অফিডিয়ান | পর্ব – ৪৭

হঠাৎ কারো গমগমে কন্ঠস্বর শুনে ভড়কে গেলো মারুফ লোকটা। চমকে উঠে দরজা দিয়ে বাইরে তাকালো ও। ওর চ্যালাব্যালা দের মাথার ওপর দিয়ে সাফওয়ানের মুখ টা স্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান।

পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মারুফের চ্যালাব্যালা গুলোও পেছনে তাকালো। বিশালাকার সাফওয়ান কে দেখে ওরা সম্মোহিতের মতো দরজা থেকে সরে দাড়ালো সাফওয়ান কে ভেতরে যেতে দেওয়ার জন্য৷ ধীর গতিতে ভারিক্কি পায়ে ভেতরে ঢুকলো সাফওয়ান।

নিজের থেকে এত লম্বা কাউকে দেখে মারুফ যেন দমে গেলো কিছুটা, কিন্তু সাহস হারালো না৷ সাফওয়ানের বলা কথা টাও ওর বোধগম্য হয়নি। নিজের আধিপত্য বুঝাতে ও তেজী কন্ঠে বলে উঠলো,
— আপনি কে? আমাদের ভেতর কার ঝামেলার ভেতরে আপনার কি কাজ? এখনি এখান থেকে বেরিয়ে যান৷ নেতা গিরি দেখিয়ে নাক গলাতে আসবেন না৷

মারুফের কথায় ডিপার্টমেন্ট হেড ধমকে বলে উঠলেন,
— মারুফ, ভদ্র ভাবে কথা বলুন। উনি আমাদের কলেজের একজন সম্মানিত শিক্ষক। জ্ঞানে, শ্রদ্ধায়, সম্মানে উনি আপনার থেকে অনেক অনেক গুন উপরে৷ নিজের অবস্থান টা ভুলে যাবেন না।

ডিপার্টমেন্ট হেডের কথা শেষ হতেই সাফওয়ান কঠিন কিন্তু শান্ত কন্ঠে মারুফের উদ্দেশ্যে বলল,
— যাকে আপনি একটু আগে তুই তোকারি করছিলেন তিনি আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রী কে রাস্তার কোনো লোক তুই তোকারি করবে বিষয় টা আমার কাছে খুবই মর্মান্তিক এবং দুঃখজনক।

এরপর সাফওয়ান মারুফের কাছাকাছি এগিয়ে এসে আগের মতো করেই বলল,
— এইটা একটা স্বনামধন্য কলেজ, কোনো সিনক্রিয়েট করার জায়গা নয়। দুই ক্লাসমেটের ভেতরে ঝামেলা হয়েছে সেটা তারা নিজেরা নিজেরাই মিটিয়ে নিবে। এর ভেতরে আপনার আমার ইনভলভ হওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু আপনি যেহেতু ইনভলভ হয়েই গেছেন, সেহেতু আমাকেও হতে হলো। বিষয় টা যখন তাদের থেকে আমাদের পর্যন্ত পৌছেই গেছে তখন আমাদের উচিত পার্সোনালি এর একটা সমাধান করা, এন্ড সেটা কলেজের ভেতরে নয়, বাইরে৷

সাফওয়ানের এমন ঠান্ডা স্বরে মারুফ যেন একটু আশকারা পেলো। দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে উঠলো,
— কোনো পার্সোনালি কিছু হবে না, যা হবে এখানেই। আর কি হবে সেটাও আমি জানিয়ে দিয়েছি। আপনার বউ কে এই মুহুর্তেই ক্ষমা চাইতে হবে আমার প্রেমিকার কাছে, আর সেটাও পায়ে ধরে। তাহলেই আমি তাকে ছেড়ে দেবো৷ আর আপনি যদি বাগড়া দিতে আসেন তাহলে আপনি যে এখানে মাস্টারি করেন সেটা আমি ভুলে যাবো। আমার অনেক বড় বড় নেতার সাথে পরিচয় আছে, আপনার চাকরি খেয়ে দিতে আমার দু মিনিট ও সময় লাগবে না। তাই যা বলছি চুপচাপ মেনে নিয়ে কেটে পড়েন।

