অফিডিয়ান | পর্ব – ২৭

রুনিয়া ছাদে সাফওয়ানকে খাবার দিতে এসেছেন। ফোন টাও নিয়ে এসেছেন ছাদে। ওনার ফোনে হঠাৎ করেই চার্জ নিচ্ছে না, তা নিয়ে উনি খুবই চিন্তিত। চার্জ এখন দশের ঘরে নেমে এসেছে। শাফিনের কাছে নিয়ে গিয়ে ছিলেন কিন্তু শাফিন কোনো সল্যুশন দিতে পারেনি। তাই সাফওয়ানের কাছে এনেছেন৷

বর্তমানে ফোন টা সাফওয়ানের কাছে৷ চিলেকোঠার বাইরে টি টেবিল টার পাশে বসে মা ছেলে দুজনে মিলে মিস্ত্রী গীরি করছে। সাফওয়ান খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছে। ফোন টাকে দেখতে দেখতেই সাফওয়ান কঠিন গলায় বলে উঠলো,
— মামার কাছে কল দিয়েছিলে? তো মামা কি বলল?

রুনিয়া চুপ রইলেন, ছেলেকে এখন কিভাবে বলবেন যে তার ভাই মুখের ওপর ফোন কেটে দিয়েছে? আবার তার ছেলেকে জংলি জানোয়ার বলেছে!

রুনিয়া গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
— তোর মামা রাজি হয়নি। বলেছে রুমির এত আকাল পড়েনি যে তোকে বিয়ে করতে হবে, আর বলেছে রুমিকে তোর বউ করার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে, তোর সাথে কখনোই বিয়ে দিবেনা রুমি কে। আর তারপর কল কেটে দিয়েছে।

রুনিয়ার কথায় সাফওয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজের কাজ অব্যাহত রেখেই বলল,
— মা, শাফিন চলে আসার পর থেকে রিমু কে ফোনে পাচ্ছি না। আমার মনে হয় ওদের বাড়িতে কিছু একটা গন্ডগোল লেগেছে, আর সেটা বাধিয়েছে মামি, জেনে শুনে।

রুনিয়া ছেলের কথার আগা মাথা কিছু বুঝলেন না, উল্টো প্রশ্ন করলেন,
— কি গন্ডগোল লাগবে, আর আয়েশা গন্ডগোল লাগাবেই বা কেন?

সাফওয়ান ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,
— সেটা তোমাকে আমি পরে বুঝিয়ে দেবো, বা তুমি এমনিতেও বুঝতে পারবে, হয়তো৷

কথাগুলো বলে সাফওয়ান আবার ও কাজে মন দিলো।

কিছু সময় পর রুনিয়ার ফোনে কল এলো শামসুলের। সাফওয়ান সেদিকে দেখে রুনিয়ার দিকে তাকালো, তারপর বলে উঠলো,
— আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তাই-ই হয়েছে। এখন তুমি নিজেই জানতে পারবে।

রুনিয়া ছেলের দিকে অবুঝের মতো চেয়ে রইলেন। সাফওয়ান ফোন টা মায়ের হাতে দিলো। রুনিয়া এমন সময়ে শামসুলের ফোন কল একদমই আশা করেনি। খানিক আগেই তো ও কল কেটে দিলো রাগ দেখিয়ে। তাহলে এখন আবার কেন ফোন করলো? রুনিয়া কল টা রিসিভ করে কানে ধরলেন ফোন৷ ধরার সাথে সাথেই ওইপাশ থেকে শামসুলের কর্কশ কন্ঠ শোনা গেলো।

— রুনিয়া আপা, তুই কি জানিস সাফওয়ান কাল রাত টা আমার মেয়ের সাথে কাটিয়েছে? সেটাও আবার আমার বাড়িতে!

শামসুলের কথায় অবাক হলেন রুনিয়া। চকিতে একবার সাফওয়ানের দিকে তাকালেন, তারপর চোখ ফিরিয়ে বলে উঠলেন,
— সাফওয়ান কাল তোদের বাসায় ছিলো? রাতের বেলা? তাও আবার রুমির সাথে?

শামসুল রাগী গলায় বললেন,
— না জানার ভান ধরিস না আপা। আমি জানি যে সাফওয়ান তোর কথাতেই এই কাজ করেছে। আমার মেয়ে কে ছেলের বউ করার জন্য তুই তোর ছেলে কে আমার মেয়ের পেছনে লেলিয়ে দিলি! আর সেটাও একেবারে বেডরুমে!

