রুনিয়া এইভাবে হঠাৎ এসে উঠে দাড়াতে বলায় কিছুটা অবাক হলো রুমাইশা৷ দ্বিধান্বিত হয়ে ফোন টা পাশে রেখে দিয়ে উঠে দাড়ালো।
রুনিয়া ফিতা টা দিয়ে রুমাইশার বক্ষের মাপ নিতে নিতে বলল, তোর তো এইখানে আর কোনো জামাকাপড় নেই, কয়েক টা না বানালে পরবি কি? মাপ নিয়ে রাখছি, সাফওয়ান নয়তো শাফিন, নয়তো তোর ফুপ্পা; যে কেউ বাইরে গেলেই নিয়ে আসতে বলেছি।
রুমাইশা ও আর কিছু বলল না প্রতিউত্তরে৷ রুনিয়া ঠিক ঠাক মাপ নিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে৷ তারপর ব্লাউজ আর পেটিকোট বানানোর কাজে লেগে পড়লেন।
৩৯. সূর্য পশ্চিমে ঝুকে পড়েছে আকাশ লালচে আভায় ছেয়ে গেছে। গাছের ডালে পাখিরা কিচির মিচির করছে। বাড়িতে বিছানায় বসে আছে রাফসান৷ গা থেকে এখনো শার্ট প্যান্ট কিছুই খোলেনি ও। মাথার ওপর পুর্ণ গতিতে বৈদ্যুতিক পাখা চালানো৷
আয়েশা বসে আছেন ছেলের পাশে। শামসুল বাড়িতে নেই, বেরিয়েছেন একটু।
ভ্রমণের ক্লান্তিকর ছাপ ফুটে আছে রাফসানের চেহারায়। ঘামে শার্টের কয়েক জায়গা ভিজে উঠেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।
আয়েশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন,
— কাপড় ছেড়ে ফ্রেস হয়ে আয়, তোর জন্য খাবার দিচ্ছি টেবিলে। টেবিলে দেবো নাকি রুমে নিয়ে আসবো?
রাফসান উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
— টেবিলেই দাও, আমি আসছি এখনি।
আয়েশা চলে গেলেন। ছেলে বাড়ি ফেরায় খুব খুশি তিনি, কিন্তু খুশির ছাপ টা মুখে ফোটেনি। রুমাইশার সাথের মানসিক বিচ্ছেদ আর নিজের বোনের ছেলের মর মর অবস্থা ; দুই মিলিয়ে তিনি মোটেও স্বস্তিতে নেই।
জুবায়ের ভর্তি আছে হাসপাতালে। কলার বোন থেকে হাত খুলে গেছে। নাকের এক পাশের হাড়ে চিড় ধরেছে। ডাক্তার প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিয়েছেন। কয়েকদিন পরেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে ওকে৷
রাফসান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হাত মুখ মুছে টেবিলে বসলো। আয়েশা পাশে বসে ছেলে কে খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। রাফসান খাওয়া শুরু করলো। আয়েশা তাকিয়ে দেখছেন ছেলেকে। বাচ্চা গুলো কত দ্রুতই বড় হয়ে যায়। রাফসানের বয়স এখন আঠাশ ছুই ছুই। আয়েশার মনে হলো সেদিন রাফসান সমস্ত গায়ে ধুলাবালি মেখে গুটি গুটি পায়ে হেটে বেড়াচ্ছিলো সমস্ত উঠান জুড়ে। আর এখন সেই ছোট্ট রাফসান পরিপূর্ণ যুবক হয়ে বসে আছে তার সামনে। বিয়ে দিতে হবে খুব দ্রুতই!
খালি গায়ে বসে আছে রাফসান। ওর ফর্সা পিঠের বাহুর দিক টার কাছে অনেক গুলো তিল এক জায়গায় জড় হয়ে আছে। শরীরের আর কোথাও তিল নেই, এই একটা জায়গাতেই এক গাদা তিল ওর৷ গায়ের রঙ ওর রুমাইশার থেকেও ফর্সা৷ মাথার ঝাকড়া চুল গুলো প্রচন্ড রকম কালো। মুখ ভর্তি চাপা দাড়ি, আর তার সাথে গোলাপি ঠোট। চোখের পাপড়ি গুলো ঘন আর কালো! যেখানে চুলের আসলেই প্রয়োজন সেখানেই সৃষ্টিকর্তা ওকে পুরো ঢেলে ঢেলে দিয়েছেন৷
খাওয়ার এক পর্যায়ে রাফসান বলে উঠলো,
— রুমি কথা বলেছে ও বাড়িতে যাওয়ার পর একবার ও?
