ততদিনে শশাঙ্কদা টেলিফোনের জন্য আবেদন করে দিয়েছিলেন আর গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন চলে আসে। তারপর থেকে মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন কথা হত। না সেই জুলাই মাসের পরে আমাকে কোনদিন ফোন করেনি ও। হয়ত করেছিল জানিনা আর ফোন হয়ত বা করেছিল কিন্তু ছোটমা বা বাবু হয়ত ফোন ধরেছিলেন আর আমাকে হয়ত দেওয়া হয়নি। আমি একদিন বাবুর ফোনের ডায়রিতে ব্যানারজি কাকুর ফোন নাম্বার খুঁজতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম অরুন্ধতির সাথে দেখা করতে, কিন্তু পারিনি, সেই চেষ্টাও বৃথা গেল আমার।
আমি জানিনা কেন ও আমার সাথে দেখা করেনি। ও চলে যাওয়ার পরে ছোটমা ওর আর অরুন্ধতির সম্পর্কের কথা হাজার বার আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি ছোটমাকে সত্যি কথা জানাই যে আমি ওকে ভালবাসতাম আর ও আমাকে ভালবাসত। জানিনা, হয়ত আমার মাথায় হাত দিয়ে করা প্রতিজ্ঞার ফলে ও অনেক ব্যাথিত হয়েছিল আর তাই হয়ত মনে প্রানে চাইত যে আমার কোন ক্ষতি না হোক। হয়ত বা ওই অরুন্ধুতিকে আমার সাথে দেখা করতে বারন করেছিল বা হয়ত অরুন্ধুতি আমাকে ফোন করেছিল কিন্তু আমি সেই ফোনের উত্তর দিতে পারিনি।
মহালয়ার দুদিন পরের ঘটনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি বাথরুমে দাঁত ব্রাস করছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে ওঠে। বাবু অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েন, আর সেদিন বাবু সকাল সকাল বাজারে সেরে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। ফোন যখন বেজে ওঠে তখন বাবু ফোনের কাছেই ছিলেন আর ছোটমা রান্না ঘরে ছিলেন। বাথরুম থেকে আমি ওদের কথা শুনতে পাই।
বাবু, “পরীকে কি এই সব কথা জানাতে হবে?”
ছোটমা, “না এখুনি ওকে এই সব কথা জানিয়ে দরকার নেই। বাড়ি গিয়ে অবস্থা বুঝে দেখি তারপরে। আমি চাই না আমার মেয়ের এই পুজোর ছুটি এখুনি মাটি হয়ে যাক। দেখি পুজোর ছুটিতে কোথাও বেড়াতে বেড়িয়ে যাবো।”
আমি দাঁত ব্রাস করতে করতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ওদের কাছে এলাম। আমি জিজ্ঞেস করি, “কি হয়েছে?”
ছোটমা মাথা নাড়িয়ে কথা চেপে বললেন, “না কিছু হয়নি।”
বাবু আমার পাসে এসে দাঁড়িয়ে ছোটমাকে বললেন, “উলুপি, আমার মনে হয় পরীকে জানিয়ে দেওয়া উচিত।”
ছোটমা আমাকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে গাউন খুলতে নির্দেশ দিলেন, আমি ছোটমায়ের আচরনে অবাক হয়ে যাই। ছোটমা নিজেই আমার গাউনের ওপরের কয়েকটা বোতাম খুলে বুকের ওপরে হাত দিয়ে নেড়ে চেরে কি যেন দেখলেন। আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরি ছোটমায়ের আচরনে। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার বুকের বোঁটা থেকে কোন কিছু তরল বের হয় কিনা। আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে না বের হয় না।
ছোটমা আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নে, আমরা গ্রামের বাড়িতে যাবো।”
ছোটমায়ের আচরনে আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিলাম, আবার তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মন খুব উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিল। প্রথমেই আমার মায়ের কথা চিন্তা হয়েছিল, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি যে বাড়িতে কার কি হয়েছে।
ছোটমা উত্তর দিলেন, “তোর মা ভালো আছেরে সোনা মা। পুজোর ছুটি ত আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে আমি ভাবলাম কয়েক দিন আগেই তোকে বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
ছোটমা বাবুকে ট্যাক্সি ডাকতে বলে দিলেন। ট্যাক্সি চেপে আমি আর ছোটমা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ট্যাক্সিতে চেপে ছোটমা আমার কলেজের কথা আমার বন্ধু বান্ধবীদের কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি মাথা নেড়ে উত্তর দেই, কিন্তু মনের কোন এক গহিন কোনে সংশয় থেকে যায়। আমার মা ঠিক আছেন তাহলে বাড়ির অন্য কারুর কি কিছু হয়েছে। ছোটমা আমাকে কিছুতেই জানাতে দেয় না সেই কথা।
কথা ঘুরিয়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “নতুন বান্ধবী হল তোর?”