রুনিয়া শামসুলের কথা কিছু বুঝলেন না, অসহায় হয়ে বললেন,
— এসব কি বলছিস তুই শামসুল! আমি কেন সাফওয়ান কে লেলিয়ে দেবো? হ্যা, আমি রুমি কে ছেলের বউ করতে চাই, আর সেটা চাই কারণ, আমার ছেলে চায় রুমি কে বিয়ে করতে। আর সাফওয়ান রাতের বেলা ছিলো বলতে তুই কি বোঝাচ্ছিস? ও যদি থেকেও থাকে, ও অনৈতিক কিছু করবে বলে আমি মনে করিনা৷

শামসুল কঠিন গলায় বললেন,
— আপা আমি তোর কাছে সাফওয়ানের সাফাই চাই না৷ তোর ছেলে আমার মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে, এই কথা জানাজানি হলে কি হবে তোর ধারণা আছে? তোকে আমি ভালোভাবে বলছি, সাফওয়ান কে বলবি আমার মেয়ের থেকে যেন দূরে দূরে থাকে৷ আমি খুব দ্রুতই আমার মেয়ের ব্যাবস্থা করবো। কোনো অমানুষের হাতে আমি আমার মেয়ে কে তুলে দেবো না৷ আমি কালই…….

কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন বন্ধ হয়ে গেলো রুনিয়ার৷ চার্জ শেষ।
রুনিয়া শামসুলের এতসব কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ছেন! পাশে সাফওয়ান চোয়াল শক্ত করে, হাত দুইটার মুঠি শক্ত করে বসে আছে। চোখ ওর তীক্ষ্ণ হয়ে চেয়ে আছে শূন্যের দিকে।

রুনিয়া অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন সাফওয়ানের দিকে।
সাফওয়ান কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর হুট করেই উঠে দাড়ালো, তারপর রুনিয়া কে বলল,
— মা, নিচে গিয়ে রেডি হও, আমরা বেরোবো। রিমু দের বাসায় যাবো। দ্রুত।

৩১. আজকের রাত টা অন্যান্য রাতের থেকে যেন একটু বেশিই নিস্তব্ধ। চারপাশ যেন কি এক নীরাবতায় ছেয়ে আছে। ঝিঝি পোকাও ডাকছে না যেন।

নিজের রুমে থম মেরে বিছানায় বসে আছেন শামসুল। রুনিয়ার কল কেটে যাওয়ার পর আর ও কয়েকবার কল দিয়েছেন, কিন্তু নম্বর বন্ধ দেখাচ্ছে৷ রাগ টা দেখাতে পারলেন না ঠিকঠাক।

আয়েশা দাঁড়িয়ে আছেন স্বামীর পাশে। থেকে থেকে রুমাইশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন তিনি৷ রুমাইশা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশেই, পরিস্থিতি কোনদিকে যায় সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। তার মাকে এতবার করে বলার পর ও মা বিশ্বাস করলো না। ও তো কখনোই ওর মাকে মিথ্যা কথা বলে না৷ আয়েশার তো উচিত ছিলো ওকে বিশ্বাস করা৷ কিন্তু করলো না। উলটো বাবাকে এসে বলে দিলো!

মাথায় ভিষণ জেদ চাপলো ওর, এর শেষ ও দেখে ছাড়বে৷ অকারণে ওকে এইভাবে অপবাদ দেওয়ার মাশুল তুলবে ও। রাগে ওর গায়ের ভেতর রিরি করছে। মুখ টা শক্ত করে তাকিয়ে আছে ও নিজের বাবা মায়ের দিকে৷

শামসুল কিছুক্ষণ পর ঝাঝালো কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— আমার মুখের ওপর ফোন কেটে দিলো! আর এখন ফোন বন্ধ করে রেখেছে।

আয়েশা রুমাইশার দিকে একবার বাকা চোখে তাকিয়ে পাশ থেকে বললেন,
— তুমি যত দ্রুত সম্ভব ছেলে দেখো। ওর বয়স হয়েছে বিয়ে দিয়ে দাও, পড়াশোনা বিয়ের পরেও করা যাবে৷ নইলে এইভাবে থাকলে কি হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

মায়ের কথা শুনে রুমাইশার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো যেন! বিস্ফোরিত নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। বিস্ময়ে অধরজোড়া আলগা হয়ে এলো! সেদিন ও আয়েশা বললেন বিয়ে দিবেন না আপাতত ওকে, পড়াশোনা কমপ্লিট করিয়েই তারপর বিয়ে দিবেন। হঠাৎ মায়ের এমন মতের পরিবর্তনে দিশেহারা হয়ে গেলো রুমাইশা।

ধরা গলায় বলে উঠলো,
— মা! তুমি কেন আমাকে বিয়ে দিবা? তুমি সেদিনও বললে পড়াশোনা শেষ করিয়ে বিয়ে দিবা! আজ সেই তুমি আমার বিয়ের কথা তুলছো?

