অগোচরে তুমি | পর্ব – ৩১

নিঃস্তব্ধ রাতে মাউথ অর্গানে সুর তুলে ল্যাম্পপোস্টের আলোর পথ ধরে হেঁটে চলা মানবীর দিকে তাকিয়ে আছে টরেন্টোবাসী।তাঁদের মধ্যে বাঙালীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।চাকরীর সুযোগ সবচেয়ে বেশী এবং সবচেয়ে বেশী বাঙালী এই টরেন্টো অর্থাৎ এই অন্টারিও প্রভিন্সে বসবাস করে।তাদের সবচেয়ে প্রিয় গন্তব্য টরেন্টো।কেউ জানালার পর্দা সড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে তো কেউ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে।ছাদের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই ওর দিকে হাত নাড়িয়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।বিনিময়ে সেও একগাল হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছে।তাদের মধ্যে থাকা একজন উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
– কবে ফিরলে?এতদিনে বুঝি আমাদের কথা মনে পড়লো?
– এসেছি প্রায় মাস হতে চললো।ক’দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম গো,তাই দেখা হয় নি।
গলার স্বর উঁচু করে বললো কিরণ।অন্যপাশ থেকে কেউ একজন হাঁক ছেড়ে জিজ্ঞাস করলো,
– কোথা থেকে আসা হচ্ছে?শো ছিল নাকি?
– না গো।
– তবে?
– রাত্রি বিলাশে বেরিয়েছি।
– রাত্রি বিলাশে বের হয়েছ সাথে একজন সঙ্গী থাকলে কিন্তু মন্দ হতো না।
– আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমার এই মাউথ অর্গানই যতেষ্ট।
জোর গলায় বললো কিরণ।কিরণের কথার প্রত্যুত্তরে উনি কিছু বলতে পারলেন না,শুধু এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া।আসলেই কিরণের কারোর সঙ্গের প্রয়োজন হয় না।ওর সঙ্গী ও নিজেই!ওর সুর,ছন্দই ওকে সঙ্গ দেয়।কিরণ মৃদু হেসে বললো,
– আজ যাই গো অন্যদিন আসবো।ভালো থেকো সবাই।
– ঠিক আছে।সাবধানে যেও।
সমস্বরে বলে উঠলো সবাই।সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজের মতো মাউথ অর্গানে ফের সুর তুললো কিরণ।দেখতে দেখতেই আদো আলো আদো অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ওর অবয়ব।ধীরে ধীরে অর্গানের সুরও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যায়।
_________________________
ঘুমে চোখ টলোমলো।ঢলতে ঢলতে বাসায় ঢুকলো কিরণ।অনেক দিন পর বেশ খানিকটা পথ হেঁটে এসেছে ও।কিন্তু শরীরটা ক্লান্ত হলেও আজ মনটা বেশ শান্ত, প্রফুল্ল,সজীব।চিরচেনা মানুষগুলোকে কতদিন পর দেখলো তার হিসাব কষার দরকার নেই।চোখের দেখা দেখতে পেয়েছে,কথা বলেছে এটাই অনেক।নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে।ডগিরা উচ্চস্বরে ঘেউঘেউ করে উঠতেই চমকে উঠলো কিরণ।পরমুহূর্তেই অসহায় মুখ করে ডগিরার দিকে তাকায়।ও ভেবেছিল ডগিরা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে।তাই ওকে আর বিরক্ত করতে চায় নি।কিন্তু ও বুঝতে না পারলে কি হবে ডগিরা ঠিকই টের পেয়ে গেছে যে, কিরণ বাসায় ফিরেছে।কিরণ হয়তো ভুলেই গিয়েছিল ওদের ঘ্রাণ শক্তি প্রখর থেকে প্রখর তর।পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গন্ধ শুঁকে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মলগ্ন থেকেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত।কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের থেকে আটাশ হাজার গুন বেশি।কিরণ স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় ডগিরার দিকে।ডগিরা দৌঁড়ে এসে কিরণের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো।ডগিরাকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরলো কিরণ।ডগিরা কিরণের গাল চেটে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।কিরণও গভীর মমতায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
