– তোমার বিয়ে হয়েছে?
আমেনা বেগম মুখভর্তি পান চিবাতে চিবাতে প্রশ্ন ছুড়লেন তাঁর পাশেই বসে থাকা মেহেনূরের দিকে।রাওনাফ আর রোশনির বিয়ে উপলক্ষে অর্কদের গার্ডেনটাকে খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।এই গার্ডেনেই হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠানটা করা হবে। এখন রাওনাফ আর রোশনির ফটোশুট চলছে।স্টেজের সামনে পেতে রাখা আসনগুলোয় সবাই বসে আছে।মেহেনূর মিনিট দশেক আগেই এখানে এসে বসেছে।হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে একটু দেরি হবে।কারণ এখনো বাসার সবাই নিচে এসে উপস্থিত হয় নি।তাই বর কনের ফটোশুটটাই আগে করে ফেলা হচ্ছে।মেহেনূর মনোযোগ দিয়ে ওদের ফটোশুট দেখছিল।
আমেনা বেগম আর মেহেনূরের মাঝে একটা খালি চেয়ার পড়ে আছে।এই পরিত্যক্ত চেয়ারটায় অর্ক ওর বিবিজানকে নিয়ে বসে ছিল।আয়েশা বেগম এসে অর্ককে একটু বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছেন।মেহেনূর আসার পর থেকেই আমেনা বেগম মেহেনূরের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন।মেয়েটা বেশ স্নিগ্ধ আর মায়াবী।সতেজ সুন্দর তাঁর হাসি।গায়ের রং দুধে আলতায় মোড়ানো না হলেও বেশ উজ্জ্বলতায় প্রস্ফুটিত।দেখেই বুঝা যাচ্ছে ও খুব চুপচাপ আর ঠান্ডা মেজাজের।পরিচিতদের সাথে কি সুন্দর নম্রমুখে কথা বলছে।চোখে মুখে লাগাতার অমায়িক হাসি।চোখ দুটো তো মাশাল্লাহ,মায়ায় ভরা।মেয়ে হতে গেলে তো এমনই হওয়া চাই।আমেনা বেগম ঠিক করে নিয়েছেন।উনার নাতিবউ হিসেবে এই মেয়েই পারফ্যাক্ট।নাতির ভুলগুলোকে নরম গলায় শক্ত কথায় ধরিয়ে দেবে।কখনো অন্যায় আবদার করলে ওর মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখবে তাঁর নাতিকে।স্বামীর ভালোর জন্য না হয় একটু কঠোরই হবে!তবে,স্বামীর অভিমান ভাঙানোর জন্য এই মেয়ের মায়াবী চাহনিতে মিষ্টি হাসিই যতেষ্ট।
মেয়ের মায়ায় পড়ে আকাঙ্ক্ষা বেশি বেড়ে যাওয়ার আছে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া প্রয়োজন।তাই আমেনা বেগম অত্যাবশকীয় প্রশ্নটায় আগে করলেন।
আমেনা বেগমের কথাটা কর্ণকুহরে যেতেই বিস্ফোরিত চোখে মেহেনূর ওর পাশে ফিরে তাকায়।পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা সপ্তশতী এক রমনী ওর দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।যৌবনে হয়তো তাঁর দুধে আলতা গায়ের রং ছিল!তাঁর রূপের আগুনে হয়তো ঝলসে গেছে হাজারো তরুণের হৃদয়।বয়সের ভারে গায়ের রং একটু কমে গেলেও এখনো শরীরের চামড়া তেমন একটা কুঁচকায় নি।মাথার চুলের এক তৃতীয়াংশে পাক ধরেছে মাত্র।চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল।হয়তো পুরুষকুল এই চোখের চাহনিতে ঘায়েল হয়েছে বারংবার।বাঁশ পাতার ন্যায় খাঁড়া নাক তাঁর।আর পান চিবানোর ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে বত্রিশটা দাঁত এখনো ঠিকঠাকই আছে।তাহলে উনাকে রমনী বললে ভুলটা কোথায় শুনি?