তারপর হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে গেলো রুমাইশার গলা, বলল,
—আমি মোটেও বিয়ে করবো না এখন। আর করলেও সেটা সাফওয়ান কেই করবো৷ অন্য কাউকে না৷

আয়েশা রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে।
— তোর মতামত চাইনি আমি। তোকে বিয়ে দিবো ব্যাস দিবো, কার সাথে দিবো সেটা তোর দেখার বিষয় না। আর সাফওয়ানের কথা ভুলে যা। ওর সাথে তোর বিয়ে আমি এই জীবনেও দিবো না।

রুমাইশার রাগ হলো প্রচন্ড, রাগের মাথায় বলে উঠলো,
— আমাকে বিয়ে দিবা, কিন্তু আমার মতামত নিবানা! আবার বলছো সেটা আমার দেখার বিষয় না, তাহলে বিয়ে টা তুমি করে নাও! আমাকে বলো কেন?

আয়েশা উঠে এসে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন রুমাইশার গালে,
— বেয়াদব হচ্ছিস তুই দিনে দিনে! আমাকে এই কথা বলার সাহস পাস কই তুই? এই মুহুর্তে নিজের রুমে যা। বের হবি না আর তুই৷ তোর মুখ দেখতে চাই না আমি।

রুমাইশা দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ শীতল চাহনি দিলো মায়ের দিকে, তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নিজের রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা দিয়ে দিলো।

আয়েশা শামসুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— শুনেছো তোমার মেয়ের কথা! আমার মুখে মুখে তর্ক করে। বলে কিনা, তুমি বিয়ে করে নাও! এদের কে আমি খাইয়ে পরিয়ে বড় করছি এই সমস্ত শোনার জন্য!

তারপর কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
— শোনো রাফসানের বাবা, তুমি যত দ্রুত সম্ভব মেয়েকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও৷ তোমার মেয়ে বিগড়ে গেছে, আর শোধরাবে না। যত তাড়াতাড়ি পারো এই সমস্যার সমাধান করো, নইলে সমাজে তুমি মুখ দেখাতে পারবে না।

শামসুল প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না। মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। নিজের মেয়ের কীর্তিকলাপের কথা মনে পড়লেই তিনি ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ছেন।

শামসুল কে এমন চুপচাপ দেখে আয়েশা ও আর কথা বাড়ালেন না। স্বামীর পাশেই বসে রইলেন তিনি৷ রাতে আর খাওয়া হবে না হয়তো কারো। খাবার গুলো ফ্রিজে রাখতে হবে ওনার, ভাবলেন পরে তুলবেন। কারণ শামসুল ক্ষিদে পেটে থাকতে পারেন না, যদি কিছুক্ষণ পর মাথা ঠান্ডা হলে খেতে চায়! তাই আর উঠলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন।

“””

ঘন্টা খানেকের মাথায় হঠাৎ গেটের কাছে গাড়ির হর্ণের শব্দ শোনা গেলো। শামসুল আয়েশা ওইভাবেই বসে ছিলেন নিজেদের রুমে। এত রাতে গেটের কাছে গাড়ির আওয়াজ শুনে ভড়কে গেলেন দুজনেই।

শামসুল উঠে দাড়ালেন, গেইটের চাবিটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। আয়েশা ও এলেন পেছন পেছন৷

গেটের বাইরে সাফওয়ানের মার্সিডিজ বেঞ্জ দাঁড়িয়ে আছে বীরদর্পে। লক খোলার আগে গাড়ির দিকে চোখ বুলালেন শামসুল, গাড়িটকে দেখেই চিনে ফেললেন এটা কার গাড়ি৷ গেটের লক খুলে ড্রাইভিং সিটের দিকে তাকাতেই সাফওয়ান কে শক্ত চোখ মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখলেন তার দিকে।