আয়েশা বললেন,
— কল দিয়েছিলো দুপুরের একটু আগে আমার কাছে, কিন্তু আমি রিসিভ করিনি।
রাফসান খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
— মা, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে, আটকাতে চেয়েও পারোনি, সেহেতু এখন আর রাগ পুষে রেখে লাভ কি বলো? তুমি ফোন দিয়ে কথা বইলো এক সময়। জানোই তো ও তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না! আর আমিও দেখি কথা বলবো রাতে একবার, আর পারলে একবার দেখে আসবো কাল গিয়ে ওকে।
আয়েশার চোখে পানি এসে গেলো৷ মেয়ের ওপর জেদের বসে অনেক অত্যাচার করেছেন তিনি, যা করা একদমই উচিত হয়নি তার। এখন খুব অপরাধবোধে ভুগছেন, আবার মেয়ের ওপর অভিমান ও হচ্ছে!
নিজের জীবিনের ঝুকি নিয়ে মেয়েটা বিয়ে করলো সাফওয়ান কে। এক টা ঝুকি তো এমনিতেই ছিলো, তার ওপর আর একটা ঝুকি এসে যুক্ত হয়েছে এখন৷ মড়ার ওপর খাড়ার ঘা এর মতো। তার মেয়ে এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু জানে কিনা সেটাও তিনি জানেন না এখনো।
গলা খাকারি দিয়ে আয়েশা অসহায় দৃষ্টিতে রাফসান কে জিজ্ঞেস করলেন,
— বিদেশের ওই লোক গুলো যিদি সাফওয়ান কে ধরে ফেলে তাহলে আমার রুমির কি হবে? ওরা কি আমার রুমির কোনো ক্ষতি করবে?
রাফসান আবার খাওয়া শুরু করে বলল,
— তুমি তো জানোই মা সাফওয়ান কেমন। ওর নিজের জান চলে যাবে তবুও রুমির গায়ে কোনো আচড় লাগতে দেবে না, ওকে এই দিক থেকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো৷ কিন্তু ওর নিজের ই লাইফ রিস্ক এখন। সেরকম কিছু হলে আমরা রুমি কে আমাদের কাছে নিয়ে চলে আসবো। তারপর সাফওয়ানের যা হয় হবে৷ কিন্তু এখন যেহেতু বিয়ে টা হয়েই গেছে, তাই এই নিয়ে আর মন খারাপ করে থেকো না। সাফওয়ান কে জামাই হিসেবে মেনে নাও, আমিও মেনে নয়েছি। শুধু শুধু ঝামেলা করলে আমরা ও অশান্তি তে থাকবো ওরাও অশান্তি তে থাকবে, কিন্তু কোনো সমাধান হবে না। সেটার থেকে ভালো হয় সবকিছু মিটিয়ে নিয়ে এক সাথে পথ চলা। বাকি টা আল্লাহ ভরসা৷ আর সাফওয়ানের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে এগুলো প্রিভেন্ট করার। এখন শুধু অপোনেন্ট পার্টির সাথে কুলাতে পারলেই হলো।
.
সন্ধ্যা রাত, মাগরীবের নামাজের পর রুমাইশা বসে আছে ওর রুমে৷ সাফওয়ান কে দেখতে ইচ্ছা করছে ভিষণ, কিন্তু সে লোক সেই সকাল বেলা এসেছিলো একবার রুমে তারপর থেকে তার আর কোনো খোজ নেই। কয়েক বার ফোন দিবে দিবে করেও দেয়নি। লজ্জা লাগছে কেমন যেন, ফোন দিলে যদি সাফওয়ান ভাবে যে বউ তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য তড়পাচ্ছে তাহলে ব্যাপার টা খুব লজ্জাজনক হবে।
কিন্তু ওর তো আর ভালো লাগছে না। রাত বাড়ছে আর বুকের ভেতর ছটফট করছে ওই ইস্পাত দৃঢ় শরীর টাকে নিজের আলিঙ্গনে বদ্ধ করতে। কিন্তু এ কথা তো কাউকে বলতে পারছে না ও, নিজের ভেতর গুমরে গুমরে মরছে শুধু।
রুনিয়ার ব্লাউজ আর পেটিকোট বানানো শেষ। সমস্ত বিকাল জুড়ে এই কাজ ই করেছেন তিনি। রুমের ভেতর রুমাইশার জন্য আনা শাড়ি আর গয়না গুলোকে পাশাপাশি রেখে নিজের কল্পনায় একবার রুমাইশা কে দেখে নিলেন তিনি। রুনিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো যেন!