হ্যাঁ,রমনী ঠিক আছে।তাই বলে কি উনাকে রমনী বলে
সম্মোধন করা যাবে?কিন্তু,মেহেনূর তো আমেনা বেগমকে চেনেও না।উনাকে ঠিক কি বলে সম্মোধন করবে বুঝতে পারছে না?তাই মেহেনূর একটু দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়।কিন্তু মানুষটা তখন থেকে ওর উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে।আগে অন্তত উত্তরটা দিক।মেহেনূর আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে নরম গলায় বললো,
– না!
মেহেনূরের উত্তর শুনে চোখ চকচক করে উঠলো আমেনা বেগমের।বিড়বিড় করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।তবে শব্দটা শুধু উনার মুখেই সীমাবদ্ধ রইলো।মেহেনূরের কর্ণধারে এসে ভিড়লো না।পরমুহূর্তেই আমেনা বেগম উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
মেহেনূর অবাক হয়ে কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে তাকালো আমেনা বেগমের দিকে।মেহেনূরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমেনা বেগম ভ্রু নাচিয়ে ফের জিজ্ঞাস করলেন।মেহেনূর উনার এমন প্রশ্নে অবাক হয়েছে ঠিকই আবার মনে মনে ভাবছে একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই প্রশ্নটাকে একটা কমন প্রশ্ন হিসাবে ধরা যেতেই পারে!তাই মেহেনূর স্মিত হেসে স্বাভাবিকভাবে বললো,
– না।
মেহেনূরের এই উত্তরে আমেনা বেগম বেশ অবাক হয়েছেন।এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই?এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!আমেনা বেগম মেহেনূরের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভারী কন্ঠে বললো,
– তুমি কাউকে পছন্দ করো?
আমেনা বেগমের কথাটা মেহেনূরের বোধগম্য হতেই ওর কান গরম হয়ে যায়।হঠাৎ করেই গলায় কেমন যেন ঝাল ঝাল অনুভব করলো।সাথে সাথে ওর হেঁচকি উঠে যায়।সামনে কেউ একজন একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল ধরতেই মেহেনূর চটজলদি বোতলটা হাতে নিয়ে নেয়।রুদ্ধশ্বাসে ঢকঢক করে হাফ লিটারের অর্ধেক পানি শেষ করে।একটু দম ছেড়ে ফের বাকিটা পানিটা শেষ করে ফেলে মেহেনূর।
– ঠিক আছো তুমি?
উৎকন্ঠিত স্বরে বলা কথাটা কানে যেতেই মেহেনূর একপলক তাকালো সামনে থাকা মানুষটার দিকে।উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে অর্ক।হাতের পিঠে মুখ আর গলা মুছে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহেনূর।মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ও ঠিক আছে।বুকে হাত দিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে অর্ক।অর্ক ফের উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– তুমি একেবারে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে।তা হঠাৎ করে এমন হেঁচকি উঠার কারণ কি?
হেঁচকি উঠার কারণ জানতে চাওয়ায় মেহেনূরের আমেনা বেগমের কথা মনে পড়ে। তড়িৎ গতিতে আমেনা বেগমের দিকে তাকায় ও।উনিও ঠিক একই প্রশ্নের উত্তরের আশায় ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। মেহেনূর তা বেশ বুঝতে পারছে।
আমেনা বেগম হতভম্ব হয়ে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছেন।কি এমন হলো যে, মেয়ের এক্কেবারে হেঁচকি উঠে গেছে? আর এতক্ষণ ধরে এইখানে কি ঘটছে সেটাও বুঝার চেষ্টায় আছেন।তবে অর্ককে দেখে একটু হলেও বুঝতে পারছেন যে, ওরা পূর্ব পরিচিত।
মেহেনূর ইতস্ততবিক্ষিপ্ত হয়ে ফের তাকায় অর্কের দিকে।অর্ককে কি আর বলা যায় , এই সপ্তদশী রমনী এমন এমন প্রশ্ন করছেন যে তা শুনে ওর হেঁচকি উঠে গেছে! আবার ওই রমনীকেও তো বলা যায় না যে,উনার প্রশ্নবিদ্ধে ওর এই হাল হয়েছে।তবে হেঁচকি উনার একটা যথাযথ যুক্তি তো উনাদের দেখাতে হবে। মেহেনূর কাচুমাচু মুখ করে বললো,
– আসলে আমার পানি তেষ্টা পেয়েছি…….
– মেহেনূর!
