থেকেই এই জঙ্গলেই ছিলে! সাফওয়ান ভাইয়া কে কারা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে, তুমি জানো সেসবের কিছু?
আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত রুমাইশা শাফিনের কথার কোনো উত্তরই দিলো না। কুড়েঘরের ভেতর ঢুকে পাসওয়ার্ড দিয়ে ল্যাবের দরজা খুলতে লেগে গেলো। সাফওয়ান ওকে একবার শিখিয়ে দিয়েছিলো, যে কি করলে পাসওয়ার্ড দিয়ে দরজা খোলার পরও পাসওয়ার্ড আর চেঞ্জ হবে না। সেই সিস্টেমেই দরজা খুলে ফেললো ও৷ তারপর শাফিন কে ইশারা করলো আগে যেতে।
শাফিন কোনো বাক্য ব্যয় না করে আগে আগে দরজা দিয়ে ঢুকে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো৷ আর ওর পরই নামলো রুমাইশা। ভেতরে ঢুকে ল্যাবের দরজা টা আবার বন্ধ করে দিয়ে ও নিজেও সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো।
শাফিন গিয়ে ভাইয়ের বিছানা পত্র গুলো দেখছে। অনেকদিন এখানে কেউ না আসায় কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে সব কিছু থেকে। বিছানা টাও কেমন যেন ময়লা ধরে গেছে। কিন্তু শাফিন সেসবের তোয়াক্কা না করে বিছানায় বসে পড়লো৷
রুমাইশা ভেতরে এসেই নিজের শরীর থেকে ওর পা পর্যন্ত লম্বা কালো রঙা হুডি টা টেনে খুলে ফেললো। তারপর নিজের চোখ মুখের ওপর থেকেও কাপড় সরিয়ে ফেললো৷
আর এরপর রুমাইশা কে দেখেই চমকে গেলো শাফিন। হতবাক হয়ে বলে উঠলো,
— আপু! তোমার শরীরের একি অবস্থা হয়েছে, আর, তোমার অত লম্বা চুল গুলো কই গেলো?
রুমাইশার মুখের সেই মায়া মায়া, গুলুমুলু ভাব টা কেটে গেছে একদম। তার বদলে মুখ টা এখন হয়ে গেছে কঠিন। ফোলা ফোলা গাল দুটো এখন তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে। সবুজাভ-হলুদ চোখ দুইটা থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। মাথার সেই নিতম্ব ছাড়ানো চুল গুলো আর নেই। সেগুলো এখন ঘাড়ের কাছে এসে পড়ছে। পরনে ওর কালো রঙা ওয়াইড লেগের ব্যাগি প্যান্ট, সাথে টার্টলনেক এর কালো রঙা স্লিভলেস ক্রপ টপ। ওকে সম্পুর্ন অন্য রকম লাগছে দেখতে।
আগের থেকে আর ও বেশি স্লিম লাগছে এখন রুমাইশা কে। যার জন্য একটু বেশিই লম্বা দেখাচ্ছে ওকে৷
রুমাইশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাফিনের পাশে এসে বসলো। তারপর বলল,
— আমার পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজ পত্র কি রাফসান ভাইয়ার কাছে?
রুমাইশার গলা শুনে আর শাফিন আরও একধাপ অবাক হলো। রুমাইশার সেই রিনরিনে গলা আর নেই। কণ্ঠ টা আগের তুলনায় ভারি হয়ে গেছে অনেক খানি। গলা শুনে মনে হচ্ছে যেন রশকষ হীন কোনো মেয়ে অনুভূতি হীনদের মতো কথা বলছে।
শাফিন রুমাইশার প্রশ্নের উত্তরে বলল,
— হ্যা, ওসব রাফসান ভাইয়া নিজের সাথে নিয়ে গেছেন৷ কিন্তু তুমি এতদিন কোথায় ছিলে আপু! তোমাকে না পেয়ে সাফওয়ান ভাইয়ার কি অবস্থা হয়েছিলো তুমি জানো! ভাইয়া না খেয়ে খেয়ে মরতে বসেছিলো। সেদিন যদি ভাইয়া সুস্থ সবল থাকতো, তাহলে ওই লুকাসের ক্ষমতা ছিলো না ভাইয়া কে নিয়ে যাওয়ার৷ ভাইয়া সবগুলোকে ওপরে পাঠিয়ে দিতো। কেন চলে গেছিলে আপু তুমি? ভাইয়া কিডন্যাপ হওয়ার আগের দিনে তুমি এইখানেই ছিলে, কিন্তু আমাদের কাছে আসোনি। আমরা তিন জন মিলে তোমাকে কত টা খুজেছি তুমি জানো! আর, তোমার এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে, ভাইয়ার মতো কিভাবে হয়ে গেলে তুমি! তোমার এত পরিবর্তন হলো কি করে?
