ফ্লোরেনসিয়া – ১৯

ত্রিশটি ঘোড়া তীব্র বেগে ছুটছিল। ক্রিস্তিয়ান সবগুলো ঘোড়সওয়ারকে ছাড়িয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেল। ক্রিস্তিয়ানের পেছনে ইনায়া। সিয়াকে দূর-দূরান্তে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। সবার পেছনে আর্নি। চলমান প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে থাকা ঘোড়সওয়ার দু’জন যেন আচম্বিতে গায়েব হয়ে গেল। ক্রিস্তিয়ান বিস্মিত হলো। মনে মনে ভাবল,

– ওদের ঘোড়া দু’টো কি পক্ষিরাজ ঘোড়া? যেন চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ইনায়া একহাতে শক্ত করে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। অন্যহাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের ঘোড়াটাকে অনবরত চাবুক আঘাত করল। দৃঢ়কন্ঠে উচ্চস্বরে বলল,

– যাহ। যাহ।

আঘাত পেয়ে ঘোড়াটা আরও তীব্রবেগে ছুটতে শুরু করল। যার ঘোড়া যত দ্রুত ছুটবে সে তত দ্রুত হ্যানস পাহাড়ে পৌঁছাতে পারবে। ইনায়া নিমেষেই ক্রিস্তিয়ানের ঘোড়াটাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেল। ক্রিস্তিয়ান হাসল। ওদের চারজনের মধ্যে যে কেউ একজন বিজয়ী হলেই হবে। কিন্তু হঠাৎই আরও একজন ঘোড়সওয়ার ক্রিস্তিয়ানের ঘোড়াটাকে অতিক্রম করে ফেলল। ক্রিস্তিয়ান ঝুঁকি নিল না। ইনায়াকে সম্পূর্ণ ভরসা করতে পারল না।

– এই লোকটা যদি ইনায়ার ঘোড়াটাকেও অতিক্রম করে যায়?______ক্রিস্তিয়ান ভাবল।

সে আরও জোরে ঘোড়া ছুটাল। একহাতে অনবরত চাবুক আঘাত করল।

সিয়া অনেকটাই পেছনে। ওর মন পড়ে আছে বাড়িতে। প্রতিযোগীতায় মনোনিবেশ করতে পারছিল না। কিন্তু সহসা ওর কর্ণকুহরে ইলহামা অ্যালিয়েভের বলা কথাগুলো বেজে ওঠল,

– তুমি পারবে সিয়া। তোমাকে জিততেই হবে। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। তুমি বিজয়ী হয়ে ফিরবে।

সিয়ার টনক নড়ল। ওর মা ওর বিজয়ী মুখখানা দেখার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে। ভরসা করেছে ওকে। ভরসা হলো এমন একটা জিনিষ যা শুধুমাত্র বিশ্বস্ত মানুষগুলোর উপরই করা যায়। সিয়া কি করে নিজের মায়ের বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারে?

– আমার উপর মায়ের ভরসা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাকে জিততেই হবে। আমি তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা দেখতে চাই। কৃত্রিম নয় একঝলক নির্মল হাসি।

সিয়া মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। সব মিলিয়ে দু’ঘন্টার মতো সময়। তারপরই সবাই মিলে বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। ওকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। ভাবতে ভাবতেই সিয়া আর্নির ঘোড়াটাকে পেরিয়ে গেল। ও নিজের মধ্যে আলাদা এক ধরনের শক্তি অনুভব করল। কোনো প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য কঠিন মনোবল প্রয়োজন। লক্ষ্য স্থির রেখে নিজের উপর অগাধ ভরসা রাখতে হবে। পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই।

সিয়া ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলো। দু’পায়ে নিজের ঘোড়াটাকে শক্ত করে চেপে ধরে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখল। পিঠের পেছনে ঝুলে থাকা ব্রেচার অব আর্চারি(ধনুর্বিদ্যার ব্র্যাকার) থেকে আরও একটা চাবুক হাতে নিল। দু’পাশ থেকে দু’হাতে ঘোড়ার গায়ে সজোরে চাবুক আঘাত করল। ঘোড়াটা তীব্র হ্রেষাধ্বনি তুলে ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করল। সিয়া একহাতে লাগাম টেনে ধরে আবার ছেড়ে দিল। একে একে কতগুলো ঘোড়সওয়ারকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। একটুখানি দূরে ক্রিস্তিয়ানের ঘোড়াটাকে দেখতে পেল।