আমি বুঝে গেছিলাম যে আমার মনের উদ্ভিগ্নতা কম করার জন্য ছোটমা কথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে কথার রেশ টানছেন, সেই জন্য ত আমার দিদি আমার মা।
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “ছোটমা, কলেজে কি আর আধ খানা বান্ধবী হয়, সবাই ওখানে বন্ধু বান্ধবী।”
ছোটমা মাথা নাড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে বলেন, “সোনা মা, কলজের জীবন স্কুলের জীবনের থেকে অনেক আলাদা। কলেজে সবাই মতলবি হয়, সবাই যেন বন্ধুতার বদলে কিছু চায়। এটা তোর গ্রাম নয় রে সোনা মা, এটা কোলকাতা, এখানে মানুষ মানুষকে তখনি চেনে যখন ওপর জনের কাছ থেকে কিছু পাবার আশা থাকে।”
আমি ছোটমাকে জানাই আমার দুটি ভালো বান্ধবীর ব্যাপারে, তিস্তা সরকার আর ডেলিসা খাতুন। ছোটমা বললেন, “পুজোর পরে ওদের বাড়িতে ডাক একদিন।”
আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে।”
আমি একটু ইতস্তত করে ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “ছোটমা, আমার কিছু বলার আছে।”
ছোটমা, “কি?”
আমি, “ছোটমা, আমার একটা সেলফোন চাই। আমার কলেজের বন্ধু বান্ধবীদের কাছে সেলফোন আছে ওদের সামনে কেমন যেন মনে হয় আমার। প্লিস ছোটমা।”
ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ঠিক আছে, পরের জন্মদিনে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”
আমি, “না ছোটমা, অনেক দেরি আমার জন্মদিন আসার।”
গত আগস্টে আমার জন্মদিন ছিল, পরের জন্মদিন মানে প্রায় এক বছর অপেক্ষা করা, আমার যেন তর সইছিল না। আমি মাথা নেড়ে আব্দার করে বলি, “না না ছোটমা আমার এখুনি চাই।”
ছোটমা, “ঠিক আছে, এই ক্রিস্টমাসে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”
আমি খুশিতে নেচে উঠে ছোটমায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই, “আমার আদরের ছোটমা।”
ছোটমা স্কুলের টিচার, ছেলে মেয়েদের মানসিকতা নিয়ে প্রতি নিয়ত থাকতে হয়। ছোটমা জানতেন কি করে আমার মন ভুলান যায়, তাই আমার ছোটমাকে এত ভালো লাগত। কিন্তু কোন এক সময়ে মনে হত, কি করে ছোটমা ওর প্রতি অত নিষ্ঠুর আচরন করেছিলেন, কি করে নিজের ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
দুপুর নাগাদ আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেছিলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম। বাড়ির সবাই যেন আমাদের পথ চেয়ে বসেছিল। লক্ষ্য করলাম যে মা খাওয়ার ঘরে বসেছিল, মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী পাশেই দাঁড়িয়েছিল। দুপুর বেলা দেখে বাড়িতে শশাঙ্কদা আর সুব্রতদা ছিলেন না, বড়দা হয়ত মাঠে গেছেন আর পার্বতী বৌদি হয়ত বড়দা কে খাবার দিতে গেছেন। আমাকে দেখে মা আর মেঘনা বৌদি একটু হাসলেন।
আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, “কার কি হয়েছে?”
মা আমাকে উত্তর দিলেন, “পরী, তুই অনেক দূর থেকে এসেছিস, খেয়ে দেয়ে নে তারপরে কথা হবে। কারুর কিছু হয়নি এখানে সবাই ঠিক আছে।”
শেষের কথাগুলি বলার সময়ে মায়ের গলা কেন জানিনা কেঁপে উঠেছিল। চেহারার বেদনার ছায়া দেখেও আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা যে ঝড় আসছে।
ছোটমা বাড়িতে ঢুকে মাকে নিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে পরে। আমি মেঘনা বৌদিকে প্রশ্ন করাতে বৌদি সেই একি উত্তর দিলেন। আমি শেষ পর্যন্ত মৈথিলীকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু মৈথিলী আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমাকে দেখে দৌড়ে এসে কোলে চাপে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই। দুষ্টুর প্রথম প্রস্ন আমাকে জর্জরিত করে তোলে, “পিসি, তুমি একা কেন? অভি কাকু কোথায়?”
অনেক দিন পরে ওর মুখে সেই নাম শুনে মন হুহু করে কেঁদে ওঠে। মনে হল যেন পায়ের তলার মাটি নড়ে উঠেছে। দুষ্টুকে প্রাণপণে বুকের কাছে জড়িয়ে ওর নরম গালে ঠোঁট চেপে ধরি।
আমি অর দিকে ম্লান হেসে ঝাপসা চাহনি নিয়ে বলি, “পরের বার আসবে। অনেক দুরে গেছে চাকরি করতে নতুন চাকরি তাই এবারে পুজোর ছুটি পায়নি।”
আমি ওকে প্রবোধ দিলাম বটে, কিন্তু মনের মাঝে নিজেকে কি বলে প্রবোধ দেব সেই চিন্তা করি।
দুষ্টুর মুখে তারপরের বাক্য আমার পায়ের তলার মাটি নাড়িয়ে দিয়েছিল, “বড় জেঠিমা বুকে ব্যাথা নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি।”
আমি দুষ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার বুকের মাঝে আগে থেকেই এক প্রবল ঝড় বইছিল তার ওপরে ওই খবর শুনে আমার বুক ফেটে যায়। আমি ওকে কোলে নিয়েই দৌড়ে যাই ঘরে, যে ঘরে ছোটমা আর মা বসেছিলেন। পার্বতী বৌদি, সর্বদা আমার ভালো চেয়েছিলেন, সে কথা আমাকে ও বলেছিল।
আমি ছোটমা আর মায়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠি, “দুষ্টু কি বলছে, মা? তোমরা দুজনে আমার কাছ থেকে কি লুকিয়ে রেখেছ?”
আমি ভুলে গেছিলাম যে আমার কোলে দুষ্টু, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “কেন ছোটমা আমার বুক ধরে চেক করছিল?”
মা আমার কোল থেকে দুষ্টুকে নিয়ে অন্য ঘরে যেতে বলে। আমি লক্ষ্য করলাম যে ছোটমা আড়ালে নিজের চোখ মুছে নিলেন। আমি ছোটমায়ের কাছে এগিয়ে এসে পায়ের কাছে বস পরি।
ছোটমা আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “তোর বড় বৌদি ঠিক আছে। একটু বুকের ব্যাথা হয়েছে তাই ওকে নিয়ে হস্পিটালে গেছে, বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে তোর বড় বৌদি।”
আমি বিশ্বাস করিনা, “কিন্তু সকালে আমার বুক টিপে কি দেখছিলে তুমি?”
ছোটমা, “কিছু না এমনি একটু চেক করছিলাম।”
আমি ছোটমায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারিনা যে বড় বউদির শুধু মাত্র একটু বুক ব্যাথা হয়েছে, “না, তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে কথা বলছ।”
মা ছোটমায়ের দিকে ইশারা করে যাতে আমাকে কিছু না জানানো হয়, আমি সেই ইশারা লক্ষ্য করি আর বড় ব্যাথা জাগে বুকের ভেতরে সেই দেখে। আমি কাতর চোখে ছোটমাকে প্রশ্ন করি, “প্লিস ছোটমা, বল না কি হয়েছে।”
ছোটমা বুক ভরা এক নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলেন, “পার্বতীর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে।”
আমার ছোটো পাখীর মতন বুকে আর কত ঝড় আসবে সেটা বুঝে পাইনা। আমি ছোটমায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ফেলি। আমি চিৎকার করে উঠি, “না এ হতে পারে না।”
ছোটমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “জ্যাতস হি ধুব মৃত্যু, ধ্রুভম জন্ম ম্রিতশ্যচ, তস্মাদ অপরিহার*্যথে, নঃ ত্বম সচিতুম অরহসি।”
আমি সেই সংস্কৃত শ্লোক শুনে রেগে যাই, চিৎকার করে বলি, “ছোটমা তোমার সংস্কৃত শ্লোক কি আমার পার্বতী বৌদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে? আমি রক্ত মাংসের ছোটো একটি মেয়ে। আমাকে শুধু এই টুকু বল, কেন আমার জীবনের সব রঙ মুছে যায় বারে বারে।”
ছোটমা আমার মুখ খানি আঁজলা করে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বলেন, “সোনা মা, তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, জীবনের অনেক কিছু তোর এখন বোঝা উচিত।”
আমি মাথা দুলিয়ে জোরে বলি, “না না না, আমি এখুনি বউদির কাছে যেতে চাই।” ছোটমা আমাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেন সেদিন।
বিকেল হয়ে সন্ধ্যে গড়িয়ে আসে, দাদারা কেউ ফেরে না দেখে আমি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। বুকের মাঝে চরম সত্যি কথা শোনার জন্য মন বেঁধে তৈরি হয়ে নেই। এক সেকেন্ড যেন আমার কাছে এক বছরের মতন মনে হয়। এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে, আমি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরি, ওপর পাসে সুব্রত।
আমাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “তুই এখানে কখন এলি?”