শাফিন নিজের কৌতুহল ধরে রাখতে পারছে না৷ চোখে মুখে ওর সত্য জানার আগ্রহ ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ভাবে৷
রুমাইশা ওকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল। তারপর বলল,
— শান্ত হয়ে বস৷ আমি যা যা বলবো, চুপ চাপ শুনবি। কথার মাঝে কোনো প্রশ্ন করবি না। আমার কথা শেষ হলে তবেই প্রশ্ন করবি। বুঝেছিস?
শাফিন মাথা নাড়িয়ে সায় মানলো। তারপর পা উঠিয়ে বিছানায় আরাম করে বসলো ও রুমাইশার দিকে ফিরে রুমাইশার থেকে ওর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার এক্সপ্লানেশন শুনতে।
রুমাইশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু গলায় বলল,
— আমার যে এমন পরিবর্তন হয়েছে তার জন্য আমার কোনো আফসোস নেই, আমার আফসোস শুধু সাফওয়ানের জন্য, ওর আমাকে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য না জানানোর জন্য। আর ভুল সময়ে সেই সঠিক তথ্য জানার পর আমার সাফওয়ান কে না চাইতেই ভুল বোঝার জন্য৷
আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমি যদি কাউকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি, তবে সেটা সাফওয়ান৷ আমি যেদিন থেকে আবিষ্কার করেছি যে আমার ভেতর অন্যরকম এক পরিবর্তন হচ্ছে সেদিন থেকেই আমি অনেক খুশি ছিলাম। এটা ভেবেই যে সাফওয়ানকে আর নিঃসঙ্গতা ছুতে পারবে না। ওর কষ্ট টাকে ওর মতো করে গ্রহণ করার জন্য এখন আমি আছি।
কিন্তু আমার পরিবর্তন হওয়ার শুরু থেকেই আমি প্রচুর শর্ট টেম্পার্ড হয়ে গেছিলাম। নিজের মনের বিরুদ্ধে কিছু হলেই যাচাই বাছাই না করে রেগে যেতে শুরু করলাম প্রচন্ড। আর যেদিন আমি পালিয়ে গেলাম, সেদিন তো আমার রাগ টা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলো।
আমি যখন সাফওয়ানের এতদিনের না বলা সত্যি গুলো জানতে পারলাম, তখন নিজের মতো করে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে আমি ঘটনা গুলোকে আমার মনের মতো করে ব্যাখ্যা দিলাম। সাফওয়ান আমাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো অনেক, কিন্তু আমি শুনিনি।
সেদিন এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম আমি, আর এতটাই রাগ হয়েছিলো আমার যে কোনো কিছু চিন্তা না করেই রাগের মাথায় আমি ল্যাব ছেড়ে ছুটে চললাম, আর সেই ছুটতে গিয়েই আমি আবিষ্কার করলাম আমার দৌড়ের গতি। কিন্তু আমার তখন নিজের ওপর ইম্প্রেসড হওয়ার সময় ছিলো না, মানসিকতা ছিলো না। অত দ্রুত গতিতে আমি কোথায় যাচ্ছিলাম, কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, শুধু ছুটছিলাম!
