কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
সশব্দে দরজা খুলে আব্রাহামের কামরায় প্রবেশ করে এদুয়ার্দো। তার চোখে মুখে বিচক্ষণতা, অচাঞ্চল্য। পুরো কামরায় কোথাও আব্রাহামকে দেখা যায় না। সব জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে ছিলো। পরিধেয় পোশাকগুলোও এদিকে সেদিকে ছড়ানো ছিটানো। আসবাবপত্রে ময়লার স্তুপ জমে গেছে। এদুয়ার্দো অভিনিবেশ সহকারে দেখে। তার শান্ত মুখশ্রীর চোয়ালদ্বয় হঠাৎই শক্ত হয়ে উঠে। পরমূহূর্তেই নিজেকে আবারও যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করে। পেছন ফিরে দাড়াতেই পিদর্কার সম্মুখীন হয়। ছেলের কঠিন মুখখানার দিকে তাকিয়ে পিদর্কা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,
– কি হয়েছে? আব্রাহাম কি করেছে? সেদিনের পর থেকে ও আমাদের সাথে দুর্গে বন্দি আছে। তুমি হঠাৎ ওর খোঁজ করছো কেনো?
এদুয়ার্দো প্রত্যুত্তর দেয় না। থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে,,,
– পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি মা। আব্রাহামকে আমার সামনে হাজির করুন।
– ও নিজের কামরাতেই ছিলো। এখন কোথায় আছে কিভাবে বলবো?
– যেখানেই থাকুক। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি ওকে আমার সামনে দেখতে চাই।
নিজের কথা শেষ করে এদুয়ার্দো হলরুমের দিকে চলে যায়। পিদর্কা ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। পরবর্তী পরিকল্পনা করে। কিভাবে এদুয়ার্দোকে প্রাসকোভিয়া জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে পাঠানো যায়।
________
ইম্যুভিল।
ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দুরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আব্রাহাম। নির্দিষ্ট একটা সীমানার মধ্যে আঁটকে গেছে সে। সামনে এগোতে পারছে না। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বারবার বাঁধা প্রদান করছে। ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে প্রবেশ করতে গিয়েও সজোরে বারি খেয়ে অদুরে ছিটকে পড়ছে।
ঘটনাটা আব্রাহামকে কাস্ত্রোরুজ থর্পের সেই শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যারিয়ারের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেরকম ব্যারিয়ার দেওয়া ছিলো কাস্ত্রোরুজ থর্পে। নিজে থেকে কয়েকবার চেষ্টা করার পর একজন সহৃদয়বান ব্যক্তির সাহায্যে কাস্ত্রোরুজ থর্পে প্রবেশ করেছিলো সে। এবারও কি কারো সাহায্য নিয়ে ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে প্রবেশ করা যাবে? কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে সাহায্য করবে কে?
ক্রমে ক্রমে আব্রাহামের হৃদয় অস্থির হয়ে উঠে। দম আঁটকে আসে। প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মিনিট কয়েক যুগের মতো দীর্ঘ বলে মনে হয়। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে সে? এখানে পৌঁছানোর পর বেশ কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেছে। আশে পাশে কোনো লোকজনের চিহ্ন মাত্র নেই। আদৌও কি কেউ তাকে সাহায্য করবে? কাস্ত্রোরুজ থর্পের সেই ব্যারিয়ারটা না হয় উইজার্ড ডিয়েটস দিয়েছিলো। কিন্তু ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে এরকম সুরক্ষা ব্যারিয়ার কে দিয়েছে?
আব্রাহামের রাগ হয়। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। রাস্তার উল্টো দিক থেকে একসাথে দু’জন মাঝবয়সী লোক আসতে দেখা যায়। বাজার থেকে বাড়ির দিকে ফিরছিলো তারা। দু’জনের হাতে দু’টো করে বাজারের ব্যাগ। লোক দু’টো কাছাকাছি পৌঁছেতেই আব্রাহাম মুখ আড়াল করে একপাশে সরে দাড়ায়। তারা কি যেন বলাবলি করছে। হঠাৎই একজন লোক ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে সকরুণ কন্ঠে বলে,,,,
– এ বাড়িতে কি হয়েছে কে জানে। পরপর দু’দিন দু’ দু’টো মেয়ে নিরুদ্দেশ। প্রথমদিন ছোট বোন, তারপরের দিনই বড় বোনটা হারিয়ে গেছে।
– ওরাতো জনাব ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলো। শুনেছি ওদের বাবা নাকি অনেকদিন ধরে বাড়ি ছেড়ে গেছে।___স্বাভাবিক কন্ঠে কথাটা বলে দ্বিতীয়জন।
তার কথা শুনে প্রথম জন প্রত্যুত্তর দেয়,,
– হ্যাঁ।
– এখন পর্যন্ত কি একটা মেয়েকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি?
– জানি না। ____প্রথমজন হতাশ কন্ঠে বলে।
– আপনারা কি কোনোভাবে সিয়া-ইনায়ার কথা বলছেন?_____সহসা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে আব্রাহাম।
লোক দু’টো হতবাক দৃষ্টিতে তাকায়। এরকম সুদর্শন মানুষ জীবনে আগে কোনোদিনও দেখিনি তারা। আব্রাহামের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়। শ্বেতশুভ্র মুখখানার নীলাভ নেত্র আর লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রয়। আব্রাহাম অধৈর্য হয়ে উঠে। খানিকটা উচ্চস্বরে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,,,
– আপনারা কি সিয়া-ইনায়ার কথা বলছেন?
লোক দু’জন নিজেদের চেতনা ফিরে পায়। প্রথমজন গলা ঝেড়ে স্পষ্ট কন্ঠে বলে,,,,
– হ্যাঁ। ছোট বোনের নাম ফ্লোরেনসিয়া, বড় বোনের নাম ইনায়া ইবতিসাম।
লোকটা জানে না, গতকাল মাঝরাতে সিয়া বাড়িতে ফিরে এসেছিলো। ফিরে এসেছিলেন ক্রিসক্রিংগল। তারা যতটুকু জানে, ততটুকু নিয়েই দু’জনের মধ্যে আলোচনা করছিলো।
উড্রো উইলসনের ভাষ্য মতে অনারেবল ওভারলর্ড ইনায়াকে তুলে নিয়ে গেছেন। তিনি কি প্রথমে সিয়াকে তারপর ইনায়াকে নিয়ে গেছেন? কিন্তু মহারাজের এরকম করার উদ্দেশ্য কি? মামা মশাই-ই বা শুধুমাত্র ইনায়ার কথা বললেন কেনো? তিনি কি সিয়ার নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ পাননি।- আব্রাহাম ভাবে। দুর্দম্য বুক পোড়া জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করে। এদুয়ার্দোর ব্যাপারে এই তিক্ত সত্যি বিশ্বাস হয়না। তার মন-মস্তিষ্ক যেন মানতে চায়না। সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে লোক দু’টোকে জিজ্ঞেস করে,,,,
– নিশ্চিত হয়ে বলছেন? ওরা দু’জনেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে? আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে নাতো?
– ভুল হবে কেনো? পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে বলছি। কিন্তু তুমি কে? ওদের কোনো আত্নীয়? তাহলে বাড়ির ভিতরে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি করছো?___প্রথমজন সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আব্রাহামকে জিজ্ঞেস করে।
আব্রাহামের পক্ষে আর এক মূহুর্তও স্থির দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়না। লোকটার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। লোক দু’টো সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখে।
★★
বিষন্ন বদনে কামরার দোরগোড়ায় বসে ছিলেন মাদাম ল্যারি। আর্নি বিনাছায় শুয়ে শুয়ে দু’চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলো। সিয়া, ক্রিসক্রিংগল, ক্রিস্তিয়ান, মার্কস আর মার্টিন লরেন্স মিলে ভোর রাতেই ইনায়ার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন। কোথায় খুঁজবেন, কখন আর কিভাবে খুঁজে পাবেন, জানা নেই কারো। মনের কোণে ইনায়াকে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিলো বেশ গাঢ়। স্ট্রিকল্যান্ড আর ফ্রাঙ্কলিনও অবশ্য তাদের সাথে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। কিন্তু দু’জনের একজনকেও সাথে নেননি মার্টিন লরেন্স।
ফ্লোরেনসিয়ার ভয়াবহ কঠিন জীবন আজ থেকেই শুরু হলো। নিজের মেয়েকে পাথরের মতো শক্ত, দুঃসাহসী, আক্রমণাত্মক আর শক্তিধর করে তুলতে মার্টিন ঠিক কি কি পদক্ষেপ নিতে পারেন, ভাবতেই ফ্রাঙ্কলিনের অবিরত বুক কাঁপতে শুরু করে। কর্ণকুহরে বাজতে থাকে ফ্রাঙ্কলিনের উদ্দেশ্যে গম্ভীর মুখে মার্টিনের করা একটাই প্রশ্ন,,,,,
– আপনারা এতোগুলো মানুষ থাকতেও মেয়েটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেন না বাবা?
