অফিডিয়ান | পর্ব – ২৩

মেসেজ পড়ে আঁতকে উঠল রুমাইশা। সাফওয়ান আজ আবার এসেছে নাকি! তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দরজার সামনে দাড়ালো, তারপর কান পাতলো দরজায়। নাহ কোনো শব্দ আসছে না তো!

বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো ও, তারপর আস্তে আস্তে দরজার লক খুলল, যেন শব্দ না হয় একটুও।
দরজার লক খুলে আস্তে করে টান দিয়ে সামনে তাকাতেই কারো চওড়া বুকে চোখ পড়লো ওর। বুকের মালিক টা কে সেটা বুঝতে আর বেগ পেতে হলো না৷

নিমিষেই মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো রুমাইশার; সেই সাথে উৎকণ্ঠিত হলো৷
বুকের থেকে চোখ সরিয়ে সাফওয়ানের মুখের দিকে তাকালো ও৷ মাস্ক আর গগলস পরিহিত দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে সাফওয়ান কে ভেতরে আসার জন্য জায়গা করে দিলো ও। ধীর পায়ে রুমের ভেতর ঢুকে বিছনায় গিয়ে বসে পড়লো সাফওয়ান। বাম হাত দিয়ে টেনে মুখের মাস্ক আর গগলস টা খুলে ফেললো ও।

চারদিক টা চোখ বুলিয়ে নিয়ে দরজা টা আবার সাথে সাথে লক করে দিলো রুমাইশা। তারপর সাফওয়ানের পাশে বসতে বসতে আতঙ্কিত গলায় বলল,
—আপনি কেন এসেছেন এখন! কিভাবে এসেছেন? কেউ দেখে ফেলে কি হবে আপনি ভাবতে পারছেন?

— ছাদের দরজা বন্ধ করেনি আজ তোর বাপ। নইলে রাস্তার ওপর থেকে তোকে জানালা দিয়ে দেখেই চলে যেতাম।
এরপর দুই হাত উপরের দিকে উঠালো সাফওয়ান। তারপর রুমাইশা কি ইশারা করে বলল,
—আমার টি শার্ট টা খুলে দে।

রুমাইশা বাধ্য মেয়ে মতো সাফওয়ানের টি শার্ট টা ধরে ওপরের দিকে টান দিয়ে খুলে দিলো, তারপর সেটা আলনায় মেলে দিলো।

বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা দিয়ে চোখ দুইটা বন্ধ করে ডান হাত টা উলটো করে কপালের ওপর রাখলো সাফওয়ান৷
আর তখনি রুমাইশার চোখ গেলো সাফওয়ানের হাতের ক্ষতের দিকে।

— এ কি! আপনার হাত কেটেছে কিভাবে? খুব ভালো ভাবেই তো কেটেছে দেখছি!
সাফওয়ানের হাত টা টেনে নিজের কোলের ওপর নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল রুমাইশা।

— ব্যান্ডেজ ও তো বাধেননি, এইভাবে আলগা করে রাখলে তো ইনফেকশন হয়ে যাবে৷ কিসে কেটেছেন?

— কাঁচ ঢুকে গেছিলো। ঠিক হয়ে যাবে, তুই অতো লাফালাফি করিস না৷ স্থির হয়ে বস আমার কাছে একটু।
মৃদুস্বরে বলল সাফওয়ান।

কিন্তু রুমাইশা শুনলো না। উঠে গেলো ওর ড্রেসিং টেবিলের কাছে। ড্রেসিং টেবিলের মাঝ বরাবর একটা তাক থেকে অয়েন্টমেন্ট, তুলা আর ব্যান্ডেজ বের করলো ও।
এরপর আবার বিছানার কাছে ফিরে গিয়ে সাফওয়ানের হাত টা কোলের ওপর নিয়ে ধীরে ধীরে সতর্কতার সঙ্গে সাফওয়ানের হাত টা ড্রেসিং করতে থাকলো৷
খুব আলতো করে স্পর্শ করলো, যেন সাফওয়ানের একটুও ব্যাথা না লাগে।

সাফওয়ান ওভাবেই চোখ বুজে রইলো, রুমাইশার এই ছোট্ট সেবা টুকু যেন সমস্ত মন দিয়ে শুষে নিচ্ছে ও। চোখ খুললে হয়তো এত টা গভীর ভাবে ওর স্পর্শ গুলো অনুভব করতে পারবেনা ও, সেই ভয়ে চোখ খুলছে না!

