কালকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা লাইভ কনসার্ট আছে নূরের।সারাদিন অফিস সামলে গান নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পায় না নূর।তবে যতই বিজি থাক না কেন গান সে ছাড়বে না।মন খারাপের সময় গুলোতে এই গান ই ছিল একাকিত্ব ঘুচানোর একমাত্র সঙ্গি।তাই বাবার দেয়া দায়িত্ব সামলে ও নিজের ক্যারিয়ারে মন দিবে।
অফিসের সমস্ত কিছু অনেকটা গুছিয়ে এনেছে নূর।আশমিন এখন পুরো পুরি রাজনীতি নিয়ে ব্যাস্ত। দায়িত্ব থেকে রেহাই পাওয়ার পর থেকে সে আর এদিকে মারায় নি।নূর ইদানীং চোখে চোখে রাখছে আশমিন কে। অফিসের রেসপনসেবলিটি থেকে মুক্ত হওয়ার পর সে যেন একটু বেশিই বেয়াড়া হয়ে উঠছে। সকাল থেকে অমির কোন পাত্তা নেই।ছেলেটা হুট করেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। মোবাইল ও বন্ধ। এক আআঙ্গুলের সাহায্যে কপালের মাঝখানে হালকা ম্যাসাজ করে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকালো নূর।ঘড়ির কাটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। চেয়ার থেকে উঠে গ্লাসের দেয়ালের সামনে গিয়ে দাড়ালো নূর। কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে কয়েকটা। আজ সকাল থেকে অমি আশমিনের উপর নজর রাখছিল।আশমিন কিছু করে নি তো!চিন্তা টা মাথায় আসতেই নূর কয়েকবার মাথা ঝাকালো। আশমিন অমির কিছু করবে না তা সে খুব ভালো করেই জানে। মোবাইলের রিংটোনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো নূর। দ্রুত পায়ে গিয়ে কল রিসিভ করলো।
— হ্যালো ম্যাম।আমি অমি বলছি।
— অমি!কোথায় তুমি? মোবাইল বন্ধ কেন তোমার? আর এটা কার নাম্বার?(চিন্তিত গলায়)
অমি নূরের একসাথে করা এতগুলো প্রশ্ন শুনে ভেবাচেকা খেয়ে গেলো।
— আমার ফোন টা বন্ধ হয়ে গেছে ম্যাম।
— তুমি ঠিক আছো?
— জ্বি ম্যাম।
— কোন নিউজ পেলে?
— স্যারের সাথে ওইদিন হোটেলে যে মেয়েটার ছবি ছিল সেই মেয়ের খোঁজ পেয়েছি ম্যাম।মেয়েটি ওই হোটেলের বার সিঙ্গার।ইয়ে মানে আসলে ম্যাম।
অমি কিছু একটা বলতে গিয়ে বার বার আটকে যাচ্ছে। কথা টা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না।
— যা বলার সরাসরি বলো অমি।(শান্ত গলায়)
— আসলে ম্যাম,ওইদিন মেয়েটা স্যারের,সাথেই ছিল।
নূর চোখ বন্ধ করে কয়েক বার শুকনো ঢোক গিললো।অমি নিজেও চুপ করে আছে। নূর কে সময় দিচ্ছে নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য। নূর কয়েকবার জোরে শ্বাস নিয়ে শান্ত অথচ ভয়ংকর গলায় বলল,
— ওটা যেখানেই থাকুক না কেন তুলে নিয়ে এসো অমি।
— ওকে ম্যাম।
অমি ফোন রাখতেই চেয়ারে গা এলিয়ে দিল নূর।আশমিন কে নিয়ে কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সামনে অনেক ভয়*ংকর সত্যি অপেক্ষা করছে। এখন ভেঙে পড়া চলবে না।
~
সানভি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিনের অবশ্য সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে নিজ মন ল্যাপটপে কিছু একটা করছে।
— মেয়েটাকে এখনো বাচিয়ে রেখেছো কেন সান?
আশমিনের হিমশীতল গলা শুনে কেপে উঠলো সানভি।কয়েক দফা ঢোক গিলে চিন্তা করলো, মেয়েটা কে মা*রার কথা কবে বললো!