এত খানিক বলে রুমাইশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেদিন ছিলো ওর সাফওয়ানের সাথে ওর শেষ দেখা, আর সেই থেকে এখনও পর্যন্ত সাফওয়ান কে একটু শান্তি মতো দেখতে পারেনি ও। সাফওয়ান যে সেদিন ভুল বোঝার জন্য পরাণ টা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ওর এখনো।
শাফিন বুঝতে পারলো রুমাইশার কষ্ট পাচ্ছে। রুমাইশা কে স্বান্তনা দিয়ে ও নরম গলায় বলল,
— মন খারাপ করো না আপু, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, সেটা আর ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব না৷ তুমি বলো, এরপর তুমি কোথায় গেলে, কি করলে?
রুমাইশা জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
— আমি জানিনা, সেদিন আমি এক ছুটে কোথায় গেছিলাম। তবে অনেক অনেক রাস্তা পার করে ফেলেছিলাম, ওই অল্প সময়ের ভেতরেই! তারপর ছুটতে ছুটতে একসময় আবার একটা বড়সড় জঙ্গল পেলাম। সেখানে গিয়ে থামলাম আমি। সে জায়গা টা আসলেই কোথায় তা আমার জানা নেই৷ কিন্তু এই পালিয়ে যাওয়াই আমার জীবনের কাল হয়ে দাড়ালো।
যেদিন আমি এইখান থেকে পালিয়েছিলাম তার আগের দিন রাতে আমার হাড় কাপানো জ্বর এসেছিলো৷ সে জ্বর টা তখনও পুরোপুরি নির্মুল হয়নাই, তার রেশ বাকি ছিলো হয়তো, বা হতে পারে আমার এই পরিবর্তনের প্রভাবে জ্বরের প্রকোপ বাড়ছিলো!
সেদিন রাতে আবার ও প্রচন্ড জ্বর এলো আমার৷ জঙ্গলের ভেতর খাবার পানি বিহীন, বাসস্থান বিহীন, সামান্য পোশাকে থাকা আমি জ্বরের তীব্রতায় কাপতে শুরু করলাম, আর তারপর জ্বরের ঘোরে কখন জানি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, বা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
কিন্তু এরপর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ঝুম বৃষ্টির মাঝে। খোলা আকাশের নিচে মাটিতে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে শুয়ে ওই জ্বর অবস্থাতেই কতক্ষণ যাবৎ ঝমঝমে বৃষ্টিতে আমি ভিজেছি সেটা বলতে পারিনা। কারণ, জ্ঞান ফিরে কয়েকবার চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম, বৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই দেখিনাই, আর তারপর হয়তো আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
এরপর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সূর্য মাথার ওপরে। আমার শরীরের ভেজা পোশাক গুলো ততক্ষণে বেশ খানিক টা শুকিয়ে গেছে। জ্বরের ঘরে চোখে ঝাপসা দেখছিলাম। মাটি থেকে মাথা তুলতে পারছিলাম না। মাথা ভারী হয়ে ছিলো প্রচন্ড। চোখের পাতা ফুলে গেছিলো, চোখ মেলতে পারছিলাম না পুরোপুরি।
অনেক কষ্টে উঠে দাড়ালাম আমি, ক্ষিদেতে পেটের ভেতর যন্ত্রণা করছিলো। কোনো রকমে হেটে আমি সামনে এগোচ্ছিলাম, কোথায় যাচ্ছিলাম জানিনা৷ হাটতে হাটতে একসময় ঘন জঙ্গল টা পার করে ফেললাম। জঙ্গলের পরেই ছিলো বিশাল ফসলি মাঠ৷ ওই মাঠের কোণায় একটা ছোটখাটো বাড়ি ছিলো, খুবই জরাজীর্ণ সে বাড়ি টা৷ কোনো কিছু না ভেবেই সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলাম। সে বাড়িতে শুধু একটা বুড়ি ছিলো, তার স্বামী সন্তান কেউ নেই। জ্বরে কেপে টলতে টলতে সেই বুড়ির কাছে গিয়ে আমি কোনোরকমে সাহায্য চাইলাম।
বুড়ি চোখে দেখতেন না তেমন, এতে করে আমারই সুবিধা হয়েছিলো। আমার জ্বলজ্বলে চোখদুটো তার নজরে পড়েনি কখনো।
কিন্তু বুড়ির বাড়িতে সমস্যা আর ও প্রকট হয়৷ আমি আমার নাকে অদ্ভুত সব গন্ধ পেতাম সারাক্ষণ। দূর দুরান্ত দিয়ে কোনো প্রাণি, তা সে হোক মানুষ বা অন্য কিছু, সব কিছুর গন্ধ পেতাম আমি। আর তাদের কে আমি সেই দূর থেকেই শুনতে পেতাম।
মানুষের একে অপরের কানে কানে বলা ফিসফিস কথা, সতর্ক পায়ে হেটে যাওয়া শেয়ালের পায়ের আওয়াজ, মুরগীর মাটি থেকে ঠোকর দিয়ে পোকা খাওয়া, দূরে গাছের ডালের পাখির বাচ্চার চিউ চিউ, সবই শুনতে পাওয়া শুরু করলাম আমি। অসহ্য লাগতে শুরু করলো আমার। এই সম্পুর্ন নতুন আমি কে আমার সহ্য হচ্ছিলো না একটুও৷ মনে হতো আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাবো, বা হয়তো পাগল হয়ে গেছি!
