অফিডিয়ান | পর্ব – ২

২. লিভিং রুমে ঢোকার আগ মুহুর্তে বাবা আর ফুপ্পার কিছু কথা কানে এলো রুমাইশার৷
ফুপ্পা থেমে থেমে বলছেন,
—দেখ শামসুল, ছেলে আমার আজ ও অপরাধ বোধে ভোগে৷ ওই ঘটনার পর থেকে ও নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নিয়েছে৷ দেশে আসার পর থেকে ও চিলেকোঠার রুমে থাকে, নিচেও আসে না। ওর মা ওর তিনবেলার খাবার দিয়ে আসে৷ কিন্তু, ওর মাও ওকে চোখের দেখা দেখেনি কতকাল তার হিসাব নেই। রুনিয়ার সামনেও আসে না ও। ওই ঘটনায় আমরা যতটানা অবাক হয়েছি তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে সাফওয়ান, ও পুরো ভেঙে পড়েছিলো। নিজেকে ও অভিশাপ মনে করতো! হয়তো এখনো করে। আমার ছেলের জীবন টা শেষ করে দিলো ওই লোক টা। আমি ঘৃণা করি ওকে!”

বলতে বলতেই হু হু করে কাদতে শুরু করলেন ইশতিয়াক আহমেদ। শামসুল ইশতিয়াক কে স্বান্তনা দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। অনুতপ্ত হয়ে বললেন,
—দুলাভাই, ভেঙে পড়বেন না, আমি বুঝতে পেরেছি, আমার ও উচিত হয়নি আপনাদের এইরকম একটা সময়ে এইভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া, কিন্তু কি করবো বলুন, আমার মেয়ের ওই অবস্থা দেখার পর আমি আর কিছু ভাবতে পারিনি!”

রুমাইশা এসব শুনছে আর মনে মনে ভাবছে, ‘কি চলছে এখানে, সাফওয়ান ভাইয়া কারো সাথে কথা বলেন না কেন? এইজন্যই কি শাফিন বলছিলো যে ভাইয়া থাকা আর না থাকা সমান! আর ফুপ্পা কার কথা বলছেন, কাকে ঘৃণা করেন উনি?”এইসব প্রশ্ন রুমাইশার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো৷

এমন সময় রুনিয়া পেছন থেকে বলে উঠলেন,
—কি রে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা!”

রুমাইশা থতমত খেয়ে বলল,
—হ্যা ফুপ্পি যাচ্ছি।”

ভেতরে ঢুকে রুমাইশা টি টেবিলের ওপর নাস্তার ট্রে টা রাখলো। রুনিয়া এসে বসলেন ইশতিয়াকের পাশে, আর রুমাইশা গিয়ে বসলো ওর বাবার পাশে।
—’কি খবর ওদিকের, ভাবি কেমন আছে? রুনিয়া ট্রে থেকে খাবারের প্লেট শামসুলের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো।

শামসুল প্লেট নিতে নিতে বললেন,
—খবর সব ভালো, তোর ভাবি ও ভালো আছে, আলহামদুলিল্লাহ। রুমির সেকেন্ড ইয়ারের পরিক্ষা শুরু হবে সামনের মাসে, তাই মেস দেখতে এসেছি। রুম ও বুকিং দিয়ে এসেছি৷ ফার্স্ট ইয়ারের পরিক্ষার সময়ে বাড়ি থেকেই যেতো, কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেতো অনেক। আর ক্লান্তির কারণে পড়তেও পারতো না, তাই ভাবছি পরীক্ষার এই এক দুই মাস মেসেই থাকুক৷”

রুনিয়া গর্জে উঠে বললেন,
—সে কি! আমরা এখানে থাকতে রুমি মেসে থাকবে কেন? ওর কি মেসের খাবার খাওয়ার অভ্যাস আছে? ও তো পরদিন ই অসুস্থ হয়ে যাবে?”

শামসুল বোনের এহেন রূপ দেখে চুপসে গেলো, বলল,
—না, ও কে যেখানে রাখবো সেখানে রান্না করে খেতে হয়। মেসের খাবার খেতে পারবেনা তা তো জানি, তাই এই ব্যাবস্থা।”

রুনিয়া ভ্রু কুচকে বললেন,
—মানে কি? ওর পরীক্ষা, আর ও পরীক্ষার পড়া না পড়ে রান্না বান্না করবে? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস শামসুল?”

