৪০. সেদিন বিকাল বেলা রাফসান এলো হাতে কয়েক রকমের মিষ্টি নিয়ে৷ রুমাইশা তখন চিলেকোঠার রুমে ভাত ঘুম দিচ্ছিলো। আর সাফওয়ান ল্যাপটপে কিছু নোট করছিলো।
রাফসান আসায় রুনিয়া খুশি হলেন অনেক। হলরুমে সোফায় রাফসান কে বসতে দিয়ে তিনি শাফিন কে বললেন রুমাইশা কে গিয়ে ডাকতে৷ শাফিন ওর রুমে পড়ছিলো। মায়ের আদেশ পালন করে সে গেলো রুমাইশা কে ডাকতে।
শাফিন গিয়ে রুমের দরজায় নক দিলে সাফওয়ান ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলো কে৷ শাফিন উত্তর দিলে সাফওয়ান চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দিলো৷ শাফিন বলল যে রাফসান এসেছে, সে আর রুমাইশা যেন নিচে যায় দ্রুত। খবর টা দিয়েই শাফিন আবার নিচে চলে গেলো দ্রুত পায়ে।
শাফিন যাওয়ার পর রুমের দরজা টা ভেজিয়ে দিয়ে সাফওয়ান এলো বিছানার কাছে। ঘুমন্ত রুমাইশার চোয়ালে আলতো হাতে কয়েক বার চাপড় মেরে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়ে বলল,
— তাড়াতাড়ি উঠ, নিচে যেতে হবে। আমার শালাবাবু এসেছে।
রাফসানের আসার কথা শুনে শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে পড়লো রুমাইশা৷ পরনে ওর আগের দিনে সাফওয়ানের নিয়ে আসা গোলাপি জমিনের ওপর সাদা কুচি ফুলের সুতির সালওয়ার কামিজ। রুনিয়া আজ দুপুরের আগে এইটা তৈরি করে দিয়েছে৷
ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে মুখে অল্প একটু ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে, কিঞ্চিৎ ফাটা ঠোঁটে আলতো করে ভেজলিন লাগিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো ও। সাফওয়ান ওকে আগে চলে যেতে বলল, ও পরে আসতে চাইলো। কিন্তু রুমাইশা শুনলো না। কাবার্ড থেকে একটা ফুল স্লিভ টি শার্ট বের করে সাফওয়ান কে জোর করে ধরে পরিয়ে দিলো। বেকুবের মতো করে রুমাইশার দিকে তাকিয়ে রইলো সাফওয়ান। বিয়ে হতে না হতেই বউ তার ওপর মাতবারি করা শুরু করে দিয়েছে
গোছ গাছ শেষে রুমাইশা রুম থেকে বের হলো। ওর পেছন পেছন সাফওয়ান ও বেরিয়ে এলো।
ওরা যখন দোতলায় এলো তখন রুনিয়া আর ইশতিয়াক হলরুমের সোফায় বসে রাফসানের সাথে গল্প করছিলেন।
ভাইকে দেখে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে দিয়ে রুমাইশা দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নামলো। পেছন থেকে সাফওয়ান ধমকে আস্তে যেতে বলল ওকে, কিন্তু কে শোনে কার কথা।
নিষেধ করা সত্বেও রুমাইশা এমন লাফালাফি করায় সাফওয়ান ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা। বিয়ের দিন মামা ওকে সত্যি কথাই বলেছিলো, আগে খুব শান্তশিষ্ট ছিলো পাগলি টা, এখন দুনিয়ার খচ্চর হয়েছে।
ছোটবেলায় সাফওয়ান যা বলতো তাই শুনতো রুমাইশা, একটা কথাও এদিক ওদিক হতো না। অতি সিনিয়র ভাইয়া হিসেবে সমীহ করে চলতো ওকে। কিন্তু এখন দেখো, বারণ করা সত্বেও হরিণের মতো লাফাইতে লাফাইতে নিচে গেলো, সিড়ির থেকে মুখ থুবড়ে একবার পড়লে নাচুনি বেরিয়ে যাবে!