বাংলাদেশে যাওয়ার আগে ডগিরাকে কানাডায়-ই রেখে গিয়েছিল।তার কারণ ছিল বাংলাদেশের ওয়েদার।কানাডার ওয়েদারে বেড়ে ওঠা ডগিরা বাংলাদেশের ওয়েদারে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে না বলে স্নেহের ডগিরাকে কানাডায়-ই রেখে যায় কিরণ।ওর অনুপস্থিতিতে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে নি।খাবারের অনিয়ম হয়েছে বিধায় ডগিরার শরীরটা ভেঙে গেছে।আজও হয়তো কিচ্ছু খায় নি।তাই তো পেট’টা ওমন করে পড়ে আছে।হয়তো আজ ওর খাবারটা কিরণ খাইয়ে দেই নি বলেই অভিমান করে বসে আছে।কারণ প্রত্যেকবার কিরণই ওকে খাইয়ে দেয়।
কিরণ ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ডগিরার দিকে।ডগিরা ক্ষীণ স্বরে অভিমানী আর্তনাদ করে।কিরণ ডগিরার দু’গাল ধরে কপালে একটা চুমো দেয়।ডগিরা খুশিতে গদোগদো হয়ে লেজ নাড়িয়ে আরেক দফায় কিরণের গাল চেটে দেয়।ডগিরার আহ্লাদী পনা দেখে ফিক করে হেসে দেয় কিরণ।ডগিরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বললো,
– চুপটি করে এখানে বসে থাকবি। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
ডগিরা কিরণের কথা শুনে জিভ বের করে ঘনঘন লেজ নাড়াচ্ছে।ভাবে বোঝাচ্ছে ও এতক্ষণ এইটারই অপেক্ষায় ছিল।কবে কিরণ আসবে আর ওকে খাইয়ে দেবে।কিরণ ডগিরার ভাব দেখে ঠোঁট টিপে হেসে ঘরের ভেতরে চলে আসে।
ডগিরার জন্য সদ্য কিনে আনা শুকনো খাবারগুলো থেকে কিরণ একটা প্যাকেট বের করেছে মাত্র ওমনি ডগিরা এসে কিরণের জামা কামড়ে ধরে টানতে শুরু করে।আচমকায় এমন হওয়ায় কিরণের হাত ফস্কে প্যাকেটটা নিচে পড়ে যায়।কিরণ চকিত দৃষ্টিতে ডগিরার দিকে তাকায়।ও কিছু বুঝে উঠার আগেই ডগিরা ওর জামা কামড়ে ধরে ব্যালকনির দিকে নিয়ে যেতে থাকে।কিরণ ভ্রুকুটি করে ডগিরার দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ করে ওর আবার কি হলো?তখন তো খাবারের কথা শুনে দিব্যি তো লাফাচ্ছিল।এখন খাবারটাই নিতে দিলো না।
– আরে ডগিরা তুই করছিস কি।আস্তে যা,পড়ে যাবো তো।
কিরণ উৎকন্ঠিত স্বরে বললো।ডগিরা নিজের মতো কিরণকে টেনে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে ছাড়ে।কিরণ হাটু মুড়ে ডগিরার সামনে বসে ওর দু’গালে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে বললো,
– কি হয়েছে আমার ডগিরার?আমার উপর বড্ড রাগ হয়েছে বুঝি?
কিরণের কথা শুনে ঘেউঘেউ করে উঠলো ডগিরা।কিরণ কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে ডগিরার দিকে।ডগিরাকে কেমন যেন উত্তেজিত দেখাচ্ছে।ও সচরাচর এমন করে না।যখন খুব বেশি অভিমান বা খুশি হয় তখনই এমন করে।কিরণ ডগিরাকে পরখ করে দেখে নিয়ে নরম গলায় বললো,
– কিছু বলতে চাস তুই?
ডগিরা আবার ঘনঘন লেজ নাড়াচ্ছে।কিরণ মুচকি হাসলো।ডগিরা লাফ দিয়ে কিরণের কোলে উঠে বসে।কিরণ ডগিরাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– বল কি বলবি?
ডগিরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো। কিরণ ভ্রু কুঁচকে ডগিরার দিকে তাকায়।ডগিরা কিরণের দিকে তাকিয়ে দিকে কিরণ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ডগিরা ক্ষীণ স্বরে ঘেউঘেউ করতেই কিরণের কপাল আরো সংকুচিত হয়ে যায়।ডগিরা ফের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করে উঠলো।এইবার কিরণের সংকুচিত কপাল প্রসারিত হয়ে যায়।এতক্ষণে ও বুঝতে পারে ডগিরা ওকে কিছু দেখার জন্য বার বার রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করছে।কিরণ চটজলদি রাস্তার দিকে তাকায়।রাস্তায় দিকে তাকাতেই ঠোঁটের আগায় হাসি ফুটে উঠে কিরণের।পরমুহূর্তেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ডগিরার দিকে।ডগিরা জিভ বের করে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে।যার ফলস্বরূপ ওর সারা শরীর কম্পিত হচ্ছে।কিরণ অবাক হয়ে বললো,
– ডগিরা সিরিয়াসলি!তোকে মাত্র একবার তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি,তাও আবার ছবিতে।আর তুই এই একদিনেই তাদেরকে চিনে ফেললি?