শাড়ি, ব্লাউজ, গয়না আর অন্যান্য কসমেটিক্স গুলো সাফওয়ানের নিয়ে আসা বক্সের ভেতর রেখে, নিজের জন্য আনা শাড়িটাতে একবার হাত বুলালো রুনিয়া।
কাঞ্জিভরম শাড়িটাতে হাত বুলাতে ইচ্ছা করছে শুধু। ছেলের পছন্দের তারিফ করতে হয়। এই শাড়িটা ইশতিয়াক এখনো দেখেননি। রুমির গুলো দেখেছেন শুধু।
শাড়িটা রাতের বেলা পরবেন ইশতিয়াকের জন্য ভাবলেন তিনি, তার আগে দেখাবেন না।
সাফওয়ানের রুমে বর্তমানে সাফওয়ান আর শাফিন বিছানা সাজানোর কাজে আছে৷ সাদা রঙের বিছানার ওপর লাল সাদা মিশেলের চার টা বালিশ রাখা। আর সমস্ত খাট জুড়ে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে শাফিন। বিছানার চার পাশ দিয়ে বেলি ফুলের মালা ওপর নিচ করে সাজানো, ফুলের গন্দে ম-ম করছে চার পাশ। বেডসাইড টেবিলের ওপর কিছু রঙবেরঙের ছোটছোট স্বচ্ছ ক্যান্ডেল রাখা।
অসম্ভব সুন্দর করে গোছানো রুম টাতে আভিজাত্যের ছাপ, আর এখন এই ফুল দিয়ে সাজানো বিছানা টা যেন রুমের ভেতরের পরিবেশ টা পুরাই বদলে দিয়েছে।
বিছানা সাজানো শেষে দুই ভাই মিলে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো বিছানা টাকে। শাফিনের কেন যেন হাসি পাচ্ছে হঠাৎ করে। ঠোট টিপে হাসি টা আটকানোর চেষ্টা করছে ও, কিন্তু হাসি টা এত চেষ্টার পর ও মুখের ওপর দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠলো।
প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়ানো সাফওয়ান শাফিনের এমন হাসি হাসি মুখ টা খেয়াল করলো, তারপর বলল
— চিন্তা করিস না, তোর ও হবে; কিছুদিন পর। এখন বল রিমুর পছন্দ হবে কিনা।
বিছনার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো সাফওয়ান। শাফিন মুচকি হেসে বলল,
— খুব পছন্দ হবে! আমার ই ইচ্ছে করছে এর ওপর লাফিয়ে শুয়ে পড়তে, রুমি আপুর কথা আর কি বলবো! পছন্দ হতেই হবে। দেবর আর বর মিলে সাজিয়েছে, পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়?
