৫২. জঙ্গলের ভেতর টা আজ কেমন জানি নিশ্চুপ। বেলা হয়েছে অনেক খানি, কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো আজ পাখিদের কলরব নেই তেমন৷ মাঝে মাঝে বাতাসের কারণে গাছের শুকনা পাতা গুলো মরমর ধ্বনি করছে, আর সেই সাথে বাতাসের শন শন শব্দ শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে।
জঙ্গলের মাঝের জরাজীর্ণ কুড়েঘরটার নিচে, ল্যাবের বেড রুমের স্টাডি টেবিলে, নিজের কালো মলাটের মোটা নোটবুক টাতে কিছু একটা নোট করছে সাফওয়ান। রুমাইশা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। ওর জ্বর টা যেমন হুট করে এসেছিলো, তেমন হুট করেই নেই হয়ে গেছে। কোনো মেডিসিন লাগেনি। তারপর ও কিছুক্ষণ পর পর গিয়ে সাফওয়ান ওর কপালের তাপমাত্রা টা পরখ করে দেখছে।
দশ টার দিকে রুমাইশা একটু নড়েচড়ে উঠলো বিছানায়। সাফওয়ান সেদিকে তাকিয়ে নোটবুক টা বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো রুমাইশার কাছে৷ বিছানায় বসে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা রুমাইশার মুখের ওপর ঝুকে, নিজের ডান হাতের উপরিভাগ দিয়ে রিমুর চোয়ালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
সাফওয়ান হাতের স্পর্শে আধো ঘুমে থাকা রুমাইশার ঘুম ভাঙলো পুরোপুরি। ধীরে ধীরে ও চোখ মেলে তাকালো সাফওয়ানের দিকে। আর রুমাইশা চোখ মেলতেই সাফওয়ান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো রুমাইশার চোখের দিকে৷
রুমাইশার বাদামি রঙা চোখ দুইটা অবিকল সাফওয়ানের চোখের মতো ধুসর সবুজ রঙে পরিণত হয়েছে। চোখের গোলাকার পিউপিল টা লম্বা হয়ে তীর্যক আকার ধারণ করেছে। জ্বল জ্বল করছে চোখের মণি দুইটা, সাফওয়ানের চোখের থেকেও তার উজ্জলতা যেন কয়েকগুন বেশি৷
সাফওয়ান কে এইভাবে তাকিয়ে থাকিতে দেখে রুমাইশা ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কেন তাকিয়ে আছে। কিন্তু সাফওয়ান কিছুই বলল না। দৃষ্টি স্বাভাবিক করে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে রুমাইশা কে আস্বস্ত করলো যে কিছুই হয়নি।
এতক্ষনে রুমাইশার চোখ গেলো রুমের দিকে। এটা তো চিলে কোঠার রুম নয়, এটা তো ল্যাব এর রুম। সে এখানে এলো কিভাবে? রুমের এদিক ওদিক কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে সাফওয়ানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সাফওয়ান গম্ভীর গলায় বলল,
— তোকে রাফসান নিতে আসবে বিকেলে। তাই ভাবলাম দুজনে মিলে একটু নিরিবিলি সময় কাটালে মন্দ হয় না৷ তুই ঘুমিয়ে ছিলি তাই তোকে আর জাগায়নি৷ কোলে করে নিয়ে এসেছি এখানে।
সাফওয়ান কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু ওর দৃষ্টি রুমাইশার ওই জ্বলজ্বলে তীর্যক পিউপিলের চোখের দিকে। রিমুর চোখ দুইটা যেন সম্মোহনী শক্তি দিয়ে ওকে দুর্বল করে ফেলছে! ওই চোখে তাকালে কেমন যেন একটা ঘুম ঘুম ভাব আসছে, মাদকতা ময় হয়ে যাচ্ছে চার পাশ। সাফওয়ান যেন চোখ ফেরাতে পারছে না ওর ওই জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা থেকে।
রুমাইশা বিছানা থেকে উঠে বসলো, আর তখনি ওর নাকে এলো কোনো এক জংলি পশুর গন্ধ। ও নাক উচিয়ে এদিক ওদিক ফিরে গন্ধ শুকতে লাগলো। সাফওয়ান ওর এই অদ্ভুত কার্যকলাপে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হচ্ছে? কোনো গন্ধ আসছে?
রুমাইশা নাক মুখ কুচকে বলল,
— হ্যা, বিচ্ছিরি একটা গন্ধ আসছে৷ সম্ভবত কোনো জন্তুর হবে, শেয়াল ফেয়াল হয়তো! আপনি পাচ্ছেন না?
