অগোচরে তুমি | পর্ব – ১১

– তোদের দুজনেরই হঠাৎ করে এমন ঠান্ডা লেগে গেলো কি করে?বিকালে বাসা থেকে তো দিব্যি ভালো বের হয়েছিলি।
আয়েশা বেগম রোশনি আর রাওনাফকে ডিনারের জন্য উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছে।সবাই ডিনার করতে একসাথে বসেছে মাত্র।অর্ক আর রাওনাফকে একনাগাড়ে হাঁচি আর নাক টানতে দেখে আকাশ সাহেব অর্ক আর রাওনাফ দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে কথাটা জিজ্ঞাস করলেন। দুজনেই চোর ধরা পড়ার মতো চোখ লুক্কাচ্ছে।অর্ক ওর বাবাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।কিছু একটা তো বলতে হবে।অর্ক মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– আসলে বাবা আমার মনে হচ্ছে গোসল করার সময় মাথায় পানিটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছিল।
আকাশ সাহেব আড়চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– আর তোমার?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাওনাফ।এখন কি হবে?ও কি উত্তর দিবে?আমতা-আমতা করে গলা টেনে বললো,
– আমারো!
বিষম খেয়ে যায় অর্ক।আকাশ সাহেব অবাক হয়ে বললো,
– দুজনেরই একসাথে?
রাওনাফ নিরুত্তর।অর্ক রেগে রাওনাফের পেটে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বললো,
– বলার জন্য আর কোনো কারণ পেলি না শালা!এখন ঢেলা সামলা।
– আমি তোর শালা হলাম কবে?
– চুপ থাক,শালা!
আকাশ সাহেব বুঝতে পারছেন দুজনে মিলে কিছু একটা খিচুড়ি পাকিয়েছে।কিন্তু স্বীকার করতে চায় না।উনি শীতল কণ্ঠে বললো,
– বুঝতে পেরেছি!
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অর্ক আর রাওনাফ।আকাশ সাহেব যে যুক্তি সংগত উত্তর না পেয়েও ওদের আর বেশি ঘাটে নি এটাই ওদের কাছে অনেক।
– মেহেনূর কোথায়?
আকাশ সাহেবের জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি অনুসরণ করে টেবিলে উপস্থিত অর্ক, রাওনাফ, রোশনিও তাকায় আয়েশা বেগমের দিকে।আয়েশা বেগম মলিন মুখে বললো,
– কত করে বললাম আসার জন্য। কিন্তু ও রাজি হলো না।বললো,ওর নাকি অনলাইন ক্লাস আছে দশটায়।
– ওহ!
আকাশ সাহেব আর কোনো প্রশ্ন না করে সবাইকে খেতে বললেন।সবাই খেতে শুরু করে।কিন্তু অর্কের কেমন জানি একটু খটকা লাগলো। রাতের দশটায় অনলাইন ক্লাস?খটকা লাগলেও এতটা মাথা না ঘামিয়ে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে।অর্ক রোশনিকে মেহেনূরদের বাসা অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসে।রাওনাফকে ও যেতে দেয় নি।রাওনাফ আজকে অর্কের সাথেই ঘুমাবে।অর্ক রোশনিকে দিয়ে এসে রাওনাফ আর ও শুয়ে পড়ে।দুজনেই অসুস্থ তাই ঘুমটা খুব তাড়াতাড়িই এসে ভর করেছে ওদের চোখে।
সকালে অর্ক আর রাওনাফের ঘুম ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।দরজার বাহিরে হট্টগোলের শব্দে ওদের ঘুম ভেঙে গেছে।অর্ক কপাল কুচকে দরজার দিকে তাকায়।কন্ঠগুলো ওর পরিচিত।রাওনাফ হয়তো চিনতে পারছে না।কিন্তু অর্কের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।গলা শুকিয়ে আসছে।এখন যদি দরজাটা গিয়ে না খুলে তাহলে এবার হয়তো দরজা ভেঙে ওদের মুখে এসে পড়বে।এক লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে অর্ক।শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।তারপর মুখে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
– তোরা?
