আরহাম চুপচাপ শুয়ে পড়লেন।এবারও কোনো উত্তর না পেয়ে হাফসা অধৈর্য হলো।বলল, ‘কিছু বললে চুপ থাকেন কেন শুধু? আমার ভালো লাগে না। ‘
আরহাম তবুও নিরুত্তর।
বেশ কিছুক্ষণ পেরোলো।উনি এদিক ফিরছেন না।জড়িয়েও ধরছেন না,বুকে নিয়ে ঘুমও পাড়াচ্ছেন না।হাফসা অনুতপ্ত হলো।রাগের মাথায় কি না কি অভিযোগ করেছে।উনি কি কষ্ট পেলেন?
উনি উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে আছেন।হাফসা উনার বাহুতে আলতো হাত রেখে বলল,’শুনুন।’
উনি এপাশ না ফিরেই বললেন, ‘শুনছি।’
আ্ আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন আমার কথায়?রাগ করেছেন?’
‘না তো।’
‘তাহলে তাকাচ্ছেন না কেন?’
আরহাম এপাশ ফিরে বললেন, ‘এইতো।’
‘কি এইতো?’
‘তাকালাম।’
‘কষ্ট পেয়েছেন আমার কথায়? আমি বুঝে বলি নি।রেগে বলেছি।’
‘জানি তো।আমি তো রাগ করিনি সোনাপাখি।কষ্ট পাইনি।’
‘তাহলে কথা কেন বলছেন না?’
‘ভাবছিলাম, আপনাকে কেন নিয়ে গেলাম না।’
‘বাদ দিন না।আমার তো মা-বাবা নেই আমি কার কাছে যাব?’
‘উমায়ের এভাবে বলবেন না।আই এম সরী।আমার ভুল হয়েছে।’
‘উহু,আপনাকে কিছু বলছি না।বাদ দিন এ বিষয়।আমাকে এখন ‘তুমি’ করে বলুন।’
আরহাম আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কেন?’
‘ডাকুন না?’
‘আমার ‘আপনি’ ডাক ভালো লাগে না? ‘
‘লাগে।এখন তুমি শুনতে ইচ্ছে করছে।’
‘উহু।’
‘কেন কেন?’
‘আমার অভ্যেস নেই।’
‘একটাবার?’
‘আপনি বলুন আগে।তারপর আমি বলব।’
‘আ্ আমি পারবো না।’
‘আমিও না।’
‘বউয়ের একটা আবদার রাখলেন না?কি স্বামী আপনি?’
হাফসার এমন সম্বোধনে আরহাম হেসে ফেললেন।
সে আরহামের চোখের পাপড়ি গুলো টানতে টানতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি আপনার কি?’
‘বউ।’
হাফসা লজ্জা পেয়ে যায়।আরহাম হেসে ফেলেন।এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।এলোচুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আপনি আমার হৃদপিণ্ড।’
‘পুরোটা?’
‘হুমম।এতো সুন্দর করে ঠোঁট নাড়ান কীভাবে?’
হাফসা কৌতূহলী হয়ে ঠোঁট চুকো করতেই আরহাম তাতে চুমু খেয়ে বসেন।সে আবারো লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে।উনি মুচকি হেসে বললেন, ‘লজ্জা কি কমে না একটুও?’
‘ঘুম আসছে।’
‘আচ্ছা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।ঘুমান।’
‘আমি ঘুমিয়ে গেলেও আপনি জেগে থাকেন তাই না?’
‘কে বলেছে? ‘
হাফসা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট ইবনে আব্দুল্লাহ বলে।’
‘বাবা টা কি জেগে থাকে?ঘুমায় না?’
‘বাবাটা জেগে থাকলে বাবাকে পাহারা দিবে কে?’
আরহাম হাসলেন।বললেন, ‘তার বাবাকে না দেখেই,না চিনেই বাবার প্রতি এতো ভালোবাসা?’