সাফওয়ান ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। রুমাইশার ক্যারেক্টারিস্টিক্স বোঝার চেষ্টা করছে ও৷ ও যে বদলের কথা জেনেছিলো সেটাই হয়তো কাল রাতের জ্বরের ভেতরে হয়ে গেছে, হয়তো জ্বর টা সেকারণেই হয়েছে!
রুমাইশা আবার ও নাক উচিয়ে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করলো, তারপর ই চুপ হয়ে গিয়ে কান খাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করলো ও৷ তারপর সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে সতর্কতার সঙ্গে বলল,
— আলনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন?
সাফওয়ান আবার ও ওর দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আগের মতো করেই মাথা নাড়ালো। কিন্তু রুমাইশার মুখে উদ্বেগ পরিলক্ষিত হলো। ও আর ও নড়ে চড়ে বসে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করলো আবার ও। তারপর সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত গলায় বলল,
— কিছু একটার হাটার আওয়াজ পাচ্ছি আমি, শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হাটছে, শব্দ টা সেকারণেই হচ্ছে৷ আপনি পাচ্ছেন না?
সাফওয়ান উত্তর দিলো না, পাল্টা প্রশ্ন করলো,
— কোন দিক থেকে আসছে?
রুমাইশা আর ও একবার কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে বলল,
— ওপরের দিক থেকে। শব্দ টা আস্তে আস্তে বাড়ছে।
সাফওয়ান রুমাইশার দিকে আবার কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— তুই এখানেই থাক, আমি দেখে আসছি ওপরে কিছু আছে কিনা৷
এরপর রুমাইশা কে রেখেই সাফওয়ান ল্যাবের সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কুড়েঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আর তারপরই দেখলো ওদের থেকে প্রায় বিশ/বাইশ গজ দূরে আসলেই একটা খেকশিয়াল খাবারের খোজে মৃদু পায়ে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেটে এদিকেই আসছে, আর কিছুক্ষণ পর সেটা কোনো মানব জাতির উপস্থিতি টের পেয়েই পেছন দিকে ঘুরে ছুটে পালিয়ে গেলো।
সাফওয়ান সেদিকে কিছুক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেমে এলো আবার নিচে। আসার পর ই রুমাইশা বিছানা থেকে নেমে ছুটে এলো ওর কাছে, এসেই বলল,
— একটু আগেই কিছু একটা অনেক জোর শব্দ করে দৌড় দিয়ে চলে গেছে কোনো একদিকে৷ কি ছিলো ওটা? আপনি দেখেছেন?
সাফওয়ান ওকে আস্বস্ত করে বলল,
— ভয়ানক কিছু নয়, শেয়ালই ছিলো। খাবার খুজতে এসেছিলো হয়তো।
রুমাইশা নিরব হয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে রইলো। ওর মাথায় আসছে না, যে ও শুনতে পেলো, অথচ সাফওয়ান কেন শুনতে পেলো না।
এরপর আবার চোখ তুলে তাকালো ও সাফওয়ানের দিকে৷ নিজের সম্মোহনী দৃষ্টি ফেললো সাফওয়ানের মুখের ওপর৷ সাফওয়ান মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলো রুমাইশার চোখের দিকে৷ ওর মাথা ফাকা হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়াবি কোনো কিছুই ও সমস্ত মস্তিষ্ক হাতড়েও খুজে পাচ্ছে না। ওই চোখ দুইটা ওকে টানছে প্রচন্ড তীব্র ভাবে৷ সাফওয়ানের মাথা ঘুরে আসলো, চোখ দুইটা ছোট ছোট হয়ে আসলো, যেন এখনি বন্ধ হয়ে যাবে।
রুমাইশা এতক্ষন ধরে সাফওয়ানের এই হঠাৎ নিশ্চুপতা কে বোঝার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সাফওয়ান কে এইভাবে ঢুলতে দেখেই আতকে উঠলো ও। ভ্রু কুচকে চিন্তিত গলায় বলে উঠলো,
— কি হচ্ছে আপনার? ঠিক আছেন আপনি? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
আর সেই মুহুর্তেই সাফওয়ান জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো রুমাইশার গায়ের ওপর৷ কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে রুমাইশা সাফওয়ানের বিশালাকার দেহটার ভার সামলে নিলো। নিজের জায়গা থেকে দুইপা সরে গেলেও সাফওয়ান কে জড়িয়ে ধরে সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে রউলো ও। নিজের কাজে নিজেই চমকে গেলো রুমাইশা।
যেখানে সেদিন শাফিন আর ও দুজনে মিলেও বিশালদেহী সাফওয়ান কে বিছানায় তুলতে পারছিলো না, আজ অনায়াসেই সেই সাফওয়ানের সমস্ত দেহ টা ধরে নিয়েই ও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এখন অত শত চিন্তা করার সময় নেই ওর৷ দ্রুত পায়ে সাফওয়ান কে নিজের সাথ জড়িয়েই এক প্রকার টেনে নিয়ে আসলো বিছানার কাছে। তারপর সাফওয়ানের দেহের উর্ধাংশ টা বিছানায় রেখে নিম্নাংশটাও বিছানায় উঠিয়ে দিলো। তারপর সাফওয়ানের মাথা টা ভালোভাবে উঠিয়ে দিলো বালিশের ওপর। আর এরপর সাফওয়ানের স্টাডি টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতল টা এনে খানিক পানি হাতে নিয়ে ছিটিয়ে দিলো সাফওয়ানের মুখে।
মুখে পানির ছিটা পেয়ে সাফওয়ানের জ্ঞান ফিরলো। চোখ মেলতেই রুমাইশাকে ওর মুখের ওপর ঝুকে থাকতে দেখলো। রুমাইশা সাফওয়ান কে চোখ মেলতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হচ্ছে আপনার? দুর্বল লাগছে? হঠাৎ করেই পড়ে গেলেন আপনি। এমন তো আপনার হয়না কখনো! শাফিন কে জানাবো? আসতে বলবো?