আমি জোর গলায় বলি, “আগে আমাকে বল যে বৌদি কেমন আছে?”
সুব্রত, “মাকে ফোন দে।”
আমি চেঁচিয়ে উঠি, “না আমি মাকে ফোন দেব না, আমি কি এই বাড়ির কেউ নই যে আমাকে বউদির কথা বলা যাবেনা?”
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, আমি চোখ চেপে বন্ধ করে থাকি চরম খবর শোনার জন্য। সুব্রত বলে, “বৌদি এখন ঘুমাচ্ছে, তাঁর কেমথেরাপি শুরু হয়ে গেছে। এবারে মাকে একটু ফোন দে।”
অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#02)
আমি মায়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দেই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে, সুব্রতর সাথে কি কথা হয়েছে সেটা শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। আমি জানালাম যে বড় বউদির কেমো শুরু হয়ে গেছে আর বৌদি ঘুমোচ্ছে। সেই সময়ে আমি বুঝতে পারি যে কেন সকাল বেলায় ছোটমা আমার বুক টিপে পরীক্ষা করছিলেন। আমি ছোটমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলি, এত ভালবাসে আমাকে?
ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “কাল তোকে হস্পিটাল নিয়ে যাবো।”
রাতে দাদারা হস্পিটাক থেকে ফিরে আসার পরে সবাই ঘরে বসে কথা বার্তা বলেন। আমার সেই ঘরে ঢোকা মানা ছিল। আমার সেই দিনের কথা মনে পরে যায়, আমি আর ও যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। সেইদিন প্রথম বার বড় বৌদি নিজের হেঁসেল ছেড়ে বাড়ির উঠান পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। আমি জানিনা, বড় বউদির সাথে ওর কি কথা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন বড় বউদির হাসি হাসি চোখ আমার ঝাপসা দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে।
আমি ছাদে উঠে এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সেদিন ঠিক যে জায়গায় ও দাঁড়িয়েছিল আর আমাকে চুমু খেয়েছিল। ওর সাথে দেখা করার জন্য মন আকুলি বিকুলি হয়ে ওঠে, কিন্তু একি সাথে ছোটমায়ের ভালোবাসা আর স্নেহ মমতা আমাকে পেছনে টেনে ধরে রাখে। ছোটমাকে ছেড়ে কি করে আমি চলে যেতাম, আমার জীবন যে ছোটমায়ের কাছে ঋণী। আমি কি করে ছোটমায়ের মান সন্মান এই সমাজের সামনে নিচু করে দিতাম শুধু মাত্র নিজের জন্য? আমি বাংলার গ্রামের সামান্য একটি মেয়ে, বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পদক্ষেপের আগে আমি শত বার মরে যেতাম যে।
আমার মাথায় চিন্তার বেড়ি যেন ঝনঝন করে ওঠে। বড় বউদির ক্যান্সার, আমার ভালোবাসার হারিয়ে যাওয়া আর ছোটমায়ের অকপট স্নেহ মমতা। আমার মাথা ঝিনঝিন করতে শুরু করে, চোখের সামনে অন্ধকার দেখি আর ধুপ করে ছাদের মেঝেতে লুটিয়ে পরে যাই।
চোখ খুলে দেখি যে আমি বিছানায় শুয়ে, মাথার কাছে মা বসে চারপাশে ছোটমা আর বাড়ির লোকে। মায়ের দুচখে জল, ব্যাথা ভরা চাহনি নিয়ে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় প্রশ্ন করে মা, “উলুপি আমার বাড়িতে এই সব কি ঘটে চলেছে?”