— গরিবের ঘরের মেয়ে স্যার। অন্ধ বাবার মেই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই।
আশমিন চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্ত চোখে তাকালো সানভির দিকে। কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল,
— আমি আছি সান।
সানভি আর কিছু বললো না। আশমিন বাকা হেসে বললো,
— চিন্তা করো না সান।আমার ইচ্ছাকৃত ফেলে রাখা কাজ গুলো তোমার ম্যাম করে দিবে।
সানভি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সানভি বের হতেই আমজাদ চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে আশমিনের কেবিনে ঢুকলো। বাবার এমন অস্থির ফেস দেখে মুচকি হাসলো আশমিন। আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বললো,
— রাস্তায় ইভটিজিং করে পালিয়ে এসেছো নাকি।এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন,?
আমজাদ চৌধুরী চটে গেলেন।দাত কিড়মিড় করে বললো,
— বাবা হই তোমার। বাবা কে ইফটিজার বলতে লজ্জা করে না তোমার?
— লজ্জা কেন করবে? কাল থেকে তুমি গার্লস হোস্টেলের সামনে দাড়িয়ে থাকবে।এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে তোমার।ওখানে দাঁড়িয়ে মেয়ে পছন্দ করবে।যাকে পছন্দ করবে সেই আমার মা হবে।
আমজাদ চৌধুরীর বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এই ছেলে।এখন নাকি তাকে বখাটে ছেলেদের মতো গার্লস হোস্টেলের সামনে দাড়িয়ে মেয়ে খুজতে হবে। আমজাদ চৌধুরী আর কথা বারালেন না।এই অসভ্য ছেলে যখন তখন ইজ্জতের দফারফা করে দিতে পারে।
— আমার কিছু টাকা লাগবে আশমিন।
— আমি জানি আব্বু।চিন্তা করো না। তোমার বিয়ে আমি স্পনসর করবো।আমার একমাত্র বাবার বিয়ে বলে কথা।তুমি বরং পার্লারে গিয়ে হালকা একটা ফেসিয়াল করিয়ে এসো।
আমজাদ চৌধুরী বুঝলেন ছেলে তার কথা শুনবেন না।বাধ্য হয়েই চলে গেলেন।বাসায় কামিনী হা হুতাশ করে কাদছে।এক মাসের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে তাকে জেলে যেতে হবে। বার বার নূর কে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ছেলে উঠে পরে লেগেছে তাকে বিয়ে করানোর জন্য। কামিনী যাই করুক না কেন সে তো কামিনী কে ভালোবাসে। কামিনীর জায়গা অন্য কাউকে সে কোন দিন ও দিতে পারবে না।এতে কামিনী একা কামিনী একা যন্ত্রণা ভোগ করবে না। তার সমান ভাগিদার সে নিজেও হবে।আশমিন বুঝে শুনেই এসব করছে।সে কষ্ট পাবে জেনেও তাকে আবার বিয়ে করানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে। না জানি কোন ভুলের শাস্তি দিচ্ছে ছেলে তাকে।
আশমিন শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তার বাবার যাওয়ার দিকে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো,
— তুমি ভুল করেছো বাবা।কাছের মানুষ কে না চেনার ভুল যখন করেছো শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।
নূরের টর্চা*র রুমে একটা মেয়েকে বেধে রাখা হয়েছে।নূর মেয়েটার সামনে একটা চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে।থেমে থেমে গুন গুন করে কিছু একটা গাইছে।মেয়েটার জ্ঞান ফিরতে না দেখে এবার বিরক্ত চোখে তাকালো নূর।অমির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,
— এর জ্ঞান ফেরাও অমি।
অমি বালতি ভর্তি পানি নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল।নূরের হুকুম পেতেই এক বালতি পানি ছুড়ে মারলো মেয়েটার মুখে। কয়েক সেকেন্ডে পিটপিট করে চোখ মেললো সে।নূর পা নাচিয়ে শরীর দুলিয়ে মেয়েটিকে পরখ করছে।
— আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে??