অর্ককে পাত্তা না দিয়ে ওকে ঠেলে হুড়মুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকলো দিহাদ,কলি,অয়ন আর তনিমা।যে যেমন পারছে ধুমধাম কিল ঘুষি মারছে অর্কের পিঠে।অর্ককে মারছে দেখে রাওনাফ তেতে গিয়ে ওদের বাধা দিতে দিতে বললো,
– কি হলো? তোমরা ওকে মারছো কেন?
যেইনা রাওনাফ মুখ খুললো ওমনি সবাই হামলে পড়লো ওর উপর।রাওনাফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।ছেলেগুলো না হয় মারছেই কিন্তু এই মেয়ে দুটোও বাদ গেল না?অর্ক হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।রাওনাফ অবাকের সপ্তম আসমান বেধ করলো।ও এইবরকম বেদম মার খাচ্ছে আর অর্ক দাঁত বের করে হাসছে?রাওনাফ চোয়াল শক্ত করে এক ঝটকায় সবাইকে দূরে সড়িয়ে দিয়ে চিল্লিয়ে বললো,
– স্টপ ইট!কি শুরু করেছো তোমরা?আমাকে এইভাবে মারছো কেন?
দিহাদ এগিয়ে গিয়ে বললো,
– এই তুই আবার কথা বলছিস?এই ধর ওকে!
আবার সবাই রাওনাফের উপর হামলা করে।রাওনাফ ওদের এমন রিয়েক্ট করার কারণ বুঝতে পারছে না।তারউপর অর্ক ওইভাবে হাসছে।চরম বিরক্তিও লাগছে আবার রাগও হচ্ছে।রাওনাফ দাঁত কড়মড় করে অর্কের দিকে তাকায়।অর্ক রাওনাফের মুখ দেখে হাসি চেপে বললো,
– বেচারার সামনে বিয়ে!মেরে মেরে ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিবি নাকি?
অর্কের কথায় সবাই থেমে গিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।অয়ন হাতে তালি বাজিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– বাহ বাহ!এই মধ্যে বিয়েও ঠিক করে ফেললি?
রাওনাফ করুণ চোখে অর্কের দিকে তাকায়।এদের কথাবার্তা আর কর্মকাণ্ডে ও শুধু অবাকই হচ্ছে।কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছে না।অর্ক রাওনাফকে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– সত্যিই কি তুই ওদের চিনতে পারিস নি?
– না!
একরোখা উত্তর রাওনাফের।অর্ক জোর গলায় বললো,
– একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখ তো চিনতে পারিস কিনা।
রাওনাফ একটু খেয়াল করে দেখলো একজনের হাতে ছয়টা আঙুল,তার মানে এটা অয়ন!আরেকজনের কানের লতিতে কালো জন্ম দাগ টা অনেক দূর থেকেই ঝলঝল করছে,তার মানে এটা দিহাদ!তনিমার গাঢ় বাদামি চোখ!ছোট বেলায় তনিমাকে ক্যাট বলে ডাকতো অর্ক আর ও।অন্যজনের চোখে সেই আগের মোটা ফ্রেমে ভারী গ্লাসের চশমা,মানে ওটা কলি!বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে রাওনাফের মুখে।এক লাফে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দিহাদ আর অয়নকে জড়িয়ে ধরলো।ওরাও তাই করলো।একটু দূরে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনিমা আর কলি।রাওনাফ স্মিত হেসে ওদের কাছে গিয়ে আলতো করে ওদেরকেও জড়িয়ে ধরলো।দিহাদ অভিমানী স্বরে বললো,
– এসেছিস কাল সকালে,একজনকে ফিরে পেয়েছিস বলে আমাদেরকে ভুলে গেলি?আমাদের জানালে কি তোদের পেটের ভাত হজম হতো না!
– আসলেই হজম হয় নি!তবে এখন তোদের হাতের কিল ঘুষি খেয়ে মনে হয় হজম হয়েছে!
কথাটা শেষ করে অর্ক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।অর্কের কথার মানে বুঝতে পেরে সবাই শব্দ করে হেসে দেয়।
__________________
মেহেনূর আর রোশনি ব্রেকফাস্ট করছিল।এর মধ্যেই আগমন ঘটে দিহাদদের।ওরা যখন সবাই রোশনির সাথে কথা বলছিল তখন সবাই রোশনির কথায় বেশ অবাক হচ্ছিলো।কারণ রোশনি সবাইকেই চিনে!সবার নাম ধরে কথা বলছিল।কলি বরাবরই একটু গম্ভীর টাইপের।কিন্তু বাকিরা এটা দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে যায় যে,রোশনির সাথে কলি খুব কম্ফোর্টেবল হয়েই কথা বলছে।ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা পূর্বপরিচিত।কিছুক্ষণের মধ্যেই দিহাদরা এনজিওতে যাবে বলে মেহেনূরদের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসে।রাওনাফ আর অর্ককে ওদের বাসা থেকে নিয়ে সবাই চলে যায় এনজিওতে।
– বউমা তোমার বাবা মা কবে আসবে?
রেনুফা বেগম রোশনির মাথায় তেল দিয়ে দিতে দিতে বললেন।রোশনি চোখ বন্ধ করে বসে ছিল।রেনুফা বেগমের হাতে জাদু আছে।ওর খুব আরাম লাগছিল।শাশুড়ির প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে ঝটপট বললো,
– কবে নাগাদ আসতে বলবো?
রেনুফা বেগম শান্ত কন্ঠে বললো,
– বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে এক বাড়িতে থাকাটা সমাজ ভালো চোখে দেখে না মা।আমি চাই না আমার ছেলে আর ছেলের বউকে মানুষ খারাপ কথা বলুক।
– বাবা মাকে কবে আসতে হবে মা?
– আমার ছেলের বিয়ে বলে কথা।মহা ধুমধামে আমি আমার ছেলের বিয়ে দেবো।তোমার বাবা মাকে বলো খুব শীগ্রই চলে আসতে।
স্মিত হেসে আবার বললো,
– উনাদেরো তো মেয়ের বিয়ে।
রোশনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।মানে ও বলবে।মেহেনূর টম এন্ড জেরি দেখছে তার খিলখিল করে হাসছে।রেনুফা বেগম মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বললো,
– এই মেয়েটা সারাদিন এই টম এন্ড জেরি দেখে কি মজা পায় বলো তো বউমা?খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করে না।
শাশুড়ির কথায় ফিক করে হেসে দিয়ে রোশনি বললো,
– আসলে মা,মেহেনূর প্রচুর কার্টুন পাগল।একবার যদি টম এন্ড জেরির এই চ্যানেল ওরবসামনে এসে পড়ে তাহলে তো আর কোনো কথায় নেই।রাওনাফ আর ও সারাদিন এই কার্টুন দেখেই কাটিয়ে দিতে পারে।এই টম এন্ড জেরি দেখে দেখেই যত বাদরামি শিখেছে ভাই বোন দুটো! আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কোনো এক সাক্ষাৎকারে মেবি বলেছিলেন তিনিও টম এন্ড জেরি দেখেন।এটা শুনার পর মেহেনূর কি বলে জানেন?
রেনুফা বেগম অবাক হয়ে বললো,
– কি বলে?
– বারাক ওবামার মতো একজন প্রেসিডেন্ট যদি সময় পেলে টম এন্ড জেরি দেখতে পারে তাহলে ও কেন দেখবে না।যারা জ্ঞানী তারাই নাকি কার্টুন দেখে!
– আমি ঠিক কথাই বলি ভাবী!
বউ শাশুড়ি দু’জনই চমকে উঠে মেহেনূরের দিকে তাকায়।ও ঘাড় ঘুরিয়ে উনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর উনাদের কথা শুনতে পেরেছে।রোশনি হেসে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– জানি তো রাজকুমারী।
রেনুফা বেগম রোশনিকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।মেয়েটা সত্যিই সবাইকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপন করে নিতে পারে।সকালেই তার প্রমাণ পেয়েছেন তিনি।ভেবেছিলেন বিদেশে বড় হয়েছে আদব কায়দা কিছু জানে কিনা কে জানে?কিন্তু না,উনার ছেলে ওর যোগ্য মেয়েকেই খুঁজে নিয়েছে।তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে রোশনিকে বুকের সাথে আরেকটু চেপে ধরেন।রোশনিও পরম শান্তি মাথা রাখলো শাশুড়ির বুকে।

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।