বিড় বিড় করতে করতে নিচে নামলো সাফওয়ান। সাফওয়ানকে দেখে রাফসান বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে সাফওয়ানের সাথে করমর্দন করে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো। দু দিন আগেও যে নিজেদের ভেতরে ভার্চুয়ালি তাদের একটা দা কুমড়া সম্পর্ক ছিলো তা ভুলে গেলো নিমিষেই।
সাফওয়ান পিঠ চাপড়ে দিলো রাফসানের, তারপর বলল,
— কতগুলো বছর পর আবার আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম, ভাই আমার।
রাফসান হেসে উঠলো, তারপর কোলাকুলি শেষ করে রাফসান দাড়িয়েই সাফওয়ানের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে দুই হাত দিয়ে সাফওয়ানের পেশিবহুল বাহুদ্বয় শক্ত করে ধরে বলল,
— ভাই তো পুরো জনসিনা হয়ে গেছো! করেছো কি?
তারপর হঠাৎই দুজন দুজনের দিকে চমকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক স্টাইলে হ্যান্ডশেক করে ডান হাতের কবজি মুখের সামনে নিয়ে এসে জনসিনা স্টাইলে হাতের আঙুল গুলো ছড়িয়ে দিয়ে সমস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
— ইয়্যু কান্ট স্যি ম্যি
তারপর হেসে আবার দুজন দুজন কে বুকে জড়িয়ে নিলো। এদের বাচ্চামি কান্ড কারখানা দেখে বাকিরা হেসে উঠলো। দুই ভাইয়ের সেই আগেকার মতো মোহাব্বত দেখে রুমাইশা খুশি হলো প্রচন্ড। মন খুলে হাসলো ও আজ অনেক গুলো দিন পর।
ওর মনে আছে, ছোটবেলায় যখন এ বাড়িতে আসতো ওরা, তখন শুধু একতলা বাড়ি ছিলো রুনিয়া দের, সেটাও সাধারণ বাড়ি। নতুন করে বাড়ি করেছে ইশতিয়াক বছর দশেক হলো। ইশতিয়াক করেছে বললে ভুল হবে, বেশির ভাগ অর্থ সাফওয়ান ই দিয়েছে।
তখনকার একতলা বাড়িটার গেস্টরুমে একটা সাদাকালো টেলিভিশন রাখা ছিলো। সেখানে সুযোগ পেলেই ডাব্লিউ ডাব্লিউ ই এর সিডি প্লে করতো ওরা। তারপর বিছানার ওপর সাফওয়ান আর রাফসান মিলে কুস্তিগিরি করতো, রেফারি হতো রুমাইশা। যদিও মাঝে মাঝে রেফারির গায়ে দুই একটা ছুটা আঘাত লেগে যেত ভুল বসত, তখন রেফারি আকাশ বাতাস কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে কাদতো, আর এই দুইজন নিষ্পাপ প্রতিযোগি তখন নিজেদের কুস্তিগিরি রেখে রেফারির সেবা যত্নে লেগে পড়তো।
ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো রুমাইশা। ওরা সবাই মিলে গল্প করলো অনেক ক্ষন। কিছুক্ষন পর শাফিন ও এসে যোগ দিলো ওদের সাথে। অতঃপর মাগরিবের আযান দিলে আসর ছেড়ে উঠলো সবাই।
.