ডগিরা মাথা নিচু করে গুঙিয়ে উঠলো।সঙ্গে সঙ্গে ডগিরাকে জড়িয়ে ধরে কিরণ।অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দেয় ডগিরাকে।ডগিরাও পরম আদরে মাথা ঠেকায় কিরণের বুকে।হঠাৎ করেই স্মরণে এলো এমন করে চমকে উঠলো কিরণ।ওর যে এক্ষুনি নিচে যাওয়া প্রয়োজন সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে,আনন্দে আত্মহারা হয়ে।কিরণ চট করে ডগিরাকে কোলে তোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত পা চালিয়ে ব্যালকনি প্রস্থান করে।
_______________________
রাস্তার দুপাশে থাকা সারি সারি দালানগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলেও কিরণদের বাড়িটা উজ্জীবিত, আলোকিত হয়ে আছে।বাসায় থাকা পাঁচ জন কাজের লোকই পুরো দমে কাজ করছে।দুজন কিচেনে আর বাকি তিনজন গেস্টরুম গুলো সাজিয়ে দিচ্ছে।যদিও কিরণ সবকিছু গুছিয়েই রাখে সবসময়।এই বাড়ির প্রত্যেকটা কোণা নিজের হাতে ডেকোরেশন করেছে কিরণ।কিন্তু প্রথমবারের মতো ওর প্রিয় মানুষগুলো ওর কাছে আসছে তাঁদের জন্য স্পেশাল ভাবে নতুন করে কিছু করতেই হয়।বিছানার চাদর, কুশন, জানালার পর্দা,ওয়ালপেপার, ওয়াল মেট, একুরিয়াম, ফুলের টব,এমনকি পাপোশ গুলোও পরিবর্তন করা হয়েছে।
কলিং বেলের শব্দটা কর্ণগোচর হতেই ডগিরা লাফ দিয়ে কিরণের কোল থেকে নেমে যায়।ও এতক্ষণ অবধি কিরণের কোলেই ছিল।ডগিরা দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খোলার জন্য লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে।এই কাজটা ওর সাধ্যের বাইরে জেনেও বেচারা বৃথা চেষ্টা করছে।ডগিরা দরজার লক খুলতে পারে!কিন্তু ওর একটু সাহায্য লাগে শুধু।কিরণ অনেকক্ষণ যাবৎ ডগিরাকে লক্ষ্য করছে।গেস্টদের আগমনে ও খুব খুশি হয়েছে।অথচ ওর এত খুশি বা উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণটা কিরণের কাছে স্পষ্ট নয়।তবে হ্যাঁ, যেটাতে কিরণ খুশি সেটাতে ডগিরাও খুশি।কিরণ সেটা জানে।আর হয়তো সেই কারণেই ও ওমন করছে।
দরজা খোলার জন্য ডগিরার এত কৌতূহল দেখে ফিক করে হেসে উঠলো কিরণ।দরজার লকটা নাগাল পাচ্ছে না তাও হাল ছাড়ছে না,লাফিয়েই যাচ্ছে।কিরণ একটা চেয়ার নিয়ে দরজার কাছে রাখলো।ডগিরা এক লাফ চেয়ার উঠে বসলো।এক পলক তাকালো কিরণের দিকে।কিরণ মুখের হাসি প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে বুঝালো ওকে পারমিশন দেওয়া হয়েছে।ও এবার দরজাটা খুলতে পারে।
দরজার বাহিরে উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকা কয়েক জোড়া চোখ ডগিরাকে দরজা খুলতে দেখেই হতবাক।ভেবেছিল হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে।দরজা খোলার পর সামনে ডগিরাকে দেখে সবাই আশাহত হয়ে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।পরমুহূর্তেই কিরণ উচ্চস্বরে হেসে উঠতেই চমকে উঠলো প্রত্যেকটি অস্তিত্ব।অস্থির দৃষ্টিতে তাঁকে খুঁজতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
– ডগিরা গেস্টদের ঢুকতে দাও।
আদুরে গলায় বলল কিরণ।সবাই চকচক চোখে তাকালো কিরণের দিকে।সবার ঠোঁটে কোণে মিষ্টি হাসি,চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ।ডগিরা কিরণের দিকে এক পলক তাকিয়ে ফের সম্মুখে তাকিয়ে শরীর ঝেড়ে উঠতেই সামনে থাকা ক’জন একটু নড়েচড়ে উঠলো।ডগিরা ধীর গতিতে দুবার মাথা নুইয়ে চেয়ার থেকে নেমে এক দৌঁড়ে আবার চলে যায় তাঁর মালিকের কোলে।ডগিরা চলে যেতেই ভৃত্যদের একজন এসে দরজার সামন থেকে চেয়ারটা সড়িয়ে নেয়।বাকিরা এসে গেস্টদের লাগেজগুলো নিয়ে যায়।কিরণ ডগিরাকে ওর জন্য বরাদ্দ আসনে রেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলো।স্মিত হেসে শীতল কণ্ঠে বলল,
– এতদিনে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো তবে!

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।