অপেক্ষা – মাহা আরাত | পর্ব – ৩৬

আরহামের আক্ষেপের সুরে কথাটা বলার সাথে সাথেই মাইমুনার চোখের বাঁধ ভাঙ্গলো।অনুতপ্ত সুরে বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন।প্লিজ শাহ।আর কখনো এমন ভুল হবে না।আই প্রমিস!
আপনি অসন্তুষ্ট থাকলে মরে গেলেও শান্তি পাবো না।’

আরহাম মাইমুনাকে নিজের বাহুডোরে সযতনে আগলে বললেন, ‘আর কখনো এমন কথা বলবেন না।আমার কোনো অভিযোগ নেই।উমায়ের এর কাছে আপনি ক্ষমা চাইবেন।’

‘আচ্ছা।’

‘ভাববেন না উনাকে বেশী ভালোবাসি আমি।আপনাকেও বাসি।কিন্তু আপনি ভালোবাসার সুযোগ দেননি।’

‘আফওয়ান।’

‘হুমম।কান্না বন্ধ করুন এখন।আপনারা দূজনেই এত কাঁদেন!আমি রাগ করে থাকতে পারি না।’

আরহাম মাইমুনার চোখ মুছে দিয়ে মাথায় চুমু দিয়ে বললেন, “ভুল বোঝাবুঝি হোক,মন মালিন্যতা হোক,তবুও দূরে যাবেন না।বাইরে থেকে রেগে থাকলেও আপনাকে লুকিয়ে দেখতাম আমি।সামনে থাকলে শান্তি লাগে।কিন্তু আড়াল হলেই অশান্তি বাড়ে।আপনি চলে আসুন আমরা বাড়ি ফিরে যাই।’

মাইমুনা আরহামের কথায় হেসে বললেন, ‘এতদিনে আসছি,আম্মু যেতে দিবেনই না।’

আরহাম মুখ গোমরা করে বললেন, ‘কিন্তু আপনাকে ছাড়া থাকার অভ্যেস তো নেই।’

‘আপনিও থাকুন প্লিজ।’

‘ইনশাআল্লাহ।আচ্ছা খেয়েছেন কিছু?আমি যাওয়া পর আর কাঁদবেন না।বিগত দিনের সবকিছু ভুলে যান।ওকে?’

‘আচ্ছা।’

‘আচ্ছা আসি আমি।লেট হয়ে যাবে পৌঁছাতে।’

‘উঁহু।আপনি যেতে পারবেন না।আমি যেতে দিব না।বলে টেবিল থেকে বই বাধানোর রশ্মি থেকে রশ্মি এনে আরহামের দূহাত বাঁধতে বাঁধতে বলে,আপনাকে যেতে দিব না।প্রয়োজনে বেধে রাখলাম।’

আরহাম রীতিমতো হাসছেন ওর কান্ডে।

মাইমুনা আরহামকে প্যাচিয়ে পুচিয়ে বেঁধে বলল,’দেখি এবার যান তো।’

আরহাম নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘ছাড়ুন আমাকে।মাকে ডাক দিচ্ছি।দেখুন এসে আপনার মেয়ে কত ভয়ানক হয়েছে!’

মাইমুনা মুখে হাত দিয়ে হেসে বললেন,’ডাকুন।নিজের প্রেস্টিজ নিয়ে আর বাড়ি যেতে পারবেন না মা আপনাকে এভাবে দেখলে!’

‘আপনি কি চান আমার প্রেস্টিজ যাক?”

‘এই মুহুর্তে চাই।’

‘ছাড়ুন।’

‘উহু।’

*****
‘মাইমুনা এদিকে আসো তো একটু’

মায়ের ডাকে মাইমুনা চলে গেলেন।যাওয়ার আগে আরহামকে খুলে গেলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর কিচেন থেকে মাইমুনা চেয়ার টেনে বের হতে দেখে আরহাম ড্রয়িং রুমে দাদীর সাথে গল্প করছেন।সত্তোরোর্ধ বয়স দাদীর।আরহামকে উনার খুব বেশী পছন্দ।ঘরের বাকি তিন জামাই থেকে সবচেয়ে বেশী পছন্দ করেন আরহামকে।

ঘড়িতে তখন ৯ টার কাটা পেরিয়েছে।
মায়ের অনেক জোরাজুরির পরও ডিনার করলেন না।বরং রুমে এসে তড়িঘড়ি করে বললেন, ‘আমাকে যেতে হবে।আপনি কাল…

‘কি বলছেন।আজকে অন্তত থেকে যাবেন আপনি।’

আরহাম মাইমুনার গালে হাত রেখে বললেন,’অবশ্যই থাকবো।অন্য একদিন।এখন বাসায় যেতে হবে।’

মাইমুনা আবদারের সুরে বলল, ‘একটা রাতও থাকবেন না?’