রুমাইশা আলতো হাতে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে তুলা দিয়ে ক্ষত টা মুছে, অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।

সাফওয়ানের মন পুড়তে লাগলো, ওর হাতে বেশি সময় নেই। যে কোনো সময় যা কিছু হয়ে যেতে পারে। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হতাশ হলো ও। এই সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত গুলো আর হয়তো এইভাবে পাওয়া হবে না৷ পুরো জীবনের চিত্র পালটে যাবে ওর যেকোনো দিন, যেকোনো মুহুর্তে৷ ও জানেও না কখন কিভাবে কি হয়ে যাবে!

ব্যান্ডেজ টা শেষ করে রুমাইশা সাফওয়ানের মুখের দিকে তাকালো একবার।
— এ কি, আপনার চোখে পানি কেন! ভাইয়া, আপনি কাদছেন কেন? কি হয়েছে!
আতঙ্কিত হয়ে বলল রুমাইশা।

সাফওয়ানের চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখ খোলেনি এখনো ও। আগের মতো করেই চোখ দুট বন্ধ করে আছে।

রুমাইশা তৎক্ষনাৎ হাতের জিনিস পত্র গুলো টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে সাফওয়ানের কাছে আসলো, তারপর ধরা গলায় বলল,
— আপনি কেন কাদছেন! কি কয়েছে বলুন আমাকে?

সাফওয়ানের চোয়াল দ্বয় ধরে সাফওয়ানের মুখের দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকালো রুমাইশা৷

ভ্রু দুট কুচকে আছে সাফওয়ানের! যেন ব্যাথা গুলোকে নিজের ভেতরে রাখারা প্রাণপণ চেষ্টা করেও পারছেনা৷ চোখ থেকে অবিরত পানি গড়িয়ে পড়ছে, নাক টানছে সাফওয়ান! ঢোক গিলছে বার বার।

— চোখ খুলুন সাফওয়ান, আমার দিকে তাকান! কি হয়েছে বলুন! দয়া করে বলুন আমাকে, এইভাবে কাদবেন না প্লিজ!
অসহায় দৃষ্টি তে তাকিয়ে মিনতিপূর্ণ কন্ঠে বলল রুমাইশা৷
সাফওয়ানের চোখের কোনা গুলো হাত দিয়ে মুছে দিলো আলতো করে।

সাফওয়ান চোখ খুলল এবার। রুমাইশা কে টেনে এনে শুইয়ে দিলো নিজের পাশে৷ তারপর উবু হয়ে শুয়ে মাথা টা উচু করে রুমাইশার মুখ টা দেখলো, কিছুক্ষন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রুমাইশার মুখের দিকে।

রুমাইশা কি হচ্ছে তা বুঝতে না পেরে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফওয়ানের দিকে।

রুমাইশার দিকে তাকিয়ে থাকা রত অবস্থাতেই চোখ দুইটা আবারও ঝাপসা হয়ে এলো সাফওয়ানের। হুট করে জড়িয়ে ধরলো ও রুমাইশা কে। রুমাইশার বুকে মুখ লুকিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ওকে, নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে।

সাফওয়ানের এমন ভালোবাসাময় আক্রমণে হকচকিয়ে গেলো রুমাইশা। অপ্রস্তুত হয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ধীরে ধীরে নিজের দুইটা হাত সাফওয়ানের নগ্ন পিঠের ওপর রাখলো, তারপর ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিলো পিঠে।

— কি হয়েছে আপনার? কেন কাদছেন আপনি? দয়া করে বলুন আমাকে৷ এইভাবে নিজের ভেতর কথা জমিয়ে রেখে কষ্ট পাবেন না প্লিজ!
ডান হাত টা সাফওয়ানের চুলের ওপর রেখে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল রুমাইশা।