ফ্রাঙ্কলিন অপরাধীর মতো স্থির দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন। কোনো উত্তর দিতে পারেননি। ভুল ছিলো। ইনায়াকে একাডেমিতে যেতে দেওয়া একদমই উচিত হয়নি।
সিয়া এখনো জানে না ওর আসল পরিচয়। জানলেও হয়তো বিশ্বাস করবে না। প্রচন্ড আঘাত পাবে। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়তে পারে। অথবা পুনরায় হয়ে যেতে পারে পাথরের মতো নিষ্প্রাণ। ক্রিসক্রিংগলকে কতটা ভালবাসে সিয়া, সেকথা এ বাড়ির সবাই জানে। ক্রমশই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। আরও কত ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় তা কেবলই ঈশ্বর জানেন। ফ্রাঙ্কলিন মনে মনে মহান যিশুর নাম স্মরণ করেন।
________
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
পাঁচ মিনিটের জায়গায় প্রায় আধঘন্টা সময় চলে গেছে। সম্পূর্ণ দুর্গের ভিতরে-বাইরে কোথাও আব্রাহামকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদুয়ার্দোর সামনে ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে দাঁড়ানো ব্রাংকো আর উড্রো উইলসন। সোফার উপর বসে আছেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
আব্রাহামের কামরাটা থাকার উপযোগী ছিলো না। এদুয়ার্দো নিশ্চিত, বেশ অনেকদিন ধরে কেউ থাকে না উক্ত কামরায়। এতো ধুলো বালি আর অগোছালো কামরায় কেউ কিভাবে থাকতে পারে? তাহলে দুর্গে বন্দি হওয়ার পর থেকে আব্রাহাম ছিলো কোথায়?
– অন্য কোনো কামরায় নাকি বেসমেন্টে?____এদুয়ার্দো মনে মনে ভাবে। স্যাভেরিন ক্যাসলের বেসমেন্ট নিয়ে কোনো দিনও মাথা ঘামায়নি সে। বিস্তৃত আয়তন জুড়ে বানানো বেসমেন্টের সম্পূর্ণটা ঘুরে দেখা হয়নি একবারও।
– স্যাভেরিন ক্যাসলে কি চলে মা?
হঠাৎ করে করা এদুয়ার্দোর এমন প্রশ্নে ভড়কে যান পিদর্কা স্যাভেরিন। হুট করে তখন এদুয়ার্দোকে বলেছিলেন, আব্রাহাম নিজের কামরায়। মনে ছিলো না, কামরাটা অযত্নে অবহেলায় ক্রমশই থাকার অনুপযোগী হয়ে গিয়েছিলো। এদুয়ার্দো হঠাৎ ক্যাসল নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল কেনো? তার করা দুর্দান্ত পরিকল্পনা কি তার নিজের জন্যই ঘোর বিপদ বয়ে আনবে?
ওদের ছোট বেলা থেকেই দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রাণ বিনাশক শত্রুতা তৈরী করতে চেয়েছিলেন পিদর্কা স্যাভেরিন। একে অপরকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দী বানাতে চেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি বরাবরই ফ্লভেয়ারকে ব্যবহার করেছিলেন। প্রতিবার এদুয়ার্দোকে প্রাণঘাতী আক্রমণ করতো ফ্লভেয়ার, কিন্তু আব্রাহামের উপর গিয়ে জমা হতো সেইসব অপরাধের সমস্ত দায়ভার। এতোকিছুর পরও শুধুমাত্র যুদ্ধের অনুশীলন ব্যতীত এদুয়ার্দো ব্যক্তিগতভাবে কখনো আব্রাহামকে পাল্টা আক্রমণ করেনি। নিজের ছোট ভাইকে এতোটাই ভালবাসতো সে। এদুয়ার্দোর প্রতি আব্রাহামের ভালবাসাও ছিলো অতুলনীয়, অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পিদর্কা বিস্মিত হতেন। শত চেষ্টা করেও দু’ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করতে পারেননি। কিন্তু দু’জনের মধ্যে মনের দিক থেকে দুরত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রথম থেকেই এদুয়ার্দো ছিলো কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুপুরুষ। যুবতীদের সাথে অবাধ মেলামেশা এবং অহেতুক কোনো মেয়ের সাথে ইন্টিমেট হওয়ার ব্যাপারটা বেশ অপছন্দ করতো। অথচ আব্রাহামের চরিত্রে বহুনারীগামী দোষ লক্ষ করে সে। যার ফলে এদুয়ার্দো আর আব্রাহামের মাঝখানে ধীরে ধীরে দুরত্ব বাড়তে থাকে। আব্রাহামের এই চারিত্রিক দোষের পেছনেও সম্পূর্ণভাবে পিদর্কা স্যাভেরিন দায়ী ছিলো।
– মা।
এদুয়ার্দোর ডাকে নিজের ভাবনার ইতি টানেন পিদর্কা স্যাভেরিন। অকপটে জিজ্ঞেস করেন,,,
– ক্যাসলে কি চলবে?