‘আব্বু বাসায় থাকলে থাকতাম হানি।আব্বু বিকেলে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন।বাসায় আম্মু আর উনি একা।চিন্তা হচ্ছে।যেতে হবে।’

গোমরা মুখে আরহামকে বিদায় দিলেন মাইমুনা।যাওয়ার আগে আরহাম অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে ছিলেন মাইমুনাকে।বারবার বলে গিয়েছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে।

******
বাসায় ফিরতে ফিরতে ঘন্টাদূয়েক লেট হলো।কোনো এক দলীয় সমাবেশের কারণে মেইন রোডে জ্যাম পড়েছিলো।আর তাতে আরহামের অশান্তির মাএা চরম বেড়েছিলো।বাসায় ডুকেই মা খাবার বেড়ে দিলেন।মায়ের জোরাজুরি তে খেয়ে রুমে এসে দেখলেন, উনার টুনটুনি পাখিটা ঘুমিয়ে পড়েছে অলরেডি।আরহাম কিছুক্ষণ চোখ জড়িয়ে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে গেলেন।এসে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ঘুমন্ত হাফসার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলেন আরহাম।মা বলছিলেন, হাফসা আরহামের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে টেবিলেই ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছিলো।অতপর পা জোর করে খাইয়ে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলেন ঘুমানোর জন্য।

‘আপনার ঘুম ব্যতিক্রম।ঘুম একবার আসলে আর রেহাই নেই।’

লাইট নিভিয়ে বিছানায় আসতে আসতে ভাবলেন, কেমন ভয়ানক অনুভূতি। একেকজন কে ছাড়া থাকা যায় না।একজন পাশে থাকলে আরেকজনের জন্য মন অস্থির হয়ে যায়।কপালে উষ্ণ দিয়ে হাফসাকে কাছে টেনে শুয়ে পড়লেন তিনিও।এমন শান্তি মায়ের কোলের পর আর কোথাও পাওয়া যায় না!

******
পরের দিন
একসাথে বসে তিনজনে যখন নাস্তা করছিলেন তখন বিমর্ষ মুখে বাবা ডুকলেন।উনাকে অতিরিক্ত চিন্তিত দেখাচ্ছিলো,সাথে চোখগুলো লাল।তিনজনের দৃষ্টি যখন উনারই উপর নিবদ্ধ আম্মু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাল কোথায় গিয়েছিলেন এত রাতে কাউকে কিছু না বলে?কিছু হয়েছে?’

আরহামও তখন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।বাবা আরহামের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টি রেখে ‘কিছু না’ বলে ঘরে চলে গেলেন।

আরহাম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আব্বু কখন গিয়েছিলেন?কেন রাতে বাইরে গিয়েছিলেন?’

‘কিছুই বলে যাননি।ফোনে হন্তদন্ত হয়ে কথা বলে বেরিয়ে গেলেন।’

‘আ আমি কিছু করেছি?’

‘জানি না তো।’

‘আব্বুকে জিজ্ঞেস করব?’

‘এখন যেয়ো না।পরে করিও’

*****
মাইমুনা আরহামের ফোন রেখে খুশিতে আনমনে বারবার হেসে উঠছিলো।একটা দৃশ্য বারবার মনে পড়ছে।কাল বিদায় নেওয়ার সময় আরহামকে মা বলেছিলেন, ‘মাইমুনাকে একমাস না রেখে ছাড়ছি না এবার।তুমিও সময়-সুযোগ করে এসো।”

একমাসের কথা শুনতেই আরহাম অসহায় চোখে মায়ের পিছে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মাইমুনার দিকে তাকালেন। মাইমুনা তো ভেতরে ভেতরে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলো।উনার অসহায় চেহারা দেখে বেশ মায়া হচ্ছিলো মাইমুনার।এ দিকে খুব কৃপন আরহাম।স্ত্রীদের বাবার বাড়ি থাকার মেয়াদ খুব কম দেন।উনারই বা কী দোষ!

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই মাইমুনাকে টেক্সট করেছিলেন, ‘মা যদি উনার মেয়েজামাই কে মেন্টাল সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে না পাঠাতে চান,তবে তিনদিনের মাথায়ই যেনো মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেন।তা না হলে আমি আমার বাড়িটা শূন্যে তুলে এখানে চলে আসবো।’

৯৫
রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলেন আরহাম।বেশ তাড়া আছে উনার।হাফসার কাছ থেকে বিদায় নিতেই যাচ্ছিলেন।তাড়াহুড়োর বসে দরজায় নক না করেই পান্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে রুমে ডুকেই চমকে গেলেন।সামনাসামনি ওয়াশরুমের দরজা খোলা।হাফসার পিছন সাইড দেখা যাচ্ছে।বেসিনে উনি কি করছেন?

ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলেন হাফসার বমিটিং হচ্ছে।তবে কারণ কি?গত কয়েক দিন থেকে আমার থেকে দূরে দূরে থাকা,রাতেও এভোয়েড করা,খাবার টেবিলে হাফসার মিট-ফিস এভোয়েড করা, টক খেতে চাওয়া,খাওয়ায় অরুচি,শুকিয়ে যাওয়া আর চুপচাপ থাকা থেকে আরহাম কিছু ভাবতে থাকলেন।

বমিটিং শেষে খুবই দূর্বল লাগছে হাফসার।ভালোভাবে মুখ ধুয়ে চলে আসতেই একেবারে সামনাসামনি আরহাম কে দেখে চমকে যায় হাফসা আরহাম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন।চোখমুখ কঠিন।হাফসা ভয়ে ঢুক গিলে তাকায়।
‘আ্ আ্ আ্ আপনি কখন…

‘কয়দিন থেকে অসুস্থ?’

আরহামের শান্ত কন্ঠের এমন প্রশ্নে হাফসার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম।ভয়ে হাত পা অনবরত কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

আরহাম কিছুসময়ে বুঝলেন, হাফসা মাএাতিরিক্ত কাঁপছে।চোখে মুখে ভয়ের ছাপ।আরহাম নিজেকে মনে মনে ঝাড়ি দিলেন।এভাবে কঠিন হয়ে প্রশ্ন করা মোটেই ঠিক হয় নি।নিজেকে সামলে হাফসাকে ধরে বিছানায় এসে বসালেন।অতঃপর ওর দূ হাত নিজের হাতে নিয়ে নরমগলায় প্রশ্ন করলেন, ‘বলুন,ভয় পাবেন না।’

হাফসা পিটপিট করে চোখ তুলে তাকিয়ে আবারো নিজেকে গুটিয়ে নিলো।

আরহাম ওকে আবারো কোমল স্বরে জিনিস করলেন, বলুন, ‘কতদিন থেকে অসুস্থ উমায়ের?

‘দূ দূই্ ই্ মাস থেকে ম্যাটার্নাল প্রবলেম।’

আরহাম চিন্তিত হলেন।কঠিন না হয়েও রুঢ় গলায় বললেন, ‘আপনার এত সব সমস্যা আমাকে তো একবার বলেননি।হুয়াই?আমি আপনার আপন না?দূমাস থেকে অসুস্থ আমাকে জানিয়েছেন একবারও?’

59★

‘দ্ দূই মাস থেকে ম্যাটার্নাল প্রবলেম।’

আরহাম চিন্তিত হলেন।কঠিন না হয়েও রুঢ় গলায় বললেন, ‘আপনার এত সব সমস্যা আমাকে তো একবার বলেননি।হুয়াই?আমি আপনার আপন না?দূমাস থেকে অসুস্থ আমাকে জানিয়েছেন একবারও?’

হাফসা এবার ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো। যেনো ওর ভুলটা এখন কান্না দিয়ে শুধরে নিবে।গাল বেয়ে চোখের পানি পড়লো সাথে বলল, ‘আ্ আমি ভয় পেয়েছিলাম, তা তাই বলিনি।’

‘আমি আপনার কে?’