শামসুল কাদের বললেন,
—এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাড়ি থেকে যাওয়া আসা করতে গেলে অনেক সমস্যা হয়। আর আমার ও সময় হয়ে ওঠে না ওকে নিতে আসার৷ রাফসান বাড়িতে থাকলে না হয় ওকে বলতাম, কিন্তু ওর ও ভার্সিটি তে এক্সাম চলছে।”

রুনিয়া বললেন,
—রুমির যে কয়দিন পরীক্ষা আছে ও আমার এখানেই থাকবে। এর বাইরে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। এত বছর পরে মেয়ে টা এসেছে ওকে আমি কিছু দিন আমার কাছে রাখবো, আর এইটাই ভালো সুযোগ৷”

শামসুল ইতস্তত করে বললেন,
—কিন্তু আপা….”

রুনিয়া শামসুল কে কথা শেষ করতে দিলেন না, তার আগেই বলে উঠলেন,
—কোনো কিন্তু ফিন্তূ না৷ আর তুই যেটার ভয় পাচ্ছিস সেটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমার ছেলে আমার সামনেই আসে না, আর কোথায় রুমি! তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস৷”

শামসুল বললেন,
—ঠিক আছে, আমি পরীক্ষার দু দিন আগে ওকে এইখানে দিয়ে যাবো, তাহলে মেসের বুকিং এর টাকা ফেরত নিয়ে আসি।”

রুনিয়া জিজ্ঞেস করলেন রুমাইশা কে
—পরীক্ষা কবে থেকে?

প্রতিউত্তরে রুমাইশা বলল,
—দুই তারিখ থেকে ফুপ্পি।”

—’দুই তারিখ? তাহলে তো আর নয় দিন আছে।”

রুনিয়া শামসুল কে বললেন,
—কোনো দরকার নেই রুমির এখন বাড়িতে যাওয়ার, আর তো নয় দিন আছে, এই কয়দিন ও নিজেকে এখানে কম্ফোর্টেবল করে নিক। তুই কাল ওর বই খাতা আর কিছু জামা কাপড় এনে দিয়ে যাস।”

শামসুল রুনিয়ার কথার বিরোধিতা করে বললেন,
—না আপা, তা হয় না, আর রুমির মাও এ ব্যাপারে জানে না, ও রাগ করবে ভিষণ। আর রুমি এত আগে থেকে এখানে কি করবে। কম্ফোর্টেবল দুদিনের ভেতরেই হয়ে যাবে ও, তুই চিন্তা করিস না৷”

কিন্তু রুনিয়া মানতে নারাজ, বললেন,
—আমি ফোন করছি আয়েশা কে, করে বলে দিচ্ছি, যে রুমি আমাদের বাড়িতেই থাকছে। আমি যতটুকু পারি বুঝিয়ে বলবো, আর বাকি টুকু তুই বাড়ি গিয়ে বুঝাস।”

শামসুল তবুও দোনোমোনো করতে লাগলেন। এমন সময় শাফিন এলো, রুমির পাশে বসতে বসতে ও বলল,
—এত শোরগোল হচ্ছে কোন বিষয়ে?”

রুনিয়া শাফিন কে বললেন পুরো ঘটনা! শাফিনের মুখ আনন্দে ঝিলিকি দিয়ে উঠলো, ও রুমাইশার পাশ থেকে উঠে শামসুল এর পাশে গিয়ে বসল এবার, বসে শামসুল এর হাত ধরে বলল,
—মামা, রাজি হয়ে যাও না প্লিজ! মামি কে রাজি করার দায়িত্ব আমার আর মায়ের, আর তুমি রাজি হলে মামিও রাজি। রাজি হয়ে যাও মামা, প্লজ প্লিজ!”