চোখ মুখ ঢাকা নেই আজ ওর৷ সাফওয়ানের এমন ভয়ঙ্কর প্রতি মুর্তি দেখে চমকালেন শামসুল। সাফওয়ানের পাশেই বসে আছেন রুনিয়া। চোখ মুখ ওনার বিষাদগ্রস্থ।

তড়িঘড়ি করে গেট খুলে দিলেন শামসুল। সাফওয়ান তার গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে বাইরে বের হলো সাফওয়ান, আর পরমুহূর্তেই রুনিয়া বের হলেন অন্য পাশ দিয়ে৷ সাফওয়ান কে দেখে পিলে চমকে গেলো আয়েশার।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি সাফওয়ানের দিকে। বড়ো হওয়ার পর এই প্রথম সাফওয়ানের চেহারা দেখছেন তিনি।
শ্যাম রঙা হলেও মুখের গঠন টা ওর অস্বাভাবিক সুন্দর। তীক্ষ্ণ চিবুকে যেন সৌন্দর্য টা বহু গুনে বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু সমস্ত সৌন্দর্য কে ছাপিয়ে মুখের ওপর জ্বল জ্বল করছে অদ্ভুত রঙের দুইটা চোখ। যেগুলো শিকারি দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আয়েশার দিকে।

সাফওয়ানের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তেই আয়েশা কে ও চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।আয়েশা ভয় পেলেন প্রচন্ড, তাড়াহুড়ো করে শামসুলের পেছনে গিয়ে দাড়ালেন।

শামসুল আয়েশা কে নিজের পেছনে আগলে রেখে রুনিয়ার দিকে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বললেন,
— তুই তোর ছেলেকে এখানে এই ভাবে নিয়ে এসেছিস কেন? আমাদের ভয় দেখাতে?

রুনিয়া সাফওয়ানের দিকে দৃষ্টি দিলো। সাফওয়ান শামসুলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— মামা, ভেতরে চলুন, আপনার সাথে আমার কথা আছে কিছু।
তারপর আয়েশার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল
— আপনার সাথেও, মামি।

কথা বলার সময় সাফওয়ানের ঝকঝকা ক্যানাইন দাঁতদ্বয় দৃশ্যমান হলো৷ সেদিকে চোখ পড়তেই আয়েশা ভীত হলেন প্রচন্ড৷ শামসুল যেন নিজের সমস্ত শক্তি হঠাৎ করেই কোথায় হারিয়ে ফেললেন, এই দীর্ঘদেহী সুপুরুষের সামনে৷ উনি কোনো উচ্যবাচ্য না করে সাফওয়ান কে ইশারা করলেন ভেতরে যেতে৷ সাফওয়ান সামনে এগোলো, রুনিয়া ও গেলেন পেছন পেছন।

সাফওয়ান গিয়ে ডাইনিং রুমে রাখা সোফায় বসলো, রুনিয়া গিয়ে বসলেন ওর পাশে৷

শামসুল আর আয়েশা বসলেন ওদের বিপরীত পাশের সোফায়৷ সাফওয়ানের দৃষ্টি স্থীর হয়ে আছে আয়েশার পানে৷ চোখ দিয়েই যেন আয়েশা কে ও পিষে ফেলছে।
আয়েশার বুকের ভেতর দুরুদুরু করছে সাফওয়ান কে দেখার পর থেকেই। সাফওয়ানের চোখে চোখ মেলাচ্ছেন না তিনি৷

ডাইনিং এ গুটিকয়েক পায়ের শব্দ শুনে রুমাইশা কৌতূহল নিয়ে বাইরে এলো। রুম থেকে বেরোতেই ওর চোখ গেলো সাফওয়ানের দিকে। বাকিরাও দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তাকালো সেদিকে। সাফওয়ানেরও চোখ পড়লো রুমাইশার দিকে। আর আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা রুমাইশার গালে যে চার আঙুলের দাগ পড়ে গেছে সেটাও তার মুহুর্তেই দৃষ্টি গোচর হলো৷

তড়িত গতিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সাফওয়ান। হেটে হেটে রুমাইশার নিকট গিয়ে ওর চোয়ালদ্বয় ধরলো ডান হাতের আঙুল গুলো দিয়ে। তার পর ডানে বামে ঘুরিয়ে ওর মুখের অবস্থা টা দেখলো সাফওয়ান। আর সেই সাথে সাথে শক্ত হয়ে এলো ওর চোয়াল। চিবুক ছেড়ে দিয়ে রুমাইশার হাতের আঙুলের ফাকে নিজের হাত দিয়ে মুঠি করে ধরলো ওর হাত টা। তারপর আবার সোফার নিকট এসে রুমাইশা কে বসিয়ে নিজেও বসে পড়লো রুমাইশার পাশে।

রুমাইশা চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে৷ শামসুলের দৃষ্টি সাফওয়ানের হাতে রাখার রুমাইশার হাতের দিকে।

সাফওয়ান এবার আয়েশার দিকে দেখলো, আয়েশা তাকিয়ে আছে মেঝেতে, উপরের দিকে তাকাচ্ছেন না সাফওয়ানের চোখে চোখ পড়ার ভয়ে৷

সাফওয়ান আয়েশার উদ্দ্যেশ্যে শক্ত গলায় বলে উঠলো,
— মামি, ভোরবেলা এখান থেকে বেরোনোর আগে আমি আপনাকে বলেছিলাম, যে আমাদের মাঝে অবৈধ কিছু হয়নি। আমি শুধু রিমু কে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছি। এর বাইরে আর কিছুই না। নাথিং অ্যাট অল! এরপর ও আপনি রিমু কে মেরেছেন, আর মামার কাছে ওর নামে মিথ্যা দোষারোপ করেছেন। আর আমার মাকে এর ভেতরে টেনে এনে ফাসিয়েছেন। কেন?

আয়েশা কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। রুমাইশা সাফওয়ানের কথা শুনে অবাক হলো, কাল তাহলে মায়ের সাথে ওর দেখা হয়েছে! কথাও হয়েছে? কিন্তু মা সেটা ওকে বলেনি কেন? আর মা তাহলে এটাও জানে যে ওদের ভেতর এক্সট্রিম কিছু হয়নি, তারপরেও এইরকম কেন করলো?

আয়েশা কে চুপ থাকতে দেখে সাফওয়ান রেগে গিয়ে আবার ও বলল,
— আমি জানি যে রুমাইশাকে জড়িয়ে ধরে বা চুমু খেয়ে আমি মরালিটি ব্রেক করেছি। কিন্তু সেটা আমি আপনাকে বলে সিউর করেছি যে এর বাইরে কিছু হয়নি, যেন আপনি ওকে কিছু না বলেন। তাহলে আমি ওর মুখে আঙুলের ছাপ কেন দেখছি?

শেষের কথা টা উচ্চস্বরে বলল সাফওয়ান।

রুনিয়া পাশ থেকে নিজের হাত টা সাফওয়ানের হাতের ওপর রেখে শান্ত হতে ইশারা করলেন। রাস্তাতে সাফওয়ান তাকে সমস্ত কিছু খুলে বলেছে৷ আর রুমাইশাকে সাফওয়ানের থেকে আলাদা করতে যে আয়শা এই ধরনের কিছু করবেন সেটাও বলেছে রুনিয়া কে।

সাফওয়ান এবার শামসুলের দিকে দৃষ্টি দিলো। তারপর মৃদু গলায় বলল,
— মামা, আমি কিছু কথা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। রিমুর প্রতি যে আমার ছোট বেলা থেকেই অন্য ধরনের অ্যাফেকশান ছিলো, সেটা আপনাদের কারো অজানা নেই।
আর এখনো সেটাই আছে, সেই ভালোবাসা টা কমেনি কখনো, বরং দিনকে দিন বেড়ে গিয়েছে। আমি কিছুদিন আগেও জানতাম না ওর প্রতি আমার ভালোবাসা টাকে ঠিক কি নামে আখ্যায়িত করা যায়। শুধু এটা জানতাম যে আমি ওকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসি৷ কিন্তু এখন আমি জানি যে ওকে আমি কিভাবে চাই৷ আমার মা আপনাদের কাছে সেই প্রস্তাবই রেখেছে৷

কথা গুলো বলে কিছুক্ষিন বিরতি দিয়ে সাফওয়ান আবার বলল,
— আপনি যদি চান যে আপনার মেয়ের সাথে বা আপনার বোনের সাথে আপনার ভালো সম্পর্ক বজায় থাকুক তাহলে আমার মায়ের দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। কারণ বিয়ে টা আমি রুমিকেই করবো, আর রুমির বিয়ে টাও শুধু মাত্র আমার সাথেই হবে। তাই সে যেভাবেই হোক।

শামসুল মুখ খুললেন এবার। সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,
— তুমি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছো সাফওয়ান? আর এত রাতে একারণেই এসেছো? আমি আমার মেয়ের বিয়ে কার সাথে দিবো কি দিবো না সেটা সম্পুর্ন আমার ব্যাপার৷ তুমি নিজের দিকে কখনো তাকিয়ে দেখেছো? তোমার চেহারার দিকে তাকালে জঙ্গলের বাঘ ও ভয়ে পালাবে। আর তুমি ছোটবেলায় ওর সাথে কি করেছিলে সেটা তোমার মনে আছে নিশ্চই। সেসব মেনে নিয়ে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেবো? ওকে মেরে ফেলার জন্য?

সাফওয়ান আর নরম রইলো না। কঠোরতার সাথে বলল,
— মামা, সেটা অনেক অনেক আগের ব্যাপার। সেই কথা এখন তুলে এনে ঝামেলা বাধাবেন না। আমার দ্বারা যদি ওর ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা থাকতো তাহলে আমি নিজেই ওর থেকে সরে যেতাম। কিন্তু নেই যেহেতু, সেহেতু সরছি না৷ ওকে আমি আমার করেই ছাড়বো। আর এটা যদি আপনার কাছে হুমকি মনে হয়, তাহলে এটা হুমকিই৷

এরপর সাফওয়ান আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল,
— রিমুর ফোন টা সম্ভবত আপনার কাছে। ওর ফোন টা ওকে দিয়ে দিবেন। আমি এখন থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় ওর খোজ নিবো। আর যদি কোনো একটা ঘন্টায় আমি ওর রেস্পন্স না পায় তাহলে আমি আবার আসবো। তারপর আর একা ফিরবো না, ওকে নিয়েই ফিরবো।

এরপর সাফওয়ান ইশারা করলো মায়ের দিকে। রুনিয়া ছেলের ইশারা পেয়ে নিজের পার্স ব্যাগের ভেতর থেকে একটি স্বর্ণের আংটি বের করে সাফওয়ানের হাতে দিলো। সাফওয়ান সেটা হাতে নিলো, তারপর রুমাইশার ডান হাত টা বাম হাত দিয়ে ধরে ওর অনামিকাতে পরিয়ে দিলো সেটা। কিন্তু ঢিলা হয়ে গেলো আংটি। অনামিকা থেকে খুলে নিয়ে আবার পরালো মধ্যমাতে৷ একটু ঢিল ঢিল হলেও পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলো না।

সবকিছু এত দ্রুত গতিতে হলো যে শামসুল আয়েশা সহ রুমাইশাও চমকে গেলো৷
আংটি পরিয়ে রুমাইশার হাত টা নিয়ে চুমু খেলো সাফিওয়ান হাতের পিঠে৷ তারপর মৃদু গলায় বলল,
— আংটি টা মায়ের৷ আপাতত এইটা পরে নে, কয়েকদিন পর এসে আমি তোর নিজস্ব আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবো।

রুমাইশা যেন অবাক হওয়ার ও সময় পেলো না, তার আগেই সব হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে রইলো ও৷
সাফওয়ান এবার শামসুল আর আয়েশা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
— আজ থেকে রিমু আমার বাগদত্তা৷ খুব দ্রুতই আমি ওকে বিয়ে করবো। আপনারা মানলেও, না মানলেও। তবে মেনে নিলে বিষয় টা আপনাদের জন্যই সহজ হবে৷

এরপর উঠে দাড়ালো সাফওয়ান। রুনিয়া ও দাড়িয়ে গেলেন।
আয়েশার দিকে আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সাফওয়ান বাইরে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে পা বাড়ালো। কিন্তু কয়েক পা আগানোর পর ই আবার ঘুরে দাড়ালো সাফওয়ান, শামসুল আর আয়েশার দিকে৷ তারপর শক্ত গলায় বলল,

— রিমু আমার বউ হতে চলেছে। কিছুদিন পর ও পুরোপুরিভাবে আমার হবে। সুতরাং ওর গালে আমি আর কোনো দাগ দেখতে চাই না। আর যদি দেখি তাহলে সেটা আপনাদের কারোর জন্য মোটেই ভালো হবে না। কথা টা মাথায় রাখবেন।

এরপর গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো সাফওয়ান। রুনিয়াও গেলেন ওর পেছন পেছন। তারপর গাড়ি নিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেলো সাফওয়ান মা কে নিয়ে।

রুমাইশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু একটু আগে ঘটা ঘটনা গুলোর ই পুনরাবৃত্তি করতে থাকলো নিজের মাথার ভেতর৷

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।