ইম্যুভিল।
দ্বারপ্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ইনায়া। ক্রিস্তিয়ানের বলা কেবল একটা কথাই ওকে পাথরের মতো স্থির করে দেয়। এক’পা সামনে বাড়ানোর ক্ষমতা নেই যেন। ওর মুখখানা মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ক্রিস্তিয়ানের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। ক্ষণকাল সময় গড়ায়। ইনায়া নিজের সম্বিত ফিরে পায়। উচ্চস্বরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে,,,,
– আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
– আমি যা বলছি, তা এই দিনলিপি পড়ে জানতে পেরেছি। সত্যি কিনা মিথ্যা তুমি নিজেই যাচাই করে নিও।___ক্রিস্তিয়ানের ম্লান কন্ঠ।
বিশ্বাস হয় না। ক্রিস্তিয়ান যা বলছে, তা কখনো সত্যি হতে পারে না। ইনায়ার ডুকরে কান্না পায়। অশ্রুসিক্ত দু’চোখের কাতর দৃষ্টি মেলে ফ্রাঙ্কলিনের দিকে তাকায়।
— বহু বছর ধরে কিছু মানুষ একের পর এক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। শুধুমাত্র এই জিনিষগুলো রক্তপিপাসুদের থেকে রক্ষা করার জন্য। এমনকি তোমার দাদা, দাদিন আর মা’ও। তুমি কি তাদের আত্মবলিদান এতোটাই তুচ্ছ মনে করো?___ফ্রাঙ্কলিনের অকপট প্রশ্ন।
স্ট্রিকল্যান্ড স্বাক্ষী ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় এই জিনিসগুলোর জন্য ওরা তিনজন মানুষকে নৃ’শংসভাবে হ’ত্যা করেছিলো। মৃ’ত্যুর আগমুহূর্তেও হার স্বীকার করেননি উরসুলা। ইনায়ার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে কথা বললেন মাদাম ল্যারি,,
– সিয়াকে অক্ষত অবস্থায় বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং এই জিনিসগুলো নিজেদের কাছে সুরক্ষিত রাখা দু’টোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তুমি কি একবারও বোঝার চেষ্টা করবে না, কেনো তোমার দাদু এতোগুলো বছর ধরে এগুলো লুকিয়ে রেখেছিলো?
ইনায়া তবুও নিরুত্তর। ওর বক্ষস্থলে বয়ে যায় দুর্দমনীয় ঝড়। হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। ভীষণ গলা শুকিয়ে আসে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পরপর দু’বার দু’দিকে মাথা নাড়ায় ও। কেমন হাঁসফাঁস করতে শুরু করে। এইটুকু জীবনে পাওয়া এতো এতো দুঃখ যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করবে? হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। মনে হয় গহীন সমুদ্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে ও। মুখের উপর হাত রেখে হা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। আর্নির চোখগুলো যেন কোটর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবে।
অবশ হয়ে আসা পায়ে হেঁটে গিয়ে ইনায়া বিছানার উপর বসে। কম্পিত গলায় অনুচ্চস্বরে বলে,,,,
– আমাকে একা ছেড়ে দিন। আর্নিকেও সাথে নিয়ে যান।
ইনায়ার মানসিক অবস্থা বেশ বুঝতে পারে সবাই। কেউ কোনো কথা বাড়ায় না। আর্নিকে সাথে নিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।
বিছানায় শুয়ে ইনায়া অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে। দিনলিপিটা পড়ার সাহস পায় না। কিন্তু পড়তে হবে ওকে। অতঃপর সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভাবতে ভাবতেই কাঁপা কাঁপা হাতে দিনলিপির পৃষ্ঠা উল্টায়। বিরামহীন অশ্রুকণায় দু’চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। তবুও ইনায়া পড়তে শুরু করে।
★★
সাল ১৭৫১।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে ইউক্রেনের শাসক ছিলেন বাওলিও স্যাভেরিন। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা তার পুত্র রাফায়েল স্যাভেরিন তখন বত্রিশ বছরের তরতাজা যুবক। বাবার মতো এতোটা ভীতু আর নির্বোধ ছিলেন না তিনি। প্রতিবাদী ছিলেন। পি’শাচদের দাসত্ব মেনে নিতে চাননি। কিন্তু তার একার পক্ষে পি’শাচদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। যেখানে তার বাবা ইউক্রেনের শাসক বাওলিও স্যাভেরিন পি’শাচদের দ্বারা পরিচালিত কাঠের পুতুল। সেখানে ক্ষমতাহীন একলা একজন যুবক অসংখ্য ভ্যাম্পায়ারদের সাথে কিভাবে লড়াই করতেন?