একমাত্র ছোটমা জানে আমার মনের ব্যাথার আসল কারন। ছোটমা বুঝতে পারে যে বড় বউদির ক্যান্সারের খবর আমার জ্ঞান হারানোর কারন নয়, আমার জ্ঞান হারানোর আসল সত্য অন্য কিছু।
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর আমি চুপ করে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। ছোটমায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমার মুখ দেখে, হয়ত ছোটমায়ের মন কাঁদে তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য। কিন্তু নিজের মনের ভাব ছোটমা কোনদিন প্রকাশ করেননি। ছোটমা আমার পাসে এসে বসে বলেন যে পরের দিন আমাকে হসপিটাল নিয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন কোন এক অজুহাত দেখিয়ে আমাকে হসপিটাল যেতে দেওয়া হয় না।
দিনটা ছিল চতুর্থী, আকাশে বাতাসে যেন আগমনীর সুর ভেসে বেড়ায়, কিন্তু আমার মন ভারাক্রান্ত। ভালোবাসার বিচ্ছেদ আর বড় বউদির ক্যন্সার। আগমনীর সুরের সাথে বুকের ভেতরে বেদনার করুন বাঁশি বেজে ওঠে। আমি ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পেছনের দিকে যাই। সেই পুকুর পাড়, সেই আম কাঠালের বাগান, সব জায়গায় যেন ওর ছোঁয়া খুঁজে বেরাই আমি। এমনকি বাড়ির আনাচে কানাচে তেও যেন ওর ছোঁয়া লেগে আছে বলে মনে হয় আমার।
আমি সেই পুকুর পাড়ের এককোণে ওর পোঁতা আম গাছের নিচে গিয়ে বসে পরি। আম গাছের গুঁড়ি ছুঁয়ে ওর হাতের পরশ অনুভব কররা প্রানপন চেষ্টা করি। এই আম গাছের তলায় এক দিন ও আমাকে চুমু খেয়েছিল, পাগল করে তুলেছিল এক শীতের রাতে। সেই চুম্বন আমার গালে, আমার কপালে আজও লেগে আছে। আমি নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাই, নীল আকাশের নিচে, সাদা মেঘের ভেলা ঘুরে বেড়ায়। বাতাসের সেই পুজোর গন্ধ আমার নাকে প্রবেশ করেনা, নাকে লেগে থাকে ওর গায়ের গন্ধ।
এমন সময়ে দুষ্টু বাড়ির দিক থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জানায়, “বড় জেঠিমা বাড়ি ফিরে এসেছে।”
আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি, বউদির ফেরার খবর শুনে বুকের ভেতরের বেদনা যেন কিছু টা কমে যায়। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেস করে দেখি যে সবাই খাবার ঘরে গোল করে বসে। মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা উত্তর দেন যে বৌদি নিজের ঘরে শুয়ে আছেন।
আমি বউদির ঘরে ঢুকে, সেই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলি। চোখের জল মুছে তাকিয়ে দেখি, বৌদি বিছানায় শুয়ে, গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। খুব রোগা হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে একটু হাসেন, মনে হয় যেন বউদির সেই হাসিতে কান্না ঝরছে। আমি বৌদিকে বলতে চেষ্টা করি, “বৌদি তোমাকে হাসতে হবে না, শুধু মাত্র তুমি আমার কাছে ফিরে এস।”
সেই ক্ষণের পরে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বড় বউদির পাশ ছেড়ে যাইনি। রাতেও আমি বউদির পাশে শুয়ে থাকতাম, যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায় সেই ভয়ে। বউদির বাম স্তন বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, কোমরে কেমো র থলি। কয়েকদিনের মধ্যে বৌদি কিছুটা শক্তি ফিরে পান। অন্তত বিছানায় উঠে বসতে পারতেন বা বাথরুম পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারতেন।
সেই দিন, নবমি। বউদির শরীর একটু ভালো ছিল। আমি বৌদিকে স্নান করিয়ে দেয়ার পরে মাথার চুল আঁচরে দেই। কেমোর জন্য মাথার অনেক চুল ঝরে গিয়েছিল।
বৌদি মিনমিন করে আমাকে বললেন, “পরী আমাকে একটু দুর্গা মন্দির নিয়ে যাবি?”
আমি উত্তর দিলাম, “নিশ্চয় বৌদি।”
বৌদি, “আজ বিকেলে?”