এবার ইশতিয়াক আহমেদ ও এই কাজে অংশ নিলেন, তিনজনে মিলেই শামসুল কে রাজি হওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন, এমন সময় শামসুল বললেন,
—আচ্ছা রুমি যা বলবে তাই হবে। রুমি মা, তুই কি চাস বল! তুই থাকতে চাইলে থাকবি, যেতে চাইলে যাবি৷ তোর কথাই শেষ কথা।”

সবাই রুমির দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের আশায়, সবার অগোচরে শাফিন রুমিকে চোখ টিপ মেরে ইশারা করলো থেকে যাওয়ার জন্য৷
রুমি মুখে কিছু বলল না, উঠে গিয়ে ফুপ্পির পাশে বসে পড়লো। সবার মুখে ঝরঝরে হাসি ফুটে উঠলো, শাফিন দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উপরে উঠিয়ে আবার নিচে নামিয়ে নিঃশব্দে বলল ‘ইয়েসসস’!

শামসুল কাদের বললেন,
—ঠিক আছে, মেয়ে যখন বলেছে তখন আর কি করা, আমি কাল ওর জিনিস পিত্র দিয়ে যাবো৷ এখন আমি উঠি।”
অতঃপর রুমাইশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—সাবধানে থাকিস মা,”
আর রুনিয়াকে বললেন,
—আমার মেয়েকে দেখে রাখিস! ওকে কিন্তু তোর ভরসা তেই রেখে যাচ্ছি!”

রুনিয়া শামসুল কে আস্বস্ত করে বলেন,
—তুই কোনো চিন্তা করিস না, তোর মেয়ে আমার কাছে সেইফ এন্ড সাউন্ড থাকবে। তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস।”

শামসুল কাদের মেয়ের দিকে আর একবার তাকিয়ে গেটের দিকে এগোলেন বাড়িতে ফেরার জন্য।

৩. দোতলায় সাফওয়ান এর রুম টা অনেক দিন ধরেই খালি পড়ে আছে। সাফওয়ান এখন চিলেকোঠার রুমে থাকে৷ তাই দোতলার খালি রুমটাই রুমাইশা কে গুছিয়ে দিলো রুনিয়া৷
দেয়ালের পাশ ঘেসে ঘুমানোর জন্য একটা বেড, আর তার সাথের দেয়ালের পাশ ঘেসে একটা টেবিল, চেয়ার। বিছানার শেষ প্রান্তে একটা ড্রেসিং টেবিল আর পড়ার টেবিলের পাশে একটা ছোট আলমিরা, আপাতত এটুকুই। রুমে রুমাইশার জন্য পড়ার সুন্দর একটা পরিবেশ করে দিলো রুনিয়া।

রুমাইশার ডান পাশের রুম টা শাফিন এর। রুনিয়া রুমাইশাকে অভয় দিয়ে বললেন,
—’শাফিন অনেক রাত জেগে পড়ে, কিছু মাস পরেই ওর ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল এক্সাম, তোর ভয় করবে না। আর ভয় পেলে আমাকে বা শাফিন কে ডাকিস। আমি নিচেই আছি, দরকার হলে ফোন দিস। আর শাফিন কে আমি বলে দিচ্ছি, তুই যতক্ষন জেগে থাকবি ততক্ষণ যেন শাফিন ও জেগে থাকে।”

রুমাইশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
—আচ্ছা ফুপ্পি, আমার ভয় করবেনা, আর করলেও তোমাকে জানাবো। আর এটাচ ওয়াশরুম আছে তো, আমার সমস্যা হবে না৷”

রুমাইশা কে ঘুমাতে বলে রুনিয়া চলে গেলেন নিচে, নিজের রুমে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে রুমাইশার ওপর দিয়ে। তাছাড়া বই খাতাও তো কিছুই নেই, তাই উপায় না পেয়ে রুমাইশা ঘুমানোর ই সিদ্ধান্ত নিলো। শাফিন এর ফোন এলো এমন সময়। ফোনের ওপাশ থেকে শাফিন বলল,
—ভয় পেলে আমাকে কল দিও আপু,”

রুমাইশা বলল,
—সমস্যা নেই শাফিন, আমি ভয় পাবো না, আমি এখনই ঘুমিয়ে যাবো ভাবছি। তাই ভয় পাওয়ার আর কোনো অবকাশ থাকবে না।”

—’ঠিক আছে, আপু, তুমি তাহলে ঘুমাও, আমি আর কিছুক্ষন পড়ে তারপর ঘুমাবো।”

আচ্ছা’ বলে ফোন রেখে দিলো রুমাইশা। তারপর বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লো। সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো মনে করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে ও গেলো!
হঠাৎ ভারী কিছু মাটিতে পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো রুমাইশার……

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।