আরহাম ওর এমন প্রশ্নে হাফসা দিশেহারা হয়ে গেলো। কিছুই বুঝছে না।উনি কি বললেন, এর মানে কি!এত মাথা ঘুরছে কেন?

আরহামের দিকে আর একবারও তাকানোর সুযোগ হলো না।চারপাশ হঠাৎ-ই ঝাপসা হয়ে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো মুহুর্তেই।

হাফসাকে দ্রুত ধরে ফেললেন আরহাম।ও সেন্স হারিয়েছে।অজানা এক ভয় আঁকড়ে ধরলো আরহাম কে।এত আকুপাকু করছে কেন মনটা?

*****
একজন উচ্চপদস্থ গাইনীওকলোজিস্ট ডাক্তারের চেম্বারে পাশাপাশি বসে আছেন দূজন।আরহামের সব মনোযোগ হাফসাতে।এত ভয় কেন পাচ্ছেন?কাঁপা-কাঁপি বন্ধই হচ্ছে না উনার।

‘আপনার এরকম সমস্যা কদিন থেকে হচ্ছে?’

‘পাঁচ-ছয় সপ্তাহ হ হবে।বাট আগে কম ছিলো,এখন বেড়েছে।’

কথাগুলো কম্পনসুরে বলে আরহামের দিকে তাকাতেই আরহাম দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।হাফসা একদিকে ভয় পাচ্ছে রেজাল্ট কি আসবে?আর অন্যদিকে আরহামকে কীভাবে সামলাবে!উনি খুব কষ্ট পাবেন,কারন হাফসা ওর এতদিন যাবত যে সমস্যা বুঝছে তাঁর কোনোকিছুই আরহামের সাথে শেয়ার করে নি।

‘এর আগে কখনো এমন হয়েছে?’

‘জ্ জ্বি না।

‘এত ভয় কেন পাচ্ছেন?’

হাফসা আরহামের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো,আরহামের দৃষ্টি নিচু।নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় বলল, ‘জ্ জ্বি না।কিছু না।ঠিক আছি।’

*****
বাসায় ফিরেছে মিনিট পনেরো হলো।রিপোর্টের জন্য আরো ঘন্টাদেড়েক ওয়েট করার কথা ছিলো।কিন্তু হাফসার কষ্ট হবে বলে আরহাম ওকে নিয়ে বাসায় ফিরেছেন।হাফসা অস্থিরচিত্তে আরহামের ওয়াশরুমের সামনে পায়চারি করছে।উনি শাওয়ার নিচ্ছেন।

কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে হাফসাকে দেখেও না দেখার ভান করে চুল মুছতে লাগলেন।হাফসা ভয়ে ভয়ে কাছে এসে বলল,’আ আ আমি মুছে দিই?’

আরহাম কোনো উত্তরই দিলেন না, যেনো তিনি কিছুই শুনেন নি।

হাফসা আরহামের হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে চুল মুছে দিলো।উনার শুভ্র বুকে কালো ঘন পশমগুলো বারবার দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে।বুকের এই পাজরে জড়িয়েই তো উনি প্রতিদিন যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দেন।কিন্তু হাফসার মন মস্তিষ্ক অন্য চিন্তায় ব্যস্ত।ভেজা টাওয়াল বারান্দায় শুকাতে দিয়ে এসে দেখে আরহাম রুমে নেই।
তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো,

উনি গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে নিচে নামছেন। ড্রয়িং রুমের সোফায় আম্মুকে দেখে আরো চিন্তায় পড়লো হাফসা।যদি আরহাম আম্মুকে কিছু বলেন?

আম্মু আর আরহাম কি কথা বললেন জানা হলো না।কিন্তু কিছুক্ষণ পরই নিচ থেকে কাজল এসে বলে গেলো, ‘খালাম্মায় আমনেরে ডাকছেন।’

বুকের ভেতর ভয়ে টিপটিপ টিপটিপ করছে।একবুক ভয় নিয়ে নিচে নামতে থাকলো হাফসা।হাফসা দেখলো, আরহাম ওর দিকে তাকাচ্ছেনই না।

ভয়ে ভয়ে সামনে যেতেই আম্মু ওনার কাছে বসিয়ে নিলেন হাফসাকে।

‘আসছি আমি’–বলেই আরহাম বেরিয়ে গেলেন।

এবার আম্মু সব মনোযোগ ওর দিকে দিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসেলেন, ‘কেমন আছো?’