সাফওয়ান হাসলো নিঃশব্দে। আজকের রাত টা ওর জীবনের অন্যতম বিশেষ রাত; অন্যতম বললে ভুল হবে, বলা উচিত সবচেয়ে স্পেশাল রাত। এরকম রাত আর কখনো আসবে না।
জীবন সঙ্গিনী কে প্রথমবারের মতো নিজের করে পাওয়ার যে মুহুর্ত সেটা কখনোই মুখে বলে, কাগজে লিখে প্রকাশ করা যায় না। এই অনুভূতি টা সম্পুর্ন মানসিক।
বিছানার দিকে আর ও কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সাফওয়ান শাফিন কে বলল,
— মা কে বল রিমু কে সকাল সকাল খাইয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে। রিমু কে আমার নয়টার ভেতরে নিজের কাছে চাই।
শাফিন ভাইয়ের দিকে দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলল,
— এত তাড়াহুড়ো করছো কেন ভাইয়া, বউ তো তোমারি, কেউ তো আর নিয়ে চলে যাচ্ছে না। যত রাত ই হোক রুমি আপু তোমার কাছেই আসবে, তুমি এত উতলা হইয়ো না৷
সাফওয়ান মুচকি হেসে বলল,
— যেদিন আমার জায়গায় থাকবি সেদিন বুঝবি, প্রতিটা সেকেন্ড কেমন ধীরে চলে এই রাতে, বউ কাছে পাওয়ার আগ পর্যন্ত।
শাফিন হেসে সাফওয়ানের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে গেলো মায়ের কাছে। শাফিনের কথা মতো রুনিয়া ব্যাবস্থা নিলেন। এশার নামাজের পর পর ই খাবার প্লেটে নিয়ে গেলেন রুমাইশার রুমে৷ গিয়ে দেখলেন জানালার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে রুমি। চুল গুলো পিঠময় ছড়ানো। ফুলে ফেপে ওঠা চুলগুলোর জন্য কেশবতী দেখা যাচ্ছে রুমি কে।
দরজায় শব্দ হলে রুমাইশা পেছন ফিরে তাকালো। ফুপ্পিকে এই সময়ে খাবার হাতে দাড়াতে দেখে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— ফুপ্পি, তুমি এখন আবার খাবার বয়ে নিয়ে এসেছো কেন? আমি নিজেই যেতাম! তখন একবার খাবার বয়ে দিয়ে গেছো, কেন বলতো? আমি কি বাচ্চা? আর এত সকাল সকাল খাবার আনলে যে!
রুনিয়া খাবারের থালা টা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললেন,
— সেই কোনো দুপুরে খেয়েছিস, যোহরের আগে। এতক্ষনে তো ক্ষিদে লেগে যাওয়ার কথা। রান্না হয়ে গেছে তাই ভাবলাম তোকে আগে খাইয়ে দিই৷
রুমাইশা ঠিক আছে বলে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নিলো হাত ধোয়ার জন্য৷ কিন্তু রুনিয়া বাধা দিয়ে বললেন,
— তোর হাত লাগাতে হবে না, তুই বস এখানে আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
রুমাইশার মুখে হঠাৎ করেই হাসি ফুটে উঠলো, সেই সাথে চোখের কোন টা ভারি হয়ে উঠলো, মাকে মনে পড়ছে ভিষণ। সকালে একবার কল করেছিলো, কিন্তু মা ধরেনি, রাগ করে আছে নিশ্চয়! মা কথা না বললে ভালো লাগে না ওর! এখন ফুপ্পির এমন আদুরে আচরণে ওর চোখের পরে মায়ের মুখটা ভেসে উঠছে বারে বারে।
বিছানায় এসে বসলো রুমাইশা, রুনিয়া ওকে মুখে তুলে খাইতে দিতে লাগলেন। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর পর ই ফোন এলো রুমাইশার ফোনে৷ ফোন টা উঠিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই মন টা খুশিতে ভরে গেলো ওর৷ মা কল দিয়েছে।
রুনিয়া ও দেখলেন, রুমাইশার সাথে সাথে তিনিও খুশি হলেন। শাফিন সব বলেছে তাকে কি কি হয়েছে ও বাড়িতে। তিনি নিজেও চিন্তিত ছিলেন আয়েশা কে নিয়ে। কিন্তু আয়েশার কল দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
রুমাইশা কল রিসিভ করলো, হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আয়েশা বলে উঠলেন,
— মাকে তো ভুলে গেছিস, একবার কল দিয়েছিস ধরিনি, আর একবার কি কল দেওয়া যেতো না? অন্যের বাড়ি গিয়ে একদম পর পর করে দিচ্ছিস আমাকে?