বাতাসের বেগে সিয়ার চুলগুলো খুলে গিয়ে কোমরে দোল খাচ্ছিল। একসময় ক্রিস্তিয়ানের ঘোড়াটাকেও অতিক্রম করে গেল। ক্রিস্তিয়ান স্তম্ভিত নয়নে দেখল। একজন বাদামী রঙা এলোকেশী মেয়ে বীরাঙ্গনার বেশে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিল। যার মুখাবয়বে সে জয়ী হওয়ার এক অদম্য প্রচেষ্টা দেখতে পেল। ক্রিস্তিয়ান পুনরায় ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। দেখা যাক, কোন বোন বিজয়ীনির সম্মান জিতে নিতে পারে।

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সিয়ার ঘোড়াটা ইনায়ার ঘোড়ার পাশাপাশি চলে এলো। দু’বোন একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। কথা বলার সুযোগ নেই। অন্তত প্রতিযোগিতায় কেউ কাউকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। দু’জনের সামনে দু’টো রাস্তা। অথচ দুরত্ব সমান। ঘোড়া দু’টো বাঁক নিলো। দু’জন দু’জনের বিপরীত রাস্তায় ঘোড়া ছুটাল। সিয়া ডানদিকের রাস্তাটা ধরে গেল। ইনায়া বামদিকের রাস্তাটা ধরে গেল। ওদের ঘোড়াগুলোর সামনে আরও কতগুলো ঘোড়া আছে তা বোঝা মুশকিল হয়ে দাড়াল। কে জানে হ্যানস পাহাড়ে ইতোমধ্যে কেউ পৌঁছে গেছে কিনা। ইনায়া নিজের সামনে অনেক দূর পর্যন্ত কোনো ঘোড়া দেখতে পেল না।

– হুডিযুক্ত ট্রেঞ্চকোট পরিধান করা ঘোড়সওয়ার দু’টো গেলো কোথায়? তারা কি পৌঁছে গেছে হ্যানস পাহাড়ে?

ইনায়া ভাবল। ভাবতে ভাবতে ক্ষণিকের জন্য নিজের লক্ষ্য থেকে সরে গেল। তন্মধ্যে ওর ঘোড়াটা অন্য রাস্তা ধরে ছুটতে আরম্ভ করল। ইনায়া নিজের ঘোড়াটাকে থামাতে চাইল। কিন্তু হঠাৎই একটা পাহাড়ের পেছন থেকে একজন ঘোড়সওয়ারসহ একটা ঘোড়া এসে ওর সামনে দাঁড়াল। ইনায়ার হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলো। সহসা ওর ছুটন্ত ঘোড়াটাও থেমে দাঁড়াল।

ইনায়া ভীষন আতংকিত হলো। ওর দৃষ্টির সম্মুখে ঘোড়ার পিঠে ছাইরঙা ট্রেঞ্চকোট পরিধেয় একজন যুবক বসে ছিলো। মুখটা দেখা যাচ্ছিলো না, কারণ হুডি দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো। ইনায়া বিস্মিত হলো। ভীত-সন্ত্রস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

– কে তুমি?

– আব্রাহাম স্যাভেরিন।____ছেলেটা সগর্বে প্রত্যুত্তর দিলো।

– তুমি যেই হও। আমার রাস্তা ছাড়ো।___কঠিন কন্ঠে কথাটা বলল ইনায়া।

আব্রাহাম দু’হাতে আলগোছে মাথার হুডি খুলে ফেলল। লাল টুকটুকে দু’ঠোঁটের ফাঁকে ঝকঝকে সাদা দাঁতে হাসল। তার হালকা নীলাভ চোখজোড়া থেকে যেন দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল। ইনায়া থমকাল। ভয়ংকর কোনো ঘোরের মাঝে চলে গেল। দু’চোখের পলক পড়ল না ওর। একজন মানুষ কি করে এতটা সুদর্শন হতে পারে? অকস্মাৎ ইনায়ার ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠল। ও নিজের সম্বিত ফিরে পেল। মুহূর্তেই ভয়াবহ চমকাল। কারণ এই ছেলেটাকে ইনায়া সেদিন সন্ধ্যায় দেখেছিল।

– তুমি! তুমি একজন পি’শাচ?___কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করল ইনায়া।

আব্রাহাম ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। থমথমে পা ফেলে ধীরে ধীরে ইনায়ার দিকে এগিয়ে গেল। ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসল। যেন ইনায়ার কথাটা শুনে ভীষণ মজা পেল। অকস্মাৎ হাসি থামিয়ে অকপটে জিজ্ঞেস করল,

– তোমার কি মাথা খারাপ? আমি কেনো পি’শাচ হতে যাবো?

– দূরে থাকো। আমার কাছে আসবে না। আমি তোমাকে দেখেছিলাম সেদিন সন্ধ্যায়। আমার শরীরের সমস্ত রক্ত খেয়ে আমাকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিলে।___ভয়াবহ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল ইনায়া।

ওর মাঝে থাকা সমস্ত ভয় অসামান্য ক্রোধে পরিণত হয়। আব্রাহাম অবাক হওয়ার ভান করে বিস্মিত কন্ঠে বলে,

– সত্যি! তুমি কি আমাকে পি’শাচ রুপে দেখেছিলে? আমার ইয়া বড় বড় দু’টো দাঁত আর রক্তলাল দু’টো চোখ ছিলো নিশ্চয়ই?

ইনায়া যেন দমে গেল। ও স্বচক্ষে দেখেনি কোনো কিছুই। সেদিন সন্ধ্যায় প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিলো মনে নেই ওর। তবুও আব্রাহামকে প্রবল সন্দেহ হলো।

– সেদিন সন্ধ্যায় তুমি আমাকে দেখে অচেতন হয়ে গিয়েছিলে। আর আমিও তোমাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে রেখে চলে এসেছিলাম।

বলল আব্রাহাম। ইনায়া ভাবল হয়তো ছেলেটা ঠিক বলছে। স্বচক্ষে না দেখে বা পাকাপোক্ত প্রমাণ ব্যতীত কাউকে সন্দেহ করা উচিত নয়। তবুও ইনায়া ফের রেগে যায়। রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বরে বলে,

– একটা মেয়েকে সন্ধ্যাবেলা মাঝ রাস্তায় অচেতন অবস্থায় রেখে কাপুরুষের মতো চলে আসতে আপনার লজ্জা করেনি?

আব্রাহাম কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে আসা ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনতে পেল। সে লাফ দিয়ে ইনায়ার ঘোড়ার পেছনে চড়ে বসল। ইনায়া চমকাল। একহাতে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে অন্য হাতের কনুই দিয়ে আব্রাহামের বুকে সজোরে আঘাত করল।

– আহহ! ____আব্রাহাম মৃদু আর্তনাদ করে উঠল।

– আমার ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ান। নাহলে আমি পুনরায় আঘাত করতে বাধ্য হবো।

– তুমি আমাকে প্রতিনিয়ত জ্বালিয়ে মা’রছো। আজ এর একটা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আপাতত চুপ করে বসে থাকো। পেছনে কেউ আসছে। আমাদের একসাথে দেখলে সন্দেহ করতে পারে।

– এমনিতেও আমি প্রতিযোগিতায় হেরে যাবো। এতক্ষণে সিয়া হয়তো হ্যানস পাহাড়ে পৌঁছে গেছে। আপাতত এই অসভ্য ছেলেটাকে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। ____ইনায়া মনে মনে ভাবল।

আব্রাহাম তার শক্তপোক্ত পেশিবহুল একহাতে ইনায়াকে আগলে রাখল। অন্যহাতে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। ইনায়ার শিরদাঁড়া বেয়ে অজানা শিহরণের শীতল স্রোত গড়িয়ে গেল। আব্রাহামের শরীর থেকে অদ্ভুত একধরনের মাদকীয় সুঘ্রাণ ভেসে এলো। ইনায়া বিমোহিত হলো। আব্রাহাম প্রগাঢ়, প্রশান্তির নিঃশ্বাস টেনে নিলো। অসম্ভব ভালো লাগছিল তার। যেন বহুকাল ধরে জ্বলতে থাকা অঙ্গার হৃদয় পুনরুজ্জীবিত হল। তীব্র বাতাসে ইনায়ার চুল থেকে মন মাতানো সুগন্ধি নাকে এসে লাগল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসল। মেয়েটার সুদীর্ঘ লালচে-সোনালী চুলগুলো খুলে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সাহস হলো না। যদি রেগে যায় ও?

ক্ষণকাল সময় গড়াল। আচমকা আব্রাহাম ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। গড়িয়ে গিয়ে প্রকান্ড এক পাথরের সাথে বারি খেয়ে মাথায় আঘাত পেল। এতক্ষণ হুশে ছিলো না যেন। বারি খেয়ে হুশ ফিরে পেল। ইনায়া চিৎকার দিয়ে বলল,

– আশা করি শিক্ষা হয়ে গেছে আপনার। নিজের এই সৌন্দর্যের মায়াজাল অন্যকারো উপর ফলাবেন। আমার উপর নয়। আমি___ইনায়া ইবতিসাম। নামটা মনে রাখবেন। দ্বিতীয়বার আমার সামনে আসার দুঃসাহস দেখাবেন না। তাহলে আজকের থেকেও ভয়াল করুন পরিণতি হবে।

ইনায়ার রাগান্বিত মুখখানা দেখে আব্রাহামের হাসি পাচ্ছিলো। একহাতে মাথা চেপে ধরে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। ইনায়া ঘোড়া ছুটিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আব্রাহাম মিষ্টি করে হেসে অনুচ্চস্বরে বলল,

– ইনায়া ইবতিসাম।

– এস্টীম রুলার। আপনি কি খুব বেশি আঘাত পেয়েছেন?

