ইট পাটকেল পর্ব ৪০
সানজিদা বিনতে সফি
হাসপাতাল চত্তরে মানুষের ঢল নেমেছে। আশমিনের দলের কয়েকশ লোক এসে জমা হয়েছে সেখানে। সবার চেহারায় তীব্র ক্ষোভ বিদ্যমান। সাধারণ জনগণ ও এসেছে। অনেকে এসেছে তামাশা দেখতে।আবার অনেকেই প্রিয় নেতার খারাপ সময়ে ছুটে এসেছে তাকে একটু শান্তনার বানী শোনাতে। অমি, সানভি আশিয়ান, বাহাদুর সবার অবস্থা ভয়ংকর খারাপ।আশমিন নূর, আমজাদ চৌধুরী আর সুখ কে নিয়ে হসপিটাল পৌঁছাতে পৌঁছাতে নিজেই স্ট্রোক করে বসেছে। তাকে হসপিটালাইজড করতে হয়েছে সবার আগে।
পরিস্থিতি দেখে সানভি পাগলের মতো কান্না করছে। কিছুক্ষণ পর পর হাত পা ছেড়ে বসে পরছে। হাতে পায়ে সামান্য টুকু শক্তিও পাচ্ছে না সে। বাহাদুরের মতো শক্ত পোক্ত মানুষ টা ও বিধ্বস্ত চোখে শুধু ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। অমি আর আশিয়ান পাগলের মতো একবার নূরের কাছে যাচ্ছে তো একবার পাখির কাছে যাচ্ছে। আশমিনের কেবিনের সামনে কাওকে এলাও করছে না ডাক্তার। সেখানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা কড়া পাহাড়ায় আছে। পুরো হসপিটাল পুলিশের লোকেরা ঘিরে রেখেছে। তদন্ত কমিটি বসেছে । পুরো শহরে কার্ফু জারি হওয়ার মতো অবস্থা। আমজাদ চৌধুরীর অবস্থা আশংকাজনক। নূরের মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
পেটের মধ্যে কয়েকবার ধারালো ছু*রি দিয়ে আঘাত করার ফলে খাদ্যনালী অনেকটা কেটে গিয়েছে। নূরের অপারেশন চলছে। বাচার আশা ক্ষীণ। পাখি এখন কিছুটা ভালো আছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হাতের বাইরে। রফিক তার সিকিউরিটি টিমের পাচ জনের লা*শ সমস্ত ফর্মালিটি শেষ করে পরিবারের হাতে হস্তান্তর করেছে। মায়া বেগমের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। পোস্টমর্টেম করার পরে তাকে দাফন করা হবে। অমি আপাতত পোস্টমর্টেম করতে নিষেধ করেছে। আশমিনের অনুমতি ছাড়া সে এ ব্যপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর আশমিন এখন কিছু বলার অবস্থায় নেই।
আশিয়ান নিজের লোকদের লাগিয়ে দিয়েছে হামলাকারী কে খুজে বের করার জন্য। শুভ্র মুখটা রক্তজবার মতো লাল হয়ে আছে। তার চিৎকারে হসিপিটালের স্টাফরা ও কেপে কেপে উঠছে।
— আমি ওদের চাই মিজান। আকাশ থেকে আনবে না পাতাল থেকে আনবে আমি জানি না। আমি আজকের দিন শেষ হওয়ার আগেই সব কয়টা কে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। কে করেছে? কেন করেছে তার কোন এক্সপ্লেনেশন চাই না। আমার ওদের আমার সামনে চাই।পুরোপুরি জ্যান্ত। একটা আচড় ও জেন ওদের গায়ে না লাগে। বুঝেছো?(চিৎকার করে)
মিজান ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। কাপা কাপা গলায় বলল, ‘ঠিক আছে স্যার’।
আশিয়ান ফোন রেখে অপারেশন থিয়েটারের দিকে ছলছল চোখে একবার তাকালো। বাহাদুর অসহায় মুখে দাড়িয়ে আছে। আশিয়ান গম্ভীর গলায় বাহাদুর কে বলল,
— বাহাদুর,,আমাদের ব্যক্তিগত গার্ডরা যদি নাও থাকে তবুও এরকম হামলা হওয়ার কথা নয়। সরকারি ফোর্স তো ছিল। তাদের থাকা অবস্থায় এরকম হামলা হলো! তোমার কি মনে হয়?
বাহাদুর ভনিতা না করে সরাসরি বলল,
— পচিশ জন পুলিশের মধ্যে বারোজন অজ্ঞান ছিল স্যার।তাদের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি তেরো জন মা*রা গেছে স্যার। কেউ তাদের খাবারের সাথে বি*ষ মিশিয়ে দিয়েছিল। তাদের খাবার যারা তৈরি করতো তাদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
আশিয়ান একবার দূরে এদিক ওদিক ছূটতে থাকা অমির দিকে তাকালো। অমির সবসময় এমন শান্ত থাকা তাকে বারবার ভাবিয়ে তোলে। মায়ের পেটে একসাথে থাকা সত্ত্বেও তারা দুজন কতো ভিন্ন। সে পাখিকে নিয়ে এসে পাগলের মতো ব্যবহার করেছে। তার হুংকারে ডাক্তাররা পাখিকে ধরতেও ভয় পাচ্ছিল। অবশেষে কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার এসে তাকে সামলেছে। নূর আর সুখ কে নিয়ে আসার পর যখন আশমিন অসুস্থ হয়ে গেলো তখন আশিয়ান উন্মাদের মতো করেছে। সানভি তো হাউমাউ করে কেদে দিয়েছে। কিন্তু অমি ছিল শান্ত। সবাইকে সামলে নিজের দায়িত্ব গুলো কতো সহজেই না পাগল করে যাচ্ছে!
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ চলছে।
“মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর পরিবারের উপর হামলা করা হয়েছে। তাদের সবার অবস্থা আশংকাজনক। পরিবারের এই অবস্থা দেখে আশমিন জায়িন চৌধুরী নিজেও অসুস্থ হয়ে পরেছেন। তাদের এই সংকটময় মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী তাদের সমবেদনা জানিয়েছেন”
তিনদন পর জ্ঞান ফিরেছে আশমিনের। পুরো সময়টা পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কাওকে এলাউ করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাব আর ডিবি পুলিশ সারাক্ষণ পাহারায় আছে। সাংবাদিকরা দিন রাত হসপিটালের নিচে কাটিয়ে দিচ্ছে লাইভ নিউজ করে। এই পর্যন্ত পুলশ কোন ক্লু খুজে বের করতে পারেনি। তবে আশিয়ান লারা আর তার বাবা কে তুলে এনেছে। সেদিন বাড়িতে লারা এসেছিল তা সিসিটিভি ক্যামেরাতে ধরা পরেছে। কিন্তু মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর বাড়িতে হামলা করার মতো কলিজা লারা বা তার বাবার এখনো হয়নি। এর পিছনে অন্যকারো হাত আছে নিশ্চিত। পেয়াদাদের সমাদর করলেই রাজার নাম বের করা যাবে।একজন মা*ফিয়া হিসেবে আশিয়ান বড় নিষ্ঠুর। তার নিষ্ঠুরতা সিরিয়াল কি*লারদের ও হার মানায়।
আশমিন জ্ঞান ফেরার পর থেকে শুধু মেয়েদের দেখতে চাইছে। সুখ এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবে পাখির কপালে দুটো সেলাই পরেছে৷ তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আশমিনের কাছে সুখকে এনে দিলো সানভি। ডাক্তার আশমিন কে বেশি কথা বলতে ও নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছে। আশমিন সুখ কে বুকে জরিয়ে সুয়ে আছে। আমজাদ চৌধুরী আর মায়া বেগমের কথা জিজ্ঞেস করলেও নূরের কথা একবার ও জিজ্ঞেস করেনি আশমিন। উপরে অভিমান থাকলে মনে মনে সে অস্থির হয়ে উঠছে নূরের জন্য। সানভি বোধহয় আশমিনের মনের কথা বুঝতে পারলো। তাই নিজে থেকে নূরের অবস্থার কথা জানালো আশমিন কে। নূরের সার্জারি হয়ে গেছে। আপাতত সব ঠিক হলেও নূরের সুস্থ হওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। শারীরিক যন্ত্রণা ঠিক কতটা সহ্য করতে পারবে তা ও দেখার বিষয়। প্রতিদিন তার খাদ্যনালী দুই বার করে ড্রেসিং করতে হবে। তাই অপারেশন হলেও পেট সেলাই করা হয়নি। খাদ্যনালী প্রায় সত্তর পার্সেন্ট কেটে গিয়েছিল। নূরের এখনো জ্ঞান ফিরেনি।বেচে গেলেও সুস্থ হওয়া টা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।
আশমিন স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার কলিজাটা মনে হয় কেউ বার বার খন্ড খন্ড করছে। সব পরিস্থিতিতে শান্ত থাকা মানুষ টা মেয়েকে বুকে জরিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। সানভির চোখের কোনেও পানি জমেছে। আশমিনের সামনে কান্নাকাটি করা সম্পুর্ন নিষেধ। সানভি আশমিন কে আস্বস্ত করলো সবাই ঠিক আছে। আশমিন অসহায় চোখে সানভির দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল,,
— আমার এতো অসহায় লাগছে কেন সান! আমি কেন আমার পরিবার কে রক্ষা করতে পারলাম না? আমার পাখি,নূর, বাবা না জানি কতটা অসহায় ছিল তখন।ওরা আমাকে খুজেছে সান।আমার নাম ধরে ডেকেছেও হয়তো বাচার আশায়।আর আমি এসি রুমে আয়েশ করে বসে ছিলাম। আমার পাখি! আমার পাখিকেও ওরা আঘাত করেছে!মায়া আন্টি কে মে*রে ফেলেছে সান! আমি কি ব্যর্থ ছেলে! ব্যর্থ স্বামী, একজন ব্যর্থ বাবা। আমি ওদের সুরক্ষা দিয়ে পারিনি সান। আমার নজর রাখা উচিত ছিল।
আশমিনের এমন তীব্র অসহায় গলা শুনে সানভির চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। কোন রকম শান্তনা না দিয়ে শক্ত গলায় বলল,,
— আমরা কাওকে ছাড়বো না স্যার। ওদের দেহের প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝিয়ে দিবো কার কলিজায় ওরা হাত দিয়েছে।আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। একটা কেও ছাড়বো না।
আশমিন চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঠান্ডা মাথায় যা করার করতে হবে।