মায়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে বিব্রতবোধ করলো হাফসা।বোকা চোখে কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকাতেই আম্মু হেসে বললেন, ‘আরে,বলছি শরীর ভালো আছে? বোকা মেয়ে বুঝো না।’

হাফসা একটা সরল হাসি দিয়ে বলে, ‘ জ জ জ্বী ‘

‘আমি তোমার আম্মু না শ্বাশুড়ি?’

হাফসা অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘দূ দূটোই তো!’

‘উহু,তুমি আমার বউমা নয় মেয়ে,তাহলে আমি তোমার আম্মু তো তাই না?’

‘জ্বী।’

‘তুমার কি প্রবলেম?ডাক্তারে কেনো গিয়েছিলে?’

হাফসা সাহস নিয়ে একে একে মাকে সব খুলে বলে।সব শুনে আম্মুর চোখেমুখে খুশি চকচক করছে, সেটা হাফসা বুঝতে পারছে ভালোমতোই।

আম্মু আরও কয়েকটা প্রশ্ম করে অবশেষে বললেন, ‘তুমি আরহাম কে এসব শেয়ার করো নি?এতদিন থেকে যে এমন প্রবলেম হচ্ছে? ‘

‘জ্বী না,করিনি।’

‘কেন?এটা তো ঠিক করো নি।ও তোমার সবচেয়ে আপনজন।এ বাড়িতে আমার চেয়েও আরহাম তোমার বেশী আপন।ওকে কী তোমার শেয়ার করা উচিত ছিলো না?’

হাফসা অপরাধী কন্ঠে মাথানিচু করে বলল, ‘জ্বী ছিলো।’

‘তাও করো নি।এমনটা আর কখনো করবে না।কোনোকিছু ওর থেকে লুকাবে না,সেটা যতই পারসোনাল হোক।ও কিন্তু খুব রাগ করেছে, কষ্ট পেয়েছে।’

হাফসা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল, ‘উনাকে বলুন আমার সাথে কথা বলে নিতে।আমি আর কখনো কিছু লুকোবো না উনার থেকে।প্রমিস।’

হাফসার এমন উৎকন্ঠায় আম্মু হেসে দিলেন। বললেন, ‘তোমার স্বামী। তুমি কীভাবে রাগ ভাঙ্গাবে তুমিই ভালো জানো।বাট ও বেশীক্ষণ তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবে না দেখো।ও আসলে ক্ষমা চেয়ে নিও।’

*****
ইশার নামাজ পড়ে মাথায় হাত ঢেকে শুয়ে আছে হাফসা। চিন্তা হচ্ছে খুব।উনি আর আসেননি রুমে।একটু পর হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়।হাফসা তৎক্ষনাৎ উঠে বসে,আরহাম লাইট জ্বালিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘুমুচ্ছিলেন?ডিস্ট্রার্ব হলো?’

‘জি না,জেগে ছিলাম।’

উনার হাতে একটা রিপোর্ট।সেটা হাফসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার রিপোর্ট।’

‘ক্ কী করব?’

‘দেখুন।’

‘আ আ আপনি দেখেছেন?’

‘না।’

‘আমি দেখব না।’

আরহাম একটু পর নিজেই খুললেন রিপোর্ট টা।টেবিলে গিয়ে বসছেন উনি।হাফসা চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে উনার দিকে।

আরহাম এক পেজ পেজ করে উল্টাচ্ছেন রিপোর্ট।প্রতি পেজে উনার মুখের অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে। উনি চিন্তিত হচ্ছেন।একেবারে শেষের পেজে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে তড়িৎ গতিতে হাফসার দিকে এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালেন।

হাফসার ভয় বাড়ছে।আরহাম তাকিয়েই আছেন কিছু বলছেনও না।হাফসা গুটি গুটি পায়ে আরহামের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ‘এ এ এমনভাবে তাকাচ্ছেন কেন?আমার ভয় করছে।’

‘রিপোর্টে কি?’