সাফওয়ান চোখ জোড়া বন্ধ করে রুমাইশার বুকে নাক ডুবিয়ে ওর বুকের গন্ধ টেনে নিলো জোরে। তারপর জড়ানো গলায় থেমে থেমে বলল,
— আমি বাচবোনা বেশিদিন রিমু। আর বাচলেও মানুষ হিসেবে হয়তো বাচবো না আমি! আমি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি যেন নিজেকে , ঘোর ঘোর লাগছে সবসময়! সবকিছু অসহ্য লাগছে আমার, সবকিছু শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করছে! আমার রুমে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন! মাটিতে মিশে থাকতে ইচ্ছা করছে সবসময়! আজ ভোরে আমি হঠাৎই কাউকেই মনে করতে পারছিলাম না, আমার স্মৃতি শক্তি আস্তে আস্তে লোপ পাচ্ছে হয়তো। কিছুদিন পর হয়তো আমি পুরোপুরি জংলি জানোয়ার হয়ে যাবো রিমু! কাউকে আর আমার মনে পড়বে না রিমু, সবাই কে ভুলে যাবো আমি! আমার মস্তিষ্ক আমাকে সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। এরকম হলে আমার মায়ের কি হবে? আমার মা কিভাবে বাচবে আমাকে ছাড়া! তোকেও ভুলে যাবো আমি! তোকে আর কখনো মনে পড়বে না হয়তো। তুই কি করবি আমাকে ছাড়া!

সাফওয়ানের চোখ থেকে পানি ঝরছে আবার! রুমাইশার বুক টা ভিজে যাচ্ছে যেন!

এদিকে রুমাইশা যেন জমে গেলো সাফওয়ানের কথায়! সাফওয়ান ভুলে যাবে সব! সব ভুলে যাবে! ওকেও? ও কি করবে তখন! ও কিভাবে বাচবে সাফওয়ান কে ছাড়া!

সাফওয়ান চোখ মুছলো, রুমাইশাকে আর ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ও, যেন একটু আলগা করলেই রুমাইশা চলে যাবে ওর আলিঙ্গনের ভেতর থেকে।

— আমি বাচতে চাই রিমু! অনেক অনেক বেশি! এরকম আদর খেতে চাই সারাটা জীবন, সারাটা ক্ষন! তোকে নিজের বউ করতে চাই। আমার মায়ের কোলে মাথা রাখতে চাই। আমার বাবা, আমার প্রাণের বাবাকে আগের মতো করে জড়িয়ে ধরতে চাই আবার! আমার ছোট ভাইটিকে আদর করতে চাই আবার আগের মতো করে! আমাদের বাচ্চা দের সাথে খেলতে চাই আমি, ওদের মুখের বাবা ডাক টা শুনতে চাই আমি। এসব-এসব কেন হলো আমার সাথে! একটা সুন্দর জীবন তো আমার প্রাপ্য ছিলো রে রিমু! তাহলে আমার সাথেই কেন এমন হলো! কি পাপ করেছি আমি। আমি-আমি এই বুক থেকে এখন কোথাও যেতে চাই না আর, কখনো না, কোথাও না! একটুও না!

ডুকরে কেদে উঠলো সাফওয়ান। রুমাইশার বুকের সাথে মিশে যেতে চাইলো যেন!

রুমাইশা হতবিহ্বল হয়ে ছিলো এতক্ষন, সাফওয়ানের কান্নার শব্দে হুসে এলো ও। ও কি করবে ভেবে পেলো না! কিন্তু এখন সাফওয়ানের সাথে সাথে ওকেও ভেঙে পড়লে চলবে না, ওকে শক্ত হতে হবে, সাফওয়ান কে সাহস দিতে হবে!
নিজেকে সামলে রুমাইশা নিজের দুই হাত দিয়ে সাফওয়ানের মাথা টা নিজের দিকে নিয়ে এসে কপালে গভীর ভাবে চুম্বন দিলো।

— চিন্তা করবেন না আপনি, ঠিক হয়ে যাবে সব! সব ঠিক হয়ে যাবে কিচ্ছু হবে না আপনার৷ আমি আছি আপনার সাথে, ফুপ্পি আছে, ফুপ্পা আছে, শাফিন আছে! আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন ইন শা আল্লাহ! আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা কোনো না কোনো রাস্তা দেখিয়ে দেবেন৷ আপনি আর কাদবেন না। মন খারাপ করবেন না আর! আপনি এইভাবে কাদলে আমি কোথায় যাবো বলুন! কোনো না কোনো উপায় ঠিকই পেয়ে যাবো আমরা!
সাফওয়ান কে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ধরা গলায় বলল রুমাইশা।

সাফওয়ান অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো, কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে রুমাইশার বুকের ওপর থেকে মাথা উঠিয়ে থুতনি টা বুকের ওপর ঠেকিয়ে জ্বলজ্বলে চোখ দুইটা দিয়ে তাকালো রুমাইশার চোখের দিকে, তারপর বাচ্চা দের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—ক্ষিদে পেয়েছে আমার, কিছু খাইনি আমি দুপুর থেকে!