সাফওয়ান বাকা হাসলো, কিন্তু মুখটা ঢাকা থাকার কারণে সে হাসি কারো দৃষ্টিগোচর হলো না। ও মারুফের দিকে আর ও দুই কদম এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
— যে ডিসিশনই নিবেন, ভেবেচিন্তে নিবেন। পরবর্তী তে আফসোস করলে কিন্তু আর কোনো লাভ হবে না। তখন পায়ে ধরে পড়ে থাকলেও ছেড়ে দিবো না৷

সাফওয়ানের এমন হুমকি মারুফের আত্মসম্মানে লাগলো। ওর চ্যালাব্যালা গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে ওর অ্যাকশন নেওয়ার আশায়। ওদের কাছে নিজের সম্মান বজায় রাখতে ও নিজেও হাতা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে গেলো সাফওয়ানের দিকে৷ তারপর গলা নাচিয়ে বলল,
— এই তুই কাকে ভয় দেখাচ্ছিস? আমি আফসোস করবো? এই মারুফ ভাই আফসোস করবে? আবার বলিস আমাকে ছেড়ে দিবি না! কে রে তুই? আফসোস তো এইবার তুই করবি। তোকে আর তোর বউ কে আমি আজ বুঝাবো আফসোস কি জিনিস৷

বলে দ্রুত গতিতে সাফওয়ানের পেছনে, কিছুটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা রুমাইশার দিকে হাত বাড়ালো ও রুমাইশা কে আঘাত করার উদ্দ্যেশ্যে।

রুমাইশা মারুফ কে এগিয়ে আসতে দেখেও ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো, নিজের জায়গা থেকে এক চুল ও নড়লো না। আর মারুফের হাত রুমাইশার শরীর স্পর্শ করার ঠিক আগ মুহুর্তেই সাফওয়ান ক্ষিপ্র গতিতে নিজের বাম হাত দিয়ে মারুফের গলা ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলে গেলো মারুফের পেছন দিক টার দেয়ালের কাছে। মারুফের পিঠ দেয়ালে ঠেকতেই দেয়ালের সাথে ঘসে নিয়ে ওকে গলা ধরেই উচু করে ধরলো সাফওয়ান৷ মারুফের বেটে খাটো শরীর টা হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। দম নেওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকলো ও৷

মারুফ কে এইরকম ভাবে তড়পাতে দেখে ওর চ্যালাব্যালা গুলোর কয়েক জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে এগিয়ে আসলো সাফওয়ানের দিকে৷ কিন্তু প্রথমেই যে এগোলো সাফওয়ান তার দিকে তাকিয়ে নিজের ডান হাতের তর্জনি উচিয়ে সাবধান করে দিলো।

সাফওয়ানের এই নিরব হুমকিতে সেই ছেলে গুলো পিছিয়ে গেলো। আগানোর সাহস পেলো না৷ আর মারুফের পাশে দাঁড়ানো মারিয়া এমন অবস্থা দেখে দূরে সরে গিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কেদে উঠলো আবার।

ডিপার্টমেন্ট হেড তাড়াতাড়ি সাফওয়ানের কাছাকাছি এসে বললেন,
— সাফওয়ান, বাবা, মাথা গরম করো না৷ তুমি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক৷ তুমি মারদাঙ্গা করলে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে৷ আমাদের কলেজের সুনাম নষ্ট হবে৷ বাইরের ছেলে দের সাথে শিক্ষক হয়ে তুমি ঝামেলা করো না। এইটা এখন তোমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। যা করার তোমরা কলেজের বাইরে গিয়ে করো৷

হেডের কথা শুনে সাফওয়ান মারুফের গলায় আর একটু জোরে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিলো ওকে৷ মারুফ উচু থেকে মেঝেতে আছড়ে পড়লো৷ সাফওয়ান ওর দিকে চোখ মুখ কুচকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীর পায়ে সরে এলো পেছন দিকে৷

মারুফ মেঝেতে পড়ে নিজের গলায় হাত বুলাতে বুলাতে হাসফাস করতে করতে ওর সাথের ছেলেদের বলল,
— এই, তোরা ধর ওকে। ওর কত বড় সাহস! আমাকে গলা ধরে উচু করে।

কিন্তু এই কথা বলার সাথে সাথেই সাফওয়ান আবার ক্ষিপ্র গতিতে গিয়ে মেঝেতে বসে থাকা মারুফের মুখ বরাবর একটা ঘুষি মেরে দিলো। আর সে ঘুষির তোড়ে মারুফের সামনে থেকে একটা দাঁত ছিটকে বেরিয়ে এসে মেঝেতে শব্দ করে পড়ে ছুটে গেলো কোনো এক দিকে। আর মারুফ জ্ঞান হারিয়ে সাথে সাথেই মেঝেতে পড়ে গেলো৷

সাফওয়ান মারুফের চ্যালাব্যালা দের কে কড়া গলায় বলল,
— এই বেয়াদব টাকে নিয়ে এই মুহুর্তে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাও৷ দ্বিতীয় বার যেন একে আমি কলেজের ত্রিসীমানায় না দেখি৷

মারুফের সাথের কয়েক জন ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে মারুফ কে ধরাধরি করে উঠিয়ে নিয়ে চলল বাইরে৷ মারিয়াও দ্রুত পায়ে ওদের সাথে সাথে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো৷
সাফওয়ান পেছন থেকে আবার আগের মতো করে বলে উঠলো,
— ওর ওই নোংরা দাঁত টাও নিয়ে যাও, ওর কোনো চিহ্ন এইখানে দেখতে চাই না আমি।

সাফওয়ানের কথায় দলের পেছন থেকে একটা ছেলে ফিরে এসে মেঝে থেকে মারুফের খুলে যাওয়া দাঁত টা কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো৷

ডিপার্টমেন্ট হেড যেন হাফ ছেড়ে বাচলেন। এই ঝামেলার কথা প্রিন্সিপালের কানে গেলে ব্যাপার টা তার বা সাফওয়ান কারো জন্যই ভালো হবে না৷ তাই সাফওয়ান কে বললেন ব্যাপার টা সম্পুর্ন চেপে যেতে। সাফওয়ান ডিপার্টমেন্ট হেডের কথায় সম্মতি জানিয়ে রুমাইশার দিকে এক নজর তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নিজের ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে। আর রুমাইশাও তার পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে।

৪৮. দুপুর গড়িয়ে বিকাল হওয়ার পথে। লুকাস ও তার দলবলের পুরো জঙ্গল খোজা শেষ কিন্ত তারা একটা রক্ত মাখা ট্র‍্যাকার ছাড়া আর কিছুই পায়নি। লুকাস বুঝলো সাফওয়ান তাদের বোকা বানিয়েছে। নিজের শরীরের ট্র‍্যাকার টা খুলে এই খানে রেখে গিয়েছে। এক মিলিয়ন ডলার হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে লুকাসের মুখ টা থমথমে হয়ে আছে।

শেষ চক্কর টা দিয়ে এসে দিয়েগো বলল,
— বস, আমরা কিছুই পেলাম না। ওই সাফওয়ান বাস্টার্ড টা আমাদের ধোকা দিয়েছে। ও কুষ্টিয়া তে ট্র‍্যাকার ফেলে গেছে। আমাদের এখন যশোরে যেতে হবে। ওকে ওখানেই পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। কারণ কুষ্টিয়া তে ওর ট্র‍্যাক দেখার আগে সর্বশেষ ও যশোরেই ছিলো।

লুকাস নিজের ডান হাত টা মুষ্টিবদ্ধ করে বিড় বিড় করে বলল,
— তুই যেখানেই যাস না কেন, তোকে আমিই খুজে বের করবো, আর কাউকে তোকে খুজে পেতে দেবো না৷ ওই টাকা টা আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবো না।

এরপর দিয়েগোর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— এখনি সবাই কে গাড়িতে উঠতে বলো। যশোরে যত গুলো ঘন জঙ্গল আছে সব কটা সার্চ করে দেখবো আমি। ওকে জঙ্গলেই পাওয়া যাবে। কারন সেটাই ওর ফাইনাল ডেস্টিনেশন৷

লুকাসের আদেশে দিয়েগো সবাই কে জড় করে আবার গাড়িতে উঠিয়ে যশোরাভিমুখে রওনা হলো৷ সব গুলো জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুজে সাফওয়ানকে না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না ওরা৷

.

মাগরিবের আযান পড়ে গেছে৷ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে৷ সাফওয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গাড়ির ভিউ মিররে তাকিয়ে ড্রাইভ করে চলেছে। ওর পাশে চোখে মুখে উৎকন্ঠা নিয়ে দুরু দুরু বুকে বসে আছে রুমাইশা৷ কারণ এই মুহুর্তে ওদের গাড়িটাকে ফলো করছে আর ও দুইটা গাড়ি।

কলেজ থেকে বেরনোর পর রুমাইশার অভিমান ভাঙানোর উদ্দ্যেশ্যে সাফওয়ান ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। রুমাইশার ফুল অনেক পছন্দ হওয়ায় সাফওয়ান ওকে গদখালি তে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঝিকরগাছা বাজার পার হতেই সাফওয়ানের নজরে আসে দুইটা মাইক্রোবাস৷ যাদের কে প্রথমে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও ক্রমে সেটা অস্বাভাবিকে রূপ নিয়েছে। আর তখন থেকেই সাফওয়ান ওর ড্রাইভিং কন্টিনিউ রেখেছে, কোথাও থামায়নি।

রুমাইশা জানে না যে ওরা আসলেই কোথায়। আর সাফওয়ানই বা ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে৷ সাফওয়ান অনেক ক্ষণ ধরে ঘড়ি দেখছে আর রাস্তার আশপাশ টাতে নজর বুলাচ্ছে৷ সাফওয়ানের মুখ ঢাকা থাকায় ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে না রুমাইশা। তবুও থেকে থেকে সাফওয়ানের দিকে তাকাচ্ছে ও৷

মিনিট দশেক ড্রাইভিং করার পর হঠাৎ করেই ব্রেক কষলো সাফওয়ান। আর তার সাথে সাথে থেমে গেলো পেছনের দুইটা গাড়িও৷ চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে রুমাইশা বুঝলো এইটা কোনো জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা। আর জায়গাটা ও বেশ নির্জন। আর বৃষ্টির কারণে নির্জনতা টা আর ও বেশি জেকে ধরেছে।

উৎকন্ঠিত রুমাইশা চকিতে একবার সাফওয়ানের দিকে তাকালো। সাফওয়ান রুমাইশা কে এত চিন্তিত দেখে ডান হাত টা দিয়ে ওর চোয়াল ছুয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল,
— একদম চিন্তা করিস না, চুপ চাপ এইখানে বসে থাক। বাইরে বের হবি না কোনো মতেই। আমি শুনে আসি, ওদের সমস্যা কি।

এই বলে সাফওয়ান গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। তারপর গাড়ির দরজা টা আবার লাগিয়ে দিয়ে পেছনের গাড়ি দুটোর দিকে এগোলো।

সাফওয়ান কে বের হতে দেখে পেছনের গাড়ি দুটো থেকে একে একে প্রায় জনা বিশেক লোক বের হয়ে এলো। প্রায় সবার হাতেই লাঠি সোটা, কারো কারো হাতে আবার চাকুও দেখলো সাফওয়ান। মাস্কের তলে ক্রুর হাসি হেসে ও নির্ভয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

লোক গুলোর ভেতর থেকে কিছুটা সকালের মারুফ ভাইয়ের আদলের একজন এগিয়ে এলো। মারুফের থেকেও কিছুটা বয়স্ক মনে হলো তাকে। মুখের ভেতর পান চিবাচ্ছে সে, হাতে তার হকিস্টিক।

সাফওয়ান এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দুই হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
— জ্বি, বলুন। আপনাদের কি সমস্যা। আমাকে গত চার ঘন্টা ধরে কেন ফলো করছেন৷

পান চিবানো লোকটা মুখ থেকে এক দলা খয়েরী রঙা থুথু ফেলে বলল,
— তুই দাড়ালি দাড়ালি, জঙ্গলের ভিত্রে এসে দাড়ালি! মানুষ জনের মইধ্যে দাড়াইলেও তো তোর বাচার এট্টা চান্স ছিলো। কিন্তু সেইডাও তুই হারালি। আচ্ছা, সমেস্যা না, ভালোই হইলো! এহন তোরে আমার হাতের তে আর কেউ বাচাতি পারবে না। এই জঙ্গলেই তোরে পুতে রাইখে যাবো আমি৷ আর তোর গাড়িতে বসা সুন্দরী বউ রেও উড়াই দেবো। তুই মাস্টর, মাস্টরের মতো থাকবি। তুই ক্যান ছেলে পেলের মারামারির ভেতর যাবি? গেলি গেলি, আমার ভাইডারে মাইরে দাঁত ফেলায় দিলি কেন? ওর একটা দাঁতের জন্যি তোর বত্রিশ টা দাঁত ফেলাবো আমি, তবেই আমার নাম মঈনুদ্দিন।

বলেই আর একবার পানের পিক ফেললো মঈনুদ্দিন। সাফওয়ান মঈনুদ্দিন এর দিকে আরও খানিক এগিয়ে এসে বলল,
— আসলেই জঙ্গলের ভেতর আসা তোদের উচিত হয়নি। এখান থেকে বেচে ফেরা আদতেই অসম্ভব ব্যাপার৷

মঈনুদ্দিন এর এত কথা শোনার টাইম নেই৷ ও সাফওয়ানের কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছনের ছেলে গুলোকে বলল,
— এই ধর এরে, ধরে ওর মাস্টরি বাইর করে দিবি একদম। ঠ্যাং দুখান এমন ভাবে ভাংবি যেন ওর সুন্দরী বউ সারাজীবন সেবা করলেও ঠিক না হয়। গুড়ো গুড়ো করে ফেলবি একদম।

মঈনুদ্দিনের বলা শেষ হতে না হতেই সাফওয়ান মঈনুদ্দিনের হাত থেকে হকিস্টিক টা ক্ষিপ্র গতিতে কেড়ে নিয়ে মাথার বাম পাশ বরাবর শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে বাড়ি দিলো।
এক বাড়িতে হকিস্টিক এর মাথা টা ভেঙে ছিটকে পড়লো এক পাশে। আর মঈনুদ্দিন জবান বন্ধ হয়ে হাটু গেড়ে মাটিতে বসেই ধপ করে পড়ে গেলো রাস্তায়। মাথা থেকে কল কল করে রক্ত বের হয়ে রাস্তা ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলো।

সাফওয়ান এবার তাকালো ওর সামনের ছেলে গুলোর দিকে৷ ওরা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে সাফওয়ানের দিকে৷ সাফওয়ান ওদের দিকে দৃষ্টি রেখেই ধীরে ধীরে নিজের পাঞ্জাবি টা খুলে ছুড়ে দিলো ওর মার্সিডিজ বেঞ্জের ওপরে। সাফওয়ানের পেশিবহুল দেহ টা দৃশ্যমান হয়ে যেন প্রতিপক্ষ কে নিঃশব্দে হুমকি দিলো।

আর এরপরই সাফওয়ান নিজের মুখ থেকে মাস্ক আর গগলস টা খুলে আগের মতো করেই ছুড়ে দিলো পেছনে৷
আর তারপর ছেলে গুলোর দিকে ওর উজ্জ্বল চোখ দুইটা দিয়ে শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ক্যানাইন দাঁতদ্বয় দৃশ্যমান করে ভয়ঙ্কর রকমের একটা হাসি দিলো৷

সাফওয়ানের হুলিয়া দেখে সামনে দাড়ানো ছেলে গুলোর শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে গেলো। কয়েক জনের হাত থেকে লাঠি সোটা গুলো পড়ে গেলো মাটিতে। আর এরপরই ওদের কয়েক জন সাফওয়ানের সামনে থেকে দৌড়ে নিজেদের জান বাচাতে পেছন দিকে ছুটে পালানোর পায়তারা করলো।

কিন্তু সাফওয়ান বিদ্যুৎ গতিতে দৌড়ে পালানো ছেলেগুলোর একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর সাফওয়ানের এহেন গতিতে সেই ছেলে গুলো সহ বাকি সবাই চমকে গিয়ে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ানের দিকে।

সাফওয়ান দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করা ছেলে গুলোর দিকে আগের মতো করেই হেসে ধীরে ধীরে আগাতে থাকলো। আর ছেলে গুলো ভয়ে ভয়ে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে একে অপরের সাথে বেধে যেতে লাগলো, কিন্তু সেদিকে ওদের ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। ওদের সমস্ত মনোযোগ এখন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্বলজ্বলে চোখের এই হিংস্র মানব টির দিকে৷

সাফওয়ান আগাতে আগাতে নিচে পড়ে থাকা একটা হকিস্টিক হাতে নিলো। আর তারপরই ক্ষিপ্র গতিতে এসে মুহুর্তের ভেতর হকিস্টিক এর এক আঘাতে সবার সামনে থাকা তিন জনকে ধরাশায়ী করে ফেললো। মাটিতে পড়ে কোকাতে থাকলো ওরা৷

এরপর মাটিতে পড়ে থাকা একটা ধারালো চাকু নিচু হয়ে ঝুকে হাতে উঠিয়ে নিলো সাফওয়ান।
আর তারপর ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে গুলোর দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ডেভিলের মতো হেসে নিচে পড়ে থাকা ছেলে গুলোর একটার কাছে গিয়ে তার গলার নল বরাবর হাতের চাকু টা ক্ষিপ্র গতিতে ঢুকিয়ে দিলো। আর এরপর আবার চাকু টা টেনে উঠাতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো সেখান থেকে। চিৎকার করার সুযোগ ও পেলো না সে৷

এরপর অন্য ছেলেটার কাছে এসে হাতের চাকু টা ঘুরিয়ে শুণ্যে চেলে দিয়ে আবারও সেটা খপ করে ধরে খচ করে ঢুকিয়ে দিলো ছেলেটার বাম চোখের ভেতরে৷ আর ছেলেটা চিৎকার দিতে নিতেই চাকুটা ওর চোখ থেকে বের করে ওর মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে এক টান দিয়ে মুখ টা দুই ফালি করে দিলো।

এতসব কিছুর ভেতরেও ওর চোখ ছিলো সামনে থাকা ছেলে গুলোর দিকে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে আছে ওরা সাফওয়ানের দিকে, যেন পা সরাতে ভুলে গেছে! চিৎকার দেওয়ার মতো শক্তিও পাচ্ছে না যেন ওরা।

দ্বিতীয় ছেলেটার মুখ থেকে চাকু বের করে সেটা দূরে ছুড়ে দিলো সাফওয়ান। এরপর ধীর গতিতে মাটিতে পড়ে থাকা অন্য ছেলেটার কাছে গিয়ে ওর ঘাড় ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে ঘাড় টা মচকে মাথা টা ঘুরিয়ে দিলো৷ ছেলেটা সেখানেই জান খোয়ালো।

এরপর উঠে দাড়ালো সাফওয়ান, দরাজ গলায় সামনে থাকা ছেলে গুলোর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
— আমি আজ পর্যন্ত কখনোই অস্ত্র ব্যাবহার করিনি। আমার এই দেহই যে কাউকে ওপরে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! কিন্তু আজকের ব্যাপার টা অন্যরকম৷ আজ আমার বউ আছে সাথে। তাই কাজগুলো দ্রুত সারতে চাই।

এরপর ছেলে গুলোকে হাতের তর্জনি দিয়ে ইশারা দিয়ে সামনের বৃষ্টি ভেজা ফাকা রাস্তা টা দেখালো, তারপর ভ্রু দুইটা নাচিয়ে ক্রুর হাসি হেসে বলে উঠলো,
— পালা!

সাফওয়ানের মুখ থেকে বের হওয়া এ শব্দ টা যেন ওদের ওপর জাদুর মতো কাজ করলো। উর্ধশ্বাসে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র গুলো ফেলে দিয়ে ছুটলো ওরা সাফওয়ানের বিপরীত দিকের রাস্তায়৷

সাফওয়ান দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। ওদের এইভাবে দৌড়াতে দেখে যেন অদ্ভুত রকমের পৈশাচিক আনন্দ পেলো ও৷ আর তখনি নিজের প্যান্টের পকেট থেকে কলমের চেয়ে কিঞ্চিৎ লম্বা, ইঞ্চি তিনেক পুরু একটা মেটালিক দন্ড বের করলো ও। আর এরপর সেটার মাঝখান টা মুষ্টি করে ধরতেই দন্ড টার দুই পাশ থেকে দুই হাত লম্বা, শক্ত, ধারালো, তীক্ষ্ণ ব্লেড সদৃশ দুইটা দন্ড বের হলো। গাড়ির হেডলাইটের মৃদু আলোয় ঝকমকিয়ে উঠলো সেগুলো।

আর সেটা হাতে নিয়েই সাফওয়ান ঝড়ের গতিতে ছুটে চলল উর্ধশ্বাসে দৌড়ে পালানো ছেলেগুলোর দিকে৷ আর মুহুর্তেই তাদের কাছে পৌছে মেটালিক দন্ড টা আড়াআড়ি ভাবে ধরে ছুটে চলে গেলো ওদের মাঝখান দিয়ে।
আর ব্লেডের সংস্পর্শে আসা ছেলেগুলোর দেহ সাথে সাথেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে গেলো রাস্তায়। ওদের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে, রক্তে লাল হয়ে আরও ভিজে উঠলো রাস্তার বৃষ্টি স্নাত পিচ৷

ওদের কে পার হয়েই সাফওয়ান মুহুর্তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলো। যে ছেলে গুলো ধারালো ব্লেডের হাত থেকে কোনোমতে বেচে ফিরলো ওরা ওদের সামনে সাফওয়ানকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডুকরে কেদে উঠে হাটু গেড়ে পায়ে পড়ে গেলো সাফওয়ানের৷
সাফওয়ানের কাছে কেদে কেদে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে কাকুতি মিনতি করলো ওরা৷ নিজেদের প্রাণ বাচাতে সাফওয়ানের পা ধরে পড়ে রইলো। পেছনে ওদের সাথী গুলোর নিথর দেহের দিকে বার বার তাকিয়ে সাফওয়ানের পা দুইটা জড়িয়ে ধরে ওদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য আকুতিভরা আবেদন জানালো ওরা। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সাফওয়ানের ওদের কে শেষ করার মাইন্ড সেট হয়ে গেছে। খুন চেপে গেছে ওর মাথায়। এখান থেকে ফিরে আসা ওর পক্ষে এখন অসম্ভব৷ তাই ওদের কাকুতি মিনতি সাফওয়ানের কর্ণকুহরে পৌছালো না৷

হাতের মেটালিক দন্ড টা উচু করে প্রফেশনাল দের মতো করে ঘুরিয়ে সেটা ডান দিক থেকে বা দিকে চালিয়ে দিলো ওর পায়ে পড়ে থাকা ছেলে গুলোর শরীর বরাবর৷ মুহুর্তেই ছেলেগুলোর আর্তনাদ থেমে গেলো চিরতরে। দেহের উপরিভাগ গুলো অভিকর্ষের টানে খসে পড়লো মাটিতে৷ কল কল করে রক্ত বের হয়ে সাফওয়ানের পা ভিজে উঠলো।

আর বেচে রইলো একটা মাত্র ছেলে। সে ভয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করে কাদতে কাদতে ছুটে পালাতে লাগলো সাফওয়ানের থেকে।
কিন্তু সাফওয়ান নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর হাসি হেসে দেখতে লাগলো ছেলেটার ওই ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা। আর তারপরেই ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গিয়ে ছেলেটার ঘাড় ধরে ফেললো ও পেছন থেকে। আর তারপর ই ছেলে টাকে নিজের দিকে হ্যাচকা টানে ঘুরিয়ে কামড় বসিয়ে দিলো ওর গলার নলিতে৷ আর তারপরই দাঁত দিয়ে হ্যাচকা টানে ছিড়ে নিয়ে এলো ছেলেটার শ্বাস নালি। ছেলেটার চিৎকার সেখানেই থেমে গেলো। রক্তের বন্যা বয়ে গেলো সমস্ত রাস্তায়।

এর পর ছেলে টাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে এত গুলো লাশের ভেতর দাঁড়িয়ে মেটালিক দন্ড টার মাঝখানে চাপ দিয়ে আবার আগের মতো করে নিয়ে সেটা প্যান্টের পকেটে রেখে দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দিলো সাফওয়ান। তারপর খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত, হিংস্র ভাবে হাসতে লাগলো ও৷ ওর হাসিতে আকাশ বাতাশ কেপে উঠলো যেন। বৃষ্টির দমকা ছাট এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো ওকে। রাস্তায় পড়ে থাকা রক্ত গুলো বৃষ্টির পানিতে বয়ে চলল স্রোতের সাথে।

আর এই সমস্ত খুনের দৃশ্য গুলো গাড়ির ভেতরে বসে স্পষ্ট ভাবে দেখলো রুমাইশা৷

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।