রাফসান রাত টা এখানেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু আজ ওরা প্লান করলো চার জন একসাথে ঘুমাবে ছাদের ওপর বিছানা পেতে। অনেক অনেক দিন থাকা হয়না আগের মতো করে৷ আর শাফিনের তো সুযোগই হয়নি। রাফসান রা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার সময় তো ওর বয়স ছিলো ৬/৭ মাস। সেসময় মায়ের কোলেই থাকা হতো ওর। আজকের এই ঘটনা ওর জন্য সম্পুর্ন নতুন। তাই ও রকটু বেশিই এক্সাইটেড।
রাতে খাওয়ার পর ওরা সবাই বিছানা পত্র, বালিশ কাথা নিয়ে চলে এলো ছাদে। আকাশ পরিষ্কার, মেঘের একটা কুচি ও নেই। কিন্তু তারপর ও মেঘের মুড সুইং এর কথা চিন্তা করে ওরা ভেবে নিলো যে যদি বৃষ্টি আসে তাহলে ওরা সাফওয়ানের রুমে চলে যাবে।
রুমাইশা ছাদের ওপর পাটি পেতে তার ওপর একটা লম্বা তোশক বিছিয়ে দিলো। এরপর তার ওপর বেডশিট পেতে বালিশ গুলো সুন্দর করে পেতে রাখলো। সাফওয়ান হাতে হাতে সাহায্য করলো ওকে।
রুম টাও গুছিয়ে রেখে এলো যেন বৃষ্টি আসলে রুমে গিয়েই শুয়ে পড়তে পারে, কষ্ট না করতে হয় বেশি।
তারপর সব গোছগাছ শেষে বিছনার বাম পাশে শুয়ে পড়লো শাফিন, তারপর রাফসান। রাফসানের পাশে সাফওয়ান শুয়ে পড়লো, আর সাফওয়ানের পাশে, বিছানার ডান দিকটায় রুমাইশা।
ঘুমানোর আগে পর্যন্ত ওরা ওদের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করলো। ওরা কেমন দুষ্টামি করতো, জঙ্গলের ভেতরের ডোবায় গিয়ে কিভাবে হুটোপুটি করে আসতো, তারপির আবার রুনিয়ার হাতে মার খেতো!
সাফওয়ান কাকে কাকে রুমাইশার জন্য বেদম মার দিয়েছিলো, কাকে কাকে কি শাস্তি দিয়েছিলো, আর তারপর সেই বিভীষিকাময় দিন টার গল্প, যে দিন টাতে ওদের সবার ভেতর কার বন্ধনচ্যুতি ঘটেছিলো।
এরপর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর সাফওয়ান কিভাবে থেকেছে, কিভাবে খেয়েছে, বন্ধুবান্ধব কজন হয়েছে, ওর ব্যাপারে কেউ জানে কিনা, এই সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা হলো অনেক রাত পর্যন্ত৷
গল্প শুনতে শুনতে শাফিন আর রুমাইশা দুজনেই এক সময় ঘুমিয়ে গেলো, জেগে রইলো শুধু সাফওয়ান আর রাফসান।
শাফিন আর রুমাইশার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে যেতেই উঠে বসলো ওরা দুজন। তারপর ছাদের অন্য কোণায় গিয়ে রেলিঙের ওপর বসলো। দুজনেই নিরব রইলো খানিক সময়। নিরবতা ভেঙে রাফসান বলে উঠলো,
— তোমার দ্রুতই কিছু একটা করা দরকার ভাই, নইলে ওরা যেভাবে তোমার পেছনে লেগে আছে কখন না জানি এই বাড়িতেই চলে আসে, তখন সবারই লাইফ রিস্ক হয়ে যাবে।
সাফওয়ানের চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো, তীর্যক হয়ে গেলো চোখের চাহনি। ভ্রু দুইটা কুচকে গেলো ওর।
মাথা নাড়িয়ে বলল,
— ওরা বিডিতে এসে পৌছেছে গতকাল রাত দুইটায়। তখনি খবর পেয়েছি আমি৷ এখন ওরা আমাকে তন্ন তন্ন করে খুজবে৷ কিন্তু আমি সব ব্যাবস্থা করে রেখেছি। আমাকে না পেলেও আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি ওরা করবে না সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ এটা আমাদের রুলস। আর ওরা গ্যাঙ এর রুলস ব্রেক করবে না। আমার চিন্তা শুধু রিমু কে নিয়ে, ও আমার স্ত্রী। ওরা আমার বাবা মা, ভাই, অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের কোনো ক্ষতি না করলেও আমার স্ত্রী কে ওরা ছাড়বে না, কারণ সেই আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।
— তাহলে কি করবে তুমি এখন? ওদের হাত থেকে বাঁচার উপায় কি? তুমি তো বলেছিলে ওরা যদি আসে তবে পুরো গ্যাঙ ধরে আসবে।”
চিন্তিত গলায় বলল রাফসান৷
সাফওয়ান ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা, কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে উঠলো,
— আমি দু সপ্তাহ আগে রিমুর পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। হাতে আসেনি এখনো। কাল পরশুর ভেতরেই চলে আসবে আশা করা যায়৷ এরপর ভিসা আসার আগে পর্যন্ত আমি রিমু কে নিয়ে আমার ল্যাবে গিয়ে থাকবো। ভিসা লেগে গেলেই চলে যাবো বাইরে।
রাফসান অবাক হলো সাফওয়ানের কথায়, রুমির সাথে বিয়ের আগেই ও পাসপোর্ট করতে দিয়েছে! ও এত নিশ্চিত কিভাবে ছিলো যে বিয়ে টা ওর রুমির সাথেই হবে?