সাফওয়ান কিছু বলল না, ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা৷ তারপর বিছানায় উঠে বসতে চাইলো, কিন্তু রুমাইশা থামিয়ে দিয়ে বলল,
— উঠবেন না, শুয়ে থাকুন। আপনার খাওয়া দাওয়া তে গাফিলতি হয়েছে নিশ্চিত। এইকারণে এইরকম হচ্ছে। আমি শাফিন কে বলছি ফুপ্পি আম্মু কে দিয়ে গরুর মাংস রান্না করে নিয়ে আসতে। তাহলে আপনার গায়ে আবার বল হবে৷ হাতির মতো একটা শরীর, হাতি বললেও ভুল হবে, ডাইনোসরের মতো শরীর! তো সে অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া করলেই তো হয়। তা না! না খেয়ে প্রেগন্যান্ট মেয়েদের মতো মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে!
সাফওয়ানের দিকে আঙুল উচিয়ে শাসনের সুরে বলল রুমাইশা৷ সাফওয়ান হাসলো মৃদু৷ তারপর রুমাইশা কে টেনে নিজের বুকের ওপর নিয়ে বলল,
— তুই তো একটু ভালো ভালো রান্না করে আমাকে খাওয়াতে পারিস, সেটা না করে শুধু আমার মায়ের পেছন পেছন ঘুরিস আর এখানে ওখানে খুন্তি নাড়াস!
রুমাইশা তেতে উঠে বলল,
— কে বলেছে আমি শুধু খুন্তি নাড়াই? আমি রান্না করি না? আমি প্রত্যেকদিন একটা না একটা কিছু রান্না করি। মোটেও আমাকে অপবাদ দিবেন না৷ একদম ফুপ্পি আম্মুর কাছে গিয়ে নালিশ করে দিয়ে আসবো। তখন আপনার পিঠে তাল পড়বে দেখে নিয়েন।
সাফওয়ান হেসে উঠলো, তারপর বলল
— এখানে একটা কিচেন আছে৷ যদিও আমি ব্যাবহার করেছি খুব কম। সেখানে মনে হয় মাকড়সা সংসার পেতেছে এখন। আপনি চাইলে সেই জায়গাটা রান্না বান্নার উপযুক্ত করে আমাকে আপনার শক্তি বর্ধক কোনো বিশেষ খাদ্য রান্না করে খাওয়াতে পারেন৷ এতে আমার দুর্বলতাও কাটবে, পারফরম্যান্স ও ভালো হবে। আপনিও আর চ্যাত চ্যাত করবেন না, খুশি থাকবেন।
রুমাইশা লজ্জা পেলো খুব। সাফওয়ানের বুকের বাম পাশে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,
— অসভ্য একটা, দিনে দিনে লাজ লজ্জা সব হারাই ফেলতাসে।
তারপর চোখ নামিয়ে নির্বিকার গলায় বলে উঠলো,
— আপনার পারফরম্যান্স এ আমি এমনেই খুশি। চ্যাত চ্যাত আমি অন্য কারণে করতেছি।
বলেই সাফওয়ানের বুক থেকে উঠে গেলো ও। সাফওয়ান দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
— উফফ, প্রশংশা! ধন্য আমি।
রুমাইশা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
— থাক, আর নকশা মারতে হবে না। ম্যালা খুশি হওয়ার মতো কিছু এখনো করেননি। কিচেন কোনদিকে তাই দেখিয়ে দিন।
সাফওয়ানের হাসি মুখ নিমিষেই দপ করে নিভে গেলো। সে নিজেও বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,
— অপমান!