মেয়েটার কর্কশ গলা শুনে বাকা হাসলো নূর। চোখ বন্ধ করে আরাম করে বসলো।
— অমি।
— ইয়েস ম্যাম।
— ওর মুখটা ভে*ঙ্গে দাও।বিশেষ করে বা পাশ টা।
অমি ইশারা করতেই একটা পালোয়ান সাইজের মেয়ে এসে মেয়েটার মুখে পরপর কয়েক বার আঘাত করলো। মুখের বা পাশ টা থেতলে যেতেই অমি থামিয়ে দিল। মেয়েটা চিৎকার করে আর্তনাদ করছে।নূর নিজের চেয়ার থেকে উঠে মেয়েটার সামনে গিয়ে হালকা ঝুকলো। পাচ আঙ্গুলের সাহায্যে থুতনি উচু করলো।নূরের চোখ মুখ ভয়ংকর লাল হয়ে আছে। নূর মেয়েটার গাল চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,,
— আমার ব্যবহার করা জুতো গুলোর ও কারখানা তে একজোড়া বানানো হয় যাতে অন্য কেউ এই মডেল ইউজ করতে না পারে।আর তুই সেই আমার নামে দলিল করা একমাত্র বরের বুকে মাথা রেখে ঘুমাস।সাহস আছে মাইরি। তোর এই শরীর আমি আস্ত রাখবো ভাবলি কি করে।
মেয়েটা এতক্ষণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল। এবার নূরের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো। ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল,
— তাহলে তো আপনার সেই দলিল করা একমাত্র বরের বুকটাও ধ্বংস করতে হয়।সে নিজেও তো অন্য একটা মেয়ে দ্বারা ইউজড হয়ে গেছে।
মেয়েটার কথা শেষ হতেই তার কপাল বরাবর একটা গু*লি এফোড় ওফোড় করে দিলো।
আশমিন ব*ন্দুকের নলের উপর ফু দিয়ে বাকা হাসলো।
কথা হবে, দেখা হবে
প্রেমে প্রেমে মেলা হবে
কাছে আসা-আসি আর হবে না
চোখে চোখে কথা হবে
ঠোঁটে ঠোঁটে নাড়া দেবে
ভালবাসা-বাসি আর হবে না
শত রাত জাগা হবে
থালে ভাত জমা রবে
খাওয়া-দাওয়া কিছু মজা হবে না
হুট করে ফিরে এসে
লুট করে নিয়ে যাবে
এই মন ভেঙে যাবে, জানো না
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না
আশমিনের গান শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো নূরের। রাগে হাত মুঠ করে ফেললো। দাতে দাত চেপে চোখ বন্ধ করে নিজের হাতের পিস্ত*লটা শক্ত করে ধরলো।রাগে মাথা দপদপ করলে ও ফেস সম্পুর্ন স্বাভাবিক করে ফেললো। অমি সহ বাকি সবাই অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।নূর পিছনে ঘুরতেই দেখলো আশমিন তার থেকে ঠিক তিন হাত দূরে।তার দিকেই এগিয়ে আসছে সে।
একটা গু*লি আশমিনের বুকের বাপাশ ভেদ করতেই থেমে গেলো আশমিন।অবাক চোখে তাকালো নূরের দিকে। সবাই স্তব্ধ হয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ নূর সম্পুর্ন শান্ত।এখনো হাতের পি*স্তল আশমিনের দিকে তাক করা।আশমিনের সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি মুহুর্তেই রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের দিকে একবার তাকিয়ে আবার নূরের দিকে তাকালো আশমিন।রক্তিম চোখ দুটো ছলছল করলেও মুখে তার মুচকি হাসি।নূর এগিয়ে গেলো আশমিনর দিকে।আশমিন হাটু মুরে বসে পরেছে ততক্ষণে। সবাই যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। নূর আশমিনের সামনে বসে তার গালে হাত রাখলো। কপালে চুমু খেয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে গাইলো,
‘ভালোবাসা ভালোবাসা থাকো তুমি দূরে,,,
কাছে এলেই জ্বলে মন না পাওয়ার
আগুনেতে ধুকে ধুকে পুড়ে থাকো তুমি দূরে’
নূর বেরিয়ে যেতেই আশমিন ঢলে পরলো।অমি ‘স্যার’ বলে চিৎকার করে এসে আশমিন কে আগলে ধরলো।
— গাড়ি বের করো বাহাদুর।
ততক্ষণে আশমিনের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে।