পরী আপাও দুই তিন দিনের ছুটি নিয়ে পলাশবাড়ী চলে এলো। মা খুব খুশি হলেন। আপার কারণে আমার আরও কয়েকদিন থাকা হলো। নাবিদ অবশ্য রেগে যায় তাতে। ও দুদিনের ছুটি নিয়ে আমাদের নিতে আসতে চায়। আমি আজ না কাল, কাল না পরশু করে আরও পাঁচ দিন বেশী থাকি।
পরী আপা আসার পর আনন্দের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। টাপুর টুপুরও নোটন কে পেয়ে ভীষণ খুশি। এখানে আসার পর মেয়েদুটো আরও বেশী হুটোপুটি করছে। কাদামাটি গায়ে মেখে খেলছে, হাসতে হাসতে জোয়ারের পানিতে গোসল করছে, বাড়ির অন্য বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বন বাদারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কিছুতেই বাঁধা দেই না। মা রেগে যান। বলেন, আমি ওদের খেয়াল রাখি না, ওদের লক্ষিছাড়া চেহারা দেখে আম্মা কী ভাববেন!
***
নাবিদ চলে আসে একদিন না জানিয়ে। অফিস করে রাতের ট্রেনে রওনা দেয়। ভোরবেলা পলাশবাড়ী স্টেশনে এসে নামে। আমাকে ফোন দিয়ে বলে,
“কাউকে একটু পাঠাও তো জরী, আমার একা যেতে লজ্জা লাগছে। ”
আমি পরী আপাকে বলি কাউকে পাঠাতে। নাবিদ একা আসতে লজ্জা পায়। নিরু আপা এই নিয়ে হাসাহাসি করে ভীষণ।
নাবিদ আসার পর জামাই আদরে যেন ত্রুটি না হয় তাই একটার পর একটা খাবার মা বানাতে থাকেন। এই পিঠে বানাচ্ছেন, মিষ্টি তৈরী করছেন। বিলের মাছ ধরা হচ্ছে, মাচার শাক কাটা হচ্ছে। বাবা দৌড়ে যান বাজারে তাজা মাছ কিনতে। চূড়ান্তরকম আতিথেয়তায় নাবিদ বিরক্ত হয়ে বলল,
“এই জরী, তুমি কী বাড়ির লোক কে বলেছ আমি রাক্ষস! আরে এতো খাবার আমি কিভাবে খাব! এতো খাওয়া যায়!”
নিরু আপা আসেন সস্তা রসিকতা করতে। পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করে বলে,
“কী খবর দুলামিয়া, তোমার বউ কী এমন জাদুটোনা করছে! দুইদিন হইলো না, চইলা আসলা।”
নাবিদের কপাল কুঁচকে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো কাশে। আমি বুঝতে পারি যে নিরু আপার রসিকতা ওর পছন্দ হয় না। অরুর সঙ্গে নাবিদের আচরণ সহজ সরল। ছোট বোনের সঙ্গে ভাইয়ের আচরণ যেমন থাকে তেমন। অরুও আমাদের দুই বোনের মতোই। নিজের সীমার মধ্যে থাকে।
সারাদিনের আদরমাখা অত্যাচার থেকে নিস্তার পেয়ে নাবিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর নাক দিয়ে চেপে ধরে আমার নাক। আমার নি:শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়, সরিয়ে দিতে চাইলেও সরে না। এক পর্যায়ে ছেড়ে দেয়। আমি বুক ভরে নি:শ্বাস নিয়ে বলি,
“তোমার রকমসকম তো সুবিধার না মোটেও। মেরে ফেলার জন্য এসেছ।”
নাবিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বলে,
“তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন! এত্তো দিন আমাকে ছাড়া থাকলে জরী? কেমনে পারলা…!”
আমি মৃদু হাসি। নাবিদ আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“এই কয়দিনে আমি না পারছি খেতে, না পারছি ঘুমাতে। আর তুমি হাসো!”
“আম্মার রান্না আমার মতো মজা হয় নাই এজন্য ঘুমাতে পারো নাই, খাইতে পারো নাই ক্যান? ”
“ঘুমাব কেমনে! পাশ ফিরে নরম তুলতুলে পাশ বালিশ টা তো পাই না। ”
আমি হেসে ফেললাম। নাবিদও হাসলো।
***
নাবিদ তিন দিনের বেশি থাকতে পারে না। আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরী আপা আরও দুদিন পর যাবেন। নোটনের ঠান্ডা লেগেছে। এই অবস্থায় মা কিছুতেই ছাড়বে না।
চাচাজান টাপুর টুপুরের জন্য জামা কিনে আনেন বাজার থেকে। সুন্দর জামা পরেও টাপুর টুপুর এর মুখ ভার। ওরা আরও ক’দিন থাকতে চায়। নাবিদ কে বলে,
“কাকাই, তুমি আসতে গেলা কেন? আমরা আরও কয়টা দিন থাকতাম। ”
নাবিদ আমার সঙ্গে কপট দেখিয়ে বলে,
“এই দুটো তো একদম তোমার মতো হইছে জরী, কী অবস্থা! ”
আসার সময় মা আমাকে বলে,
“মেয়ে দুটোর খেয়াল রাখিস। যতই দুষ্টমি করুক, তুই কিন্তু রাগ করবি না। নিজের মেয়েদের যেমন দেখতি, ওদেরকে তেমন দেখিস। ”
আমি হাসি। মা আমার স্বভাব জানেন। তবুও বারবার বলে দেন। আসার সময় আমি মায়ের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে গেলাম। মা ভীত গলায় বলে,
“কিছু বলবি?”
আমি মায়ের হাতে একটা বান্ডেল দেই। একশ টাকার কড়কড়ে একশোটা নোট। ব্যাংক থেকে নতুন নোট তোলা। মা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেন,
“কিসের টাকা জরী?”
আমার মায়ের হাত ধরে বলি,
“আমার উপার্জনের টাকা মা। তোমাকে দিলাম। তুমি ইচ্ছেমতো খরচ কোরো। ”
“তোর এতো কষ্টের টাকা! আমায় এভাবে কেন দিচ্ছিস! ”
“মা তুমিও অনেকবার তোমার কষ্টের টাকা দিয়েছো তো। ”
কলেজে উঠে সায়েন্স পড়তে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। এক ধাক্কায় খরচ বেড়ে গেল। স্কুলে ভালো রেজাল্ট এর কারণে টিউশন ফি না লাগলেও কলেজে লাগলো৷ মাসে দুই হাজার টা। চাচাজান এতো টাকা দিবেন না, তিনি আর্টসে ভর্তি হতে বললেন। আমি তখন রোজ কাঁদতাম। পরী আপা মা’কে বোঝায়, মা রেগে গেলেও সেই টাকার যোগান দেন। মামাবাড়ি থেকে জমি লাগানো বাবদ কিছু টাকা বছরে পায়। এছাড়া কাঁথা সেলাই করতেন, কুশি কাটায় ব্যাগ বুনতেন। সেই টাকা দিয়ে আমার টিউশন ফি দেয়া হয়। ডানো দুধের কৌটোয় মায়ের জমানো টাকা থাকতো। মাসের শুরুতে সেই টাকা গুনে গুনে দিতেন। একদিন বড় ফুপু মা’কে বলেন,
“এইভাবে টাকাগুলো খরচা না করে মেয়েরে সোনার জিনিস বানায়ে দিতা। এতো পইড়া কী হবে, তোমার মেয়ে কী চাকরি বাকরি করে তোমারে দেখবে। ”
মা বললেন,
“সোনা, গয়না কপালে থাকলে শ্বশুরবাড়ি থেকে দিবে। আর পড়ালেখা জানা থাকলে কাজে আসবে, আর কিছু পারুক না পারুক। নিজের পোলাপান পড়াতে তো পারবে। ”
সেই মাসে টাকা নেবার সময় আমি মনে মনে বললাম,
“জীবনে আল্লাহ আমাকে আর কিছু দিক না দিক, মায়ের এই কৌটো ভরে টাকা দেবার সামর্থ্য যেন দেন।”
মা আমাদের তিন বোন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। আমরাও কাঁদি।
আমার যাবার সময় হয়। সবার মুখ থমথমে। নিরু আপার চোখ ছলছল করে। আমি বলি,
“ঢাকা বেড়াতে যাইয়ো আপা। তোমার না চিড়িয়াখানায় যাবার শখ। ”
নিরু আপা হেসে বলেন,
“তোগো মতন এমন কপাল নাই রে জরী। আমাগো ব্যটাগুলান বউয়ের শখ, আহ্লাদ কম বোঝে। ”
বাবা আসেন স্টেশন পর্যন্ত। টাপুর টুপুর কে চকলেট কিনে দেন। বাবা আমার ই মতন। সেও কিছু বলতে পারেন না, আমিও পারি না।
ট্রেন ছাড়ার পর নি:শব্দে কাঁদি। নাবিদ আমার কাঁধে হাত রাখে। টাপুর বলে,
“কান্না কইরো না কাকীমনি। আমরা আবার যাব। আবার পরীক্ষা হইয়া যখন স্কুল ছুটি হবে আমরা আবার যাব। ”
আমি হাসার চেষ্টা করি।
***
বাড়িতে যাবার পর আম্মার সাথে আমার কথা হয় নি একবারও। মুক্তার সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল। কিন্তু আম্মাকে আমি ফোন করিনি, সেও আমাকে ফোন করে নি।
ট্রেন জার্নির পর দীর্ঘ সময় গাড়ির জার্নিতে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। বমিও হয়ে গেল। সেই সঙ্গে অসহ্য গরম। আমাকে ঘরে ঢোকানো হলো ধরে। আমি বিছানায় শুয়ে রইলাম চোখ বন্ধ করে। আম্মা আমার জন্য লেবুর শরবত আনলেন। নিজ হাতে খাইয়েও দিলেন। সেদিন তার সঙ্গে আর কথাবার্তা হলো না। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলোও দেরি করে। নাবিদ অফিসে যাবার আগে ডেকে ঘুম ভাঙিয়েছে।
আমি রান্নাঘরে যেতেই আম্মা বললেন,
“গরমে এইদিকে আইসো না, ঘরে যাও। মুক্তা খাবার দিয়ে আসবে। ”
আমি টেবিলে বসি। প্লেট নিয়ে নিজেই খাবার বাড়তে যাই। আম্মা এগিয়ে আসেন। খিচুড়ি আর ডিমভাজা। লেবু আর কাচামরিচ এগিয়ে দেয়। হঠাৎ আমার কপালে হাত রেখে বলে,
“জ্বর আসে নাই তো! খাও আস্তে আস্তে। খিচুড়ি তুমি ভালো খাও তাই তোমার জন্য খিচুড়ি করছি। খাওয়া শেষ হইলে বিশ্রাম নাও। দুই তিন দিনে তোমার কোনো কাজ করার দরকার নাই। তুমি বিশ্রাম নাও। ”
আমি বিস্মিত হই। কঠিন মহিলার এমন নরম আচরণ আমাকে অবাক করে। আমার মনে হয় ক’টা দিন যে ছিলাম না তখন সে আমাকে মিস করেছে।
চলবে…