এত শব্দ আর গন্ধে আমি বিরক্তিতে ছটফট করতাম সারাক্ষণ। বুড়ি দাদি ভাবতো আমার জ্বীনে ধরেছে। সারাক্ষণ সুরা কিরাত পড়ে আমার গায়ে ফুক দিতো। কিন্তু তাতে কিছুই হতো না। উপায় না পেয়ে আস্তে আস্তে নিজেকে আমি এই নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে থাকলাম।
তার কিছুদিন পর, জঙ্গলের পাশের মেইন রোডে তিন খানা গাড়ি দাড়ানো দেখেছিলাম আমি৷ ওরা জঙ্গলের ভেতর টা সার্চ করছিলো, কেন করছিলো তা তখনও আমি জানিনা। আমি বুড়ি দাদির রান্নার জন্য শুকনো কাঠ কুড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে৷ ব্যাপার টা কি হচ্ছে সেটা বোঝার জন্য আমি ওই গাড়ি গুলোর আশে পাশে গিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম ওদের কথা বার্তা৷
আর তখন ওই গাড়ির ভেতরকার কারো একজনের কথা আমার কানে আসে, যে বলছিলো, উত্তরের জঙ্গল টাতে নাকি ওরা খুব কড়া ভাবে নজর রাখবে, সাফওয়ান আসলেই সেখানে আছে কিনা জানার জন্য।
সাফওয়ানের নাম শোনা মাত্রই আমি বুঝে যাই যে ওরা আসলে কারা। সাফওয়ানের নোটবুকে ওদের সম্পর্কে পড়েছিলাম আমি, সম্ভবত লুকাস, না ফোকাস, কিছু একটা নাম হবে তার। সেই এই সার্চ মিশন পরিচালনা করছিলো।
সাফওয়ান বিপদে পড়তে যাচ্ছে শুনে আমি তখনি কাঠ কুড়ানো বাদ দিয়ে চলে আসি বুড়ি দাদির বাড়িতে৷ সেদিন রাত পড়ে গেলে উত্তরের জঙ্গলের উদ্দেশ্যে আমি বের হই, যেন সাফওয়ান কে আমি সাবধান করতে পারি লুকাসের ব্যাপারে৷ কিন্তু বাড়ির রাস্তা খুজে পেতে পেতে অনেক দেরি হয়ে যায় আমার। জঙ্গলে পৌঁছে আমি ল্যাবের দিকে এগোচ্ছিলাম, সাফওয়ানের কাছে যাওয়ার জন্য। সাফওয়ানের কি অবস্থা, বা বাড়ির কি অবস্থা, কিছুই আমি জানতাম না, আমি ভেবেছিলাম, সবাই হয়তো ভালোই আছে আমাকে ছাড়া, সাফিওয়ান ও৷
