ইট পাটকেল | পর্ব – ২৪

সারে দশটায় ঘুম ভাঙ্গলো নূরের।মাথা ব্যথাটা এখন একটু কম।তবে চোখ জ্বালা করছে। বিছানা থেকে উঠে চারিদিকে চোখ বুলালো নূর।আশমিন রুমে নেই।
বাকা হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আজ মন্ত্রী সাহেব কে একটু জ্বালানো যাক।
গোসল সেরে একবারে রেডি হয়ে বের হলো নূর।একটু অফিসে যেতে হবে। বজ্জাত মন্ত্রীর একটা খবর নেয়া যাক।ফোন হাতে নিয়ে কল দিতেই আশমিন সাথে সাথে রিসিভ করলো।
— আমাকে মিস করছিলে বউ? একদিনেই বর পাগল হয়ে গেলে! তুমি না,আমাকে একটু বেশিই ভালবাসো।
নূর হতাশার শ্বাস ফেললো। এই লোক এ জীবনে ঠিক হওয়ার নয়।
— কোথায় আপনি?
— আমি একটু বের হয়েছি। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবো। বাসা থেকে বের হওয়ার কথা চিন্তাও করো না বউ।আমার কয়েক দিন খুব প্রেম পাবে। তুমি বাড়িতে না থাকলে প্রেম কার উপর এপ্লাই করবো বলো তো? আব্বুর মতো তো আমার আর দুটো বউ নেই।
নূরের বিরক্তির মাত্রা আকাশ ছুলো।দুম করে ফোন কেটে দিয়ে বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে।আজ একটা বড় ডিল হওয়ার কথা।এখনো হাতে একঘন্টা সময় আছে।
নূর ফোন কেটে দিতেই আশমিন মুখ কুচকে ফেললো। তার এতো রোমান্টিক কথা শুনে ফোন কেটে দিলো! রীতিমতো মানবতা বিরোধী কাজ। তার বউ বড্ড অমানবিক।
নূরের জন্য একজন পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হবে। অমি আপাতত কয়েকদিন কিছু জরুরি কাজে ব্যস্ত। তাই একজন মেয়ে নিয়োগ দেয়া হবে। আশমিন ইন্টারভিউ নেয়ার দায়িত্ব সানভি কে দিয়েছে।
তারাহুরো করে অফিসে ঢুকতেই এক মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে কপাল ধরে দাড়িয়ে গেলো সানভি।মুহুর্তেই ঘটে যাওয়া মেজাজ টা আরো বেশি ঘটে ঘ হয়ে গেলো। সে মোটামুটি ভালোই লম্বা।তার কপালে বারি খেতে হলে অপর পাশের মানুষ টা কেও তার সমান লম্বা হতে হবে।সানভি কপাল ছেড়ে সামনে তাকাতেই দেখলো এক লিলিপুট সাইজের মেয়ে চার ইঞ্চি হিল পরে তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। সানভি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
— জুতা খোলো।
–কিহ?(অবাক হয়ে)
সানভি খ্যাঁক করে বললো,
— কথা কানে যায় নি।বলছি জুতা খোলো।
মেয়েটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। রাগ সাইডে রেখে নিজের জুতা খুলে আশমিনের মুখের সামনে ধরলো। আশমিন রিসিপশন থেকে কাচি নিয়ে সাথে জুতার সব কয়টা বেল্ট কেটে দিলো। মেয়েটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সানভির দিকে।
— আর কোনদিন এতো উচু জুতা পরে অফিসে আসবে না।যা সামলাতে পারো না তা পরো কেন?
মেয়েটা রাগে দাত কটমট করতে লাগলো। হাতের জতা গুলো নিচে ফেলে চিৎকার করে বললো,
— বলি বাসায় কি খাবার দাবার কিছু দেয় না।সকাল সকাল চোখের মাথা কেন খেতে হলো আপনার।আমার মতো আস্তো একটা মানুষ আপনার চোখে পরলো না!নিজের চোখ যদি কাজে লাগাতে না পারেন তাহলে এই মুহুর্তে আমাকে খুলে দিন।আমি চক্ষু হাসপাতালে দান করে আসবো।
সানভি হতভম্ব হয়ে গেলো। এই অফিসে কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস পায় না। এই টুকু মেয়ে তাকে এভাবে ধমকাচ্ছে!
— তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি মেয়ে।তুমি জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো? এই পেরেন্টস গুলো আজকাল দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়ে গেছে।বাচ্চা কিন্ডারগার্টেন থেকে বেরিয়ে এখানে চলে এসেছে তাদের ধ্যান নেই। (একজন গার্ড কে ডেকে) একে এখুনি যে স্কুল থেকে এসেছে সেখানে নামিয়ে দিয়ে এসো।
মেয়েটা রাগে লাল হয়ে গেলো। দাতে দাত চেপে ওই গার্ড কে বললো,
— হ্যা।সাথে একেও কবরস্থানে ছেড়ে আসুন।কবর থেকে পালিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। আর ভুল করে চোখ দুটো ওখানেই রেখে এসেছে।তাই বুড়ো দাদু একজন অনার্স পাশ করা মেয়ে কে বাচ্চা ভাবছে।
— চুপ করো বেয়াদব মেয়ে।অভদ্রতার ও একটা ভদ্রতা থাকা দরকার। অসভ্যের মতো চিৎকার করছো কেন? এই অফিসে তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে কে?এই একে এখুনি এখান থেকে বের করো।
অফিসের সবাই অবাক হয়ে ওদের ঝগড়া দেখছে।চিৎকার চেচামেচি শুনে আশমিন ও বেরিয়ে এসেছে।সানভি কে এভাবে ঝগড়া করতে দেখে সবার মতো সে ও অবাক হয়ে গেছে।
— এখানে কি হচ্ছে সান?
আশমিনের কথা শুনে সানভি চুপ করে গেলো। মেয়েটা কাদো কাদো চেহারা করে বললো,
— আমি ইন্টারভিউর জন্য এসেছি স্যার।এই লোকটার সাথে ধাক্কা খাওয়ায় সে আমার জুতা কেটে দিয়েছে। আবার আমাকে বকাবকি ও করছে।
আশমিন মুচকি হাসলো। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার নাম কি?
— লুবানা জান্নাত।
— তোমার চাকরি হয়ে গেছে লুবানা।আজ থেকেই জয়েন করবে।ওকে কাজ বুঝিয়ে আরএস কোম্পানি তে পাঠিয়ে দাও।
আশমিন চলে যেতেই সবাই নিজের কাজে মন দিলো। সানভি ভোতা মুখ করে তাকিয়ে আছে লুবানার দিকে।লুবানা বিশ্বজয় করা হাসি দিল। সানভির দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বললো,
— চলুন দাদু।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার নাট বল্টুতে জং ধরে যাবে।আমাকে আমার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে না হয় কবরে চলে যাবেন।আপনার জন্য বাইরের পরিবেশ উপযোগী না।
সানভি কটমট করে তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলো। লুবানা ওর পিছু যেতে যেতে গা জ্বালানি হাসি দিতে লাগলো।
~
আশিয়ানের মুখোমুখি বসে আছে আশমিন। ঢাকার বিলাশবহুল পাচ তারকা হোটেলের সুইট রুমে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
— কেমন আছেন জায়িন চৌধুরী?
আশমিন হালকা হাসলো।বাকা চোখে একবার আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল,
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মাফিয়া সাহেব।আপনার কি খবর? বাংলাদেশ ঘোরা হয়েছে? সুন্দরবন ঘুরে আসতে পারেন।বাংলার বাঘ সম্পর্কে আইডিয়া হয়ে যাবে।তখন আর এই শহরের বাঘের সাথে টক্কর দেয়ার চুলকানি উঠবে না।
আশিয়ান শব্দ করে হেসে উঠলো। আশমিনের দিকে হালকা ঝুকে কৌতুক গলায় বলল,
— এতো ভালবাসা কার জন্য বাঘ সাহেব।নূরের জন্য?বোন কিন্তু আমার আস্তো বাঘিনী। আমি নাহয় কিছু না ই করলাম। আপনার বাঘিনী আপনাকে ছাড়বে তো?
আশমিন অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— ছাড়বে কেন?আমি ই বা ছাড়তে দিবো কেন? আমি তাকে আমার ভালবাসায় বন্দিনী করবো।তার তেজ আমি তে শুরু হয়ে আমি তেই শেষ হয়ে যাবে। বড্ড আদরের বউ আমার। আমি আবার বউ ছাড়া একদম থাকতে পারিনা।
আশিয়ান খুক খুক করে কেশে উঠলো। সম্পর্ক যেমন ই হোক না কেন। বোন তো হয়।তাকে নিয়ে এমন লাগামহীন কথাবার্তা কানে লাগছে। আশমিন আশিয়ানের অস্বস্তি কে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি মুল কথায় ঢুকে গেলো।
— তোমার মামী তোমাকে এখানে কি মনে করে আনলো ভাই আমার। কি চাই তোমার?
— আমার পুরো সম্রাজ্য চাই। পুরোটা।
আশমিন বাকা হাসলো।
— সম্রাজ্য তো আমার রানীর। তার রাজা তোমার সামনে বসে। তাকে টপকে নিতে পারলে নিয়ে নাও।
— আর যদি রানী ই না থাকে?(এক ভ্রু উচু করে)
— আমার ফুপ্পির শেষ অংশ তুমি।তোমাকে মারতে আমার খারাপ লাগবে।বিষাক্ত অতীত টেনে এনো না আশিয়ান। আমি ধ্বংস হলে কেউ সুখে থাকবে না। চেনো তো আমাকে?কি করতে পারি নতুন করে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়ই?