এভাবেই আরও কয়েক বছর কেটে যায়। রক্তপিপাসুদের আতংকে মানুষগুলো নিজেদের কামরা বন্দী করে ফেলে। প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মুহূর্তে মৃ’ত্যুর কবল থেকে বাঁচতে চায়। এতে করেও তারা বাঁচতে পারেনি। এ যেন কোনো ভয়ংকর মহামারী, যার একমাত্র পরিণতি মৃ’ত্যু। গ্রামগুলো দিনের পর দিন যমালয় হতে শুরু করে। মানুষগুলো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলে, এমন কাউকে পাঠাতে যে কিনা রক্তচোষাদের থেকে সাধারণ মানুষগুলোকে রক্ষা করতে পারে।
পাঁচ বছর পর। সময় বদলায়। হাত বদল হয় ক্ষমতার।
সাল ১৭৫৬।
বাওলিও স্যাভেরিনের মৃ’ত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র রাফায়েল স্যাভেরিন। রাফায়েলের ছিলো দু’জন কন্যা সন্তান। তখনো তার স্ত্রী’র কোনো পুত্র সন্তান জন্ম নেয়নি। স্ত্রী জোয়ানা স্যাভেরিন তার দুই কন্যাকে নিয়ে সর্বদা ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতেন। অর্ধাঙ্গ রাফায়েল প্রতিবাদী। যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন। যদি উয়াসওয়াভার বিরুদ্ধে চলে যান! তাহলে স্যাভেরিন পরিবারে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। র’ক্তচোষাদের নৃশংসতার শিকার হয়ে সবাই মা’রা যাবেন। শুধুমাত্র কুইন জোয়ানা আর বাচ্চা দু’টোর কথা চিন্তা করে সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করেন রাফায়েল। বুঝতে পারেন, কেনো তার বাবা বাওলিও একজন শাসক হয়েও নিশ্চুপ ছিলেন। কেনো কাঠ পুতুলের মতো পি’শাচদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
পরিবার আর সন্তানদের জীবন রক্ষার স্বার্থে রাফায়েল নিজের বাবার মতো উয়াসওয়াভার আনুগত্য স্বীকার করে নেন। কিন্তু তিনি নিজের বিশ্বস্ত সেবক দিয়ে এমন কিছু মানুষের সন্ধান করে বেড়াতেন, যাদের কাছ থেকে কিনা উয়াসওয়াভা এবং তার মেয়েদের বি’নাশ করার উপায় জানতে পারবেন।
উয়াসওয়াভার কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। শুধুমাত্র তিনজন কন্যা সন্তান ছিলো। যাদের আসল বাবা কে, সে সম্পর্কে কেউ কোনদিনও জানতে পারেনি। আদৌও কি তাদের একজন বাবা ছিলো? নাকি বাচ্চাগুলো অবৈধ? এই উত্তর রাফায়েলও জানতেন না। কখনো প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাননি।
নিজের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় খুশি ছিলেন রাফায়েল। অন্তত তার পুত্রকেও এসব অন্যায় মেনে নিতে হবে না। বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হবে না পি’শাচদের। রাফায়েলই বোধহয় প্রথম শাসক, যিনি পুত্র সন্তানের পিতা না হওয়ায় আনন্দিত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই একদিন তার সমস্ত আনন্দ আতংকে পরিনত হয়। যখন তিনি জানতে পারেন, তার অর্ধাঙ্গিনী কুইন জোয়ানা পুনরায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করেন, যেন এবারও তার কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু ঈশ্বর হয়তো অন্যকিছুই চেয়েছিলেন। তাই স্যাভেরিন ক্যাসল আলো করে জন্ম নেয় একজন পুত্র সন্তান। যার নাম রাখা হয় ক্লিফটন।
রাফায়েল ভয় পান। তিনি আরও মরিয়া হয়ে উঠেন। সৈন্য লাগিয়ে এমন একজন লোক খুঁজতে শুরু করেন, যে কিনা উয়াসওয়াভার হাত থেকে তার পুত্রকে, তার পরিবারকে বাঁচাতে পারেন।
রক্তপিপাসু বি’নাশ করতে লোক খুঁজছিলেন রাফায়েল। সেকথা জেনে যায় উয়াসওয়াভা। ফলসরুপ রাফায়েলের দুই কন্যাকে মে’রে তাদের রক্তপান করে সে। রাফায়েল স্তম্ভিত। জ্ঞানশূন্য। ইউক্রেনের ভূমি থেকে পি’শাচ নির্মূলের ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে যায়। কেমন পাথরের মতো নিশ্চুপ, নির্বাক হয়ে যান। ঠিক তখনই ইউক্রেনের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো উদিত হয় একজন বিখ্যাত জাদুকর। যার নাম ছিলো ফিদেল আলেকজান্দ্রো কাস্ত্রোরুজ।
– ফিদেল আলেকজান্দ্রাে কাস্ত্রোরুজ?____অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করে ইনায়া। গভীর নিদ্রায় ওর চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে। তাকিয়ে থাকতে পারে না দিনলিপির দিকে। পাশ থেকে কেউ একজন যেন বলছে। রাত গভীর হয়ে গেছে। তুমি ঘুমাও। এখন তোমার ঘুমিয়ে পড়ার সময়।
_______
খারকিভ, ওয়াভেল কোট।
মাঝরাত। জ্বলন্ত মোমবাতির আলো নিভু নিভু হয়ে আসে। সিয়া নিষ্প্রাণ চোখে দেখে। অনেক চেষ্টা করেও কামরার বাইরে বের হতে পারেনি ও। কাতর কন্ঠে কতবার থ্যাসোকে ডেকেছিলো। পরমুহূর্তেই সিয়ার টনক নড়ে। এখানে পি’শাচদের আস্তানায় এই বদ্ধ কামরায় থ্যাসো কিভাবে আসবে? বেশ অনেকটা সময় গড়ায়। পাশ থেকে সেই অদৃশ্য মেয়েটা কথা বলে,,,,
– ভয় পাচ্ছো?
– আপনি? এখানেও?____মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে উঠে সিয়া।
– হ্যাঁ। আমিতো আত্মা। পৃথিবীর যেকোন জায়গায় খুব সহজেই পৌঁছাতে পারি। অনায়াসেই দেয়ালের এপাশ থেকে অপাশে চলে যেতে পারি। তুমি কি জানো, আমি কে?
– না বললে কিভাবে জানবো?
– আমি তোমার মা।
– মা!______ সিয়ার বিস্মিত কন্ঠ।
– হ্যাঁ।
সিয়ার মন বিষন্ন হয়। মেয়েটা তার সাথে মজা করছে? এটা কি মজা করার মতো সময়? নাকি বিষয়টা মজা করার মতো। সিয়া কয়েকপল নিশ্চুপ রইলো। অতঃপর ম্লান কন্ঠে বললো,,
– আমি এ ধরনের মজা পছন্দ করিনা। আপনি যান। এই মূহুর্তে আপনার সাথে কথা বলতে আমার একটুও ভালো লাগছে না।
– ইনায়ার জন্য দুশ্চিন্তা করছো? ও ঘুমাচ্ছে।
– ইনায়া কেমন আছে? সুস্থ আছে তো?____ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
– দুশ্চিন্তা আর রাত জাগার ফলে ও অসুস্থ হয়ে যেত। তাই আমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি।
– খুব ভালো করেছেন। এখন আমাকে সাহায্য করুন। আমি বাড়িতে ফিরে যেতে চাই। একবার এই বদ্ধ কামরা থেকে বের হতে পারলে, থ্যাসো চলে আসবে আমাকে নিয়ে যেতে।
মেয়েটা কথা বলে সিয়ার সাথে। ধীরে ধীরে সময় গড়ায়। রাতের অন্ধকার শেষে ভোরের আলো নেমে আসে পৃথিবীর বুকে।
★★
ভোরবেলা। বেসমেন্টের একটি বদ্ধ কামরা থেকে একটা ছেলের বীভৎস কন্ঠের করুন আর্তনাদ ভেসে আসে। লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। একজন শক্তপোক্ত বলশালী দেহের মানুষ অবিরত প্রহার করছিলো বেঁধে রাখা ছেলেটাকে। পেছনে রসুন আর কাঠের গজাল হাতে আরও দু’জন মানুষ দাড়িয়ে আছে।
– কিছু স্বীকার করলো ও?_____কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে অ্যাভোগ্রেডো। রসুনের গন্ধ সহ্য করতে না পারায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো সে।
– জ্বি না জনাব। মুখ খুলছে না।