রাফসান কে এইভাবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফওয়ান ওকে আঙুল দিয়ে খোচা দিলো একটা। তারপর বলল,
— যা জিজ্ঞেস করবি সরাসরি জিজ্ঞেস কর, মনে মনে রেখে এইভাবে তাকালে তো আর আমি বুঝতে পারবো না!
রাফসান ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি এত নিশ্চিত কিভাবে ছিলে যে রুমির সাথেই তোমার বিয়ে হবে!
সাফওয়ান ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
— আমার শরীরে ট্র্যাকার সেটাপ করা ছিলো। আমি কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি, সেখানে কে কে আছে, কার কি পরিচয় ওরা সবই বুঝতে পারবে স্যাটেলাইটের সাহায্য নিয়ে। আমার যে রিমুর সাথে একটা এট্যাচমেন্ট আছে সেটা ওরা অবশ্যই বুঝতে পারবে। তাই রিমুর পাসপোর্ট আমি আগেই করে রেখেছিলাম। আমার সাথে বিয়ে না হলেও ওকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হতো। অন্তত দেশের বাইরে পাঠাতে হতো৷ নইলে ওরা যেভাবেই হোক রিমু কে খুজে বের করে ফেলতো৷
আর বডিতে সেটাপ করা এই ট্র্যাকার শরীরের ঠিক কোথায় বসানো হয় সেটা ওরা কাউকে বলে না। আমি এতদিন অনেক বার ট্র্যাকার টা ট্র্যাক করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। গত পরশু আমি সেটা আবিষ্কার করেছি আমার উরুর মাংসের ভেতর, আর খুজে পেয়েই সেটা বের করে তখনি নষ্ট করে ফেলেছি।
রাফসান চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো,
— এরা আসলে কারা ভাই?
সাফওয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
— এরা সে সমস্ত লোকজন যাদের আমরা খুব বাহবা দেই, যাদের কে আমরা অনেক শ্রদ্ধা, সম্মান করি। বাহ্যিক দুনিয়াতে তারা ভালো মানুষ বলেই বিবেচিত। অথচ ওদের ভালো মানুষির আড়ালে লুকিয়ে আছে বিকৃত সত্য। সাদা টাকার আস্তরণ দিয়ে ঢেকে রাখা কালো টাকার পাহাড়ে যাদের আশপাশ টা ভর্তি।
রাফসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাফওয়ানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আজ সকাল বেলা সাফওয়ানের সাথে ওর কথা হয়েছে ফোনে৷ রাফসানের কাছে খবর এসেছিলো যে আমেরিকা থেকে একটা বিশাল মাফিয়া গ্যাঙ নাকি দেশে এসেছে। তাদের উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে রাফসান একটু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলো, আর তখনি ও কল দেয় সাফওয়ানের কাছে। সাফওয়ান সে বিষয়ে আগে থেকেই অবগত ছিলো।