বলে কেদে উঠলেন আয়েশা। মায়ের কান্না শুনে রুমাইশাও কেদে উঠলো ডুকরে,
— তুমি আমার ওপর আর রাগ করে থেকো না মা! তুমি এরকম করলে আমি কিভাবে থাকি বলো! তুমি আমার সাথে কথা না বললে আমি থাকতে পারি বলো মা! তুমি আমার ওপর আর অভিমান কইরো না মা। আমি ভালো আছি এখানে, আর আল্লাহ চাইলে ভালো থাকবো, সাফওয়ান আমাকে খারাপ রাখবে না মা, তুমি চিন্তা কইরো না। তুমি যদি আমার ওপর রাগ করে থাকো তাহলে আল্লাহ আমার ওপর নারাজ হবেন। আমি কি তাহলে সুখে থাকতে পারবো মা, তুমিই বলো!
ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল রুমাইশা। আয়েশাও ও পাশ থেকে কেদে উঠলেন ফুপিয়ে। মেয়ের বিরহে তিনি কোনো কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না, এখন মেয়ের গলা শুনে মনটা হালকা করতে পেরে শান্তি শান্তি লাগছে অনেক। মনের ভেতর কার সেই গুমোট আবহাওয়া টা কেটে গেছে নিমিষেই।
রাফসান মায়ের পাশেই ছিলো। দুজনের এমন পাল্লা দিয়ে কান্না করতে শুনে মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে মাকে বলল,
— মেয়েটা এমনিতেই দুঃখে আছে আর তুমি ওকে আর ও কাদাচ্ছো,
তারপর ফোন টা কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই রুমাইশা আর ও জোরে কেদে উঠে বলল,
— ভাইয়া, তুমি এসেছো! তুমি কতদিন পরে এসেছো, আর আমি তোমাকে একটু দেখতে পারছিনা! তুমিও কি আমার ওপর রাগ করে আছো ভাইয়া?
রাফসান রুমাইশার এমন কান্না শুনে তাড়াতাড়ি করে বলল,
— এই কাদছিস কেন? আমাকে কি আর কোনোদিন দেখতে পাবি না? নতুন বিয়ে হয়েছে হাসি খুশি মুখে থাকবি তা না কেদে কুটে অবস্থা খারাপ করে ফেলছিস! কান্না কাটি থামা এইভাবে কাদলে চোখ ফুলে ছোট হয়ে যাবে, তখন আর দেখতে ভালো লাগবে না কিন্তু, মানুষ নতুন বউ দেখতে আসলে বলবে বউ জাপানিজ।
কান্নার মাঝেও হেসে উঠলো রুমাইশা। রুমাইশা কে হাসতে দেখে রাফসান ও হাসলো৷ তারপর বলল,
— কাল আসছি আমি, তোর সাথে দেখা করতে। তোর জামাইয়ের সাথেও দেখা করবো, তুই চিন্তা করিস না। ফুপ্পি কোথায়?
রুমাইশা কান্না থামালো, কিন্তু ফোপানি যায়নি এখনো ওর৷ ফোপাতে ফোপাতেই বলল,
— এই তো আমার পাশেই বসে আছে। ভাত খাওয়াচ্ছিলো আমাকে।
রাফসান বলল,
— ছিছি, শাশুড়ীর হাতে খাচ্ছিস, বুড়ি মেয়ে! আবার শাশুড়ীর সামনে বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাদছিস! দে ফুপ্পির কাছে দে।
রুমাইশা ফোন টা দিয়ে দিলো রুনিয়ার কাছে। রুনিয়ার সাথে রাফসান আয়েশা দুজনেই কথা বলল, রুমাইশার মন টা হঠাৎ করে ফুরফুরে হয়ে গেলো। কালকে রাতের পর থেকে যে মন খারাপ টা বুকের ভেতর জেকে বিসে ছিলো সেটা হাওয়া হয়ে গেছে এখন।
রুনিয়াও হাসছেন, আয়েশার সাথে মন খুলে কথা বলেছেন তিনি, আয়েশা ও সব রাগ অভিমান ভুলে ভগিনী তুল্য ননদের সাথে কথা বলেছেন। রুনিয়ার ভালো লাগছে খুব। হালালে আসলেই অনেক বরকত! ঝামেলা টা কেমন মুহুর্তেই ঠিক হয়ে গেলো।
কল কেটে দিয়ে বাকি খাওয়া শেষ করে প্লেট নিয়ে নিচে চলে গেলেন তিনি। আর রুমাইশা কে বললেন অপেক্ষা করতে তার জন্য আবার আসছেন তিনি। রুমাইশা ঠিক আছে বলে ফোন টা তুলে হাতে নিলো।