আমি, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি যাবো, তুমি যাবে, মা ছোটমা, সবাই তোমাকে নিয়ে যাবে।”
বিকেল গড়িয়ে আসে, আমি খুব খুশি ছিলাম, বৌদি অন্তত হাঁটতে পারছিলেন। আমি বৌদিকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলাম, লাল পাড় ঘিয়ে রঙের দামী তাঁতের শাড়ি। বৌদিকে দেখতে ঠিক মা দুর্গার মতন লাগছিল সেদিন। বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিছু পরে কষ্টে বললেন যে আলমারিতে একটা আকাশী নীল রঙের শাড়ি আছে, সেটা যেন আমি পরি। আমার বড়দা নাকি বউদির জন্য কিনেছিলেন সেই শাড়ি কিন্তু বৌদি আমাকে পড়তে বলে। আমি সেই শাড়ি পরে বউদির কাছে আসি। বাড়ির সবাই আমাকে সেই শাড়িতে দেখে বেশ খুশি হয়েছিল। মা আমার কপালে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করেন।
বড় বৌদি বিছানার ওপরে বসেছিলেন, সামনে একটা কাঠের বাক্স রাখা। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বড় বৌদি তাঁর সামনে বসতে বললেন। আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, চোখের চাহনি ঝাপসা হয়ে আসে বউদির।
আমি জিজ্ঞেস করি, “তুই কাঁদছ কেন বৌদি, তুমি ত এখন ঠিক হয়ে যাবে।”
কাকে কে প্রবোধ দেয়, হে ভগবান আমি জানতাম যে সেই প্রবোধ বাক্যের কোন মুল্য নেই। ঘড়ির কাঁটা অতি দ্রুত গতিতে ঘুরছে, হাতে সময় খুব কম। দম ফুরিয়ে এসেছে জীবনের কাটার, যেকোনো সময়ে থমকে যাবে হৃদপিণ্ড।
বৌদি আমাকে বলেন, “আমি দেখছি আমার সুন্দরী ননদকে।”
আমার হাতে সেই কাঠের বাক্স তুলে দিয়ে খুলতে বললেন। আমি খুলে দেখি যে সেটা বউদির গয়নার বাক্স। আমি হতভম্ব হয়ে বউদির দিকে তাকিয়ে থাকি। বৌদি কিছু না বলে সেই বাক্স থেকে একটা সোনার হাড় বের করে আমার গলায় পড়িয়ে দেয়। তারপরে এঁকে এঁকে বাকি গয়না গুলি আমাকে পড়িয়ে আমাকে সোনায় সাজিয়ে তোলে। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে আমার। শেষে আমার হাতে একটা মোটা বালা পড়িয়ে আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বলে সুমন্তদাকে ডাকতে। আমি সুমন্তদাকে ডেকে আনি।
বৌদি সুমন্তদাকে দেখে বলে, “দেখ তোমার বোনকে কত সুন্দরী দেখাচ্ছে। ঠিক যেন স্বগের পরী আমার সামনে বসে।”
বউদির হাবভাব দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে এক অজানা আশঙ্কায়। আমার গালে যখন হাত দিয়েছিলেন আমি সেই হাত গালের ওপরে চেপে ধরে থাকি। হটাত করে বৌদি কেঁপে ওঠেন, মনে হয় যেন শত সহস্র ঢেউ এসে বউদির শরীরে ধাক্কা দেয়। আমি দুহাতে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে মাকে ডাকি। সুমন্তদা বৌদিকে বিছানায় শুতে অনুরধ করেন।
বৌদি অতি কষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, “না বিছানায় নয়, আমাকে ওর কোলে শুতে দাও।”
আবার কেঁপে ওঠে বউদির বুক, ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত বের হতে শুরু হয়। বউদির ঠোঁট শুকিয়ে আসে। অতি কষ্টে ডান হাত তুলে আমার মাথায় রাখে।
আমি আমার শেষ শক্তি টুকু সঞ্চয় করে চেঁচিয়ে উঠি, “মা শিগগির এসো।”
সবাই দৌড়ে আসে।
বৌদি আমার মাথায় হাত চেপে ধরে বলেন, “তুই আমার পাসে আছিস, এই বারে আমি শান্তিতে শুতে পারব।”
আমি প্রাণপণে বৌদিকে বুকের সাথে চেপে ধরে জোরে বলি, “না না, তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পার না।”
বউদির বুকের রক্ত আমার শাড়ি, আমার বুক ভাসিয়ে দিয়েছিল। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, আমি চেপে ধরে বউদির উষ্ণতা অনুভব করার প্রানপন চেষ্টা করি। কিছু পরে বউদির হাত আমার মাথা থেকে এলিয়ে পরে যায়, কোলের ওপরে মাথা একপাসে বেঁকে যায়। গাছের ভাঙ্গা ডাল কোলে করে বসে থাকি আমি।
বড়দা আমার পাসে এসে আমার মাথা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। আমি কান্নার জন্য ঠিক ভাবে শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না। আমার কোলে অন্তিম নিদ্রায় শায়িত আমার প্রানের বৌদি, মৃত্যু কে বাধা দেওয়ার মতন ক্ষমতা আমার ছিলনা।