— দুপুর থেকে খাননি! আপনি আগে বলেন নি কেন?
সাফওয়ান কে নিজের ওপর থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠলো রুমাইশা। তর্জনী দিয়ে নিজের চোখের কোণে জমে থাকা পানির রেশ টুকু মুছে নিয়ে বলল,
— আপনি এখানেই থাকুন আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি। দেখি ফ্রিজে তরকারি আছে নাকি! গরম করে নিয়ে আসছি আমি।

দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছিন থেকে কামিজের কোণাতে টান পড়লো। সাফওয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিতে আছে,
— আমাকে রেখে যাস না এখানে! প্লিজ!

রুমাইশা পেছন ফিরে বিছানায় উঠে বসা সাফওয়ানের মাথাটা নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে কপালে প্রেমপুর্ণ চুম্বন একে দিলো ।
তারপর সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ভেঙে পড়বেন না একদম, আমি এখনি আসছি। পাঁচ মিনিট ও লাগবে না।

সাফওয়ানের থেকে ছাড়া পেয়ে রুমাইশা ধীরে ধীরে দরজার লক খুলে গেলো রান্না ঘরে৷
বাবার নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারমানে বাবা এখন গভীর ঘুমে, আর মা এমনিতেও গভীর ঘুমই দেয়।
অতো জোরে নাক ডাকার শব্দে যার ঘুম ভাঙে না, তার এই সামান্য শব্দেও ঘুম ভাঙবে না।

তবুও নিঃশব্দে ফ্রিজের দরজাটা খুলে ভাত বের করলো ও। মাংসের বাটি টা বের করে রাখলো বাইরে। রাইসকুকারে ভাত টা গরম করার জন্য অল্প একটু পানি দিয়ে বসিয়ে দিলো, তরকারিটা চুলায় দিলো দ্রুত।
মাংস টা গরম হলেও ভাত গরম হতে সময় লাগলো খানিকক্ষন৷

রুমাইশা একটা প্লেটে বেশি করে ভাত নিয়ে, মাংসের বাটিটা হাতে করে নিয়ে চলল নিজের রুমে। নিঃশব্দে পা ফেলে ফেলে আগালো।

রুমাইশা নিজের রুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় শাফিন বের হয়ে এলো গেস্ট রুম থেকে।
বের হয়েই রুমাইশাকে এক হাতে থালা আর অন্যহাতে বাটি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও দাঁড়িয়ে গেলো!

— আপু, তুমি এত রাতে এখানে!
অবাক হয়ে বলল শাফিন।

রুমাইশা অসহায় দৃষ্টিতে ইশারায় বলল চুপ থাকতে, নইলে বাবা মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে!

শাফিন রুমাইশার ইশারা বুঝলো, নিঃশব্দে হেটে এলো রুমাইশার নিকট।
— আমি ভাবলাম কে না কে! তাই বাইরে এসেছি। কিন্তু কি ব্যাপার আপু, রাতে তো আমরা একসাথেই খেয়েছি। তোমার আবার ক্ষিদে পেয়েছে?
ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো শাফিন৷

— আমি খাবো না, তোর ভাই খাবে৷ তুই এখন চুপচাপ নিজের রুমে যা। কোনো সাউন্ড করবি না৷
রুমাইশাও ফিসফিসিয়ে বলল।

ভাইয়ের খাওয়ার কথা শুনে শাফিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।
— ভাইয়া এখানে! কখন এসেছে?