রুনিয়া রুমের বাইরে যেতেই গ্যালারি তে ঢুকে সাফওয়ানের একটা ছবি বের করলো ও। সেদিন ওদের বাড়িতে সাফওয়ান রাতে যখন ওর বুকে ঘুমিয়ে ছিলো তখন ছবি টা তুলে ছিলো ও। বাচ্চা দের মতো ঠোঁট উলটে ঘুমিয়ে আছে সাফওয়ান, ওর ঝাকড়া চুল গুলো রুমির থুতনি ছুয়ে দিচ্ছে।
সাফওয়ানের চেহারা টা দেখেই মুখ টা ওর সুখ সুখ অনুভূতি তে ছেয়ে গেলো। সাফওয়ান কে নিজের কাছে পাওয়ার জন্য বুকের ভেতর টা হাহাকার করছে। সকাল বেলার ওই মুহুর্ত টা মনে পড়লেই বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠছে ওর! সাফওয়ানের শক্ত হাতের ওই স্পর্শ, ঠোঁটের প্রতিটা ছোয়া ওর মন মস্তিষ্কে গেথে গেছে যেন একদম। চোখ বন্ধ করলেই সেগুলো অনুভব করতে পারছে ও। অসহ্য এক অনুভূতি ঘিরে ফেলছে হঠাৎ করেই ওকে। ফোন টা বিছানার এক পাশে ছুড়ে ফেলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো ও বিছানায়, তাকিয়ে রইলো মেঝেতে রাখা চেয়ারের পায়ের দিকটায়৷ এসব আর ভালো লাগছে না ওর! সাফওয়ানের সঙ্গ পাওয়ায় জন্য মন টা অস্থির হয়ে আছে৷
খানিক সময় পার হওয়ার পর রুনিয়া হাতে একটা বক্স নিয়ে ঢুকলেন রুমাইশার রুমে। রুমাইশা শোয়া থেকে উঠে বসলো। রুনিয়ার হাতে এমন বক্স দেখে কিছুটা অবাকই হলো রুমাইশা। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— এটা কিসের বক্স ফুপ্পি?
রুনিয়া বক্স টা বিছানার ওপরে রাখতে রাখতে বললেন,
— বলছি আগে গিয়ে ওজু করে আয়৷
রুমাইশা রুনিয়ার দিকে কিছুক্ষন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ব্যাপার টা বোঝার চেষ্টা করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। তারপর ওজু করে বাইরে বেরিয়ে দেখে রুনিয়া বিছানা জুড়ে শাড়ি গহনা সাজিয়ে বসে আছেন। রুমাইশা কে দেখে খুব সুন্দর একটা হাসি দিলেন তিনি।
রুমাইশার বুক টা কেপে উঠলো। আজ বাসর হবে ওদের? মুখ টা হঠাৎ করেই গরম হতে শুরু করলো। মাথা আর কানে তাপ অনুভুত হলো ওর।
এগিয়ে এসে শাড়িটা ছুয়ে দিলো একবার। রুনিয়া রুমাইশার থুতনি হাত দিয়ে ধরে উচু করে জিজ্ঞেস করলেন,
— পছন্দ হয়েছে? আমার ছেলে সব নিজে পছন্দ করে কিনেছে তোর জন্য৷
রুমাইশা রুনিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার শাড়ির দিকে মন দিলো, অসম্ভব সুন্দর শাড়িটা! অজান্তেই মুখে ওর হাসি ফুটে উঠলো। রুনিয়া হাসলেন সেটা দেখে, তারপর রুমাইশা কে শাড়ি পরানো শুরু করলেন।
.
সাফওয়ান আর শাফিন চুপচাপ বসে আছে ছাদের রেলিঙের ওপর৷ সাফওয়ানের পরনে একটা আন্ডার শার্ট আর ট্রাউজার৷ চুল দাড়ি গুলো অগোছালো হয়ে আছে। চোখে গগলস পরে আছে, মুখে মাস্ক নেই। বাইরে বসলে সবসময় গগলস টা পরে থাকে ও, জ্বলজ্বলে চোখ জোড়া অনেক দূর থেকেই দেখা যায়, বরং আর ও ভয়ঙ্কর দেখায়।
এমন সময় নিরবতা ভেঙে শাফিন বলে উঠলো,
— আজ তোমাদের বাসর, কিন্তু তোমার তো কোনো প্রস্তুতিই দেখছিনা। একটা পাঞ্জাবি তো পরতে পারতে, কিন্তু তুমি একটা শার্ট ও পরোনি, এইভাবে গেঞ্জি ট্রাউজার পরে বসে আছো!
