লাজুকপাতা | পর্ব – ৯

নাজমা ভাবী এক মাস পর আমাকে একটা খাম দিলেন। দেয়ার সময় খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন। বললেন,
“কম হলে জানাবে জরী। আরেকটু বেশী দেয়া উচিত ছিলো আসলে…
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
“ধ্যাৎ! কী বলছেন ভাবী! ”
“অনেক ধন্যবাদ জরী। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। বিকেলে এই দুটোকে নিয়ে টিউশনে দৌড়াতে গেলে আমার অনেক সময়ও নষ্ট হয়। এখন সন্ধ্যের মধ্যেই কাজ শেষ করে একটু রেস্ট নিতে পারি। ”
আমি স্মিত হাসলাম। ভাবীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি খুব। খাকি খামে পাঁচশ টাকার পাঁচ টা নোট! আমি আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। আমি টাকাটা নাবিদ কে দিতে চাইলাম,কিন্তু ও নিলো না। বলল,
“তুমি খরচ করো জরী। যা কিনতে মন চায় কিনো। ”
আমি টাকাটা খরচ করলাম না। আলমারিতে ছোট ব্যাগে রাখলাম। নাবিদ আমাকে প্রতি মাসে কিছু টাকা দেয় খরচের জন্য। সেটাও জমাই।
আম্মা জিজ্ঞেস করলেন,
“নাজমা নাকি পড়ানোর জন্য তোমাকে টাকা দিছে?”
আমি তখন মাছ ভাজতে ব্যস্ত। বললাম,
“কত দিছে?”
“আড়াই হাজার। ”
“কি করছ টাকা? ”
“আমার কাছে আছে। ”
“নাবিদ কে দাও নাই?”
“দিয়েছিলাম। কিন্তু ও নেয় নি। ”
আম্মা গম্ভীর মুখে বললেন,
“ওহ। ”
আম্মা পরদিন সকালে বললেন,
“জরী এইদিকে আসো, নাজমারে বলবা পরের মাস থেকে তিন হাজার দিতে। ”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন আম্মা?”
“দুইজন রে পড়াইতেছ না। ও তো তোমারে ঠকাইতেছে। আমি খোঁজ নিছি, এমন ই নেয় সবাই। ”
আমি স্বভাবসুলভ আচরনের কারণে কোনো কথা বললাম না। বিকেলের দিকে আম্মা বললেন,
“জরী তোমার কাছে দুইশ টাকা হবে?”
“হবে আম্মা। ”
দুইশ টাকা দেবার পর বললেন,
“টাকা, পয়সা সাবধানে রাখবা। ময় মুরব্বিদের কাছে টাকা থাকলে খোয়া যায় না। তোমরা হইলা গিয়া সিধা টাইপ। ”
আমি কিছু বললাম না।
পরদিন মনি আমার ঘরে এলো। প্রয়োজন ছাড়া ও আমার ঘরে আসে না। নরম গলায় বলল,
“ভাবী কি করেন?”
“কিছু না। শুকনো জামা কাপড় গোছাচ্ছি। ”
মিনিট দুয়েক খাটের উপর বসলো। বলল,
“ভাবী আপনার কাছে টাকা হবে?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আরও তিনশ টাকা গচ্চা গেল।
মনটা ভীষণ খারাপ হলো। সারাদিন আমার এতো মন খারাপ হলো যে ভালো করে কিছু খেতেও পারি নি। হোক পাঁচশ টাকা, তবুও এই টাকাটা আমার কাছে স্পেশাল ছিলো।
মন খারাপের দিনে এক পশলা বৃষ্টির মতো পরী আপা এসে হাজির হলো। আপা এবার শুধু নোটন কে নিয়ে এসেছে। দুলাভাই আসতে পারে নি ব্যস্ততার কারণে।
আপাকে দেখার কারণে পাঁচশ টাকার কষ্ট টা আমি ভুলে গেলাম।
আপা আমার সমস্যার কথা শুনে বললেন,
“ভুলেও এই কথা নাবিদ কে বলবি না। সংসারের কোনো কিছুই ওর কানে তুলবি না। যেমন যাচ্ছে যেতে দে। তোর পাঁচশ টাকা আমি তোকে দিয়ে যাব। মন খারাপ করিস না। ”
আপা রাতে খেয়ে গেলেন না। এসেছিলেন একটা বিশেষ কারণে। বিয়ের সময় আমাকে তেমন কিছু দিতে পারে নি। দুলাভাই এর হাতের অবস্থা ভালো ছিলো না তখন। তাই এখন এক জোড়া কানের দুল নিয়ে এসেছে। কানের দুল টা খুব সুন্দর। ডিজাইন টা ভালো। আম্মার চোখ কপালে উঠে গেল কানের দুল দেখে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন,
“তোমার দুলাভাইর আয় রোজগার তো ভালোই। তাই তোমার বোন খরচ করতে পারে। ”
আমি কিছু বললাম না সেই কথার জবাবে।
***
বাড়িতে নতুন ঝামেলা শুরু হতে যাচ্ছে। জামিল ভাইয়ের ঝামেলা তো ছিলোই সেই সঙ্গে আরেক ঝামেলা যুক্ত হচ্ছে। আম্মার কথায় নাবিদ মনি, মুক্তা দুজনকেই মোবাইল কিনে দিলো। সেই ফোন সবসময় ই দুজনের হাতে থাকে। দিনরাত ফোন নিয়ে বসে থাকে। কখনো গান দেখছে, কখনো ভিডিও দেখছে।
এসবের সঙ্গে যুক্ত হলো মনির সারাক্ষণ ফোনে কথা বলা। বাথরুমে গেলেও ফোন টা কানে থাকে। কী বিশ্রী অবস্থা! এভাবে অনেক দিন ধরে চলছে। এসব দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু পরী আপা নাবিদ কে বলতে বারন করেছে।
একদিন নাজমা ভাবী বলল,
“তোমার বড় ননদের খবর জানো কিছু? ”
“না ভাবী। সারাদিন এতো ব্যস্ত থাকি যে কারোর খোঁজ নেবার সুযোগ পাই না। ”
ভাবী নিচু গলায় বলল,
“খবর ভালো না জরী। কাওরান বাজার মাছ বেঁচে এমন একজনের সাথে তার প্রেম হইছে। সেই ছেলে সন্ধ্যের পর বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করে। ”
আমি অবাক হলাম। সত্যতা যাচাই করতে একদিন ছাদে গিয়ে সন্ধ্যেবেলা দাঁড়ালাম। কালো, রোগামতন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে চোরের মতো। একটু পর মনি বের হলো। সাদা, নীল জর্জেটের জামা পরা।
পরের দিনের ঘটনাও একই রকম। সামনের বিল্ডিং এর তানিয়াদের বাসায় যাই বলে সেজেগুজে বেরিয়ে গেল। গেটের ওখানে ওই ছেলেটা দাঁড়িয়ে। মনি আগে আগে গেল, ছেলেটা পিছনে।
আমি পরী আপার কথা শুনলাম না। নাবিদ কে জানালাম। নাবিদ এক সন্ধ্যেবেলা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাই কে আপনি? প্রতিদিন নাকি এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। কাউকে খোঁজেন?”
ছেলেটা আমতা আমতা করতে লাগলো। এরমধ্যে মনিও বেরিয়ে আসলো। নাবিদ স্বভাবসুলভ ভ্রু কুঁচকে মনিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
বেচারি ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে নি। নাবিদ সেদিন যথেষ্ট শাসন করলো। আম্মা মেয়ের পক্ষ না নিলেও চুপ করে রইলেন। তার দিন দুয়েক পর সেই মেছো ছেলেটার সঙ্গে মনি পালিয়ে গেল। যাবার আগে আম্মার আলমারি থেকে তার জমানো টাকা আর মুক্তার এক জোড়া জুতা নিয়ে গেল।

চলবে…

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।