অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ৯

(২০)
সকালে গ্লাস পেরিয়ে আসা তীর্যক রোদের আলো চোখে পড়তেই হাফসার ঘুম ভাঙ্গে।পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনে থাকা ঘড়িতে দেখে ৯ টা বেজে ৫৪ মিনিট।হাফসার চোখ কপালে উঠে যায়।প্রতিদিন ৭ টার কাছাকাছি টাইমে ওঠা হয়ে যায় আজ এত লেট হলো?

হুট করে উনার কথা মনে পড়তেই তড়িৎ বেগে পাশ ফিরে দেখে উনি উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছেন এখনো।
রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে আসে।স্বপ্নের থেকেও সুন্দর মনে হয়েছে রাতটি।আরহাম উনার ভালোবাসার গভীরতা বুঝিয়েছেন সারারাত। হাফসাকে নিয়ে উনার মনের সব অনুভূতি জানিয়েছেন বুঝিয়েছেন।বারবার জিজ্ঞেস করেছেন, ‘হাফসা কি উনাকে পছন্দ করতে?করলেও কেন করতো?’লজ্জায় কোনো কিছুই বলতে পারে নি হাফসা।আবারো ঘড়িতে টাইম দেখতেই তাড়াহুড়ো করে হিজাব ঠিক করতে গিয়ে মাথাটা ভারী ভারী লাগলো….

ফ্ল্যাশব্যাক___

গভীর রাত।সময়টা তাহাজ্জুদের।হাফসার ঠান্ডা লেগেছে।সে ক্রমাগত হাঁচিকাশি দিয়েই চলছে।আরহাম ওকে শুইয়ে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দেন।গা গরম দেখে মাথায় হাত দিয়ে টেম্পারেচার মেপে দেখেন জ্বর এসছে প্রচুর।আরহাম তড়িঘড়ি থার্মোমিটার এনে মেপে দেখেন জ্বরের মাএা।অতপর গালে, মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ঠান্ডা লাগছে?জ্বর আসছে অনেক।’

হাফসা দূর্বলকন্ঠে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ি।আযানের সময় ডাকবেন।’

‘উহু ঘুমাবেন না।আমি নিচ থেকে আসছি।’

‘কেনো?’

‘আসছি।’

আরহাম দরজা খুলে নিচে নামেন।নিচে কিচেনে গিয়ে নিজহাতে স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসেন।

রুমে আসতেই হাফসা স্যুপ দেখে মুখ কুঁচকে বলে, ‘স্যুপ কেন?’

‘খেয়ে নিন একটু।ইউ নিড টু টেইক মেডিসিন।’

‘কিসের?’
খাবো না।’

‘অল্প একটু খেয়ে নিন।প্লিজজ..’

আরহামের জোরাজুরিতে একটু খেয়ে নিলেও ঘুম আর বাঁধা মানলো না।গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তেই আরহাম দেখেন চুল থেকে পানি ঝরে হিজাব ভিজছে।
তিনি ওর হিজাবের প্যাঁচ খুলে বাথটাওয়াল এনে চুলে বেঁধে দেন।দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ওর টেম্পারেচার আবার চেক করে ওর গালে গাল ঠেকিয়ে রন কিছুক্ষণ।অতপর চোখেমুখে কয়েকটা চুমু খেয়ে ওয়াশরুমে যান।

এসব ভাবতেই উনার প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেলো বহুগুণ।উঠে টাওয়ালটা বারান্দায় শুকাতে দিয়ে ইচ্ছে হলো উনার ঘুমন্ত মায়াজড়ানো চেহারাটা দেখতে।হাফসা বিছানার পাশের বক্সটাতে বসেই পড়লো।একদিকে মুখ করে রয়েছেন।কিছু চুল মুখের নিচে অগোছালো ভাবে পড়েছে,মায়া লাগছে দেখতে।কতশত পাগলামি করেছেন কাল।এসব ভাবতেই হাফসার হুট করে হাসি পেলো।মুখে হাত দিয়ে হাসতেই আরহামের চেতনা ফিরলো।সুন্দর একটা সুরের ঝংকার যেন বেজে উঠলো কানে।চোখ মেলে তাকাতেই একটা শুভ্রফুল দেখতে পেলেন।হাফসা হাসতে হাসতে আচমকা উনার দৃষ্টিতে পড়লে তৎক্ষনাৎ হাসি বন্ধ করে হালকা ঢক গিলে।কখন জাগলেন উনি!