— এসেছে, কিছুক্ষন আগে। ভালো নেই তোর ভাইয়া! ওর মন খারাপ অনেক! তোকে আমি পরে এক সময় বলব। তুই এখন রুমে যা।

রুমাইশার কথা মতো শাফিন আবার নিজের রুমে গেলো।

রুমাইশা দরজা ডান পা দিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলো, লক করলো না। তারপর প্লেট বাটি বিছানার ওপর রেখে রুমে ডিম লাইট জ্বালালো। সাফওয়ান বিছানায় আগের মতো করেই বসে আছে এখনো।

রুমাইশা হাত ধুয়ে বিছনায় বসলো, তারপর ভাতের প্লেটে মাংস নিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো সাফওয়ান কে।

প্রচন্ড ভালো লাগলো সাফওয়ানের৷ শেষ কবে ওকে কেউ মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে ওর মনে পড়ে না৷ প্রচুর আদর আদর করে রুমাইশা খাইয়ে দিলো ওকে।

সাফওয়ানের মনে হলো এই মুহুর্ত টা কখনো শেষ না হোক।
প্রেয়সীর এই মুখে তুলে খাওয়ানো, এই আদর আদর করে তাকানো, মুখের কোণায় লেগে থাকা খাদ্যকণা গুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়া, এসব যেন এখানেই থমকে যায়। বাকিটা জীবন যেন এভাবেই কাটে।

কিন্তু তা কখনো সম্ভব না! ও আর কদিন বাচবে জানে না! এই নরম হাত টাতে আর খাওয়া হবে না হয়তো কখনো। এই মায়া মায়া মুখ টা আর দেখা হবে না! ওই সুন্দর চোখের চাহনি দিয়ে কেউ আর ওকে ঘায়েল করবে না।

আর কোনো বিপদে ঢাল হয়ে দাড়াতে পারবে না ও৷ ও যখন থাকবে না তখন ওর রিমু অন্য কারো হয়ে যাবে একসময়! অন্য কেউ ওকে ছুবে, ভালোবাসবে অনেক, আর ও হয়তো তখন থাকবে কোনো গহীন জঙ্গলে, হুস জ্ঞান হীন হিংস্র বন্য প্রাণির মতো ঘুরে বেড়াবে! বা হয়তো বেচে থাকবে না, মেরে ফেলা হবে ওকে! এই মানব সমাজের কোনো সভ্যতার কথায় হয়তো ওর মনে থাকবে না, আর একসময় নিজের মাতৃভাষাকেও হয়তো ও ভুলে যাবে!

খেতে খেতেই আবার ও ডুকরে কেদে উঠলো সাফওয়ান৷ কেদেই কেদেই বলল,
— আমি বাচতে চাই রিমু, আর ও অনেক অনেক দিন! তোর সাথে! তোর সাথে একসাথে বৃদ্ধ হতে চাই! আমাদের বাচ্চা দের কে বড় হতে দেখতে চাই! একটা ছোট্ট সুন্দর পরিবার চাই আমি। আমি চাইনা এই অভিশপ্ত জীবন! আমি তোকে ভুলে যেতে চাই না! আমি কাউকে ভুলতে চাইনা। ভুলতে চাই না আমি কাউকে!

রুমাইশা অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। সাফওয়ানের এই কান্নাভেজা আকুতি যেন ওর বুকের ভেতর এসে আঘাত করছে!
ভাতের প্লেট টা হাত থেকে নামিয়ে একপাশে রেখে দিয়ে সাফওয়ানের কাছে সরে এলো ও। বাম হাত টা দিয়ে সাফওয়ানের চোখের পানি মুছে দিয়ে চোয়াল স্পর্শ করে বলল,
—আর কাদবেন না। চুপ চাপ খেয়ে নিন৷ কোনো না কোনো রাস্তা অবশ্যই পাওয়া যাবে৷ এসব নিয়ে এখন আর ভাববেন না প্লিজ! শরীর খারাপ হবে আপনার৷ খেয়ে ঘুমান একটু, চোখ ফুলে গেছে আপনার৷ দ্রুত খেয়ে নিন।

তারপর হাতে করে খাবার তুলে আবার ধরলো সাফওয়ানের মুখের কাছে, সাফওয়ান কোনোমতে কান্না থামিয়ে রুমাইশার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খেতে থাকলো।