কিন্তু কিছুদুর এগোনোর পর পায়ে হাটার শব্দ পাই আমি, আর কারা আসছে দেখার জন্য সে রাস্তায় এগিয়ে তোকে আর রাফসান ভাইয়া কে আসতে দেখে আমি দাঁড়িয়ে যাই৷ কি করবো ভেবে না পেয়ে লুকিয়ে দেখতে থাকি তোদের কে, তোরা এত রাতে বের হওয়ায় আমার একটু খটকা লাগে। কিন্তু তোদের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো এমন অবস্থা আমার ছিলো না৷
কারণ আমি ভেবেছিলাম আমার চোখ মুখের যে হাল হয়েছে তা নিয়ে রাফসান ভাইয়ার সামনে দাড়ালে সাফওয়ানের সাথে ভাইয়ার গুরুতর ঝামেলা বাধবে।
কিন্তু আমার মনে ছিলো না যে আমার চোখ দুইটা এখন আর স্বাভাবিক নেই, তারা এখন রাতের বেলা উজ্জলতা ছড়ায় ; দূর থেকেও তাদেরকে স্পষ্টই বোঝা যায়৷ আর এই ভুলের কারণেই তোরা আমাকে দেখে ফেলিস।
আর এরপরই আমি টের পাই তোদের থেকে আর ও পেছনে জনা তিনেক লোক পায়ে হেটে এদিকেই আসছে। তারা যে আসলেই কারা সেটা আমি জানতাম না। তাই তোদের সবার থেকে পালাতে আমি আবার ছুটে যাই যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে। সাফওয়ান কে সেদিন আমার আর সাবধান করা হয় না৷ তবে আমার বিশ্বাস ছিলো, সাফওয়ানের কাছে দশ টা লুকাস আসলেও ওরা সাফওয়ানের কিছুই করতে পারবে না৷ কিন্তু পরদিন রাতে আবার সাফওয়ানের সাথে দেখা করতে আসলে আমার সে বিশ্বাস গুড়িয়ে যায়৷
তোদের দেখে যেদিন পালিয়ে গেলাম, সেদিন আমার আবার জ্বর আসলো, ভয়ানক জ্বর৷ উঠে দড়ানোর শক্তি পর্যন্ত ছিলো না শরীরে৷ কিন্তু তারপর ও পরদিন রাতে আমি আবার সাফওয়ান কে সাবধান করার জন্য আমার জ্বর তপ্ত দুর্বল শরীর টা টেনে নিয়ে কোনো রকমে এ জঙ্গলে আসি।
আর জঙ্গলের ভেতর ঢোকার কিছুক্ষণ পর আমি অদ্ভুত রকমের শব্দ শুনতে পেলাম, সাই সাই শব্দ করে কেউ যেন তালোয়ার চালাচ্ছিলো। চমকে উঠে আমি শব্দ টাকে ফলো করে সেদিকে এগিয়ে যাই।
আর এরপর দূর থেকেই দেখতে পাই আমার সাফওয়ান কে, জনা দশেক মানুষ কে একে একে চুপিসারে দ্বিখন্ডিত করতে করতে এগোচ্ছে।
কিন্তু সাফওয়ানের শরীরের অবস্থা দেখে আমি অবাক হই। ওর সেই বিশালাকারের পেশিবহুল শরীর টা শুকিয়ে শীর্ণকায় হয়ে আছে!