ফোন কলে নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি গুলো মিটিয়ে নিয়ে নিজেদের সমস্যা সমাধানে বেশি জোর দেয় ওরা৷ রুমাইশা ওদের দুজনেরই প্রাণাধিক প্রিয়। এক জনের বোন, অন্য জনের স্ত্রী। তাই নিজেদের থেকে ওদের রিমু কে নিয়েই চিন্তা বেশি। সে এখনো এসবের কিছুই জানে না। রিমু কে বিষয় টা অবগত করার জন্য সাফওয়ান সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছে , যেন রিমু তাকে বোঝে এবং এই বিষয় টা নিয়ে ভড়কে না গিয়ে নিজেকে শক্ত করে নেয়৷
কিছুক্ষণ পর রাফসান আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কিন্তু তোমরা কোথায় যাবে? ভিসা লাগাতে হবে তো! বেশি দেরি করলে ভিসা লাগার আগেই ওরা তোমাকে পেয়ে যাবে৷ তখন কি হবে সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
— আমাজন যাবো।”
মেঝের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো সাফওয়ান৷ তারপর রাফসানের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
— আমার এই সমস্ত শারীরিক সমস্যা গুলোর একমাত্র সমাধান আমার রিমু৷ আমার দাঁত আর চোখ ছাড়া আমার বাকি সব সমস্যার প্রতিষেধক ও। আমার এই খসখসে খোলস ওঠা চামড়া, এই গায়ের অসম্ভব রকমের সরিসৃপ আকৃষ্টকারি গন্ধ, আমার দ্বিখন্ডিত কুচকুচে কালো জিহবা, এই সবকিছুর সমাধান শুধুমাত্র ও৷
বর্তমানে আমার শরীরের যে অবস্থা তাতে আমাজনে গেলেই আমি শান্তিতে থাকতে পারবো, স্বাধীন ভাবে চলার সাধ পাবো। আর আমার এই অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবো৷ নিজেকে সম্পুর্ন পরিবর্তন করে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
আমি এখনো জানিনা রিমু আমার জন্য ঠিক কত টা উপকারী। ক্ষনিকের ভেতরে আমি আমার গবেষণা দ্বারা যতটুকু ইনফর্মেশন পেয়েছি তার যে পুরোটাই সঠিক সেটাও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না৷ রিমু আমার জন্য আমার ধারনার থেকে বেশি কার্যকরী, না কি কম কার্যকরী সেটা দেখার জন্য আমাকে অন্তত বছর তিনেক অপেক্ষা করতে হবে৷ কিন্তু সেটা জনসাধারণের ভেতরে থেকে কখনোই সম্ভব নয়। আর তাছাড়া এই বন্দী জীবনে আমি অতিষ্ট হয়ে গেছি। আমি একটু স্বাধীনতা চাই। নিজের মতো করে বাচতে চাই তাই ওই জঙ্গল টাই হবে আমার জন্য বেস্ট একটা প্লেইস। আর আমার শরীর ও জঙ্গল পছন্দ করে অনেক অনেক বেশি।
— কিন্তু আমাদের রুমির কি হবে? ও কি ওখানে মানিয়ে নিতে পারবে? ওই স্যাতস্যেতে পরিবেশ; সাপ, পোকা মাকড়ের আড্ডাখানা; জনমানবহীন, সভ্যতাহীন জঙ্গলে ও কিভাবে থাকবে? কখনো কোনো অসুখ বিসুখ হলে তখন কি করবে? আর তুমিই বা সব কিছু কিভাবে ম্যানেজ করবা? একটা টিকটিকি দেখলেও ও দৌড়ে পালায়, আর বিছা দেখলে তো ভাত খেতে চায়না সারাদিন ঘেন্নায়। ও কিভাবে থাকবে ওই রকম পরিবেশে?
