ইট পাটকেল | পর্ব – ১৭

নূর কে নিয়ে যাওয়ার পর আশমিন হালকা হাসলো। অমি নিয়ে গেছে নূর কে। সানভি নিস্তেজ নূর কে কোলে নিতে গেলেই আশমিনের ভয়ংকর ধমক খেয়ে থেমে গেছে। চাকরি জীবনে এই প্রথম আশমিন এভাবে হুংকার দিয়ে ধমক দিয়েছে ওকে।ভয় দ্বিধা সব নিয়ে যখন সানভি আশমিনের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন আশমিন গম্ভীর গলায় অমি কে বললো নূর কে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে।অমি এই অপেক্ষায় ই ছিল। নূরের কাটা হাত দেখে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল ওর।আশমিনের ভয়ে এতক্ষণ অস্থির হলেও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে নূর কে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে সে।সানভি মুখ ভোতা করে আশমিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আশমিন ভ্রু কুচকে বললো,
— কি?
— ম্যাম কে এভাবে আঘাত করলেন কেন স্যার??(করুন গলায়)
আশমিন হালকা হাসলো। উঠে বসার চেষ্টা করতেই সানভি এসে সাহায্য করলো আশমিন কে। বেডে হেলান দিয়ে বসে সানভির দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,,
— বাইরে তোমার ম্যাম সেফ নয় সান।আমার অনুপস্থিতিতে নূরের উপর আক্রমণ হতে পারে। আমি এখনো জানিনা শত্রু কোথায় লুকিয়ে আছে,দেখতে কেমন তাও জানি না। আমি চাই না আমার অনুপস্থিতিতে নূর বাইরে থাকুক। এমনি তে তো তোমার ম্যাম থাকবে না। তাই এই ব্যবস্থা। তোমার ম্যাম ম্যাম যেমন জেনে বুঝে আমার হার্টের ঠিক এক ইঞ্চি উপরে গু*লি করেছে। আমি তেমনি ওর হাতের শুধু চামড়া টাই কে*টেছি।ব্লাড লসের জন্য কিছুদিন দুর্বল থাকবে।এই বাহানায় ওকে এখানে আটকে রাখা যাবে। এখানে আরেকটা বেডের ব্যবস্থা করো।
সানভি হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুকাল। তারপর ঘোরের মধ্যেই বেরিয়ে গেল। আশমিন চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে বসে আছে। বুকে হালকা ব্যথা করছে। যেখানে তোকে এতো যত্নে রাখি সেখানেই আঘাত করলি বউ!এই যন্ত্রণা আমি ভুলবো কি করে! আর ভুল করিস না জান।তোকে ক্ষমা করতে করতে আমি না আবার ক্লান্ত হয়ে যাই।আমার অভিমান আমার ভালোবাসার মতোই তীব্র। সহ্য করতে পারবি না।
আপন মনে বিরবির করে বুকের ক্ষতস্থানে হাত বুলালো আশমিন। প্রেয়সীর নিষ্ঠুরতা কষ্ট দিচ্ছে। উহু,কষ্ট নয়।মরণ যন্ত্রণা দিচ্ছে।
সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। নূরের এখন ঘুমাচ্ছে। আশমিন এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপাল কুচকে নিল সে।নাহ!দুইটা বেড নেয়া মোটেই উচিত হয় নি। তার বেড টা যথেষ্ট বড়। এখানেই রাখা যেত নূর কে। দূরে রেখে হয়েছে এক জ্বালা। বউ কে চুমু খাওয়া যাচ্ছে না। কাছে থাকলে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে ফেলা যেত।ঘুমিয়ে আছে,কিছু বলতে ও পারতো না।
আশমিন আনমনে ভাবলো, সে কি তার বউয়ের ঘুমের সুযোগ নিতে চাইছে?নিজের ভাবনা কে জানালা দিয়ে ছুড়ে মেরে ভাবলো, এখানে সুযোগের কি আছে? আজব! বউ কে চুমু খেতে ইচ্ছে হলে খেয়ে ফেলবে।জেগে থাকলে ও খাবে ঘুমিয়ে থাকলে ও খাবে। বাধা দিলে অজ্ঞান করে খাবে।সে জন্মগত নির্লজ্জ। এখন কয়েকটা চুমুর অভাবে তো আর সে শুকিয়ে মরতে পারে না!সে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ।একজন গণ্য মান্য মন্ত্রী হয়ে সে নিজেকে শুকিয়ে মেরে তো আর জনগণের ক্ষতি করতে পারে না।
সকাল দশটায় হন্তদন্ত পায়ে কেবিনে ঢুকলো আমজাদ চৌধুরী আর কামিনী চৌধুরী। কামিনী চৌধুরী তো এসেই নূরের দিকে তেড়ে গিয়েছে।নূর এতক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে ছিল আশমিনের দিকে। আশমিন ও এক ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে ছিল নূরের দিকে। দেখে মনে হবে এখানে তাকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা চলছে।সেসময় কামিনী চৌধুরীর এভাবে তেড়ে আসা নূরের রাগের আগুনে ঘি ঢাললো।পাশে ফলের ছু*ড়ি টা হাতে নিতেই থেমে গেলো কামিনী চৌধুরী। নূর চোখ লাল করে কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থেকেই একটা আপেলে ছু*রি চালিয়ে দিল। আমজাদ চৌধুরী অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মুখ কুচকে তাকিয়ে রইলো তার বাবার দিকে। এরকম একটা রোমান্টিক সময়ে তার বাবা এসে বাগড়া দিল!
— এখন কেমন আছো?
আমজাদ চৌধুরীর কোমল গলা শুনে মনে মনে ফুসে উঠলো আশমিন।তবে তার ফেস আগের মতোই শান্ত।বাবা কে নিজের পাশে বসিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— ভালো আর থাকতে দিলে কই? একটা নব দম্পতির হানিমুনে বাগড়া দিতে তোমার লজ্জা করলো না?আমি নিশ্চয়ই তোমার হানিমুনে গিয়ে বাগড়া দেই নি?দিলে আমাকে দুনিয়ায় এতো তারাতাড়ি আনতে পারতে না নিশ্চয়ই। তোমার যন্ত্রণায় আমি আর বাচ্চাকাচ্চার মুখ দেখতে পারবো না।তারা পড়াশোনায় কতো পিছিয়ে যাচ্ছে জানো?এতটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন দাদু হয়ে তুমি নিশ্চয়ই গর্বিত নও।
ছেলের কথা শুনে এতক্ষণের কষ্ট পাওয়া বৃথা মনে হলো আমজাদ চৌধুরীর। বাকরুদ্ধ হয়ে তিনটা প্রাণী তার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই।সে নাক মুখ কুচকে চোখ বন্ধ করে আছে।আমজাদ চৌধুরী এবার কামিনী চৌধুরীর দিকে আহত চোখে তাকালো। ঝড়ে পরে যাওয়া পাখির
মতো ছটফট করতে করতে বললো,
— এ আমার ছেলে নয় কামিনী!সত্যি করে বলো এটা কার ছেলে?হসপিটাল থেকে বদলে দেয় নি তো(সন্দিহান গলায়)।
কামিনী চৌধুরী অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো স্বামীর দিকে।এই ভয়াবহ ঠোঁট কাটা ছেলের সামনে সে নিজেই ভয়ে ভয়ে আসে।কখন কি শুনিয়ে দেয় আল্লাহ মালুম।
নূর গা এলিয়ে দিলো। এসব শুনে মাথা ঘুরছে। তার এখন ঘুম প্রয়োজন। যতদিন এখানে থাকবে সে সারাদিন ঘুমাবে।ডিসিশন ফাইনাল।এসব ছিঃ মার্কা কথা শুনার চেয়ে মটকা মেরে পরে থাকা ভালো। এতে পিঠ আর কোমড় বাকা হলেও কিছু যায় আসে না।
কামিনী চৌধুরী বাসায় চলে গেছে। আমজাদ চৌধুরী দুজনের বেডের মাঝখানের ফাকা যায়গায় বসে আছে। আশমিন কয়েকবার বিরক্ত চোখে তাকালেও সে সেভাবেই বসে আছে। আশমিন ও আর কথা বাড়ায় নি।কেবিনে সানভির সাথে এক মহিলার প্রবেশ ঘটতেই ভ্রু কুচকে ফেললো আমজাদ চৌধুরী।তার জানা মতে আশমিনের খবর গোপন রাখা হয়েছে। তাহলে এই মহিলা কে?তাদের পরিচিত কেউ তো মনে হচ্ছে না।
মহিলাটি গিয়ে আশমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আশমিন চোখ খুললো। মিষ্টি হেসে কুশল বিনিময় করে বসতে বললো তাকে।সানভি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অমি অফিসে গিয়েছে। নূরের অবর্তমানে সেই সব কিছু সামলাচ্ছে। আশমিন তার বাবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— আব্বু, ইনি মায়া আন্টি। ওনার সাথেই আগামী শুক্রবার বিয়ে হবে তোমার।
আমজাদ চৌধুরী নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলেন না। ছেলের এই পাগলামি আর মেনে নেয়া যাচ্ছে না। চিৎকার করে বললো,
— একদম বারাবাড়ি করবে না আশমিন।পাগলামির একটা লিমিট থাকে। এসব বলতে তোমার বিবেকে ভাধছে না?তোমার মা শুনলে কতটা কষ্ট পাবে ভেবে দেখেছো? আমাকে রাগীয়ে দিয় না আশমিন।আমি যদি আদর করতে পারি তাহলে শাসন ও করতে পারবো।
আশমিন তার বাবার চোখের দিকে তাকালো। আশমিনের চোখে আজ শুধু ক্ষোভ তার বাবার প্রতি।আশমিন আমজাদ চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে ভয়ংকর ঠান্ডা গলায় বলল,
— তাহলে পচিশ বছর আগে কেন শাসন করো নি আব্বু?তখন যদি শাসন করতে তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। আর মিসেস চৌধুরীর স্বামী হারানোর কোন ভয় নেই।থাকলে সে অন্যের স্বামী এভাবে কেড়ে নিতো না(তাচ্ছিল্যের হেসে) । আমার মুখ খুলিও না আব্বু।তাতে শুধু ধ্বংস ই হবে। বিয়ের জন্য তৈরি হও।নিজেকে ঠিক ততটা উৎফুল্ল করো যতটা নিজের প্রথম বিয়েতে ছিলে। বছর ঘুরতেই নূরের জন্য ননদ চাই।আর এটাই আপাতত তোমার শাস্তি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।