– সেটাতো আপনি আমাকে বলবেন।___এদুয়ার্দো শান্ত কন্ঠে বলে। মায়ের প্রতি কঠোর আচরণ করতে পারে না সে। শত হলেও পিদর্কা তার মা। সব ছেলেরাই বাবার তুলনায় মায়ের প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়। সেখানে এদুয়ার্দো নিজের মাকে অসম্ভব ভালবাসে। বাবাকে কোনোদিনও দেখেনি সে। মা’ই ছিলো তার বাবা, মা’ই ছিলো তার সবকিছু।
– আমি তোমার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। ___পিদর্কা স্যাভেরিন বিস্মিত কন্ঠে বলেন।
যত সময় গড়ায় এদুয়ার্দো ততই অধৈর্য হয়ে উঠে। যদি সিয়ার বলা কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি হয়? যদি আব্রাহামের দ্বারা ইনায়া বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়? ভাবতেই ত্বরিত উঠে দাড়িয়ে পড়ে এদুয়ার্দো।
সে কি সিয়ার কাছে দ্বিতীয় বারের মতো অপরাধী হতে ভয় পাচ্ছে? কিন্তু কেনো? সিয়া এদুয়ার্দোর সম্পর্কে যা ভাবে ভাবুক। কিচ্ছু যায় আসে না তার। সিয়ার জন্য নয়, সে নিজের জন্য এখানে এসেছিলো। দেখতে চেয়েছিলো তার দেওয়া শাস্তি অগ্রাহ্য করে আব্রাহাম সত্যিই দুর্গের বাইরে গিয়েছিলো কিনা।
– বেসমেন্টের প্রতিটা কামরায় আব্রাহামকে খুঁজে দেখেছিলো আপনার চামচাগুলো? ওকে দুর্গের ভিতর খুঁজে না পাওয়া গেলে এর শাস্তি কি হতে পারে বুঝতে পারছেন?____এদুয়ার্দো থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে।
– হ্যাঁ। আব্রাহাম বেসমেন্টে নেই।___পিদর্কা আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলেন।
এদুয়ার্দো সামনের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে তার মা ডেকে উঠেন। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,,
– কোথায় যাচ্ছো?
– বেসমেন্টে যাচ্ছি আপনার ছোট ছেলেকে খুঁজে বের করতে।
এদুয়ার্দো বেসমেন্টের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। পিদর্কার গলা শুকিয়ে যায়। তার হাজারো কুকীর্তি লুকিয়ে আছে বেসমেন্টের কতগুলো বদ্ধ কামরায়। ওদিকে ফ্লভেয়ার নিজের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে কিনা কে জানে। এদিকে এদুয়ার্দোকে বেসমেন্টে যাওয়া থেকে আঁটকাতে হবে। যা হয় হোক। পিদর্কা এদুয়ার্দোকে ডেকে দৃঢ় কন্ঠে বলে,,,
– এদুয়ার্দো দাড়াও। আব্রাহাম ওখানে নেই।
এদুয়ার্দো দাড়ায়। পেছন ফিরে অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,
– তাহলে কোথায়?
– দুর্গের বাইরে গেছে ও।
নিমেষেই এদুয়ার্দোর মুখখানা হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। এমারেল্ড সবুজ মনিজোড়া রক্তবর্ণে বদলে যায়। ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– আপনি এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন কেনো মা? ছোট ছেলের দোষ ঢাকতে চেয়েছিলেন? বাঁচাতে চেয়েছিলেন এই অপরাধের ভয়ংকর শাস্তি থেকে?