নিলসোনের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আব্রাহাম থতমত খেল। ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করল। অস্ফুটস্বরে বলল,

– কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা নিলসোন দেখে ফেলেনি তো?

দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। পরিধেয় ট্রেঞ্চকোট ঝেড়ে বুক টানটান করে দাঁড়াল। সগর্বিত কন্ঠে বলল,

– কেনো ব্যথা পাবো? মোটেও ব্যথা পাইনি আমি। কিন্তু তুমি কখন এলে?

– এইতো, এইমাত্র। আপনি হঠাৎ ঘোড়া নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। তারপর আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছি।

– ওহ আচ্ছা।

_______★★_______

হ্যানস পাহাড়।

পাহাড়ের নিচে নিজেদের ঘোড়া দাঁড় করিয়ে রেখে সবাই সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করল। সিয়াকে অতিক্রম করে আরও দু’জন সামনে এগিয়ে গেল। লাল নিশানটা পাহাড়ের চূড়ার মাঝখানে ছিল। সিয়া প্রাণপণে দৌড়াল। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ একজন ওকে পায়ে পা বাঁধিয়ে ফেলে দিল। সিয়া মুখ থুবড়ে পড়ল।

প্রতিযোগিতার নিয়মানুযায়ী একজন আরেকজনকে আহত করে নিশান ছিনিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু কাউকে মে’রে ফেলতে পারবে না। সবার প্রথমে থাকা লোকটা নিশানের প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। আর বুঝি আশা নেই? এভাবেই কি তীরে এসে তরী ডুবে যাবে?

সিয়া উঠে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু পায়ে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করল। পেছনে আরও কতগুলো প্রতিযোগী ছুটে এলো। সিয়া মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করল। অনুচ্চস্বরে বলল,

– শক্তি দিন আমায়। আমি এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে চাই। আমার যে মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর ভীষন ইচ্ছে।

সিয়া মনে মনে পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করছিল। ওর চোখের সামনে ইলহামা অ্যালিয়েভের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল। যেন ওর সমস্ত ব্যথা মিলিয়ে গেল। মনের জোর বাড়ল। সিয়া ত্বরিত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুনরায় প্রাণপনে ছুটতে শুরু করল। সামনের দু’জন প্রতিযোগীকে অতিক্রম করে তৃতীয় জনের কাছাকাছি চলে গেল। যেন মাটিতে পা পড়ছে না ওর, শূন্যে ভাসছিল।

সিয়া নিজের মধ্যে নেই। অদৃশ্য কোনো শক্তি ওকে দুর্বোধ্য করে তুলল। ও একহাতে সামনে থাকা লোকটার পিঠে আঘাত করল। সামান্য আঘাতেই লোকটা অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল। সিয়া ত্রিকোণ লাল কাপড় বেধে রাখা একটা বর্শা দেখতে পেল। ও বর্শাসহ নিশানটা তুলে নিয়ে বিপরীত দিকে দৌড়াতে শুরু করল।

হ্যানস পাহাড়ের উচ্চতা মাত্র সত্তর ফুট। সিয়া ক্লাইম্বিং রোপ বেয়ে পাহাড়ের নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিল। কারন পেছনে বাকি প্রতিযোগীরা ছিল। তারা লড়াই বিহীন প্রতিযোগিতায় হার মেনে নিবে না নিশ্চয়ই? হাতে সময় কম। সিয়া কোনো লড়াইয়ে যেতে চাইছিল না।

সিয়া পাহাড়ের শেষ প্রান্তে ফাটলযুক্ত প্রকান্ড একটি পাথর দেখতে পেল। ও ব্র্যাকার থেকে ক্লাইম্বিং হুকসহ রোপ বের করে আনল। ক্লাইম্বিং হুকটা ফাটলে ভালো করে আঁটকে দিয়ে দড়ির একপ্রান্ত হুকসহ পাথরের সাথে মজবুত করে বেঁধে নিলো। অপরপ্রান্ত নিজের কোমরের সাথে বাঁধল। অতঃপর ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নামতে শুরু করল। যদিও কাজটা বেশ ঝুকিপূর্ণ, কিন্তু এই ঝুঁকিটা অনায়াসেই নিয়ে নিল সিয়া। কারন এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সামনে এখনো অনেকটা বাঁধা পেরিয়ে যেতে হবে। নিচের দিকে তাকাতেই সিয়ার পিলে চমকে উঠল। কোনোক্রমে যদি একবার দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে যায়, তাহলে মৃত্যু অবধারিত।