সাফওয়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আমার কোনো প্রস্তুতি লাগবে না। আমি এমনিতেই প্রস্তুত৷
শাফিন হাসলো সাফওয়ানের কথায়। ভাই টা তার কখন থেকেই অধৈর্য হয়ে বসে আছে। কত শতবার ছাদে পায়চারি করেছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। শেষে না পেরে রেলিঙে এসে বসেছে তার পাশে।
আকাশে তারা দেখতে দেখতে হঠাৎ ই সাফওয়ানের মনে পড়লো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু থেকে যাচ্ছে। তড়িৎ গতিতে রেলিঙ থেকে ছাদের বাইরে নামতে নামতে ও বলল,
— আমি আসছি একটু, তুই তোর রুমে যা। রুমি রেডি হলে আমাকে ছোট্ট করে একটা টেক্সট দিস।
তারপর ই ঝড়ের গতিতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নেমে জঙ্গলের ভেতরের দিকে হেটে অন্ধকারে মিশে গেলো ও।
শাফিন সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দোতলার উদ্দেশ্যে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলো।
.
মেরুণ রঙা শাড়ির সাথে সোনার গয়না পরে নতুন বউ সেজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুমাইশা৷ চেহারায় সামান্য প্রসাধনীর ছোয়া। চোখে গাড় করে কাজল দেওয়া। ঠোট দুটো লালচে গ্লোজ এর ছোয়ায় লোভনীয় রুপ নিয়েছে। চুল গুলো খোপা করে মাথার ওপরে উঠিয়ে দিয়েছেন রুনিয়া। গলায়, কানে, হাতে, শোভা পাচ্ছে সাফওয়ানের সদ্য কেনা কারুকার্য খচিত ভারী গহনা গুলো। অপ্সরার মতো সৌন্দর্য যেন টিকরে পরছে রুমাইশার শরীর থেকে।
রুনিয়া পাশে দাঁড়িয়ে রুমাইশা কে দেখে যাচ্ছেন। আগে কখনো শাড়ি পরিহিত অবস্থায় রুমি কে দেখেননি তিনি। আজ হঠাৎ শাড়ি পরে রুমি কে অনেক বড় বড় লাগছে যেন, অদ্ভুত রকমের একটা স্নিগ্ধতা সমস্ত মুখে লেপ্টে আছে ওর৷
এমন সময়ে দরজার কড়া নড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। বাইরে থেকে শাফিন বলে উঠলো,
— ভেতরে আসার অনুমতি আছে?
রুনিয়া ভেতর আসতে বললেন ওকে। শাফিন ভেজানো দরজাটা খুলে ভেতরে পা রাখলো। রুমাইশা কে দেখেই চোখ কপালে উঠলো ওর। অবাক হয়ে রুনিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার রুমাইশার দিকে নজর ফিরিয়ে বলে উঠলো,
— আপু, কি সুন্দর লাগছে তোমাকে! আমার ভাই এমনিতেই হাসফাস করছে, এইবার তোমাকে দেখলে দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবে বেচারা!