এদুয়ার্দো থামে। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে। অথচ মুখ দিয়ে একটাও শব্দ করেন না পিদর্কা স্যাভেরিন। এদুয়ার্দো সন্দিহান চোখে দেখে। থমথমে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– চারদিকে কড়া পাহারা থাকা সত্ত্বেও আপনার ছোট ছেলে দুর্গের বাইরে বেরিয়ে যায় কিভাবে?
– আমি কিভাবে বলবো? হয়তো তোমার সেনাধ্যক্ষ এবং সেনারা কেউ বিশস্ত নয়, নয়তো ওরা দুর্গ পাহারায় ত্রুটি রেখেছিলো।
পিদর্কা স্যাভেরিন সহজ সাবলীল কন্ঠে বলেন। এদুয়ার্দো তার দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকায়। সামান্য ঠোঁট বাকায়। বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলে,,,
– আপনি ঠিক বলেছেন। বিশ্বস্ত নয়। যেখানে একজন জন্মদাত্রী মা নিজের ছেলের বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারে, সেখানে অন্যকেউ কেন ভাঙ্গবে না?
পিদর্কা কোনো প্রত্যুত্তর দেন না। এদুয়ার্দো কেনো আব্রাহামের খোঁজ করছে তিনি জানেন না। কিন্তু এটাই মোক্ষম সুযোগ। কোনো ভাবে এদুয়ার্দোকেও পাঠাতে হবে প্রাসকোভিয়ায়। ইনায়ার মৃ’ত দেহের সামনে আব্রাহামকে দেখতে পেলে সে নিশ্চিত হবে, মেয়েটাকে নিজ হাতে হত্যা করেছে তার ছোট ভাই।
– আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিবেন না। আমাকে বলুন আব্রাহাম কোথায়?
– আব্রাহাম কোথায় আমি জানিনা।
– আপনি অবশ্যই জানেন। আপনার অপকর্মের সঙ্গী, আপনার ছোট ছেলে কোথায়, আপনি জানেন না তা কি করে হয়? আমার ভালবাসাকে আমার দুর্বলতা ভাববেন না। ওর করা যেকোন অপরাধের শাস্তি আপনাকেও ভোগ করতে হবে।
পিদর্কা ভয় পান। এদুয়ার্দোর কথাটায় কিছু একটা ছিলো। কন্ঠস্বর দৃঢ়। ফাঁকা আওয়াজ ছিলো না। শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছে না। সে সত্যিই দ্বিতীয়বার ক্ষমা করবে না। ফ্লভেয়ার এতোক্ষণে মেয়েটাকে মে’রে ফেলতে সক্ষম হয়েছে কিনা কে জানে। এখনো দুর্গে ফিরে আসছে না সে। আর কতক্ষণ এদুয়ার্দোকে আঁটকে রাখা যায়? ভাবতে ভাবতেই মুখখানা বেশ করুন করে পিদর্কা স্যাভেরিন এদুয়ার্দোর দিকে তাকান। অশ্রুসিক্ত চোখে ব্যথাতুর কন্ঠে বলেন,,,,
– আমি তোমাকে বলতে চাই বাবা। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও আব্রাহামকে এই শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দিবে। আমি আমার কোনো সন্তানকেই চিরতরে হারাতে চাইনা।
এদুয়ার্দোর কপাল কুঞ্চিত হয়। মৃদুমন্দ বুক কাঁপতে শুরু করে। ফ্লোরেনসিয়ার কথাটা সত্যি না হয়ে যায়। পিদর্কা দু’চোখের পানি ছেড়ে দেন। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে আকুপাকু করে বলেন,,,,
– আব্রাহাম প্রাসকোভিয়ায় গেছে। জঙ্গলের দক্ষিণের দিকে। ইনায়া ওর সাথে আছে। তুমি মেয়েটাকে বাঁচাও। আমার ছেলেটাকে দুর্গে ফিরিয়ে আনো। আমি ওকে জীবিত দেখতে চাই।
– মেয়েটাকে বাঁচাও মানে কি? আব্রাহাম কি ইনায়াকে মে’রে ফেলতে চায়?
এদুয়ার্দো বাকরুদ্ধ। স্তম্ভিত হয়ে কয়েক পল ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। আব্রাহাম কিভাবে দুর্গের বাইরে গেছে তা পরে দেখবে। প্রথমে ইনায়াকে রক্ষা করতে হবে। সে ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়। ফ্রন্ট ডোর হয়ে বাতাসের বেগে হলরুমের বাইরে বেরিয়ে যায়। পিদর্কা স্যাভেরিন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।