কিন্তু এরকম টা কেন হয়েছে সেটা তখনও আমি বুঝিনি। লুকাসের লোক গুলো যখন ওকে ঘীরে ধরলো তখন আমার জান প্রাণ উতলা হয়ে যাচ্ছিলো সাফওয়ান কে বাচানোর আশায়, কিন্তু আমার শরীর সায় দিচ্ছিলো না। আর এরপর যখন ওই সাদা কোট পরিহিত লোক টা সাফওয়ান কে শ্যুট করলো, তখন আমার দুনিয়া আর দুনিয়া রইলো না৷ মাথার ভেতর টা ঘুরে উঠলো আমার, আর এরপর ওখানেই জ্ঞান হারালাম আমি৷
রুমাইশা থামলো। চোখের কোণে লেগে থাকা অশ্রুকণা অনামিকা দ্বারা মুছে ফেললো। শাফিন এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো রুমাইশার কথা শুনছিলো৷ কিন্তু হঠাৎ বিরতিতে শাফিন আবার নড়ে চড়ে বসলো।
শাফিন সহ সাফওয়ানের পরিবারের কেউই জানে না সাফওয়ান আদোও বেচে আছে কিনা৷ আর তাকে ওই লোক গুলো কেন নিয়ে গেছে, আর সাফওয়ানের সাথেই বা তারা কি করতে চলেছে এসবের কোনো ধারণাই নেই ওদের৷
শাফিন রুমাইশার নিরবতার সুযোগ নিয়ে বলল,
— আমার বিশ্বাস সাফওয়ান ভাইয়া বেচে আছে আপু, কারণ ভাইয়া কে যদি মেরে ফেলতেই হতো তাহলে ওরা ভাইয়া কে মেরে, ফেলে রেখে যেতো এখানেই। তাদের সাথে করে নিয়ে যেতো না৷ মৃতদেহ তো কারো কাজে লাগার কথা নয়! তাই আমার মনে হয় ভাইয়া কে ওরা নিজেদের কাজে লাগানোর জন্যই বাচিয়ে রেখেছে। ভাইয়া হউতো আমাদের থেকে অনেক দূরে আছে, কিন্তু বেচে আছে! বাকি টা আল্লাহ জানেন৷
রুমাইশা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— হ্যা, সাফওয়ান বেচে আছে। কিন্তু ঠিক কতক্ষণ বেচে থাকবে সেটা বলা যাচ্ছে না।
রুমাইশার কথা শুনে শাফিন চমকে লাফিয়ে উঠলো এক প্রকার। তারপর চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো,
— ভাইয়া বেচে আছে তুমি শিউর? কিন্তু তুমি কিভাবে জানো? ভাইয়ার সাথে তোমার যোগাযোগ আছে? ভাইয়া কি কোনোভাবে যোগাযোগ করেছে তোমার সাথে?
রুমাইশা শাফিনের দিকে শীতল চোখে তাকালো। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
— না, অন্য এক জনের সাথে যোগাযোগ আছে৷
৬৩. ল্যাবের সিক্রেট রুমের স্ট্রেচারে হাত পা বাধা অবস্থাতেই অস্থির হয়ে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সাফওয়ান৷ আর সেই সাথে রাগে গজরাচ্ছে ও৷ নিজের দুর্বল শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে স্ট্রেচারের মেটালিক বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে৷ রুমাইশার সান্নিধ্য না পেতে পেতে ওর শরীর আগের চাইতেও বেশি দুর্বল হয়ে গেছে৷ আগের থেকেও বেশি জংলি আর হিংস্র হয়ে উঠেছে ও। তারপর ও যে টুকু শক্তি ওর দেহে বাকি আছে, তার সবটুকু নিংরে নিয়ে ও চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর৷
নিজের বিবেক বুদ্ধিও যেন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে ওর। থেকে থেকে সব ভুলে যাচ্ছে ও৷ কারো নামই মাথায় আসছে না আজকাল। রুমাইশার মুখ টা নিভু নিভু হয়ে মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে চোখের সামনে, কিন্তু সেটাও বেশিক্ষণ থাকছে না। উধাও হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি গুলো যেন ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছে ওর।
ঠিক সেই মুহুর্তেই মাইকেল আর জর্জ প্রবেশ করলো সে রুমে। ওদের দেখে সাফওয়ানের মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে গেলো। গর্জে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে ইংরেজিতে বলল,
— আমাকে আটকে রেখেছিস কেন! আমার বাধনটা খুলে দে একবার, তারপর তোদের কে বোঝাচ্ছি আমি! সবকটার গলার নল খুলে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।
মাইকেল এসে সাফওয়ানের পাশে বসল, তারপর বলে উঠলো,
— শান্ত হোন, মিস্টার সাফওয়ান আহমেদ। আপনি হয়তো অবগত আছেন, যে কেন আপনাকে এইখানে নিয়ে আসা হয়েছে৷ কিন্তু সে উদ্দ্যেশ্য সফল করার জন্য আপনাকে মরতে হবে৷
তবে আমাদের কাছে একটা উপায় আছে, আপনাকে বাচিয়ে রাখার। আপনি যদি আমাদের সব শর্ত মেনে নেন, তবে আমরা আপনাকে বাচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। এতে আমাদের দু পক্ষেরই লাভ হবে৷