দ্রুত অথচ সাবধানতা অবলম্বন করে সিয়া পাহাড়ের নিচে নেমে দাঁড়াল। কাঁধে ব্র্যাকার, হাতে বর্শাসহ লাল নিশান নিয়ে ও আবারও ছুটতে আরম্ভ করল। উদ্দেশ্য নিজের ঘোড়া। ছুটতে ছুটতে সিয়া ওর ঘোড়ার কাছে পৌঁছে গেল। যেখানে নিজের ঘোড়াসহ ইনায়া দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটার ওষ্ঠদ্বয়ে বিজয়ের হাসি দেখা গেল। ওর ছোট বোন প্রায় অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে। কি করে পারলো এই অলস মেয়েটা?

– উমহু। অলস নয়, অসাধারণ একটা মেয়ে। যার ইচ্ছে শক্তি প্রবল। লড়াকু। সহজে হাড় মানে না যে। দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়ে।____ইনায়া মনে মনে ভাবল।

সিয়া দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘোড়ায় চড়ে বসল। উচ্চস্বরে বলল,

– ইনায়া জলদি এসো।

ইনায়া ঘোড়া ছুটাল। দু’বোন ঝড়ের গতিতে ম্যাথস তৃণভূমির দিকে চলল। একে একে বাকিরাও পাহাড় থেকে নেমে এলো। সিয়া আর ইনায়াকে অনুসরণ করল। সিয়া ভরসা পেল। বোন সাথে আছে, যেকোন বিপদের সম্মুখীন হলে দু’বোন একসাথে লড়াই করে জিততে পারবে।

হ্যানস পাহাড়ে যাওয়ার সময় রাস্তাটুকু যেন খুব বেশি দীর্ঘ ছিলো। কিন্তু ম্যাথস তৃনভূমিতে ফিরে আসার রাস্তাটুকু স্বল্প মনে হলো। রাস্তায় কোনো দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়নি ওদের। ওরা দু’জন অনায়াসেই ম্যাথস তৃনভূমিতে এসে পৌঁছাল। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। হৈ-হুল্লোড়ের দাপটে ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়ে ইনায়া দু’হাতে কান চেপে ধরল। ক্রিসক্রিংগল স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। সিয়া আসছে। বিজয়ীনির বেশে লাল নিশান হাতে সিয়া আসছে।

– এটা কি সত্যিই সিয়া?

ক্রিসক্রিংগলের বিশ্বাস হলো না। মনে হয় স্বপ্ন দেখছেন। পেছনে ইনায়াকে দেখে তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন। সিয়া ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। লাল নিশানসমেত বর্শাটা ক্রিসক্রিংগলের হাতে তুলে দিল। নিস্প্রভ মুখে দূর্বল কণ্ঠে বলল,

– আপনার আয়োজিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় আপনার মেয়ে বিজয়ী হয়েছে বাবা। পুরস্কারটা না হয় আপনিই নিয়ে নিবেন। আজ যেন আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ জয় করলাম। আমি খুব ক্লান্ত বাবা। বাড়িতে ফিরে যেতে চাই।

সিয়া পরিশ্রান্ত শরীরে পায়ে পায়ে নিজের ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু পেছন থেকে তার বাবার ডাক শুনতে পেল,

– সিয়া।

সিয়া পেছন ফিরে দেখল না। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে কান পেতে রইল।

– আর পাঁচ মিনিট সময় দাও। সবাই একসাথে বাড়িতে ফিরে যাবো।

________★★________

খারকিভ, ওয়াভেল কোট।

ওভারলর্ডের আদেশে দুর্গের সমস্ত ভ্যাম্পায়ারদের রাজসভায় একত্র করেছে অ্যাভোগ্রেডো। কোনো একটা জরুরী বিষয়ে আলোচনা করবে এদুয়ার্দো। দুর্গের দূর্বল ভ্যাম্পায়ারগুলো সব বেসমেন্টের অন্ধকার কামরায় দিনের অর্ধেকটা সময় অর্ধজীবিত অর্ধমৃত অবস্থায় কফিনে শুয়ে রয়। ওরা সূর্যের সামান্য আলোও সহ্য করতে পারে না। ওদের মধ্যে শ্যারন একজন।

সুবিশাল রাজকীয় কামরার দু’পাশে কতগুলো আসন। মাঝখানে ওভারলর্ডে সিংহাসন। হিরে খচিত সোনার সিংহাসনের দু’পাশে দু’টো সিংহের মূর্তি বসিয়ে রাখা ছিল। বৃহৎ হা করে ভয়ংকর লাল চক্ষুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিংহ দু’টো। যেন জীবন্ত। যেকোন সময় ভ্যাম্পায়ারগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

হঠাৎই অধৈর্য হয়ে উঠল চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী শ্যারন। তার আজ পিদর্কা স্যাভেরিনের সাথে কাস্ত্রোরুজ থর্পে যাওয়ার কথা ছিলো। ডিয়েটসের নাতনির করা আঘাতের ক্ষতটা শুকিয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে তার সমস্ত শিরা-উপশিরায়। যতক্ষণ না পর্যন্ত ঐ মেয়েটাকে নিজ হাতে মৃ’ত্যু দিতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে।

দরজার পাশে অ্যাভোগ্রেডো দাঁড়িয়ে আছে। অকস্মাৎ রাজসভায় এদুয়ার্দো প্রবেশ করল। উপস্থিত প্রত্যেকে দু’হাটু মুড়ে বসে পড়ল। বুকের কাছে হাত মুষ্টিবদ্ধ রেখে নত মস্তকে তাকে সম্মান জানাল। সমস্বরে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

– অনারেবল ওভারলর্ড।

এদুয়ার্দো নিজের সিংহাসনে গিয়ে বসল। বাকিরা নিজেদের আসন গ্রহন করল। কামরায় পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। ক্ষণকাল সময় গড়াল। প্রত্যেকে মাথা নত করে নিশ্চুপ বসে রইল। যেন কামরায় কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। সহসা নীরবতা ভেঙ্গে হিংস্র কন্ঠে গর্জন করে উঠল এদুয়ার্দো,

– থমাস কিম্বার্লি!

থমাস কিম্বার্লি ভ্যাম্পায়ারদের সেনাধ্যক্ষ। এদুয়ার্দোর ডাকে চমকে উঠল সে। রক্তশূণ্য মুখে চোখ তুলে তাকাল। আসন থেকে ত্বরিত মেজেতে হাঁটু গেঁড়ে বসল। নত মস্তকে ভীতস্বরে বলল,

– অনারেবল ওভারলর্ড। আমি…..।

বাক্য সম্পূর্ণ করতে দিল না এদুয়ার্দো। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গিয়ে একহাতে কিম্বার্লির গলা চেপে ধরল। ক্রোধের আধিক্যে তার চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে উঠল। ঠোঁট দু’টো মৃদু কাঁপছিল। চোখগুলো ভয়াবহ রক্তবর্ণ। কিম্বার্লিকে সজোরে পাথুরে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল। শক্তিশালী আঘাতের দাপটে কিম্বার্লি পাথুরে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল। বাকিরা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

কিম্বার্লি উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এদুয়ার্দো তাকে পুনরায় আঘাত করল। প্রতিবার দেয়ালে আছড়ে ফেলল। কিম্বার্লি ক্ষত-বিক্ষত হলো। যেন তার হাড়পাঁজরগুলো সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল। কথা বলার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।

শেষবারের মতো কিম্বার্লি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। এদুয়ার্দো তার বুকের উপর পা চেপে ধরল। হুংকার ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,

– মেয়েগুলো কিয়েভের কোন ক্যাসলে যায়?

– আমি জানি না।

এদুয়ার্দো পায়ের জোর বাড়াল। আরও শক্ত করে চেপে ধরল। বজ্রধ্বনি তুলে ডাকল,

– অ্যাভোগ্রেডো।

অ্যাভোগ্রেডো তার হাতে কাঠের হাতলবিশিষ্ট একটি লোহার তলোয়ার তুলে দিল। এদুয়ার্দো তলোয়ারটা কিম্বার্লির হৃদপিণ্ডে গেঁথে দিল। কিম্বার্লি বীভৎস চিৎকার দিয়ে উঠল। ক্ষীণস্বরে বলল,

– স্যাভেরিন ক্যাসল।

এদুয়ার্দোর ক্রোধ বেড়ে গেল। তলোয়ারটা আরও একটু গেঁথে দিলো। মুখ দিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না। যেন তার রাগান্বিত দৃষ্টিই কিম্বার্লিকে পরবর্তী প্রশ্ন জানিয়ে দিলো।

– আমি সত্যি বলছি। আপনার সম্মুখে মিথ্যে বলার দুঃসাহস কারো নেই। মেয়েগুলোকে অনারেবল এমপ্রেসের নির্দেশে স্যাভেরিন ক্যাসলে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদুয়ার্দো বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস করল না। তার মা কেনো প্রতিনিয়ত এতোগুলো মেয়েকে ক্যাসলে পাঠানোর নির্দেশ দিবেন? যদি এরকম কোনো নির্দেশ দিয়েও থাকেন তাহলে এদুয়ার্দোর থেকে বিষয়টা কেনো লুকিয়ে যাবেন?