রাফসান কিছুটা রুক্ষ, কিন্তু চিন্তিত স্বরে বলল। সাফওয়ান ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর বলল,
— চিন্তা করিস না। আমাজনে আমি দু বছর থেকেছি, সম্পুর্ন একা। আর ওই দুবছর ছিলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ওরকম স্বাধীনতা আমি আমার জীবনে কখনো অনুভব করিনি।
আমাজনের সীমান্ত থেকে ত্রিশ হাজার কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে একটা নদি আছে। ওই নদীর নাম আমি দিয়েছি বিভীষিকা। কারণ বিভীষিকার মতোই তার রূপ। আজ পর্যন্ত কোনো সভ্যতা সেখানে পা রাখেনি। অদ্ভুত সব জীবজন্তু দিয়ে পরিপূর্ণ সে এলাকা৷ ওই খানে নদী থেকে কয়েক শ গজ দূরে আমি নিজের হাতে একটা কুড়ে ঘর বানিয়েছিলাম; মাটি থেকে ত্রিশ হাত ওপরে, বলতে গেলে গাছের ডালে পাখির বাসার মতো৷
ওই দুবছরে সেখানে থাকার মতো সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছিলাম আমি। সেটা এখন থেকে তিন বছর আগে। ওই এরিয়ার প্রতিটা স্থান আমার নখদর্পনে, হয়তো বহুদিন পর গেলে একটু দিকভ্রান্ত হতে হবে, কিন্তু সেটা ঠিক হয়ে যাবে কয়েকদিনের ভেতরেই।
হয়তো এতদিনে সে ছিমছাম জায়গা টা আবার মসে ভর্তি হয়ে গেছে। পোকা মাকড় এসে ঘর পাতিয়েছে সেখানে। আগাছায় হয়তো এখন সে জায়গা আবার পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি আমাজনে যাওয়ার পর রিমু কে নিয়ে সেখানেই যাবো। নিজেদের মতো করে আবার নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবো সব৷ রিমুর কোনো অসুবিধা হবে না আমি থাকতে। ওর নিরাপত্তাই আমার ফার্স্ট কনসার্ন, ফার্স্ট প্রায়োরিটি৷
রাফসান কি বলবে ভেবে পেলো না। এমন সভ্যতাহীন অঞ্চলে তার আদরের বোন কে গিয়ে থাকতে হবে, বুনো বাঘ ভাল্লুকের সাথে লড়াই করতে হবে ভাবলেই ওর শরীরের ভেতর কাটা দিচ্ছে। কিন্তু এখন ওর আর কিছু করার নেই। রুমি এখন সাফওয়ানের স্ত্রী, সাফওয়ান যেখানে যাবে রুমি কে ও সেখানেই যেতে হবে। আর সাফওয়ানের মতো দায়িত্বশীল পুরুষ যে রুমাইশার কোনো অযত্ন করবে না সেটাও রাফসান জানে। কিন্তু নিজের মন কে বোঝাতে পারছে না ও। তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ আবার নিজের বিছানায় যেতে উদ্যত হলো ও। আর যাওয়ার আগে বলল,
— ভিসা রেডি করে ফেলো তাড়াতাড়ি, নইলে ওরা টের পেলে তোমাদের দুজনের জীবনই সঙ্কটে। তোমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা আমার নেই, আমার চিন্তা আমার বোন কে নিয়ে। ও হয়তো তোমার সব কিছু মেনে নেবে, তুমি দুনিয়ার যে প্রান্তে যাও, সেও সেখানেই যেতে চাইবে, নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকবে আমার বোনের কাছে। আমার বাবা মায়ের মন মস্তিষ্ক সব তাদের মেয়ের কাছেই বাধা পড়ে থাকবে। নিজের মেয়েকে এইভাবে এতগুলো বছরের জন্য চোখের আড়াল করতে, কেউ চাইবে না। তার ওপর সম্পুর্ন যোগাযোগ বিহীন! সে বাচলো কি মরলো সেই নিশ্চয়তা ও আমরা কেউ পাবো না কোনোভাবে।
সে এখন তোমার স্ত্রী, তুমি ওকে যেখানে চাও নিয়ে যাও৷ কিন্তু এত গুলো মানুষের কলিজা ছিড়ে নিয়ে যে যাচ্ছো সেদিকে খেয়াল রেখো।
কথা গুলো বলে রাফসান গটগট পায়ে হেটে চলে গেলো বিছানার দিকে। তারপর রুমাইশার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো ও। সাফওয়ান রেলিঙেই বসে রইলো। দুঃশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে ওকে।