আরহাম কোনো কথা না বলে রিপোর্ট টা ওর দিকে এগিয়ে দিলেন।

হাফসা ভয়ে ভয়ে রিপোর্টে নজর বুলাতেই দেখে একেবারে নিচ অংশে দেখে সবুজ মার্ক করে লিখা, ‘পজিটিভ।’

মানে ও কনসিভ করেছে।হাফসা মুহুর্তেই অসার হয়ে পড়ে।হাতে থাকা পেপার টা খুব কাঁপছে। এরই মধ্যে আরহাম ওয়াশরুম চলে গেলেন কিছু না বলেই।

একটু পর ওয়াশরুম থেকে পুরো চোখোমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসে দেখলেন, হাফসা ওভাবেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরহামকে দেখা মাএ ও বুঝতে পারলো, ওর শরীর আর ঠিক অবস্থায় নেই।অথচ আরহাম ওর দিকে কোমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হঠাৎই কাছে এসে জড়িয়ে ধরলেন।

অতিরিক্ত উত্তেজনায় ওর মন মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আরহাম ওকে জড়িয়ে ধরে আছেন মিনিট পাঁচেক হলো।উনি নীরব,চুপচাপ। নিজেকে স্বাভাবিক করলো হাফসা।তখুনি অনুভব করলো ওর কাঁধে গরম কোনো তরল পদার্থ।হাফসার ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো।আরহাম কি কাঁদছেন!….

৯৬
কিছুক্ষণ যেতেই উনার কান্নার শব্দ হলো।উনি যে হেঁচকি তুলছেন, হাফসা বুঝতে পারছে।হাফসা উৎকন্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলো,’ক্ কি হয়েছে আপনার?প্লিজ বলুন।’

আরহাম কান্না রত সুরে বললেন, ‘উমায়ের,আপনি অনেক ছোট।আমার ভয় লাগছে।আপনার যদি কিছু হয়ে যায়!’

‘ক্ ক কেন এমন মনে হচ্ছে?’

‘জানিনা,আমার এতো ভয় লাগছে কেন?’

শত ঝড়েও শান্ত থাকা মানুষটা আজ ভয় পাচ্ছেন।এটা হাফসার বুকের মধ্যে কঠিন বজ্রপাতের ন্যায়।নিজে যতটুকু স্ট্রং ছিলো,মুহুর্তেই গুড়িয়ে গেলো সে।

আরহাম যত্ন করে ওকে জড়িয়ে আছেন।কাঁধ থেকে মুখ তুলে হাফসার মাথটা বুকের মাঝে ধরে বললেন, ‘এতো তাড়াতাড়ি চাইনি।সত্যি, খুব সুন্দর একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার।অন্যরকম খুশি লাগছে খুব।কিন্তু ভয় কেন হচ্ছে? আপনাকে আমি ভীষণ রকম ভালোবাসি।আপনাকে হারাতে চাই না।’

হাফসা নিঃশব্দে কাঁদছে।এতো সুন্দর অনুভূতির সাথে এতো তিক্ত মনপুড়া অনুভূতি কেন হচ্ছে? অন্তত, শুধু আজকের জন্য কি পুরোপুরি খুশি থাকা যায় না!
কিছুক্ষণ পর, আরহাম দ্রুত চোখ মুখ মুছে নিলেন। ইতোমধ্যে উনি যে ভুল করে ফেলেছেন,সেটা এখন বুঝছেন হাফসাকে দূর্বল করেছেন।ওর ভয় বাড়িয়ে দিয়েছেন।মুখ তুলে কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে আলতো হাতে চোখের পানি মুছে খুশি হয়ে বললেন, ‘কি আবোলতাবোল বলছিলাম এতসময়!উই সোড বি হ্যাপি।আলহামদুলিল্লাহ।আল্লাহ দিয়েছেন, আল্লাহই সব ঠিক রাখবেন।ওকে?’

হাফসা তাও নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না।সময়ের সাথে ওর ভয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।আরহাম ওর হেঁচকির মাএা সামলাতে বললেন, ‘কান্না বন্ধ করুন।প্লিজ।’
হাফসা কান্না থামালোই না।একেবারে না পারতেই আরহাম হাফসার ঠোঁট স্পর্শ করলেন।মুহুর্তেই হাফসার কান্না বন্ধ হয়ে অবাক বনে গেলো সে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।