রুনিয়া হেসে উঠলেন। রুমাইশা লজ্জা পেয়ে হাসি হাসি মুখ টা নিচের দিকে করলো।
শাফিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আপুর গোছানো শেষ হলে আপুকে দিয়ে আসো, তোমার ছেলের আর তর সইছে না।
রুনিয়া হাসলেন। শাফিন রুম থেকে বেরিয়ে নিচে গেলো, সোফায় ইশতিয়াক আহমেদ বসে আছেন, বাবার সাথে গল্প করা ছাড়া ওর আর কিছু করার নেই আপাতত। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে সাফওয়ানের ফোনে ছোট্ট করে একটা মেসেজ লিখে সেন্ড করে দিলো শাফিন৷
রুনিয়া রুমাইশা কে আর ও একটু গোছ গাছ করে দিয়ে বাইরে নিয়ে এলো। হল রুমে ইশতিয়াক আর শাফিন বসে ছিলো সোফায়, সেখানেই নিয়ে গেলো ওকে।
ইশতিয়াক তো রুমাইশা কে দেখে চমকে গেলেন একেবারে,
হেসে বলে উঠলেন,
— এটা কি আমাদের সেই রুমি? আমার মেয়ে থেকে আমার বউমা হয়ে তো রুমি বড় হয়ে গেছে! তাকে আর চেনাই যাচ্ছে না! ছোট্ট রুমি ছোটবেলায় যার কোলে বসে হাড়ি পাতিল খেলতো, এখন তার জন্যই সত্যিকারের হাড়ি পাতিল নিয়ে নাড়াচাড়া করবে! এটা তো একটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর ব্যাপার!
রুনিয়া লজ্জা পেলো ইশতিয়াকের কথায়। আজ প্রতি পদে পদে লজ্জা পাচ্ছে ও। এখন কোনমতে লোকচক্ষুর আড়াল হতে পারলেই বেচে যায় ও! নিচে আর ও কিছুক্ষণ থেকে রুমাইশা কে নিয়ে রুনিয়া ছাদের দিকে এগোলেন৷
ছাদের রেলিং জুড়ে নীল আর সোনালি রঙা মরিচ বাতি জ্বালানো। শাফিন আর সাফওয়ান সন্ধ্যা ধরে এসবই করেছে। ছাদ টা আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় ছিমছাম দেখাচ্ছে। রুমাইশার বাহু ধরে হেটে হেটে চিলেকোঠার কামরা টার কাছে এগিয়ে গেলো রুনিয়া।
প্রতি টা কদমের সাথে সাথে রুমাইশার বুকের ভেতর ধক ধক ক্রমে বেড়ে যেতে লাগলো। প্রবল উত্তেজনায় হঠাৎ করেই গা ঘামতে শুরু করেছে ওর।
রুনিয়া ওকে দরজার কাছে রেখে চোয়াল টা দুই আঙুল দিয়ে একটু টেনে দিয়ে নিচে চলে গেলেন। রুমাইশা একা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। নিঃশ্বাস পড়ছে ওর ঘন ঘন।
এমন তো নয় যে এই প্রথম বার ও সাফওয়ানের কাছে যাচ্ছে! এর আগেও তো সাফওয়ানের কত কাছাকাছি থেকেছে ও, কিন্তু তখন তো এমন হয়নি! এখন তাহলে এমন হচ্ছে কেন?
সাহস সঞ্চয় করে দুরুদুরু বুক নিয়ে ভেজানো দরজাটা টা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ও৷ ডিম লাইট জ্বলছে ঘরে একটা। কিন্তু ঘর তো ফাকা! সাফওয়ান গেলো কই?
ভেতরে ঢুকে ধীর পায়ে বিছানার কাছে এগোলো ও। সাদা রঙের বিছানার ওপর বড় বড় গোলাপের রক্তিম পাপড়ি গুলো ফুটে পড়েছে। বেলি ফুলের গন্ধে চারপাশ টা ভরে উঠেছে একেবারে৷ ডিম লাইটের নীলচে আলোয় ঘরটাতে যেন এক স্বপ্নময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
বিছানা থেকে চোখ সরিয়ে সাফওয়ানের বুক শেল্ফের দিকে এগোলো রুমাইশা। এক রাতে এই ঘর টাতে আসার অপরাধেই মরতে বসেছিলো ও! সেদিন ও এই বুক শেলফের কাছ টাতে এসেছিলো ও কৌতূহল মেটাতে। আজ আবার ও এসেছে, কিন্তু সেদিন আর এদিনের ভেতরে বিস্তর ফারাক!
বুক শেল্ফে চোখ বুলাতে বুলাতে একটা মোটা কালো মলাটের ডায়েরীর দিকে হঠাৎ করেই নজর গেলো রুমাইশার। শেল্ফের এক কোণায় বীরদর্পে অবস্থান করছে সেটা। রুমাইশা হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতে নিতেই পেছন থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
— রিমু!