– আমার মা পিদর্কা স্যাভেরিন। ভ্যাম্পায়ার হওয়া সত্ত্বেও যিনি কোমল হৃদয়ের নারী। একদিন তিনিই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, এদুয়ার্দো! আমার সাহসী বাবা। কখনো কোনো নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যা করো না। তিনি এমন একজন ভ্যাম্পায়ার সম্রাজ্ঞী যিনি কিনা স্বামীর হত্যাকারী ডিয়েটসকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমি নিজহাতে ডিয়েটসের প্রাণ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার অনুরোধে বুড়োটাকে শুধুমাত্র কালকুঠুরিতে বন্দী করে রেখেছি। আমার মায়ের হাজারো গুনের কথা আমি জানি। তাকে বিমুগ্ধ নয়নে দেখি। তার হাতের কোমল স্পর্শে আমি অনাবিল শান্তি খুঁজে পাই। তার কোলে মাথা রাখলে জীবন ধন্য মনে হয়। তিনি কখনো আমার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকাননি। লুকাতে পারেন না।

এদুয়ার্দো কথাগুলো মনে মনে ভাবল। নিজের মায়ের নামে মিথ্যা অপবাদ শুনে অসামান্য ক্রোধে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। কিম্বার্লিকে আর কোনো প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করল না। বুক থেকে তলোয়ারটা তুলে নিয়ে এক কোপে ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলল। ভয়াবহ আতংকে উপস্থিত প্রত্যেকের গলা শুকিয়ে গেল। থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল। এদুয়ার্দো অ্যাভোগ্রেডোকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– এই বিশ্বাসঘাতকের দ্বিখণ্ডিত দেহ অগ্নিকুণ্ডে জ্বালিয়ে দিবে এখুনি।

এদুয়ার্দো পুনরায় নিজের সিংহাসনে গিয়ে বসল। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

– ওভারলর্ড এদুয়ার্দো কাউকে কৈফিয়ত দেয় না। শুধুমাত্র মৃ’ত্যুদন্ড দেয়। সমগ্র ভ্যাম্পায়ার জাতি জানে, এদুয়ার্দো কতটা হিংস্র। সুতরাং বিন্দুমাত্র ভুল করার সুযোগ নেই। কিম্বার্লি যার হয়েই কাজ করুক, ওর বিশ্বাসঘাতকতার শান্তি ছিলো মৃ’ত্যু।

এতটুকু বলে এদুয়ার্দো দাঁড়িয়ে পড়ল। থমথমে পা ফেলে রাজসভার বাইরে বেরিয়ে গেল। কিম্বার্লি ভ্যাম্পায়ারদের সেনাধ্যক্ষ। বয়সে এদুয়ার্দোর সমবয়সী। তীরন্দাজ এবং যুদ্ধবিদ্যায় বেশ পারদর্শী ছিলো। সেভেরোদোনেৎস্ক থেকে ফেরার সময় জেলেনস্কির পিঠে লাগা তীর’টা এদুয়ার্দো নিজের সাথে করে দুর্গে নিয়ে এসেছিলো। যেটা টেবিলের উপর অবহেলায় পড়ে ছিলো। আজ শিকার থেকে ফিরে আসার পর হঠাৎই তীরটা এদুয়ার্দোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গরম তাজা রক্তে তৃষ্ণা মেটানোর পর তার মাথা ঠান্ডা ছিলো। সে তীরটা হাতে নিয়ে মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করেছিল। এদুয়ার্দোর বেশ ভালো করে জানা ছিলো এই ধরনের তীর শুধুমাত্র কিম্বার্লিই ব্যবহার করে। সুতরাং জেলেনস্কিকে উদ্দেশ্য করে তীরটা সেইই ছুঁড়েছিলো। এ ব্যাপারে এদুয়ার্দো পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো। অতঃপর বিশ্বাসঘাতকটাকে সে নিজ হাতে শাস্তি দিলো। এবার তাকে খুঁজে বের করতে হবে প্রধান অপরাধীকে। যে কিনা নিজের সমস্ত অপরাধ তার মায়ের উপর চাপাতে চাইছে।