‘চিনবে না কেন?আমি যে এতো এতো গল্প করি।’
‘তাই?’
‘হুমমম।’
‘আচ্ছা।রাত জাগা যাবে না।বউ আর বাবাসোনা ঘুমান দূজনে।’
‘আপনিও আমাদের সাথে ঘুমাবেন ওকে?’
‘জ্বি।’
______
দূপুরবেলা~
মাইমুনা তখন সবে শাওয়ার নিয়ে বেরোচ্ছিলেন,তখুনি আরহাম রুমে আসেন।স্নিগ্ধ বেলি ফুলের সুঘ্রাণে রুম ভরপুর। আরহাম মাইমুনাকে একেবারে কোলে নিয়ে ছাদে চলে এলেন।
মাইমুনা জিজ্ঞাসাদৃষ্টিতে তাকালে তিনি বললেন, ‘একবার হেয়ারড্রায়ার এভোয়েড করুন।লেট মি ফিল ইউর হেয়ার’স স্মেল হানি।’
এরই মধ্যে তাদের আরো কথা চললো।একপর্যায়ে মাইমুনা বললেন, ‘মা বলেছেন আমাকে খুব মিস করছেন বেড়াতে যেতে।’
‘উহু।পরে যাবেন।’
‘কেনো?’
‘এ বিষয়টার সমাধান হয়ে যাক।তারপর যখন খুশি।’
‘এটা তো চলছেই।আমি এমনি মাকে দেখে আসলাম?’
‘বললাম তো এখন না।’
‘কেন?আমার বাবার বাড়ি যেতে দিবেন না আমাকে?’
‘আপনি কখনো যেতে চেয়েছেন আমি বাঁধা দিয়েছি মাইমুনা?কিছুদিন পরে যাবেন।’
‘কেন?আপনার কি মনে হয় যে আমার মা ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে আপনাকে ডির্ভোস দিতে আমায় মানিয়ে নিবে?’
আরহাম নিরুত্তর চলে গেলেন।খানিক পর মাথা ঠান্ডা হতে মাইমুনা বুঝলো, হলো কি ওর।আরহামের সাথে কখনো তো উঁচুগলায় কথা বলে নি।উনি নিশ্চিত হার্ট হয়েছেন।
*****
বিকেলে বাইর থেকে ফিরে গেটের ভেতর ঢুকতেই হালকা চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে আসতেই আরহাম হতবাক।ফাইয়াজের সাথে প্লে গ্রাউন্ডে আদওয়া বল নিয়ে টানাটানি করছে।একজন এদিক টানে, তো অন্যজন আরেকদিক।আরহাম কাছে আসতে আসতে তাদের ঝগড়া আরো বেড়ে গেলো।
ফাইয়াজ অভিযোগের সুর তুলে বলল, ‘মামা আমার বল ওই পঁচা আন্টি ছাড়ছে না।’
আদওয়া দ্বিগুণ অভিযোগ নিয়ে বলল, ‘ও বলেছে আমাকে খেলতে দিবে।এখন দিচ্ছে না।’
আরহাম কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে রইলেন।কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।কোনোমতে বলটা তাদের থেকে ছাড়িয়ে এনে বললেন, ‘ওয়েট এ্যা মিনিট।একটু চুপচাপ থাকো দূজন।আদওয়া কোল।ও বাচ্চা একটা।ওর মুড সুয়িং হবেই।’
আদওয়া রাগ নিয়ে বলল, ‘ও এতক্ষণ বাসকেটে বল ছুঁড়ছিলো আমি বারবার নিয়ে এসে ওর হাতে তুলে দিয়েছি।কথা ছিলো,সেও আমাকে দিবে।কিন্তু এখন তো বল-ই দেয় না।’
আরহাম এই আরেক বাচ্চাকে কি সান্ত্বনা দিবেন বুঝে উঠতে পারলেন না।উনার থিংকিং এখনো কিডসের মতো।তাই কিডসের মতোই বুঝিয়ে বললেন, ‘ফাইয়াজ মামা আমাকে বল দিবে না?আমি আন্টির পাওনা গুলো দিই?তারপর বল নিয়ে যাবে।ততক্ষণ তুমি ইনজয় করো ওকে?’
ফাইয়াজ রাগে ফুলতে ফুলতে বলল, ‘আচ্ছা।’
আরহাম হেসে তাকে কোলে তুলে ব্রেন্চে বসালেন।কানে কানে কিছু একটা বলতেই সে হেসে ফেললো।ফুলানো গালে চুমু দিয়ে আদওয়ার উদ্দেশ্যে বল দিতে চাইলে দেখলেন, আদওয়া গাল ফুলিয়ে রাগীদৃষ্টিতে আরহামের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
আরহাম আতঙ্কে পড়ে গেলেন।এখন আবার ইনার কি হলো!
‘কি হলো ফুলটুসি?’
সে রাগে ফু্ঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘ও কে কি বলেছেন আপনি?আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো কেন?’
‘নাথিং এলস।কিছু না।রেডি হোন।’
‘নাআআআ বলতে হবে। কি বলেছেন ওকে আপনি?আমাকে বলুন না?’
আরহাম শান্তকন্ঠে বললেন, ‘বলেছি।আমি ওকে ভালোবাসি।আর এজন্যই ও হেসেছে।’
আদওয়া মিইয়ে গেলো।খানিক অস্তিত্বতেও পড়লো।অস্বতি ঢাকতে বলল, ‘হুম দিন এখন।আপনি ওখান টায় গিয়ে দাঁড়ান।’
*****
প্লে গ্রাউন্ডে কিছুক্ষণ বল ছোঁড়াছুড়ি করেই আদওয়া হাঁপিয়ে উঠলো।রুমে এসে কাশি শুরু হলো।কাশি কোনোভাবেই যেনো থামছে না।কাশির সাথে থুতু ফেলতে পুনরায় আগের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখে পড়লো।আরহাম লাগাতার দরজায় নক করছেন।বেসিন ক্লিন করে খুলতেই তিনি বললেন, ‘হঠাৎ এত কফ হচ্ছে কেন?’
‘জানিনা।’
আরো সময় পেরোলো।তখনও আদওয়াকে একনাগাড়ে কাশতেই দেখে আরহাম এগিয়ে আসলেন।একটু স্থির হতে পানি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তো অসুস্থ।কফ কমছে না।ডক্টরে যাবো রেডি হোন।’
আদওয়া দ্বিমত করে বলে, ‘উহু,আইসক্রিম খাওয়ায় ঠান্ডা লেগেছিলো।বাইরের বাতাসে আরো বাড়বে।আদা দিয়ে চা খেলেই কমে যাবে।’
‘আচ্ছা আমি আনছি।’
আদওয়া আরহাম আটকে বলল, ‘পারবো তো আমি।আমি যাচ্ছি।আপনি টায়ার্ড হয়ে আসছেন।রেস্ট নিন।’
‘যেতে হবে না কিচেনে।গ্যাসের ধোঁয়ায় আরো বাড়বে।আমি চা করে আনছি।’
আরহাম বেরোতেই আদওয়া ফ্লোরে চোখ খিঁচে হাটু গেঁড়ে বসে রইলো।বুকের তীব্র ব্যথায় ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে।শ্বাসগুলোও গুণে গুণে ফেলতে হচ্ছে!কিন্তু কেন?আগে একটা ক্যাপসুল নিলেই সব ব্যাথা অসুখের উপশম হতো,পরপর তিনদিন খেয়েও কমছে না কেনো।উনাকে কি একটা বার বলবে।না থাক,টেনশন করেন যদি!
******
ঈদের আর মাএ দূদিন।আজকে সকালে হঠাৎ আইরা হাজির।সবাইকে সারপ্রাইজ দিতেই চুপিচুপি ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ এসেছে।জেদ ধরেছিলো,দেশে সবার সাথে একসাথে ঈদ করবে।আলাদা খুশির আমেজে পুরো বাড়ি মুখরিত।আব্বুর কোল জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে এখনো সোফায় বসে আছে।দীর্ঘদিন পর আব্বুর সাথে দেখা।
আইরা নিজেও আদওয়ার মতো উড়নচণ্ডী ছটফটে হওয়ায় আসার পর থেকেই তার সাথে ভাব হয়ে গেছে।একটু পর পর ভাইকে খোঁচা মেরে মেরে বলছে, ‘তুমার যতটা বউ হবে,বাচ্চাকাচ্চা হবে, তুমার ভালোবাসার ভাগ ততটা কমে যাবে।ভালোবাসার অভাবে তুমি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে।’
আরহাম জোরালো জবাব দিলেন, ‘নেভার।’
‘আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে।শুধু বাবুটা আসুক।’
সন্ধ্যার নাস্তা শেষে আরহামের বারন না শুনে আইরা বায়না ধরলো শপিং এ যেতে।মাহদিন কড়া সুরে বললেন, ‘আপনি দেখি ভাইয়ের কোনো কথাই শুনেন না।’
আইরা মুখ গোমড়া করে আরহামের উদ্দেশ্য বলল, ‘যাবো ভাইয়া?’
আরহাম বললেন, ‘মাহদিন ভাইয়ের পারমিশন নিয়ে যাও।’
মাহদিন তৎক্ষনাৎ দ্বিমত করে বললেন, ‘লাভ নেই ভাই।আমার কথা এইভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন।’
আরহামের কড়া নজর আইরার ওপর পড়তে সে ভয়ে আমতাআমতা করে বলল, ‘সরি।এখন থেকে শুনবো।’
আইরা রুমেই ফিরে আসতে চেয়েছিলো।আরহাম ডেকে বললেন, ‘যাও শপিংয়ে।বাট খুব অল্প সময়ের জন্য।’
মাথা নেড়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে চলে আসলো আদওয়ার রুমে।আদওয়াকে যাওয়ার অফার করলে সে বলল, ‘উনার পারমিশন ছাড়া কোথাও বেরোলে বলেছেন, পা কেটে রেখে দিবেন।’
‘এত ভয় পাও ভাইয়াকে?’
‘হুমম।ওইদিন ফুচকা খেয়েছিলাম গেটের বাইরে গিয়ে।কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।’
আদওয়া অবাক বনে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি?’
‘হুমম।’
‘ভাইয়া এত রোড?’
‘হুম প্রচুর রো….ম্ মানে রোমান্টিক।’
আদওয়ার দৃষ্টি দরজায় স্থির দেখে আইরাও চোখ ফিরাতে দেখলো, আরহাম দাঁড়িয়ে।মুখটিপে হেসে বেরিয়ে গেলো সে।আরহাম ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি রোড?’
77★
(১১৭)
‘আমি রোড?’
‘আমি কি ব্ বলেছি নাকি?’
‘আমি না থাকলে সেটাই বলতেন।’
‘হ্যাঁ ন্ না না কেন ব্ বলবো?’
‘সিরিয়াসলি আদওয়া?আপনি এতো ভয় পান আমাকে?’
‘হু।’
‘কেন?’
‘আপনার রাগ।’
‘একচুয়ালি!বাট হাউ টু রিডিউস!
*****
ব্যস্তভঙ্গিতে ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে ছুটছিলেন আরহাম।সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছিলেন আচমকা দৃষ্টি আটকে যায় উত্তরপাশের রেলিং এ।আরহাম একদম অবাক বনে যান।রেলিং এর একদম কিনার ঘেষে উঁচু পিলারে বসে উমায়ের আচার খাচ্ছে।বৈয়াম হাতে গাল ফুলিয়ে চেয়ে আছে এদিক।
আরহাম এগিয়ে বললেন, ‘আশ্চর্য্য আপনি ছাদে?কার সাথে এসেছেন?’