সুমন্তদা কেঁদে ওঠেন, “আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”
নবমির দিনে, আকাশে বাতাসে যখন আগমনীর সুর বাজে, আমি তখন আমার বউদির প্রাণহীন দেহ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমার সাধের, আমার পুজ্য মা দুর্গা কে একদিন আগেই বিসর্জন দিতে হয়।
আমি জানি, প্রতি বছর নতুন করে দুর্গা পুজো আসবে, কিন্তু আমার দেবী অন্নপূর্ণা, আমার পার্বতী বৌদি আমার কাছে কোনদিন আর ফিরে আসবে না।
ভগ্ন হৃদয়ের সান্তনা
শ্রাদ্ধের কাজ তের দিনে হবে, তাই আমাকে দুই সপ্তাহের জন্যে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে হয় তখন। ছোটমা তার পরদিন স্কুল চলে যান, স্কুল যাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে যান যে প্রতিদিন বাড়ি ফেরার আগে আমার সাথে দেখা করে যাবেন।
কল্যাণী আমাদের বাড়িতে রোজ আসতো। একদিন বিকেলে আমি আর কল্যাণী পুকুরের দিকে হাঁটছিলাম। কল্যাণী আমাকে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, “পরী, অভিমন্যু কেন এলনা? তুই ওকে বউদির কথা জানাস নি? ওর ত এই সময়ে আসা উচিত।”
আমি ভেবে পাইনা, কি উত্তর দেব। ওকে সত্যি কথা বলব কি না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “তোর বাড়ি থেকে একটা এসটিডি করতে দিবি?”
আমি সুপ্রতিমদার বাড়ির নাম্বার জানতাম, আমার কথা শুনে কল্যাণী একটু অবাক হয়ে গেল। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “এসটিডি, কেন মানে, অভিমন্যু কোথায় গেছে?”
আমার বুক কেঁপে ওঠে ওর প্রশ্ন শুনে। আমরা আম গাছের দিকে হেঁটে যাই। আমি সেই আম গাছ ধরে ওর পরশ অনুভব করার চেষ্টা করি। কল্যাণী আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই ওকে খুব মিস করছিস তাই না?”
আমি মৃদু হেসে বুকের বেদনা টাকে লুকিয়ে ফেলি। কল্যাণী আমার চুবুক নাড়িয়ে বলে, “ঠিক আছে চল ওকে, ফোন করি।”
আমি ওকে বলি, “আমি যে ওর ফোন নাম্বার জানিনা।”
হতবাক হয়ে যায় কল্যাণী, “মানে? ও চলে গেছে তোকে ওর ফোন নাম্বার দিয়ে যায়নি? চলে যাওয়ার পরে ও কি তোকে ফোন করেনি?”
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দেই, “না মানে, হয়ত করেছিল সেই সময়ে হয়ত আমি কলেজে ছিলাম, ছোটমা বা বাবু হয়ত ফোন ধরেছিল।”
কল্যাণী আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেনা। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, কল্যাণী আমার চিবুক ছুঁয়ে ওর দিকে তাকাতে বলে।
আমার ঝাপসা চোখ দেখে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বলত? তোর চোখ অন্য কিছু বলছে, শুধু মাত্র অভি চলে গেছে সেটা কারন নয়। এর গুড় কারন অন্য কিছু যেটা তুই আমাকে বলছিস না।”
ওর হাতের ছোঁয়ায় আমার মন গলে যায়, আমি ডুকরে কেঁদে ফেলি, “ও আমার কাছে ফিরে আসবে, তাই না?”
আমি আম গাছের নিচে বসে পরি, কল্যাণী আমার পাসে বসে পরে আমার মুখ খানি আঁজলা করে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে কান্নার কারন। আমি ধরা গলায় ওকে জানাই, “ছোটমা আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে যায় আর ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, সব কিছু আমার ভুলের জন্য রে, আমি পাপী।”
কল্যাণী, “কি করে, কবে এই সব হয়েছে? তুই এক বারের জন্যেও আমাকে জানালি না কেন?”
আমি, “আমি বাড়ি থেকে কি করে ফোন করতাম, সব সময়ে ছোটমা না হয় বাবু আমার ওপরে নজর রেখেছিল যে।”
কল্যাণী, “তুই কলেজ থেকে ও ত ফোন করতে পারতিস।”
আমি, “আমি ভাবলাম কেন তোকে এই সব কথা জানিয়ে বিরক্ত করা।”
আমার সখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, “আরে তুই আমার বান্ধবী না।”
আমাকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলে, “তুই কি বাড়ি ছেড়ে দিল্লী যেতে চাস?”