– মা’র খেয়ে মুখ খুলবে বলে মনে হয়না। তোমরা ওর মুখে রসুন ঠুসে দাও। তবুও যদি কিছু স্বীকার না করে, হৃদপিণ্ডে গজাল বসিয়ে দিও।____কঠিন কন্ঠে কথাটা বলে অ্যাভোগ্রেডো। আর্ত চিৎকার থামিয়ে ছেলেটা কাতর কন্ঠে বলে,,,,
– অ্যাভোগ্রেডো। আমি সত্যিই কিছু জানিনা। আমাকে ছেড়ে দাও।
অ্যাভোগ্রেডো ছেলেটার কথায় কোনো কর্ণপাত করে না। গটগটে পায়ে হাঁটতে থাকে সে। মনে মনে আফসোস করে বলে,,,
– মহারাজের মনুষ্য মস্তিষ্কের সমস্ত স্মৃতি জানার বিশেষ ক্ষমতা যদি ভ্যাম্পায়ারদের মস্তিষ্কে থাকা স্মৃতিগুলোও জানায় সাহায্য করতো তাহলে বেশ ভালো হতো। বিশ্বাসঘাতকগুলোকে খুব সহজেই চিনে নেওয়া যেত।
অ্যাভোগ্রেডো মনঃক্ষুণ্ন হলো। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে আলোতে পৌঁছাল। সহসা তার সামনে এসে দাড়াল একজন ভ্যাম্পায়ার সেনা। নিচু আওয়াজে সবিনয়ে বললো ,,,,
– জনাব, অনারেবল ওভারলর্ড এখুনি আপনাকে তার কামরায় উপস্থিত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
অ্যাভোগ্রেডো কথাটা শোনা মাত্রই ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। এদুয়ার্দোর কামরার সামনে গিয়ে দাড়ায়। দরজায় করাঘাত করে। ভেতর থেকে এদুয়ার্দোর কঠিন কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,,
-এসো।
অ্যাভোগ্রেডো কামরায় প্রবেশ করে। এদুয়ার্দোর মুখখানা বেশ থমথমে। সোফায় বসে ডান হাতে নিজের কপাল চেপে ধরে আছে। অ্যাভোগ্রেডো বুকের কাছে ডান হাত বেঁধে দাড়ায়। নত মস্তকে শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানিয়ে ডাকে,,,
– অনারেবল ওভারলর্ড।
– কিছু জানতে পেরেছ?
– ক্ষমা করবেন। ও এখনো কিছু স্বীকার করেনি।
এরকম উত্তর এদুয়ার্দো মোটেও আশা করেনি। বসা থেকে ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে,,,,
– আমার মুখোমুখি হলে এতক্ষণ জীবিত থাকতো না। তাই তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছি। এখনো কিছু স্বীকার করেনি? তাহলে ওকে বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ?
– আপনার যেমন আদেশ। মহামান্য মহারাজ।
– লোহার কফিনে বন্দি করে রাখো ওকে। দেখতে চাই, কতক্ষণ নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারে। অসহনীয় যন্ত্রণায় তিলে তিলে মরুক ও।
অ্যাভোগ্রেডো দু’দিকে মাথা নাড়ায়। এদুয়ার্দো অকপটে জিজ্ঞেস করে,,,
– ইনায়াকে দেখেছিলে?
– জ্বি মহারাজ। একাডেমি থেকে বাড়িতে ফিরে যেতে দেখেছি। যেহেতু ফ্রাঙ্কলিনের বাড়িটা অদৃশ্য ব্যারিয়ারে ঘেরা। তাই দুর থেকে শুধু নজর রেখেছি। ওরা কেউ বাড়ির বাইরে বের হয়নি। রাতের অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত বরফে ঢাকা বিস্তর প্রান্তরে অপেক্ষা করে ওয়াভেল কোটে ফিরে এসেছি।
– মেয়েটা কি নিজের বাবা আর দাদুর মতই কঠিন সিদ্ধান্ত নিবে? আমিতো জানি সিয়াকে বাঁচাতে ও সবকিছু করতে পারে।
– আপনি দু’দিন সময় দিয়েছিলেন। হয়তো এখনো ভাবছে।
– ঠিক আছে। জোসেফাইনকে খবর পাঠাও। আমার সাথে দেখা করতে বলো। এখন যাও।
অ্যাভোগ্রেডো চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু হঠাৎই দাঁড়িয়ে পরে সে। কৌতুহলী কন্ঠে বলে,,,
– অনারেবল ওভারলর্ড। অপরাধ ক্ষমা করবেন। আপনি কি জিনিষগুলো সত্যিই অনারেবল এমপ্রেসের হাতে তুলে দিবেন?