মানে মানে সরে আসতে চাইলেই উনি পেছন থেকে ওর হাত চেপে ধরেন।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন, ‘হাসি কেন বন্ধ করলেন?বেশ তো লাগছিলো।’

উনি চাদর ছেড়ে এবার উঠলেন।আধশোয়া হয়ে বেডশীটে মাথা লাগিয়ে ওকে টেনে একেবারে কোলে নিয়ে বসিয়ে মাথায় টেম্পারেচার চেক করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জ্বর কমেছে?’

‘হুমম।’

‘ঘুম ভালো হয়েছে?’

‘হুমম।’

‘শরীর ভালো?’

উনার হাতে কয়েকটা দাগ দেখতে পায় হাফসা।ফর্সা হাতে লাল ছোপ ছোপ দাগ।প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এসব কি?’

আরহাম নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ধীরসুরে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, ‘রাতে কেউ একজন ভয়ে আমার হাতে লাভ বাইট দিয়েছে।’

হাফসা আবারো লজ্জা পেল।তাড়াতাড়ি কোল থেকে নেমে এসে বলে, ‘আ্ আ্ আমি নিচে যাব।’

ওকে আর পায় কে!আরহাম ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ফ্রেশ হতে গেলেন।

আজ এত লেট হলো ব্রেকফার্স্টে।হাফসা ভাবছিলো আম্মু জিজ্ঞেস করবেন কেন লেট হলো?তবে তেমন কিছুই হলো না।বরং মিষ্টি হেসে সকালের শুভেচ্ছা জানালেন।

আরহাম আসতেই নাস্তা সার্ভ করে দেন।আরহাম মাইমুনা আর আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন উনারা নাস্তা করে নিয়েছেন।

পাশাপাশি চেয়ারে বসেছে দূজন।আরহাম ওকে যত্নের সাথে খাইয়ে দিচ্ছেন।হাফসা বাধ্য মেয়ের মতো খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে রিপিট করছে উনাকে।

উনি আবার দূষ্টুমি করে ওর মুখ থেকে খাবার নিয়ে নিজে খেয়ে ফেলতেই হাফসা রাগ করে গাল ফুলিয়ে রয়।তারপর সরি বলে কানে ধরে রাগ ভাঙ্গাচ্ছেন।

দরজার ফাঁক দিয়ে তাদের এসব দূষ্টুমি দেখে রাগে ফুঁসছে মাইমুনা।এসব ঘটনা আর সহ্য করার নয়।যেমন রাতে পানি খেতে এসে যখন দেখলো আরহাম হাফসাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছেন।এখন আবার খাবার নিয়ে খুনসুটি করছেন।মাইমুনা দূহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বড় বড় দম ফেলে।আরহামের প্রতি ওর ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।কিন্তু হাফসাকে তো সহ্য করা যাচ্ছে না।কোন মেয়ে’ই বা নিজের স্বামীর সাথে অন্য নারীকে সহ্য করবে?

হাফসাকে আরহামের থেকে আলাদা করতেই হবে সেটা যেকোনো মূল্যে হোক।আরহামের সব ভালোবাসা আমার একার চাই।মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করে বাঁকা হাসলো মাইমুনা। অতপর নিজে নিজেই বলে ওঠে, ‘আমিও দেখবো তুমি কি করে শাহ’য়ের সাথে সংসার করো।গেম ইজ স্টার্ট ফ্রম নাও।’

*****
বিকেলের নাস্তা শেষে আরহাম দূজনকে নিয়ে বেরোন।বাগানের দিকটায় যাবেন।মাইমুনার জন্য আলাদা স্ট্রীট আছে স্ট্রেচার নামানোর জন্য।আরহাম ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলেন একটু সামনে।হাফসা মাইমুনাকে হেল্প করছিলো সিড়ি ক্রস করতে।তখুনি মাইমুনা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একটু তাড়াতাড়ি নামার জন্য ভুলবশত চাকা বাঁকা হয়ে দূ তিন সিড়ি ছিটকে পড়েন চেয়ারসহ।

শব্দ শুনে আরহাম তড়িৎ বেগে পেছনে তাকিয়ে দেখেন হাফসার একটা পায়ের ওপর হুইল চেয়ারের বেশীরভাগ ভর।মাইমুনা চোখ খিঁচে পা সরাতে ব্যস্ত।আরহাম দৌড়ে এসে চেয়ার সোজা করে ব্যস্ত হয়ে বলেন,

‘কি হয়েছে?পড়ে যেতে যাচ্ছিলেন কীভাবে?’

মাইমুনাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে হাফসাকে বললেন, ‘উমায়ের! ঠিক আছেন তো আপনি?’

হাফসা খুব কষ্টে ছিঁলে যাওয়া পায়ের অংশ টা পেছনে দিকে আড়াল করে বলে, ‘আমি ঠিক আছি।আপু আপনার লাগেনি তো?’

মাইমুনা কন্ঠে ঝাঁঝ এনে বললেন, ‘কীভাবে ঠিক থাকলাম আর।তুমি আমাকে ফেলে দিতে চাইছিলে।’

হাফসার মুখ বিস্ময়ে আপনা-আপনি হা হয়ে যায়।যেখানে নিজে ব্যাথা পেয়ে চেয়ার টা পড়া থেকে কন্ট্রোল করলো সেখানে দোষ নিজের হয়ে গেলো?’

চোখ ছলছল হয়ে উঠলো মুহুর্তেই।আরহাম হাফসার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকালেন।তারপর আর কোনো কথা না বলে মাইমুনা কে কোলে তুলে রুমের দিকে নিয়ে গেলেন।

নিজের অজান্তেই দূ ফোঁটা অশ্রু মাটিতে পড়লো।অতপর তাড়াতাড়ি চোখ মুছে শুকনো পাতা দিয়ে পায়ের ওপরের জমে ওঠা রক্তটা মুছে মাইমুনার ঘরের দিকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগলো।

13★

(২১)
হাফসা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ভেতরে আরহাম।মাইমুনার হাতের ব্যাথা পাওয়া কব্জিতে মাসাজ করে দিচ্ছেন।আম্মু বাইরে ছিলেন।বাড়িতে এসেই বাইরে কোনো এক সার্ভেন্টের কাছ থেকে শুনে তড়িঘড়ি মাইমুনার রুমে ডুকতে যাচ্ছিলেন।হাফসাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেনোকিছু না বলেই ওর হাত ধরে একসাথে ভেতরে ডুকলেন।ব্যাকুল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মাইমুনার কি হয়েছে?’

আরহাম একপলক হাফসার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছু না।পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছেন একটু।’

মা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কীভাবে পড়লো?’

হাফসা মাথা নিচু করে নিলো।কারণ মিথ্যে হলেও এটাই মেনে নিতে হবে যে হাফসাই ফেলেছে মাইমুনাকে।

আরহাম ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালেন ওর নত হওয়া দেখে।মাইমুনা কিছু বলতে যাবে এমন সময় আরহাম বলে উঠলেন, ‘যাস্ট একটা এক্সিডেন্ট আম্মু।’

মা বসে পড়লেন মাইমুনার পাশেই।হাফসা মাইমুনার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো।উনি একেবারে ইনোসেন্ট চেহারা বানিয়ে রেখেছেন বিনাদোষে তাকে দোষে বানিয়ে।হাফসা চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেলকনিতে গিয়ে গালে হাত দিয়ে আনমনে সোফায় বসে রইলো।খুব খারাপ লাগছে,কষ্ট হচ্ছে।ঠোঁট চেপে চোখের পানি আটকাতে চেয়েও পারলো না।গাল বেয়ে পানি পড়তেই তড়ঘড়ি মুছে নিলো।

হাফসা নিজেকে সামলে নিলো।আপু হয়তো ভুল ভেবেছেন।আচ্ছা ব্যাপার না।ভুল বুঝাবুঝি হতেই পারে!কিন্তু ছোট্টমনের কান্না যে থামছেই না।

মিনিট পাঁচেক পর রুমে কারো আসার আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নেয় হাফসা।তবে পিছন ফিরে না।পা’টা গুটিয়ে নেয় টি টেবিলের আড়ালেই।

আরহাম এসে একেবারে ওর সামনে চেয়ার টেনে বসে আচমকাই ওর পা জোড়া কোলে তুলে নেন।হাফসা বেশ অপ্রস্তুত হয়।পা সরাতে চাইলে উনি আরো চেপে ধরেন।

‘করছেন টা কী।পা ছাড়ুন।’

‘নড়াচড়া করবেন না।’

হাফসা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়।উনার সাথে কথা বলতে,তাকাতেও ইচ্ছে করছে না।উনিও হয়তো বাকিদের মতো ভাবছেন আমি আপুকে ফেলেছি।

উনি আলতো হাতে মেডিসিন নিয়ে হাফসার পায়ে লাগাতেই হাফসা চোখ খিঁচে ধরে।উনি ওর চেহারা লক্ষ্য করে চমকালেন।চঞ্চল মেয়েটা এমন চুপ হয়ে আছে কেন?

মেডিসিন দিয়ে ব্যান্ডেড লাগিয়ে কোমল পা জোড়া নামিয়ে দেন।উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে? তাকাচ্ছেন না কেন?’

ভেতরের চাপা অভিমান লুকিয়ে রেখে হাফসা বেশ স্বাভাবিক হয়ে তাকায়।পরিবেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলো।তারপর হঠাৎ’ই উনি পাশে এসে বসলেন।ধীরকন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পায়ে বেশি ব্যাথা পেয়েছেন।জ্বলছে?’

হাফসা মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিতেই উনি বলে উঠলেন, ‘সরি।’

হাফসা শুধু জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।তবে জিজ্ঞেস করলো না সরি কেন বললেন।

উনি আচমকা হাফসাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন, ‘উমায়ের!আমি আপনাকে আর মাইমুনাকে সমান ভালোবাসি।দেটস রাইট মাইমুনার সাথে আমার পথচলা বহুদিনের।তবুও আপনাকে ও কিন্তু আমি…

খানিক থেমে বললেন, ‘আমার একটা আদেশ!কখনো যেনো আপনাদের দুজনের মধ্যে হিংসা,ঈর্ষা না দেখি।নেভার এভার।আপনাদের জন্য যেনো আমাকে কখনো রোড হতে না হয়।আমার কঠিন আচরণ আপনাদের দেখাতে চাই না।সো কেয়ারফুল।আজকের সম্পর্কে আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না আমি।বাট সেকেন্ড টাইম যেনো কোনো ভুল না হয়।’

শেষ সময়ের কথাগুলো বেশ কড়া গলায় বলে চলে গেলেন তিনি।হাফসা উনার যাওয়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।চোখ বেয়ে আবারো পানি পড়ার আগেই মুছে নেয়।বারকয়েক পলক ফেলে কান্না সরিয়ে বলে, ‘আপনিও আমাকে ভুল বুঝলেন?আমি আপনার থেকে অন্তত বিশ্বাস জিনিসটা আশা করতে পারতাম।’

******
সময়টা বিকেলের,
জেলের মধ্যে একটা রুমে কর্ণারে মাথা লাগিয়ে বসে আছে রাদ।হাতের মধ্যে একটা ছবি।হিজাব পরিহিত একটা মেয়ের।টানা টানা চোখ,টুল পড়া গালের হাসি।হিজাবের নিচ দিয়ে চুল পড়ে কপাল টা একটু ঢেকেছে। হাতে একটা চকলেটের অর্ধেক খাওয়া অংশ।গালে চকলেট লেগে আছে।ছবির ছোট্ট পরীর দৃষ্টির অজান্তে এলোমেলো ভাবে তোলা হয়েছে ছবিটা।

ছবিতে আলতো করে একটা চুমু দেয় রাদ।চোখবেয়ে একফোঁটা পানি এসে পড়লো ছোট্ট পরীর ঠোঁটে।রাদ তড়িঘড়ি মুছে নেয়।যেন ছবিটা ভিজে ঝলসে দাগ না পড়ে যায়।ছবিটার কার্বন ভালো না।অনেক বছর আগের।হাফসার ছোট বেলার একটা ছবি।রাদ চৌদ্দটা বছর ধরে ছবিটা লুকিয়ে রেখেছে সবার অজান্তে।

কি করবে সে!এতবছরের ভালোবাসা।কি করে ভুলবে সে।ছোট থেকে যে হাফসার প্রতি ওর আলাদা একটা টান অনুভব করতো।সময়ের সাথে সাথে সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়।

সে তো এমনি এমনি খারাপ আচরণ করে নি।কেউ একজন হুট করে এসে ওর ভালোবাসা কেড়ে নিলো ও কীভাবে সহ্য করবে।এজন্য ই তো সেদিন বেশি রুড ব্যবহার করছিলো।কেউ বুঝেনি তাকে।এতবছরের তার লুকায়িত অনুভূতির মূল্য কেউ দেয় নি।রাদ ছবিটা যত্ন করে বুকে চেপে রাখে কিছুক্ষণ।

কিছুক্ষণ পর কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়।আওয়াজটা ক্রমশ এদিকেই এগিয়ে আসছে।রাদ কৌতূহলী হয়ে চোখ খুলে।তখুনি দেখে জেলের তালা খুলে একজন কে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।লোকটা এসে ওর একেবারে কাছাকাছি নিজেও ফ্লোরে বসে পড়লো।রাদ রীতিমতো অবাক হয়।পলকহীন তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।লোকটা মিহি গলায় ওকে সালাম দিতেই রাদ মাথা নিচু করে ফেলে।তাকে এভোয়েড করতে ঘুরে বসে।ওদিকে সে যুবক ব্যস্ত ওর হাতে থাকা সেই ছবিটা দেখতে।রাদ ছবিটা লুকিয়ে ফেলে।আরহাম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।বরাবরের মতোন শান্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

‘রাদ ভাই।আমি চাই না আপনি এখানে থাকুন।একবারের জন্য ভেবে নিন না যে এটা রবের ফয়সালা।চাইলেও এখন আর কিছু পাল্টে দিতে পারবেন না আপনি।আজ আমি আপনাদের জামিন দিতে এসেছি।আপনি যাস্ট কোর্টে বলবেন, ‘আপনি আর কোনো বাড়াবাড়ি করবেন না।’

রাদ সামনে ঘুরে ব্যাঙ্গাতক হেসে বলে, ‘আপনিই জেলে দিয়ে আপনিই জামিন দিতে এসেছেন।আপনার দয়া আমার চাই না।আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চাই না।চলে যান আপনি।আমার অসম্ভব রাগ লাগছে আপনাকে দেখে।আপনি চলে যান নাহলে আমি কিছু করে ফেলবো।’

আরহাম চুপচাপ উঠতে যেতে নিলেন।তখুনি রাদ…..

(২২)
রাত তখন সাড়ে নয়টার কাটা পেরিয়েছে ঘড়িতে।সারাদিন ঘরে একা বসে থাকতে থাকতে একগুয়েমি চলে আসছে।বলা বাহুল্য আরহাম সেই যে রুম থেকে গিয়েছেন আর আসেননি একবারের জন্য ও।তাই মাইমুনার রুমে আসতে দেখলো তিনি একটা বই পড়ছেন।

‘আপু আসব?’

হাফসার কন্ঠে চোখ তুলে তাকালে পুনরায় বইয়ে মনোযোগ গেঁথে বলেন, ‘আসো।’

হাফসা জড়তা নিয়ে মাইমুনার পাশে বসে।মাইমুনা বই থেকে মুখ তুলে বলেন, ‘কেন এসেছো?’

‘এ্ এ এমনিই,ঘরে ভালো লাগছিল না।’

‘কেন শাহ রুমে নেই?’

‘জ্বি না।’

‘এখন কোথায়?’

‘জানিনা আমি।’

মাইমুনা আড়ালে একটা তৃপ্তির হাসি দেয়।

হাফসা অনুতপ্ত সুরে বলে, ‘আ্ আপু।আইএম সরি।এটা এক্সিডেন্ট ছিলো।আমি আপনাকে….’

হাফসার অর্ধেক কথায় থামিয়ে মাইমুনা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না।’

হাফসা চুপ হয়ে যায়।আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসলেও মাইমুনা কোনো কথাই বললেন না উল্টো যেন এভোয়েড করছেন।

হাফসা “আসি” বলে রুম থেকে বেরোয়।বের হতেই দেখে দরজার বাইরে আরহাম দূ পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন।হাফসা পাশ কাটিয়ে চুপচাপ উপরে চলে আসলো।

*****
ঘড়িতে ১০ টা বেজে ৩৫ মিনিট।রুমে এসে ভালো লাগছিলো না বলে শুয়ে ছিলো।কখন যে ঘুম লেগে গেল খেয়াল নেই।

আরহামের কন্ঠে আধোআধো চোখ মেলে তাকায়।

‘ডিনার করবেন আসুন নিচে।’

‘যান আসছি আমি।’

হাফসা উঠে হিজাব ঠিক করতে করতে উনাকে কথাটি বলল।কিন্তু উনার কোনো নড়চড় নেই দেখে হাফসা উনার দিকে জিজ্ঞাসাদৃষ্টিতে তাকাতে দেখলো উনি একধ্যানে তাকিয়ে রয়েছেন ওর দিকে।হাফসা থতমত খেয়ে যায়।
উনাকে পাশ কাটিয়ে আসতে নিলে উনি আবারো সামনে এসে দাঁড়ান।হাফসা অপ্রস্তুততা কাটাতে ঢক গিলে বলে, ‘ক্ কি দেখছেন?’

‘মশা।’

‘কোথায়?’

‘গালে।’

হাফসা তৎক্ষনাৎ গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতেই উনি হেসে ফেললেন।হাসতে হাসতেই কাছে এসে হুট করে গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই হাফসা হতভম্ব হয়ে যায়।

‘আপনার চড়ের বদলে দিলাম।গালে মশা ছিলো না কিন্তু কামড় দিয়ে গিয়েছে।খুব কিউট লাগছিল,নিচে আসুন।’

‘ফ্রেশ হয়ে আসছি।আপনি যান।’

কিছুক্ষণ পর হাফসা রুমে এসে দেখে উনি এখনো যাননি।হাফসার হাত ধরে নিচে নিয়ে যান একসাথে।

ডিনারেও হাফসা চুপচাপ ছিলো।আরহাম মাছের কাটা বেছে বেছে দূপাশে দূজনকে খাইয়ে দিচ্ছেন।দূই লোকমা খাওয়ার পর হাফসা আরহামকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘এবার আপনি খান।’

উনি আবার দিতে চাইলে হাফসা উনাকে রিপিট করে।অথচ মাইমুনা একবারও উনাকে খাওয়ার কথা বলেননি।

ডিনার শেষে হাফসা ওয়াশরুম গিয়ে অযু পড়ে আসলো।ঘুমের প্রজাপতি চোখে ভীড় করছে।অযু করে এসে ঘুমাতে যাবে অমনি আরহাম রুমে আসলেন।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘একা ভয় পাবেন ঘুমাতে?’

‘কেনো?’

‘আমি আমার রুমে ঘুমাবো।’

হাফসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আচ্ছা।আমি পারবো।’

উনি এগিয়ে এসে কপালে একটা চুমু দিয়েই বেরিয়ে গেলেন।

হাফসা বুঝে ফেললো নিজের অবস্থান।চুপচাপ সয়ে নিয়ে ভাবলো সমতা বুঝি এভাবেই করতে হয়।

চুপচাপ লাইট নিভিয়ে এসে শুয়ে পড়লো।কিন্তু ভয় করছে।মৃদুমন্দ বাতাসে বারান্দার পর্দা হালকা নড়ে নড়ে উঠছে।হাফসা গুটিসুটি মেরে কাঁথা থেকে মুখ বাড়িয়ে চেয়ে থাকে জানালার ওপাশে।তবু সময়ের সাথে ভয়ের মাএা পাল্লা দিয়ে বাড়ছেই!

ঘড়িতে ২ টা বেজে ১৩ মিনিট।
বাতাসের বেগ বেড়েছে প্রচুর।হাফসা ভয়ে ভয়ে ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ হলো।হঠাৎ ভারি বাতাসের ঘর্ষণ শব্দ আর সাদা পর্দা হুড়মুড়িয়ে এপাশ ওপাশ করার সাঁই সাঁই ভয়ানক শব্দে হাফসার ঘুম ভেঙ্গে যায়।অর্ধ চোখ মেলে জানালার ওপাশে কিছু একটা অবয়ব টের পেতেই গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে।জোরে একনাগাড়ে চিৎকার দিতেই কিছুক্ষণ পর হুট করে কেউ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।হাফসা চুপ হয়ে যায়।ব্যাক্তিটির গায়ের গন্ধ হাফসা চিনে।শার্ট খামচে ধরে জড়ো হয়ে পড়ে থাকে তার বুকের মাঝে…

(📌গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।এটাকে বাস্তবের সাথে মিলাবেন না কেউ)

(📌ওয়েডিং নাইটে আলাদা করে নামাজ পড়ার কোনো নিয়ম নেই।তবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বা শুকরিয়া আদায়ের নিয়তে নফল নামাজ পড়া যায়।গল্পে এমন কিছুই বুঝিয়েছি আমি।কেউ ভুল বুঝবেন না)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।