আশিয়ান আশমিনের শান্ত মুখের দিকে তাকালো। চেহারায় কোন ভয়,অস্থিরতা, চিন্তা, রাগ কোন কিছুরই ছাপ নেই। সে জানে আশমিন ভয়ংকর। যা কেউ জানে না তা আশিয়ান জানে।ভালো মানুষ তো সে ও নয়।
— আপনার সত্যি সামনে এলে আপনার রানী ই যথেষ্ট আপনাকে ধ্বংস করার জন্য।
— নিজেকে নিয়ে ভাবো। একটা মাত্র জীবন তোমার।এটা হারালে কি দিয়ে দেহ চালাবে!
ঠান্ডা মাথায় হুমকি দিয়ে চলে গেলো আশমিন। আশিয়ানের মাথায় চিন্তার ভাজ পরেছে।ভিতরে ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে। নূর কে মে*রে ফেলা তার উদ্দেশ্য না।তার উদ্দেশ্য সব কিছু নিজের করে নেয়া।অমির সাথে কথা বলতে চেয়েছে কয়েকবার।ফলাফল শূন্য। তাদের জীবন টা বড্ড অগোছালো। সব থেকেও কেউ নেই। আশমিনের সাথে তার যে সম্পর্ক তা কয়েক জন ছাড়া কেউ জানে না। এমন কি অমি ও না। কামিনী চৌধুরী কে নিরাশ করবে না সে।নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে সে আশমিনের মোকাবেলা করবে। কেউ কাউকে জানে মা*রতে পারবে না সমস্যা টা এখানেই। নাহলে এতো দিনে কেচ্ছা খতম হয়ে যেতো।
আশমিন সরাসরি নূরের অফিসে চলে এসেছে। নূর সকাল থেকে তার ফোন রিসিভ করছে না। এতো আদর ভালবাসা দেয়ার পরেও বউ তাকে পাত্তা দিচ্ছে না! তার মেহনত সব জলে ভেসে গেলো! তাই সে চিন্তা করেছে এখন থেকে বউ কে বেশি বেশি ভালবাসবে।সকাল বিকাল ট্যাবলেট খাওয়ার মতো বউকে আদর কর‍তে হবে।দরকার হলে রাজনীতি ছেড়ে বউয়ের আচল ধরে ঘোরার চাকরি নিয়ে নিবে।বউ কে তার জন্য পাগল করেই ছাড়বে। তবে না প্রেম টা মাখোমাখো হবে।
আশমিন কেবিনে প্রবেশ করতেই নূর ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো।আশমিন কে দেখে কপাল কুচকে বললো,
— কি চাই?
— বউয়ের এটেনশন।তুমি এমন বেঈমান কিভাবে হলে নূর! সারা রাত ভালোবাসার এই দাম দিলা?এতো আদর ভালবাসার পরে তোমার উচিত ছিল আমার কোলে বসে থাকা।আর তুমি সকাল হতেই সব ভুলে গেলে! মানে,কাজ শেষ খোদা হাফেজ!
নূর শান্ত চোখে তাকিয়ে আশমিনের সমস্ত বাজে কথা হজম করে নিলো।আশমিন থামতেই পুনরায় কাজে মন দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— আপনার ছিঃ মার্কা কথা শেষ হলে বিদায় হন।
আশমিন নূর কে টেনে তুলে নিজের সাথে চেপে ধরলো। কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে শান্ত গলায় বললো,
— ফোন ধরছিলে না কেন?
— বিজি ছিলাম।
নূরের সহজ উত্তর টা সহজ ভাবে নিতে পারলো না আশমিন।তবে নূর কে কিছু বুঝতে দিলো না। কিছুক্ষণ নিজের সাথে জরিয়ে রেখে গালে বুলিয়ে বললো,
— খেয়েছো কিছু? এখন শরীর কেমন লাগছে?
— ভালো লাগছে।খাইনি,খাবো এখন।
— চলো একসাথে খাই।লুবানা নামে একটা মেয়ে আসবে।আজ থেকে ও তোমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। সান সব বুঝিয়ে এখানে নিয়ে আসবে।তোমার সাথে সারাদিন থাকবে।মেয়ে টা এতিম। রাতে নূর মঞ্জিলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ো।ছোট একটা ভাই আছে।সেও ওর সাথেই থাকবে।কোন অসুবিধা নেই তো?
— সমস্যা নেই।আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।এবার ছাড়ুন। ক্ষুধা পেয়েছে তো।
আশমিন ছাড়লো না। হাতের বাধর আরো শক্ত করে নূর কে নিজের সাথে চেপে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,
— ছাড়তে পারবো না।আমার মুড নেই।বউ কি ছেড়ে দেয়ার জিনিস?বউ এভাবে জরিয়ে রাখার জিনিস।চুপ করে থাকো।নাহলে অফিস কে বেড রুম বানাতে আমার সময় লাগবে না।
(গল্পে আরো অনেক মোড় বাকি আছে।যেকোন পরিস্থিতি মেনে নেয়ার জন্য মানুষিক ভাবে তৈরি থাকুন।সম্পর্কে চড়াই উৎরাই থাকবেই।আশা করি গল্প কে গল্প হিসেবেই নিবেন।তবে আপনাদের হতাশ করবো না। লেখিকার উপর ভরসা রাখুন।)

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।