ইট পাটকেল | পর্ব – ৭

বিয়ের ছয় মাসের মাথায় কামিনী চৌধুরী হঠাৎ করেই নিজের আগের রুপে ফেরা শুরু করে। কথায় কথায় নূর কে অলক্ষি অপয়া বলে অপমান অপদস্ত করতে থাকে।নূর তাতে খুব একটা পাত্তা দেয় নি।নিজের মতো করে জীবন কাটাতে থাকে সে।আশমিন কিংবা রাফসান শিকদার কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলতো না নূর।এর মধ্যেই তাদের জীবনে আবির্ভাব ঘটে লারা নামক রমনীর।কানাডায় আশমিনদের প্রতিবেশি ছিল তারা।লারা আশমিন কে ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতো। তবে এক আশমিনে মজে থাকার মেয়ে লারা না।কানাডায় আরো অনেক ছেলেদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। ম্যাডিসন নামের এক ছেলের সাথে দুই বছর লিভ ইন রিলেশনে ছিল সে।কিছুদিন আগে কামিনী চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ হলে কামিনী চৌধুরী আশমিনের কথা বলে লারা কে।
এ ও বলে যে,কয়েকদিন পরেই আশমিনের ডিভোর্স হয়ে যাবে।আশমিন কে পেতে চাইলে লারা যেন বাংলাদেশে চলে আসে। লারা ও ম্যাডিসন কে কিছু না জানিয়েই বাংলাদেশ চলে আসে।লারার বাবা মা ও মেয়ে কে পূর্ণ সমর্থন করে। লারার বাবা কানাডার অনেক বড় বিজনেস ম্যান।ভাইয়ের সম্পত্তি তো এখন তাদের ই। সাথে লারার টা পেলে সোনায় সোহাগা। কামিনী চৌধুরীর এর কুৎসিত পরিকল্পনার কথা কেউ জানতে পারলো না।কয়েকদিনের মধ্যেই লারা এসে হাজির হলো নূর মঞ্জিলে।বিষয়টা নিয়ে কেউ মাথা না ঘামালেও গম্ভীর হয়ে রইলেন আমজাদ চৌধুরী।এতিম আমজাদ চৌধুরী পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় স্কলারশিপ নিয়ে যায় কানাডায়। বাবা মা মারা যাওয়ার পর নিজেদের অনাথ আশ্রমেই বড় হয় সে।পুর্নবয়স্ক না হওয়ায় বাবার সম্পত্তি সব ম্যানেজার সামলাতো।বিশ বছর বয়সে সম্পত্তি সব নিজের নামে আসার পর বাংলাদেশের বিজনেস গুটিয়ে কানাডায় পারি জমায় আমজাদ চৌধুরী।দেশের অনাথ আশ্রম সে নিজের আরেকটা ঘর মনে করে। অনাথ আশ্রমের দায়িত্বে থাকা ফাদার দেখাশোনা করে সব কিছু। সমস্ত খরচ আমজাদ চৌধুরী নিজেই চালায়। কানাডায় গিয়েই কামিনী চৌধুরীর সাথে পরিচয়। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন কামিনী চৌধুরী কে। রাফসান শিকদার ও তাতে আপত্তি করে নি।বাবা মা মরা বোন কে সে খুব আদরে মানুষ করেছে।তাই তার সুখ ই মূখ্য। দুজনে একসাথেই কানাডায় পড়াশোনা করতো। কখনো বুঝতেই পারে নি তার প্রেয়সীর ভিতরে এতো কুৎসিত।
লারা আসার পর থেকে আশমিন খুব কম কথা বলতো লারার সাথে। নির্বাচন মাথায় নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছে রাফসান শিকদার ও আশমিন।বিরোধি দলিয় নেতা আয়মান তালুকদার উঠে পরে লেগেছে তাদের পেছনে। আশমিনের চমৎকার বুদ্ধিমত্তার জন্য কিছুতেই পেরে উঠছে না। তবে হাতে গুটিয়ে বসে নেই সে।শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষা। নির্বাচনী প্রচারণর জন্য নূর কেউ খুব একটা সময় দিতে পারছিল না আশমিন।বহু কষ্টে সময় বের করলেও লারার জন্য তা কোন না কোন ভাবে নষ্ট হয়ে যেত।আশমিন রেগে কিছু বলতে গেলে নূর তাকে থামিয়ে দিত।বাড়ির মেহমানের সাথে এমন আচরণ মোটেই শোভনীয় নয়।সেই সুযোগ ই লুফে নিতে লাগলো লারা।দূরত্ব সৃষ্টি হলো আশমিনের সাথে নূরের।মাঝে মাঝে রাতেও দেখা হতো না দুজনের। গভীর রাতে এসে আবার ভোরেই বেড়িয়ে যেতো আশমিন। অন্তর্মুখি হওয়ায় নূরের খুব একটা বন্ধু ছিল না।একমাত্র তানভীর সাঈদ ই ছিল নূরের ছোট বেলার বন্ধু। দুজন দুজনের প্রাণ টাইপের বন্ধুত্ব তাদের।
তাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় হয়ে আসে তানভীরের জন্মদিনের দিন।রাতে পার্টি থাকায় নূর আর কলেজে যায় নি।সারাদিন বাসায় থাকার প্ল্যান করে সে।বাবার সাথে ও খুব একটা দেখা হয় না তার।একাকিত্বে অভ্যস্ত সে।তবে মাঝখানে আশমিনের যত্ন তার অভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এখন খুব শূণ্যতা অনুভব হয় আশমিন কে ছাড়া। নিজের রুমের বারান্দায় বসে ছিল নূর। ফোনের ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠতেই ভ্রু কুচকে গেল তার। এসময়ে আবার কে ম্যাসেজ দিচ্ছে? মন্ত্রী সাহেব নয়তো? মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে মেসেজ অপশনে ঢুকতেই চোখ স্থির হয়ে গেলো নূরের।ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আশমিন আর একটা মেয়ের অন্তরঙ্গ ছবি। কোন এক অভিজাত হোটেল রুমে বিবস্ত্র এক নারী কে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে আশমিন। এতটা ঘনিষ্ঠ আজ পর্যন্ত তারা ও হয়ে উঠে নি। নির্লিপ্ত ভাবে চোখ সরিয়ে নিলো নূর। ফোনটা যায়গা মতো রেখে আগের মতো প্রকৃতিতে বিভোর হলো সে।সন্ধ্যায় রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো তানভীরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। নূর কে বোনের নজরেই দেখে তানভীর। জজন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় দশটায়। অথচ নূর জানতেই পারলো না সন্ধ্যা সাতটায় তার একমাত্র অবলম্বন তার বাবা তাকে ছেড়ে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে সন্ত্রাসীদের গু*লিতে।কয়েক হাজার কল এসে জমা হয়েছে নূরের ফোনে।আশমিনের লাস্ট ম্যাসেজ ছিল,
“কোথায় তুমি নূর?যেখানেই থাকো তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসো।মামার গু*লি লেগেছে।তোমাকে দেখতে চাইছে।নাহয় আমাকে বলো কোথায় আছো?আমি তোমাকে পিক করছি।একা বের হওয়ার দরকার নেই। প্লিজ ফোন রিসিভ করো জান আমার।আমার খুব টেনশন হচ্ছে”
মিনিট কয়েক পরেই আশমিনের ফোনে ম্যাসেজ এলো,
“আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি ব্যস্ত আছি।এখন আসতে পারবো না। গু*লি ই তো লেগেছে।মরে তো আর যায় নি।আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।গীতিকারের সাথে কথা বলছি।সব ঠিক থাকলে আজকেই আমার ক্যারিয়ারের সূচনা হয়ে যাবে।আপনার অনুপস্থিতিতে এই গান ই আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। তাই সবার আগে আমার ক্যারিয়ার”
শক্ত চোখ ম্যাসেজ পড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো আশমিন।এটা নূরের ম্যাসেজ নয়।হতে পারে না। তার নূর এমন কথা কিছুতেই বলতে পারে না। কোথায় নূর?
এদিকে নূরের অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা বারান্দা থেকে তুলে নিয়েছে কামিনী চৌধুরী। আশমিন কে ম্যাসেজ সেই করেছে। লারা তানভীরের সাথে নূরের কয়েকটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল কামিনী চৌধুরীর কাছে। কামিনী চৌধুরী নূরের ফোন থেকে সে ছবি আশমিনের মোবাইলে সেন্ড করে দিল। ছবি দেখার আগেই খবর এলো ব্যস্ততম পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে রাফসান শিকদার। ঘামে লেপ্টে যাওয়া শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো আশমিন।আমজাদ চৌধুরী ও স্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু হাপ ছেড়ে বাচলো কামিনী চৌধুরী। এই বিশাল সম্রাজ্য এখন তার।একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক করতে না পারলে ও কান্নার অভিনয় করলো পাক্কা অভিনেত্রীদের মতো। হাসপাতালের বারান্দায় ভাইয়ের শোকে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করা বোনের আর্তনাদ ফলাও করে প্রচার করা হলো। আশমিন এসে সামলে নিলো মা কে।
আমজাদ চৌধুরী স্ত্রীর অভিনয় বুঝেও চুপ করে রইলেন। মৃতদেহ নিয়ে নূর মঞ্জিলে পৌছানোর একঘন্টা পরে বিধ্বস্ত অবস্থায় খালি পায়ে দৌড়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো নূর।নিউজ দেখে সে দৌড়ে এসেছে সারা রাস্তা।পা থেকে রক্ত ঝড়ছে সমানে।সেদিকে হুস নেই নূরের।বাবার মৃতদেহের সামনে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো নূর।কাপা কাপা হাতে হাত বুলিয়ে দিলো বাবার শান্ত মুখশ্রী তে।লাশের বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আজ থেকে এই বুকটা চিরদিনের মতো হারালো সে।তার আব্বু আর নেই ভাবতেই নিঃশ্বাস আটকে আসছে নূরের।তার থেকে কয়েক হাত দূরত্বে বসে আছে আশমিন।তার পাশেই গা ঘেঁষে বসে লারা।সেই মুহুর্তে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষের পরিচয় দিল কামিনী চৌধুরী। নূর কে টেনে সরিয়ে নিলো রাফসান শিকদারের বুক থেকে।পর পর কয়েকটা চর লাগিয়ে দিল তার গালে।আসার পর থেকে একবিন্দু পানি ও চোখ থেকে বের হয় নি নূরের।থাপ্পড় খেয়েও সে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন চোখ সরিয়ে নিলো তার থেকে।নূর নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো আশমিনের মুখ ফিরিয়ে নেয়া।আরেকদফা শক্ত করলো নিজেকে।কামিনী চৌধুরী একের পর এক অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে তার উপরে।
— বেহায়া চরিত্রহীন মেয়ে মানুষ। বাবার মৃত্যুর আগেও তার সাথে দেখা না করে পরপুরুষের সাথে রঙঢঙ করে এখন এসেছে নাটক করতে।নষ্টা মেয়ে কোথাকার।লজ্জা করে না এমন নোংরামি করতে।আমার ভাইয়ের আসেপাশে ও আসবি না তুই।তোর এই কলঙ্কিনী মুখ নিয়ে বেড়িয়ে যা এখান থেকে।
কামিনী চৌধুরীর দিকে একপলক তাকিয়ে নূর আশমিনের সামনে গিয়ে দাড়ালো। শান্ত গলায় বললো,
— আপনার কিছু বলার আছে মন্ত্রী সাহেব?
আশমিন একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকালো নূরের দিকে। ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
— যে মেয়ে নিজের বাবার ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না সে আমার ভালোবাসার মূল্য দিবে কিভাবে।বাবার মৃত্যু থেকে যার ক্যারিয়ার বড় সে মেয়েকে আমি আমার জীবনে চাই না। দেখা গেলো আমাকে মৃত্যু মুখে রেখে সে নিজের স্বপ্ন পুরন করতে চলে গেলো। এই নূর কে আমি ভালোবাসি নি।তাই এই নূরের জায়গা আমার জীবনে নেই। গো টু হেল উইথ ইয়োর ফা*কিং ড্রিম।
নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। তার চোখে বাবা হারানোর শোক নেই।স্বামীর প্রতারণা, অবিশ্বাস, ধোকা কোন কিছুর জন্য কোন অনুভূতি নেই। চোখে নেই একবিন্দু নোনাজল। আশমিনের সামনে থেকে বাবার লাশের পাশে গিয়ে বসলো নূর।বাবা কে জরিয়ে ধরে ক্লান্ত গলায় বলল,
— তুমি মানুষ চিনতে ভুল করেছো আব্বু।অযোগ্য মানুষের হাতে নিজের মূল্যবান রত্ন তুলে দিয়েছো।আমাদের শেষ দেখা টা সুখকর হলো না আব্বু। যে শূণ্যতা নিয়ে তুমি চলে গিয়েছো আমাকে তা সারাজীব বয়ে বেরাতে হবে।পরপারে ভালো থেকে আমার সুপার হিরো।আমি তোমার রত্নের যত্ন নিবো।
কামিনী চৌধুরী তেড়ে আসতে নিতেই আমজাদ চৌধুরী তাকে শক্ত হাতে থামিয়ে দিল।ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিল ফলাফল ভালো হবে না। স্বামীর কড়া চাহনিতে থেমে গেলো কামিনী চৌধুরী। কটমট করে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে।
বাবার কপালে চুমু খেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো নূর।রাফসান শিকদার কে দাফন করতে নিয়ে যাওয়ার সময় ও নিচে আসেনি সে।তানভীর সারাটা সময় চুপচাপ সব কিছু দেখে যাচ্ছিল। নূরের এই শান্ত ব্যবহার ভাবাচ্ছে তাকে।নূরের পিছুপিছু সেও এসেছিল এখানে।কামিনী চৌধুরীর নূর কে আঘাত করার সময় যখন সে রেগে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন নূরের ইশারায় থেমে যায় সে।তখন থেকে সারা শরীর রাগে জ্বলছে তার।
রাফসান শিকদারের দাফন শেষ হলো রাত দুই টায়।দলীয় নেতা সহ হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেছে।বিরোধী দলীয় নেতা আয়মান তালুকদার ও এসেছে জানাজায়।সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো খু*নিকে ধরার জন্য। আশমিন হিংস্র বাঘের মতো শত্রুদের একে একে শেষ করতে লাগলো। তবুও কোথাও কোন লিংক পাওয়া যাচ্ছিল না।সারারাত বাইরে কাটিয়ে ভোরে বাসায় আসে আশমিন।রক্তজবার মতো লালা চোখ নিয়ে রুমে ঢুকেই শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য বাবা হারানো মেয়েটির দিকে ফিরে ও তাকায় না।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় সে। সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নূর।চোখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গুন গুন করে লতা মঙেস্কারের গাওয়া গানের কয়েকটা লাইন গাইলো,
Lag ja gale ke phir yeh
Haseen raat ho na ho…
Shayad phir iss janam mein
Mulaqaat ho na ho
Lag ja gale… ae… ae…
Humko mili hain aaj yeh
Ghadiyaan naseeb se
Humko mili hain aaj yeh
Ghadiyaan naseeb se
Jee bhar ke dekh leejiye
Humko qareeb se
Phir aap ke naseeb mein
Yeh baat ho na ho…
Shayad phir is janam mein
Mulaqaat ho na ho
Lag ja gale… ae… ae…
কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো আশমিনের চোখ থেকে।তানভীরের সাথে নূরের ছবি গুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।নূর কে সে অবিশ্বাস করছে না।তবে এই মুহুর্তে নূর কে বাচাতে তাদের মধ্যে দূরত্ব জরুরি। যতই কষ্ট হোক না কেন, কাল পর্যন্ত অপরাধী কে বোঝাতে হবে তার জ্বালে আশমিন ফেসেছে।নূরের প্রতি দুর্বলতা দেখালেই সে নূরের উপর আক্রমণ করবে।অজানা শত্রু কে আর সুযোগ দেয়া যাবে না।
বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে আশমিন। এত বড় প্রাপ্তিতে ও তার চোখে মুখে খুশির লেশ মাত্র নেই।পার্টি অফিসের সমস্ত কাজ শেষ করে বাসায় আসতেই ভ্রু কুচকে গেলো তার। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে আছে।একমাত্র কামিনী চৌধুরী আর লারা কেই প্রফুল্ল দেখালো।আমজাদ চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছে। আশমিন খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসে পরলো। চারিদিকে ফুলের তোড়ায় ভরে গেছে। সবাই শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুল পাঠিয়েছে।
— নূর কোথায় আব্বু?
— তাকি দিয়ে তোমার কি দরকার?
আমজাদ চৌধুরীর কর্কশ গলা শুনে থতমত খেয়ে গেল আশমিন।অজানা ভয়ে বুক কেপে উঠলো। বার কয়েক নূর কে ডেকেও যখন সারা পাওয়া গেলো না তখন আশমিন উত্তেজিত হয়ে দ্রুত পায়ে সারা বাড়ি খুজলো।আশমিনের চিৎকার শুনে কামিনী চৌধুরী সহ সবাই হাজির হলো বিশাল ড্রয়িং রুমে। আশমিন দৌড়ে এসে আমজাদ চৌধুরীর সামনে দাড়িয়ে কাপা কাপা গলায় বলল,
— নূর কোথায় আব্বু।
— চলে গেছে।
আশমিন বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আমজাদ চৌধুরীর দিকে। মহুর্তেই ভয়ের জায়গায় চোখে এসে ভীড় করলো ক্রোধ। চিৎকার করে বললো,
— চলে গেছে মানে?কোথায় গেছে নূর?আমি বলেছিলাম না নূর যাতে বাসা থেকে বের না হয়।কে বের হতে দিয়েছে ওকে?
আশমিনের ভয়ংকর রুপ দেখে কেপে উঠলো কামিনী চৌধুরী। কপালের ঘাম কাপা কাপা হাতে মুছে লারার দিকে তাকালো। তার ও একই অবস্থা। থরথর করে কাপছে সে।
আমজাদ চৌধুরী কামিনী চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাড়ালো। রক্ত চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
— মা মরা মেয়েটা তো তোমার নিজের রক্ত ছিল কামিনী।তার উপর কিসের এতো রাগ তোমার বলতে পারো? ছোট থেকে তাকে অবহেলা অপমান করে তার কোমল হৃদয় টা তুমি বিষিয়ে দিয়েছো।আমি বাধা দিলে আমাকেও কথা শোনাতে ছাড় নি।ভাইজান একটা কোমল ফুল তুলে দিয়েছিল তোমার হাতে।অথচ তুমি তার জীবন টা কাটায় ভরে দিয়েছো।এই বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারি কতবেলা না খেয়ে কাটিয়েছে তার কোন হিসেব নেই।সব কিছুতো মেয়েটা মেনেই নয়েছিল।তাহলে তাকে এভাবে ঘর ছাড়তে বাধ্য করলে কেন?তার চরিত্রে সবার সামনে দাগ লাগালে কেন?উত্তর দাও কামিনী।
স্বামীর এহেন রুপে কলিজা শুকিয়ে গেলো কামিনী চৌধুরীর।আশমিন অবাক চোখে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো কামিনী চৌধুরী।
আশমিন যেন বোবা হয়ে গেলো। টলমল পায়ে দেয়ালের উপর হাত রেখে নিজেকে সামলালো।
মরার উপর খারার ঘা হয়ে আগমন হলো তানভীরের।কারোর দিকে না তাকিয়ে নিজের ফোনটা কানেক্ট করে দিল ড্রয়িং রুমের টিভিতে। সাথে সাথেই টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠলো নূরের পরিশ্রান্ত পরাজিত মুখখানা।ভিডিও টি গাড়ির ভিতরে বসে করা।আশমিন দৌড়ে এসে দাড়ালো টিভির সামনে। কাপা কাপা হাতে ছুয়ে দিলো নূরের মুখখানা।
— জয়ের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা মন্ত্রী সাহেব। আপনার এই সাফল্য ভরা জীবনে আমার মতো অপয়া থাকা মানায় বলেন? ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয় মন্ত্রী সাহেব। ভালোবাসায় ভরসা থাকতে হয়।কোন ঠুনকো আঘাত যদি তা ভেঙ্গে দেয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে কোন ভালোবাসা ছিল না।পুরো টাই অভিনয় বা মোহ।আপনার বেলায় ঠিক কোনটা বুঝতে পারছি না। আপনি যখন বলেই দিয়েছেন আমি আপনাকে আর কি ভালোবাসবো?নিজের বাবা কেই তো ভালোবাসতে পারি নি তখন আর নিজের হয়ে কোন সাফাই আমি দিবো না।আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে সমস্ত সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়ে চলে যাচ্ছি ।
প্রমাণস্বরূপ এই ভিডিও টি আপনার কাছে রেখে দিতে পারেন।যেহেতু আমাদের বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন হয়নি সেহেতু ডিভোর্স পেপার দিতে পারলাম না। ভিডিও শেষে আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে।দেখে নিবেন প্লিজ । মিসেস চৌধুরীর কে টেনশন করতে নিষেধ করবেন।আমি নামক বোঝা সারা আপাতত বিদেয় হচ্ছি।তবে আমি ফিরবো। আমার আব্বুর খু*নীদের ভয়ংকর মৃত্যু দিতে আমি ফিরবো। কিন্তু আপনার জীবনে কখনো না মন্ত্রী সাহেব। কষ্ট দিয়েছেন আমায়।অবিশ্বাসের আগুনে জ্বা*লিয়ে আমাকে মে*রে ফেলেছেন আপনি। লাশের কি কারোর প্রতি ভালোবাসা থাকে বলেন?ভালবাসার বি*ষে আপনার হৃদয় বিষাক্ত হোক এই দোয়া রইলো। আমার ফিরে আসা পর্যন্ত জীবন টাকে উপভোগ করুন।নূর ফিরে আসলে স্বস্তির নিশ্বাস নেয়া দুস্কর করে দিবে। রাফসান শিকদারের নেয়ে তেহজিব নূর শিকদারের ওয়াদা এটা।

নূরের জ্বলন্ত চোখের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো আশমিন।নূরের ভিডিও বন্ধ হতেই স্ক্রিনে সেদিনের আশমিনের ছবি গুলো ভেসে উঠলো। রাফসান শিকদারের মৃত্যুর দিন সকালেই পাঠানো হয়েছে নূরকে।আশমিন একের পর এক ধাক্কা সামলাতে পারলো না। মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেলো। অতিরিক্ত চাপের ফলে মাইনর এট্যাক হয়ে গেলো তার। আমজাদ চৌধুরী মেঝেতে লুটিয়ে পরা ছেলেকে ধরে চিৎকার করে কেদে উঠলো। সিংহের মতো দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ টাকে এভাবে দেখে সবার চোখে অশ্রুরা ভীর করলো। দেহরক্ষীরা আর তানভীর মিলে আশমিন কে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গেলো। আমজাদ চৌধুরী ছেলের সাথে যেতে নিয়ে স্তব্ধে বিমূঢ় কামিনী চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল
— আমার ছেলের কিছু হলে তোমাকে আমি নিজের হাতে খু*ন করবো কামিনী। ভুল করেও নিজের এই নোংরা চেহারা আমার ছেলের সামনে নিয়ে আসবে না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।