আমি ওর কথা শুনে হকচকিয়ে যাই। আমি চোখের জল মুছে ওকে বলি, “না আমি বাড়ি ছেড়ে যেতে পারিনা, আমি ছোটমা বাবু কে ছেড়ে যেতে পারিনা। ছোটমা আমার জীবন, আমার মায়ের মতন। আমার জন্য অনেক করেছে, সেই ঋণ এই জীবনে শোধ হবে না। আমি কিছুতেই পারবনা ওদের মাথা এই সমাজের সামনে ঝুকিয়ে দিতে।”
বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বলি, “ও যদি আমাকে সত্যি ভালবাসে তাহলে আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি জানি ও আসবে। এই সমাজ শুধু মাত্র টাকার খেলা জানে, ও আমার জন্যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে যেতে আসবে। কিন্তু তাই বলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারিনা।”
কল্যাণী আমাকে জড়িয়ে ধরে আসস্থ করে, “হ্যাঁ ও নিশ্চয়ই আসবে তোর কাছে। সত্যি তোদের ভালোবাসা দেখে আমার খুব ভালো লাগে, তোর প্রান ভরা বিশ্বাস আর ওর জীবন যুদ্ধ।”
বাড়ি পর্যন্ত আমার সাথে হেঁটে যায়। বাড়ি ফেররা পথে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি সুপ্রতিমদা কে ফোন করতে আই কি না, আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই যে সুপ্রতিমদা কে ফোন করলে হয়ত ওর খবর জানা যেতে পারে।
বাড়িতে পা রাখতেই দেখি যে ছোটমা মায়ের সাথে উঠানে বসে কিছু কথা বলছে। কল্যাণী আর আমাকে দেখে ছোটমা একটু হাসে। ভয়ে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে যায়, ছোটমা জানেন যে কল্যাণী আমাদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। হয়ত ছোটমা কল্যাণীকে ওর কথা জিজ্ঞেস করবে। আমি আর কল্যাণী একে ওপরের মুখ চাওয়া চায়ি করি। কল্যাণী আমার দিকে ইশারা করে বলে যে ছোটমা কিছু জিজ্ঞেস করলে ও সামাল দিয়ে দেবে।
কিন্তু সেই সব কিছুই হয় না, ছোটমা কল্যাণী কে কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন। তারপরে কল্যাণীকে বলেন, “তুই ত এর ছোটো বেলার বান্ধবী, ও যদি তোর কাছে কিছু দিন থাকে তাহলে হয়ত ওর মনের অবস্থা ভালো হয়ে যাবে।”
আমি আর কল্যাণী যেন হাপ ছেড়ে বেঁচে যাই। ছোটমা আরও বলেন, “এই বাড়িতে থাকলে হয়ত ওর মন খারাপ বেশি করবে। তুই এক কাজ কর, ওকে তুই কিছুদিনের জন্য তোর বাড়িতে নিয়ে যা।”
আমার সেই সময়ে মনে হয়েছিল যে দৌড়ে গিয়ে ছোটমাকে জড়িয়ে ধরি। ছোটমা মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “পরী যদি কল্যাণীর সাথে থাকে তাহলে কি তোমার কিছু আপত্তি আছে?”
মা ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দেন, “ও ত তোর মেয়ে, তুই যা ভাল বুঝিস তাই কর।”
বাকি কটা দিন আমি কল্যাণীর বাড়িতে থেকে যাই। সেই রাতে আমি সুপ্রতিমদার বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু আমার অদৃষ্ট, কেউ ফোন তোলেনি। প্রায় প্রত্যেক দিন আমি দিল্লীতে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবার সেই এক উত্তর, কেউ বাড়িতে নেই। আমার হৃদয় একটু একটু করে ভেঙ্গে যায় কিন্তু নিজেকে সান্তনা দেই।
বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন, দুষ্টু আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “পরের বার একা আসবে না, সাথে অভি কাকু যেন থাকে। অনেক দিন কাকুর গল্প শুনিনি।”
আমি হেসে ওর চুলে বিলি কেটে বলি, “হ্যাঁ আমি ওকে জানিয়ে দেব যে তুই ওর গল্প শোনার জন্য জেগে বসে আছিস।”
আমিও যে ওর সাথে দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। নতুন শক্তি সঞ্চার করে ফিরে যাই আমার সোনার খাচায়। বুকে আশা বেঁধে নেই, আসবে আমার সেই চোর যে আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে পাহাড়ের কোলে। শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষায় থাকি আমি, আশা বেঁধে বুকে।
কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।