মেহেনূর ওর কথা শেষ করার আগেই আয়েশা বেগম এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।আসলে উনি মেহেনূরকে দেখতে পেয়ে উৎফুল্লতা সাথে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন।কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারেন নি।মেহেনূরকে বড্ড বেশিই পছন্দ করেন কিনা!
আয়েশা বেগমের এহেন কান্ডে মেহেনূর একটু চমকে উঠে।মেহেনূর কপালে ভাঁজ ফেলে আয়েশা বেগমের দিকে তাকাতেই উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।মেহেনূরকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ান।তারপর মেহেনূরের গালে হাত রেখে বেশ উৎকন্ঠার সাথে বললো,
– কখন এসেছো?
ও আসাতে আয়েশা বেগম যে অনেক খুশি হয়েছে সেটা মেহেনূরও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।তাইতো এমন হন্নে হয়ে দৌঁড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।নিজের মায়ের মতোই উনি ওকে আদর স্নেহ করেন।মেহেনূর মৃদু হেসে নরম স্বরে বললো,
– এই তো আন্টি দশ পনেরো মিনিট হলো।
আমেনা বেগমের সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।এখানে হচ্ছেটা কি?কে এই মেয়ে?ছেলে এসে পানি দিচ্ছে।মা এসে জড়িয়ে ধরে আদর করছে।অথচ উনি এই মেয়ের ছায়াও দেখে নি কোনোদিন।উনি যে এখানে আছেন সেটা যেন এই মা ছেলে ভুলেই গেছে।একটা বারের জন্য কেউ তাকাচ্ছেও না।ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমেনা বেগম বেশ জোরেশোরেই একটা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন। চমকে উঠে অর্ক আর আয়েশা বেগম।অর্ক চকিত দৃষ্টিতে তাকায় আমেনা বেগমের দিকে।দুজনের চোখাচোখি হতেই আমেনা বেগম চোখ পাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে মেহেনূরকে দেখিয়ে জিজ্ঞাস করলো,কে?অর্ক ওর নানুর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝতে পারে উনি মেহেনূরের কথা বলছেন।অর্ক আমেনা বেগমের কাছে গিয়ে স্মিত হেসে ফিসফিস করে বললো,
– ওর নাম মেহেনূর।মেহরাব আঙ্কেলের মেয়ে।রাওনাফের ছোট বোন,বিদেশে থাকে।
অর্কের কথা শুনে আমেনা বেগম অবাক স্বরে বললো,
– মেহরাবের মেয়ে?ভারী মিষ্টি মেয়ে তো ও।আমার কিন্তু বেশ মনে ধরেছে ওকে।
অর্ক সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,
– মানে?
– কিছু না।ওকে এইদিকে আসতে বল তো।
কড়াগলায় বললেন আমেনা বেগমের।উনার কথা মতো অর্ক মেহেনূরকে ডাক দিলো।অর্কের ডাকে মেহেনূর আর আয়েশা বেগম দুজনেই পিছনে ফিরে।আয়েশা বেগম স্মিত হেসে মেহেনূরকে নিয়ে আসে আমেনা বেগমের কাছে।মেহেনূর অর্কের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই অর্ক আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো,
– ইনি হচ্ছে আমার বিবিজান।
অর্ক একটু থেমে মেহেনূরকে দেখিয়ে আবার বললো,
– আর বিবিজান ও হচ্ছে মেহেনূর।
বিবিজান?ভ্রু কুঁচকে আসে মেহেনূরের।অর্কের কথা বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আমেনা বেগমের দিকে।উনি রমনী ঠিক আছে,তাই বলে এই বয়সে এসে উনাকে বিয়ে করতে হলো?অর্ক যেভাবে আমেনা বেগমকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে,দেখে মনে হচ্ছে অর্ক নিজেও খুব হ্যাপি!উনাকে কি বলে সম্মোধন করবে সেটা ভেবে মেহেনূর ফের আরেকবার দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।অর্ক যেহেতু ভাইয়া হয় সেহেতু উনাকে ভাবী নয়তো আপু ডাকার কথা। কিন্তু বসয় বিবেচনায় তো..!যাকগে, অর্ক যদি উনাকে বিয়ে করতে পারে তাহলে মেহেনূরের ভাবী ডাকতে সমস্যা কি?মেহেনূর একটু স্বাভাবিক হয়ে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো,
– কেমন আছেন ভাবী?
মেহেনূরের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় অর্ক।আয়েশা বেগম আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাঁসছেন।আমেনা বেগমও কেমন যেনো লজ্জামিশ্রিত মুখে মিটমিটিয়ে হাঁসছেন।সবার এইরূপ ব্যবহারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মেহেনূর।সেই সাথে ভীষণরকম অস্বস্তিও হচ্ছে।অর্ক আগের তুলনায় হাসির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।মেহেনূরের এবার কিঞ্চিৎ রাগ হচ্ছে অর্কের উপর।আজব,এইভাবে হাসার কি হলো?ও বিয়ে করতে পারলে মেহেনূর ভাবী ডাকলে প্রবলেম কোথায়?আয়েশা বেগম চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখেন সবাই অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।কারণ ও খুব শব্দ করেই হাসছে।আয়েশা বেগম অর্কের দিকে চোখ রাঙিয়ে ভারী কন্ঠে বললো,
– অর্ক চুপ কর,সবাই দেখছে।
আয়েশা বেগম মেহেনূরের অবুঝ চাহনি দেখে স্মিত হেসে ফের বললেন,
– উনি আমার মা,অর্কের নানু।অর্ক মাকে বিবিজান বলে ডাকে।
আয়েশা বেগমের কথা শুনে মেহেনূর বেশখানিকটা লজ্জায় পড়ে যায়।তবে এখানে কি আদৌ ওর কোনো দোষ আছে?অর্ক এমন ভাবে বিবিজান বলে ডাকলো যে, দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি উনি ওর বিবি হোন। যাইহোক, তবু নিজের বোকামির জন্য লজ্জিত ও।মেহেনূর লজ্জামিশ্রিত মুখে রিনরিনে স্বরে বললো,
– সরি নানু।আমি বুঝতে পারি নি।আসলে অর্ক ভাইয়া এমনভাবে বললো।
আমেনা বেগম মুচকি হেসে মেহেনূরের গাল টিপে আহ্লাদী গলায় বললো,
– বুঝতে পেরেছি!
বিনিময়ে মেহেনূরও হাসলো।তারপর মেহেনূরকে নিজের পাশে বসিয়ে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিয়েছেন আমেনা বেগম।মেহেনূরের প্রথম প্রথম একটু সংকোচবোধ হলেও এখন সাবলীলভাবেই কথা বলছে আমেনা বেগমের সাথে।
মেহেনূর আর আমেনা বেগমের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আয়েশা বেগম। মেহেনূরকে এখানে পেয়ে সত্যিই উনার খুব ভালো লাগছে।তিনি আসলেই খুব চিন্তিত ছিলেন মেহেনূরকে নিয়ে।তবে মেহেনূরের এখানে আসার পিছনের হাতটা যে অর্কেরই সেটাও আন্দাজ করতে পারছেন।ছেলের কথা ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে।আর মুখে ফুটে উঠে তৃপ্তির হাসি।অর্কের রাগ উঠে তবে কারণ ছাড়া নয়।আয়েশা বেগম মনে করেন ছেলেদের রাগ না থাকলে শোভা পায় না।রাগী ছেলেদের মন নরম হয় মোমের মতো।অর্ককে দেখে তা বুঝেছেন।তবে সব সময় রাগ করাটাও আবার ভালো লক্ষ্মণ না।ছেলেটা এমনিতে খুবই শান্তশিষ্ট আর ম্যাচিউর হলেও মাঝে মাঝে রাগে ওর বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে।ফলে নিজেই অনেক সময় খুব কষ্ট পায়।অর্ককে কিছু বলার জন্য পাশে তাকিয়ে দেখেন অর্ক এখানে নেই, চলে গেছে।এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে দেখলেন স্টেজ থেকে একটু দূরে ফোনে কারো সাথে আলাপ করছে।আয়েশা বেগম এগিয়ে যান ছেলের দিকে।অর্ক কথা বলা শেষ করে পিছনে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– কিছু বলবে?
আয়েশা বেগম ছেলের হাত ধরে আরেকটু সাইডে নিয়ে যান।তারপর মেহেনূরকে দেখিয়ে কৌতূহলী কন্ঠে বললেন,
– মেহেনূরকে কিভাবে রাজি করালি?
মায়ের কথা শুনে সকালের কথা মনে করে স্মিত হাসে অর্ক।
সকালে___________
মেহেনূরের মুখের হাসি মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অর্কের মনে লালন করা আশার নিভু নিভু প্রদীপটাও নিভে যায় পুরোপুরিভাবে।মেহেনূর হাসি বন্ধ করে মুখ গম্ভীর করে রেখেছে।অর্কে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধুকপুক ধুকপুক করছে।দুশ্চিন্তায় মনে হচ্ছে মাথার নিউরনগুলো জ্যামে আটকে পড়ে ওদের কার্যক্রিয়া লোপ পেয়েছে।এখন যদি মেহেনূর না করে দেয়! তাহলে?
মেহেনূর অর্কের মুখ দেখে আবারও ফিক করে হেসে উঠলো।মেহেনূরের হাসির সাথে অর্কের বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো,সাথে চিনচিনে ব্যাথাও।তবে কি ও তাচ্ছিল্যে হেসে উঠেছে?নাকি অর্ককে পরিহাস করছে?অর্কের খুব লজ্জা লাগছে।হয়তো এটা ভেবে যে,ওর এটাই প্রাপ্য!মনে মনে তাচ্ছিল্যে হাসে অর্কও।তবুও অর্ক কতক্ষণ মেহেনূরের দিকে উৎসুকভাবে তাকিয়ে ছিল,ও শুধু একবার বলুক আমি আসবো!কিন্তু মেহেনূর কোনো কথাই বললো না।
মেহেনূর ওর হাসি থামিয়ে গিয়ে উঠে বসলো ছাদের কার্নিশে।পাশে রাখা বইটা হাতে নিয়ে আঁড়চোখে একবার তাকায় অর্কের দিকে।অর্ক তখনও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।মেহেনূর বইয়ের মধ্যে দৃষ্টি স্থির রেখে ভারী গলায় বললো,
– এখন বাসায় যান।
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় অর্ক।মেহেনূর বই থেকে দৃষ্টি না সড়িয়েই থমথমে মুখে বললো,
– বাসায় অনেক মেহমান।বাসার সব রুমে কেউ না কেউ আছেই।আমার পড়তে অসুবিধে হচ্ছিলো।তাই ছাদে এসেছিলাম একটু পড়বো বলে।তারউপর আপনি এসে অনেকটা সময় নষ্ট করে দিয়েছেন।আমি এখন কি ক্লাস করবো?যান, বাসায় যান আপনি!
মেহেনূরের কথা শুনে অপমানিত বোধ করে অর্ক,সাথে নিজেকে খুব হ্যাংলাও মনে হচ্ছে।তাও একবার তাকিয়েছিল মেহেনূরের দিকে।যদি একটা বার বলে,আমি আসবো!কিন্তু মেহেনূর ভ্রুক্ষেপহীন। ও ওর মতোই পড়া নিয়ে ব্যস্ত।অর্ক একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে চলে আসে ছাদ থেকে।তবে চলে আসার পথে মেহেনূরকে গলার স্বর উঁচু করে বলতে শুনেছিল,
– আমি ঠিক সময় চলে আসবো!
বর্তমান_______
কিন্তু এইসব কথা তো আর মায়ের কাছে বলা যাবে না।অর্ক আয়েশা বেগমের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে হেঁসে বললো,
– আরে আমি কেন ওকে রাজি করাতে যাবো!ওর ভাই ভাবীর বিয়ে,ও নিজে থেকেই এসেছে!
– তুই…….
– হ্যাঁ আসছি!মা অয়ন আর দিহাদ ডাকছে,আসছি আমি।
আয়েশা বেগমকে কিছু বলতে না দিয়ে অর্ক বাহানা ধরে চলে গেলো।আয়েশা বেগম ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন আশ্চর্য হয়ে।কিন্তু তাও উনি বেশ বুঝতে পারছেন, কে কি করেছে?তবে ছেলে সেটা স্বীকার করছে না এই আরকি।যাইহোক,স্বীকার করুক বা না করুক উনার ছেলে,ছেলের মতো কাজ করে দেখিয়েছে এটাই অনেক।
চলবে…