– তোমার কি তাই মনে হয়?
– একদমই নয়। আমি বহুবছর ধরে আপনার সেবায় নিয়োজিত। কিছুটা হলেও আপনাকে চিনি। শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছি। আমার মন বলছে, ওগুলো আপনি নিজের কাছে রেখে দিবেন।
– হ্যাঁ। যেহেতু একটা বই, পাথর আর তলোয়ারের জন্য মা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নিঃসন্দেহে ওগুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের বলা কথাগুলোর সত্যতা কতটুকু আমি জানিনা। কিন্তু জানতে হবে। জিনিষগুলোর জন্য ডিয়েটসের পরিবার বার বার বিপদে পড়বে। তার থেকে বরং ওগুলো আমি নিজের কাছে রেখে দিবো। মাকে জানিয়ে দিবো, ওগুলো আমি ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। এতে অন্তত তিনি ডিয়েটসের পরিবারের পিছু ছাড়বেন। ওরা সবাই নিরাপদে থাকবে।
– জ্বি অনারেবল ওভারলর্ড।
দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। এদুয়ার্দো অনুমতি দেয়। নিঃশব্দে দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে ইজাবেল। দু’পা ভাঁজ করে কিঞ্চিত মাথা ঝুঁকায়। মিষ্টি হেসে ডাকে,,
– অনারেবল ওভারলর্ড।
– ইজাবেললল।
ইজাবেলের হাসি হাসি মুখখানা হঠাৎই বিষন্নতায় বদলে যায়। সে সকরুন কন্ঠে বলে,,,,
– বেসমেন্টে গিয়েছিলাম। আমার কিছু বই প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু প্রথম দরজার সামনে পৌঁছুতেই দ্বার রক্ষীরা আমাকে ফিরিয়ে দিলো। কোনো ক্রমেই আমাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়নি তারা। আমার সাথে এরকম বেয়াদবির মানে কি ভাই?
– ওদের কোনো দোষ নেই ইজাবেল। আমার কঠোর নির্দেশ ছিলো। বেসমেন্টের কামরাগুলোতে যেন আমি বা অ্যাভোগ্রেডো ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ না করতে পারে। তোমার কি কি বই লাগবে বলো। আমি এনে দিব।
– থাক। লাগবে না। ____ইজাবেল গাল ফুলিয়ে বলে। এদুয়ার্দো মৃদু হাসে। অ্যাভোগ্রেডোকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,,
– ইজাবেলের বইগুলো এনে দিও। এখন যেতে পারো।
অ্যাভোগ্রেডো আদেশ পেয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়। ইজাবেল সোফার উপর বসে। এদুয়ার্দোর সাথে খোশগল্পে মেতে উঠে।
★★
বেসমেন্টের গুপ্ত কামরা। কতগুলো বিশালাকৃতির দরজা পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় সিয়ার কামরায়। প্রতিটা দরজার সামনে দ্বাররক্ষী পাহারায় ছিলো। এই কামরাটা মূলত এদুয়ার্দোর। কামরার দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে রাখা ছিলো। পাশেই আরও একটি দরজা দেখা যায়। কিন্তু ওটাতে কোনো নব ছিলো না। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও দরজাটা খুলতে পারেনি সিয়া। কতগুলো লাথি দিয়েছিলো তার কোনো হিসাব নেই। ওক কাঠের বিশালাকৃতির শক্তপোক্ত ভারী দরজা খোলা কি এতোটাই সহজ ওর পক্ষে?