_______★★_______

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে বাড়িতে ফিরতে। তিনটে ঘোড়া সিয়াদের পশ্চাদ্ভাগের উঠানে এসে থামল। একে একে ঘোড়া থেকে তিনজন নেমে দাঁড়াল। সিয়া ক্রিসক্রিংগলের হাতে নিজের ঘোড়ার বকলস ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে গেল। ওর মন কেমন করে উঠল। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই থমকে গেল। অজানা ভয়ে মুহূর্তেই শরীর কাঁপতে শুরু করল। সম্পূর্ণ বাড়িটাই কেমন অন্ধকার হয়ে ছিল। কোথাও কোনো লন্ঠন নেই। সিয়া উচ্চস্বরে ডাকল,

– মা! মা!

কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সিয়া ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বারকয়েক ডাকল,

– মা! দাদিন!

সিয়ার হৃদপিণ্ডের সাথে গলা কাঁপতে শুরু করল। ওর ডাক শুনতে পেয়ে ক্রিসক্রিংগল আর ইনায়া ছুটে এলো। পুরো বাড়ি অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখতে পেয়ে সিয়ার মতো দু’জনেই হতবাক হল। সিয়ার পা যেন অসাড় হয়ে এলো। করুন কন্ঠে আকুল হয়ে ডাকল,

– মা, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?

আর একপা এগুতেই কোনো কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ল। অন্ধকার আরও খানিকটা গাঢ় হয়ে এলো। আশেপাশের কোনোকিছুই দেখা যাচ্ছিল না। ইনায়াও শঙ্কিত গলায় উচ্চস্বরে ডাকল,

– মা! দাদিন!

ক্রিসক্রিংগল রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেলেন। পায়ের কাছে নরম কিছু অনুভব করে সিয়া মাটিতে হাতরাতে শুরু করল। হঠাৎ ভয়ানক চিৎকার দিয়ে উঠল,

– বাবা!

লন্ঠন হাতে দৌড়ে এলেন ক্রিসক্রিংগল। মুহূর্তেই তিনটা দেহের হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। মাটির উপর নিথর দেহে শুয়ে আছেন উরসুলা ভনডারলেন। মুখখানা মাত্রারিক্ত ফ্যাকাশে। ঠোঁট দু’টো কালচে বর্ণ। সিয়া যেন চিৎকার দিতেও ভুলে গেল। আঘাত সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে গেলেন ক্রিসক্রিংগল। ইনায়া নির্বাক, নিশ্চল। অকস্মাৎ নিষ্প্রাণ কন্ঠে সিয়া ডেকে উঠল,

– দাদিন, দাদিন উঠুন। মা কোথায় বলুন।

উরসুলা সাড়া দিলেন না। সিয়া তড়িঘড়ি করে তার বুকের বাপাশে মাথা রাখল। হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু বক্ষস্থলের ভেতর থেকে হৃৎস্পন্দনের শব্দ এলো না। সিয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে বৃদ্ধার নাকে হাত রাখল। অথচ উরসুলার নিঃশ্বাস পড়ছিল না। ইনায়া হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। এক দৌড়ে বারান্দায় উঠে গেল। বারান্দার মাঝখানে সাসোলী কুরীকে পড়ে থাকতে দেখল।

– হানি!____

ইনায়া চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর কান্নায় ক্রিসক্রিংগল আর সিয়া দৌড়ে গেল। সাসোলি কুরীকে শরীর ঝাঁকিয়ে ডাকতে লাগল ইনায়া,

– হানি, হানি উঠো।____

সাসোলি কুরী সাড়া দিলেন না। সিঁড়ির প্রথম ধাপে উল্টে পড়ে আছেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী। প্রথমদিকে ক্রিসক্রিংগল কেমন জ্ঞানশূন্য বোধ করলেন। ইনায়া তাকে ডাকল,

– বাবা, বাবা! কেউ আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেন? সবাইকে উঠতে বলুন। কথা বলতে বলুন।

ক্রিসক্রিংগল ইনায়ার ডাকে নিজের সম্বিত ফিরে পেলেন। ছুটে গিয়ে উরসুলাকে জাপ্টে ধরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সিয়ার কাছে সবটাই কেমন দুঃস্বপ্ন মনে হলো। সহসা চোখের সামনে কিছু একটা দেখে ওর গলা দিয়ে অস্পষ্ট করুণ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো,

– মা!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।