‘বিনু আপু।’
‘কেনো?ঘরে কি জায়গা হচ্ছিলো না?’
হাফসা আমতা আমতা করতে করতে আচারের বৈয়াম টা কৌশলে আড়াল করতে চাইলে আরহাম ছুঁ মে’রে নিয়ে দেখলেন।অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আবারও স্পাইসি♨?’
‘দিন না দিন।আমি কিন্তু লাফ দিয়ে পড়ে যাবো তা না হলে।’
‘একদম কেটে কুচি কুচি করে ফেলবো ‘
‘কোথায়?’
‘আচার পেলেন কোথায়?’
‘আদওয়া দিয়েছে।’
‘জানতাম।আর কেউ দিতো না।’
আরহাম এগিয়ে এসে কোলে করে নামিয়ে নাক চেপে ধরে বললেন, ‘আপনি ইনজয় করছেন স্পাইসি খেয়ে।আর তাঁর কষ্ট হচ্ছে।’
কোলে তুলে নামাতে নামাতে বললেন, ‘আর যদি কখনো উল্টাপাল্টা কিছু খেতে দেখি তাহলে বেঁধে রেখে দিবো ঘরে।’
‘ইমাজিন তখন আচার আগেই ঘরে এনে রেখেছিলাম।আপনি দেখেননি।তখন?’
‘নিজের ভালো টা বুঝবেন না?’
‘তাহলে আপনি কেন?’
রুমে এনে দাঁড় করিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আপনি ইদানীং শুনেন আমার কথা?’
‘বাইরে গেলে আসার সময় লাল লাল আঙ্গুর আর পাপায়া আনবেন।খুব খেতে ইচ্ছে করছে।’
এগুলো উনার জন্য হার্মফুল জেনেও বায়না ধরছেন।আরহাম কড়াদৃষ্টিতে তাকালেন।তবুও তার তেমন কোনো হেলদোল নেই।
‘এই মেয়েটা এখন একটুও ভয় পায় না আমাকে
কিছু বললেই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে।
এখন তারা দূইজন বলে সাহস বেড়ে গেছে’ মনে মনে ভাবতে ভাবতে আম্মুর উদ্দেশ্যে ডেকে বললেন, ‘আম্মু।তাকে একটু বুঝাবেন?আমার কথা শুনেন না।’
*****
পরদিন বিকেলে আব্বু আর উনি রেডি হচ্ছিলেন কুরবানির পশু কিনতে যেতে। আদওয়া চিপস খেতে খেতে বলল, ‘আজকে ইয়া বড় একটা লাল গরু আনবেন।’
‘আর বড়োঅঅঅঅ একটা কালো ষাঁড়।'(মাইমুনা)
‘আর ফুটফুটে একটা সাদা গরু আনবেন।'(হাফসা)
আরহাম মুচকি হেসে বললেন, ‘আর কোনো কালার?’
‘উহু।’
*****
আজ ঈদ।
উপরের বেলকনি থেকে তিনজনে তাকিয়ে আছে।কালো পাজাবির সাথে গলডেন এর কাজ করা পাথরে উনাকে কী যে মারাত্নক সুন্দর লাগছে!এরই মধ্যে আরহাম তাকালেন একবার।মুচকি হেসে ইশারায় বললেন, নিচের বেলনকনিতে আসতে।
আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে একের পর এক তিনটা পশু জবাই করে দোয়াহ সম্পন্ন করলেন।ঘরে ফিরে এসে একসাথে নাস্তা করে সবার রুমে আলাদা গিয়ে ভালোবাসা প্রদান করে নাস্তা নিয়ে নিচে গেলেন।হাতে হাত লাগিয়ে পুরো সময়টুকু তাদের সাহায্য করলেন।
দূপুরবেলা খাবারের সময় তিনজনকে খাইয়ে দিলেন, গল্প করলেন, উপহার দিলেন।পরিবারের সবার সাথে উৎসবমুখর সুন্দর একটা দিন কাটলো।
*****
সন্ধ্যার পর গেস্টরুমে চেঁচামেচির শব্দ শুনে খানিক ভয় পেয়েই এগিয়ে এসে দেখলেন, দূপাশে ইযহান ফাইয়াজ কে নিয়ে আদওয়া ট্যাবে গেম খেলছে,আর জিতে গেলেই খুশিতে বাক-বাকুম করছে,পাশের দূজনের মতোই হুররে চিৎকার তুলছে।আরহাম দরজায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে তাকিয়ে রইলেন।চিন্তা করা যায়,কতটুকু বাচ্চা নিয়ে তিনি সংসার করছেন!একেকজন একেকরকম!চোখের সামনে একজন উনার মন-মানসিকতার সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলছে,বাবার বাড়ি যাওয়ার পারমিশন দিই নি বলে একজন গাল ফুলিয়ে রাগে ফুঁসছে,আর আরেকজন দিনের পর দিন ঘুমাচ্ছে।আর চুপিচুপি সব আনহাইজেনিক খাবার খাওয়ার পায়তারা করছে।
ভাইকে পাশ কাটিয়ে খানিক পর যোগ হলো আইরাও।আদওয়ার থেকে ট্যাব নিয়ে যখন নিজে একবার খেলতে চাইলো আরহাম অবাক হলেন না।আইরার এসব পাগলামি বরাবরই দেখে আসছেন।ছেলের বয়সী বাচ্চামিগুলো নিজে করতে একটু বাঁধে না উনারও।
আরহাম সরে আসলেন।মনে মনে আওড়ালেন, ‘মাহদিন ভাইয়ের এক পিস; আর আমার এক পিস!’
******
বেশ কিছুদিন পেরিয়েছে।আরহামের সাথে আদওয়ার সম্পর্কও সহজ হয়েছে।দূ তিনদিনের অপেক্ষা শেষে সে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে আরহামের বুকের বা পাশে মাথা রেখে ঘুমাবে বলে।আজকে আসার কথা থাকলেও তিনি এখনও আসেননি।হয়তো আজকে আসবেনও না।আদওয়া তবুও অপেক্ষা করে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আরহাম ফিরলে আদওয়া ঘুমু ঘুমু চোখে বলল,’ঘুমাবেন কখন?’
‘এইতো।আপনি জেগে আছেন কেন?’
আদওয়া আরহামের বুক ইশারা করে বলল,’এখানে ঘুমাবো বলে।’
‘এই অভ্যাস ছাড়তে হবে।’
আদওয়া আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে,’কেন কেন?’
‘বায়োডাটা রেডি আছে আপনার?’
‘বায়োডাটা দিয়ে কি হবে ?’
‘বিয়ে দিব আপনাকে।’
‘কেন?’
‘ফুচকা ওয়ালার সাথে।’
আদওয়া মুহুর্তেই মিইয়ে গেলো।ওইদিন কী না কি বলেছিল নিজেই ভুলেই গেছে।কিন্তু লোকটার শ্রবণশক্তি এত তীক্ষ্ণ কেন?’
‘ভুলে বলেছি।’
‘সো,ইউ ডিজার্ভ এ্যা পানিশমেন্ট।’
‘কি পানিশমেন্ট?’
‘আপনাকে একটা এ্যামাজিং লুকে দেখতে চাই।’
‘কেনো?’
‘সিক্রেট।’
‘এখন?’
‘বেশী ঘুম আসছে? তাহলে থাক।’
‘আচ্ছা।’
*****
আরহামকে মুগ্ধ করার জন্য এতটুকুই সাজ যথেষ্ট ছিলো।লম্বা চুলগুলো খোঁপা করে,শাড়ি পরে, অর্নামেন্টস ইউজ করে সাজলেও উনার সামনে মুঠো করা হাতজোড়া থরথর করে কাঁপছে।আরহামের নিঁখুত শুভ্র সৌন্দর্যের সাথে ওর শ্যমবর্ণের রংটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলো মুহুর্তেই।কেমন জানি মিলছে না।
আরহাম অদ্ভুত সুন্দর ভাবে তাকিয়ে আছেন আদওয়ার দিকে।আদওয়া মাথা নিচু করে ফেলল,এত সুন্দর দৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতা, আল্লাহ ওকে দেননি।
আরহামের পকেটে হাতগুজা অবস্থায় একই দৃষ্টি রেখে এগিয়ে এলেন।উনার যেনো পলক পড়ছে না।আদওয়া পেছনে সরে যেতেই উনি মুচকি হাসলেন।কাছে এসে বেয়ে পড়া আঁচলটুকু মাথায় তুলে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীরসুরে বললেন, ‘এত সুন্দর লাগছে কেন?চোখ সরাতে পারছি না কেন?’
মুহূর্তেই খুশি হয়ে পড়লো ও।গাল ফুলিয়ে বলল,’আপনি সুন্দর।আমিই শ্যামলা।’
‘শ্যামলা বলেই আপনার সৌন্দর্য আমার কাছে আরো বেশী ভালো লাগে!
শ্যামবতী ভালোবাসি!’
আদওয়ার সারা হৃদয় জুড়ে অসম্ভব সুন্দর একটা অনুভূতি ছেঁয়ে গেলো।কখনও কি ইমাজিনও করেছিলো, এই পুরুষের থেকে কাঙ্খিত কথাটা শুনবে!
লজ্জা নিয়ে বলল, ‘আমিও।’
‘শ্যামাপাখি?’
‘উমম।’
‘আপনার মতো ছটফটে এমন ছোট্ট একটা শ্যামাপাখি চাই।’
আদওয়া লজ্জায় রক্তিম হয়ে মুখ লুকালো আরহামের বুকে।তিনি বেশ শব্দ করেই হেসে ফেললেন।কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘এখন না।আমার শ্যামাপাখি পুরোপুরি এডাল্ট হওয়ার পর।’
আজকে তাদের প্রণয় হলো।বাকি থাকা দূরত্বটুকু এক রজনীতেই ঘুচে গেলো।আরহাম ছোট্ট ফুলটুসিকে যত্নে উনার বাহুডোরে আগলে নিলেন।তার পরিপূর্ণ অধিকারের অপ্রাপ্তি থেকে সিলমোহর তুলে নিলেন।
*****
ফযরের নামাজের পর ঘুমাতেই কড়া ঘুম লেগে আসছিলো আরহামের।ব্যঘাত ঘটলো অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনে।পাশ ফিরতে দেখলেন আদওয়া পাশে নেই।কান খাড়া করে শব্দের উৎস খুঁজলে বুঝলেন শব্দটা ওয়াশরুম থেকে আসছে।আরহাম চাদর সরিয়ে উঠে সেদিকে এগোলেন।ভিড়িয়ে রাখা দরজা হালকা ঠেলতে ফ্লোরে তাকাতেই চমকে গেলেন।বেসিনসহ ফ্লোরের কিছু অংশ রক্তে একাকার।বমিটিং এর পর একেবারেই নিস্তেজ হয়ে আসছিলো আদওয়া।পড়ে যেতে নিলেই আরহাম ধরে ফেললেন।কোলে করে এনে শুইয়ে ঠোঁটের গড়িয়ে পড়া রক্তগুলো মুছে বুকের সাথে চেপে ধরে রইলেন অনেকক্ষণ।তাকে শান্ত হতে সময় দিলেন।আদওয়ার শরীর থরথর করে কাঁপছে।কিন্তু তাঁর চেয়েও বেশী জোরে কাঁপছে আরহামের হৃদয়।কি হয়েছে শ্যামাপাখির?এত অসুস্থ কেন?