বদ্ধ কামরা থেকে ভাংচুরের শব্দ শোনা যায়। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নয়, সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় কামরার সব দামী জিনিসপত্রগুলো এক এক করে ভাঙ্গছিলো সিয়া। হাত দু’টো খোলা থাকায় স্পেল আওড়ে খুব সহজেই জাদুবিদ্যার প্রয়োগ করছিলো ও। দু’হাতের ইশারায় ছোট ছোট জিনিষগুলো সজোরে দেয়ালে ছুঁড়ে মারছিলো। যেন ছোট বাচ্চাদের মতো ছোঁড়াছুড়ি খেলছিলো। প্রথমেই ভেঙ্গেছিল সিলিংয়ে ঝুলে থাকা বৃহৎ ঝাড়বাতিটা। কামরার মেঝেতে যার টুকরো টুকরো অগনিত কাঁচ পড়ে আছে এখনো। হঠাৎই নব ঘোরানোর শব্দ হয়। সিয়া নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকায়। এদুয়ার্দোকে দেখে ওর নিষ্প্রাণ দৃষ্টি আক্রোশে বদলে যায়। কিন্তু এদুয়ার্দোকে বুঝতে দেয় না। ত্রিকোণ বাহুর মুষ্টিবদ্ধ বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে মাথা ঝুঁকায়। শ্রদ্ধা ভরে সম্মান জানিয়ে বলে,,,,
– মহামান্য মাস্টার।
এদুয়ার্দো কপাল কুঁচকায়। এতো সম্মান বোধহয় সহ্য হয়নি তার। সরু দৃষ্টিতে তাকায়। নিমেষেই মুখখানা হিংস্রাত্মক হয়ে উঠে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,
– এখানে কি হচ্ছিলো?
– ভূকম্প। ____জোরগলায় শব্দ টা উচ্চারণ করলেও, সিয়া মনে মনে বলে,,,,
– হা’রামজাদা। আমাকে অপহরণ করার মজা বোঝাবো তোকে।
এদুয়ার্দোর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন কন্ঠে বলে,,,,
– আমি কিছু করছি না বলে, তোমার অনেক সাহস বেড়ে গেছে। তাইনা?
– ক্ষমা করবেন। আমি একজন সামান্য মানবী। আপনি মহান র’ক্তচোষা পি’শাচ।
সিয়ার জন্য রেখে যাওয়া খাবারগুলো মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো ছিলো। কামরার সবগুলো জিনিষপত্র ভাঙ্গাচোড়া আর লন্ডভন্ড দেখে এদুয়ার্দোর ক্রোধ বেড়ে যায়। চোখের পলকে সিয়ার সামনে গিয়ে দাড়ায়। অকস্মাৎ বাতাসের দাপটে সিয়া নেত্রচ্ছদ বুজে নেয়। দু’কদম পিছিয়ে যায়। এদুয়ার্দো ওর দু’হাত পেছনে মুষড়ে ধরে। হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে বলে,,,,
– তুমি কি ভেবেছ? এসব করলে আমি তোমাকে যেতে দিবো?
বোকা মেয়ে। যা খুশি করো, আমার কিছুই যায় আসে না।
– ছাড়ো। তোমাকে ঘৃনা করি আমি।___সিয়া মোচড়ামুচড়ি করে বলে।
– ঘৃণা করো?____ এদুয়ার্দোর কন্ঠে বিস্ময়। সিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে সে এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়।
– হ্যাঁ।_____সিয়া দৃঢ় কন্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়। ওর রাগ হয়। এতো বেশি রাগ হয় যে, এদুয়ার্দোকে খু’ন করতে ইচ্ছে করে। শ’য়তানটা এক কথা আর কতবার জিজ্ঞেস করবে ওকে? সিয়া মনে মনে ভাবে। শান্ত চোখে তাকায়। স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করে ,,,,
– আমাকে এখানে তুলে আনার উদ্দেশ্য কি?
এদুয়ার্দো চেয়ারের উপর বসে। থমথমে ভরাট কন্ঠে বলে,,,,
– তোমার সাথে কথা বলতে আমার একদমই ভালো লাগছে না।
সিয়া একপা দু’পা করে এগোয়। এদুয়ার্দো থামতে বলে ওকে,,,
– ওখানেই দাড়াও।
সিয়া বারণ শোনে না। এগোতেই থাকে। ওর নিষ্প্রভ দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে এদুয়ার্দোর দিকে। আরও একপা বাড়াতেই কোমরে একজোড়া ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। এদুয়ার্দো কপট রাগ দেখিয়ে বলে,,,,
– নির্বোধ। দেখে চলতে পারো না? মেঝেতে কাচ পড়ে আছে।