খাওয়া শেষে টেবিলের ওপর থেকে পানির বোতল টা সাফওয়ানের কাছে দিয়ে রুমাইশা চলে গেলো রান্না ঘরে৷
প্লেটা আর বাটি টা নিঃশব্দে রেখে হাত টা ধুয়ে আবার এলো রুমে৷ এসে দরজা টা লক করে দিলো।

তারপর ডিম লাইট টা বন্ধ করে দিলো। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে আবছা আলো আসছে রুমে, দেখা যাচ্ছে কোনো রকমে৷ হাতড়ে হাতড়ে বিছানা পর্যন্ত গেলো রুমাইশা। তারপর বিছানায় উঠে সাফওয়ান কে বলল,
— আপনি এখন একটু ঘুমান৷ আমি আযান দেওয়ার আগে আপনাকে জাগিয়ে দেবো৷ বাবা মা ঘুম থেকে জাগার আগেই আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হবে, নইলে ফেসে যাবেন৷

এরপর বালিশ টা ঠিক করে তাতে শুয়ে পড়লো রুমাইশা।
তারপর দুই হাত সাফওয়ানের দিকে বাড়িয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলল, আসুন, আমার বুকে আসুন।

সাফওয়ান কিছুক্ষন মুগ্ধ দৃষ্টিতে শয়নরত রুমাইশা কে দেখলো, তারপর রুমাইশার কাছে সরে এসে রুমাইশার বাড়িয়ে দেওয়া একটা হাতের আঙুলের ফাকে নিজের আঙুল দিয়ে হাত টা মুঠি করে ধরলো, তারপর সেই হাত টাকে রুমাইশার মাথার কাছে নিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরলো শক্ত করে।

এরপর রুমাইশার আরও কাছে এসে ওর মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে নিজের শরীরের উর্ধাংশের সম্পুর্ন ভর রুমাইশার শরীরের ওপর ছেড়ে দিলো ও।

রুমাইশার শরীরের সমস্ত পশম যেন দাঁড়িয়ে গেলো সাফওয়ানের স্পর্শে৷ কেপে উঠলো ও। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে সাফওয়ানের চোখের দিকে তাকালো ও৷ নিঃশ্বাস ঘন হতে লাগলো ওর। নিজের বুকে সাফওয়ানের বুকের ভেতরকার হৃৎপিণ্ডের কম্পন টের পেলো যেন৷

সাফওয়ান নিজের জ্বলজ্বলে চোখের নেশাক্ত চাহনি ফেললো রুমাইশার অক্ষিযুগলে। কিয়ৎক্ষণ ওভাবেই ওর চোখে তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ নিজের কুচকুচে কালো অধর যুগল স্পর্শ করে স্নেহের চুম্বন বসিয়ে দিলো রুমাইশার ললাটে। আবেশে চোখ বুজে নিলো রুমাইশা। হৃৎযন্ত্র টা বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু করেছে ওর।

কপাল থেকে অধর সরিয়ে রুমাইশার ঠোঁটের কাছে মুখ নিয়ে এসে নিজের কালো লকলকে দ্বিখণ্ডিত জিহবা দ্বারা ধীরে ধীরে লেহন করলো রুমাইশার ঠোঁট জোড়া। আর তারপরেই প্রগাঢ় চুম্বন বসিয়ে দিলো অধর জোড়ায়। রুমাইশার সমস্ত সত্বা কে যেন এক চুম্বনেই শুষে নিলো সাফওয়ান, শুষে নিতে থাকলো।

ডান হাত টা দিয়ে সাফওয়ানের পেশিবহুল বাহু চেপে ধরলো রুমাইশা, ওর হাতের নখ বসে গেলো সাফওয়ানের বাহুতে৷ কিন্তু তার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়লো না সাফওয়ানের ওপর।

কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে দিলো সাফওয়ান৷ রুমাইশার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বের হয়ে এলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে ওর।

সাফওয়ান ওর নাকে নিজের নাক স্পর্শ করলো তারপর নেশাযুক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
— অনেক ভালোবাসি তোকে, অনেক অনেক! নিজের থেকেও বেশি!

রুমাইশার হাতের আঙুলের ফাক থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়ে রুমাইশার বুকে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পিঠের তলায় হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আবার শক্ত করে।
রুমাইশা ওর বাম হাত টা সাফওয়ানের পিঠের ওপর রেখে ডান হাত টা ওর মাথায় ছোয়ালো৷ তারপর মৃদু গলায় বলল,
— ঘুমান এইবার৷ আর কোনো কথা নয়, দুষ্টুমি ও নয়।

রুমাইশার কথায় হাসলো সাফওয়ান।
— গান শোনা একটা। তারপর ঘুমাবো।

রুমাইশা ওর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
— এত রাতে গান গাইলে সবাই ঘুম থেকে উঠে চলে আসবে।

সাফওয়ান চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
— একটা প্লিজ! আস্তে আস্তে গাইলে কেউ শুনবে না৷ তুই ছোটবেলায় কি গান গাইতি তোর মনে আছে?

— কি গান গাইতাম?

— আইয়ুব বাচ্চুর গান, এক আকাশ তারা তুই একা গুনিস নে, গুনতে দিস তুই কিছু মোরে! সারাক্ষণ এইটা গেয়ে বেড়াতিস, তোকে থামানো যেতো না।

বলতে বলতে হাসলো সাফওয়ান। তারপর আবার বলল, —খুব সুন্দর গাইতি এখন একটা গান শোনা, মাত্র একটা গান, শুনেই ঘুমিয়ে পড়বো প্রমিজ৷
নাছোড়বান্দার মতো করে বলল সাফওয়ান।

—ঠিক আছে, আপনি আর কোনো কথা বলবেন না, ঘুমের চোটে আপনার কথা ঘুলিয়ে যাচ্ছে৷ চোখ বন্ধ করুন, আমি শোনাচ্ছি গান।

সাফওয়ান আর কোনো কথা বলল না, আরও আয়েশ করে রুমাইশার বুকে মুখ ডুবালো।

রুমাইশা গান ধরলো—

খোলা চোখখানা করো বন্ধ
বাতাসের ঠাণ্ডা গন্ধ
বয়ে বেড়ায় ঘরেরও বাহিরে
আসো ছোট্ট একটা গান করি
যাতে ঘুম পাড়ানি মাসি এসে পাশে বসে
হাতখানা দিবে কপাল ভরে
ভয় নেই, আছি আমি পাশে
হাতখানা ধরে আছি হেসে
কোলেতে আমার মাথা তোমার

অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব
জোনাকির দল আজও জেগে আছে
তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের
হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি
বসে অপেক্ষা করি
কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল

আয়, ঘুম চুম্বন দে তার সারা কপালে
যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়
আয়, চাঁদমামা কাছে আয়
যাতে অন্ধকার না হয়
আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে
যাতে কিছু আলোকিত হয়
সে যাতে ভয় না পায়

পরি আয়, তার দুই হাত ধরে
নিয়ে যা স্বপ্নের খেলাঘরে
যেথা মিলবে তার সুখের ঠিকানায়
তারাদল ছুটে আয় এইখানে
তার ঘুমখানা যাতে না ভাঙে তাই
নিয়ে যা তাকে স্বর্গের বিছানায়
যদি দেখো সেথা আমায়
বসে গান তোমায় শোনাই
তুমি মিষ্টি এক চুমু খেয়ো মোর গালে

অন্ধকার রাত, নিশ্চুপ সব
জোনাকির দল আজো জেগে আছে
তারা হয়তো অপেক্ষায় তোমার ঘুমের
হাতে রেখে হাত দেখে ঘড়ি
বসে অপেক্ষা করি
কবে হবে কাল, ফুটবে সকাল

আয়, ঘুম চুম্বন দে তার সারা কপালে
যাতে ঘুম আসে সব নিশ্চুপ হয়ে যায়
আয়, চাঁদমামা কাছে আয়
যাতে অন্ধকার না হয়
আলোমাখা কপালেতে টিপ টা দে
যাতে কিছু আলোকিত হয় (ঘুম)

রুমাইশার মিষ্টি কন্ঠে এই শান্ত, স্নিগ্ধ গান শুনতে শুনতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সাফওয়ান।

(গানটি শুনবেন সবাই, নইলে এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা আবেগ টা বুঝবেন না! আমার খুব খুব পছন্দের একটা গান, আপনাদের ও ভালো লাগবে আশা করি 💙💙)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।