ফ্লোরেনসিয়া – ৩১

বিভীষিকাময় অন্ধকার রাত শেষে ভোরের আবছা আলো ফুটে উঠে চারপাশে।কাপড়ের ব্যাগে করে বয়ে আনা তাবু খাটিয়ে রাত টা কোনোরকমে কাটিয়ে দিয়েছেন ক্রিসক্রিংগল।তাবুর দু’দিকে আ’গুন জ্বালানো ছিলো।সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে তার।ভোরের আলো ফুটতেই আবারও তিনি নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

জঙ্গলের দানবীয় গাছগুলোর ডালপালার ফাঁক দিয়ে বিন্দুমাত্র আলো প্রবেশ করার যো নেই।গন্তব্যের শুরু আছে কিন্তু এর শেষ কোথায়?নিজের মনোবল দৃঢ় রাখেন ক্রিসক্রিংগল।পরিধেয় আলখাল্লার পকেট থেকে প্রাসকোভিয়ার মানচিত্র বের করে আনেন।একনজর চোখ বুলিয়ে নেন।সঠিক রাস্তা ধরে হাঁটছেন।আরও বেশ কিছুটা রাস্তা হাঁটার পর একটা সরু খালের সম্মুখীন হবেন।ঈশ্বর জানেন কিভাবে সেই খাল অতিক্রম করবেন।

চারদিকে গাঁ ছমছমে ভাব।হঠাৎই কিছু জঙ্গলী কুকুর করুন সুরে আ’র্তনাদ করে উঠে।ক্রিসক্রিংগলের বুকের মাঝখানে থাকা আত্মাটাও যেন হিম হয়ে আসে।জঙ্গলের কর্দমাক্ত মাটিতে শৈবাল জমে গেছে।স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তা দিয়ে তিনি পা টিপে টিপে হাঁটেন।সহসা সামনে থেকে কোনো এক পুরুষালী কা’তর কন্ঠের আত্ম চিৎকার শুনতে পান।অদুরে কেউ ডাকছে।কেউ একজন চিৎকার করে বলছে,,,,

-আমাকে বাঁ’চাও।কেউ কোথায়ও আছো?আমাকে বাঁ’চাও।মুক্ত করো এই ভ’য়ংকর ফাঁদ থেকে।

সেই কা’তর কন্ঠের আত্ম চিৎকার শুনে ক্রিসক্রিংগলের হৃদস্পন্দন থেমে যায়।এটাও কি কোনো ফাঁদ?নাকি কোনো মায়া?তিনি ভাবেন।সামনে এগিয়ে যাওয়া আদৌও ঠিক হবে কিনা।পুনরায় সেই অ’সহায় কন্ঠের চিৎকার শোনা যায়,,,,

-ঈশ্বরের দোহায় লাগে।মুক্ত করো আমাকে।আমি বাঁচতে চাই।

ক্রিসক্রিংগল সর্তক দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলান।দ্রুতপায়ে এগিয়ে যান।কয়েক পা হেঁটে বড় বড় ঝোপঝাড় পেরিয়ে সামনের দিকে তাকান।কয়েক পল স্ত’ব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি।একটা গাছের প্রশস্ত উঁচু ডালে শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি কাঠের খাঁচা ঝুলছে।স্তব্ধ হওয়ার কারন,খাঁচার নিচে ধিকিধিকি করে আগুন জ্বলছে।ভিতরে বন্দি থাকা ছেলেটা চি’ৎকার করে সাহায্য চাইছে।আ’গুন টা হয়তো কিছুক্ষণ আগেই জ্বালানো হয়েছিলো।এখনো তা সবগুলো ডালপালায় ছড়িয়ে পড়েনি।কিন্তু যেকোন সময় আগুন ছড়িয়ে পড়বে।এভাবে চলতে থাকলে ছেলেটা আ’গুনের তাপে সিদ্ধ হয়েই মা’রা যাবে।

ক্রিসক্রিংগলের গলা শুকিয়ে আসে।খাঁচায় বন্দি থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একপা দু’পা করে হাঁটে।আচম্বিতে ছেলেটার দৃষ্টি পড়ে তার দিকে।সে চি’ৎকার দিয়ে বলে,,,,

-সা’বধান।এখানে আরও ফাঁ’দ পাতা আছে।

ক্রিসক্রিংগলের সম্বিত ফিরে আসে।তিনি সাবধানী পা ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে যান ছেলেটার কাছে।ছেলেটা বাঁচার জন্য কাকুতি মিনতি করে বলে,,,,

-দয়া করে আমাকে বাঁ’চান।ওরা আবারও এখানে ফিরে আসতে পারে।

খাঁচার নিচে আ’গুন জ্বলছে।অন্য গাছের ডালে বেঁধে রাখা দড়ি খুলে দিলে ছেলেটা খাঁচাসহ জ্ব’লন্ত আ’গুনের উপর পড়বে।ক্রিসক্রিংগল কিভাবে বাঁ’চাবেন তাকে?

-যতদ্রুত সম্ভব এই আ’গুনসহ শুকনো ডালপাতা সরিয়ে ফেলতে হবে।___ক্রিসক্রিংগল মনে মনে ভাবেন।লম্বা,মোটা আকৃতির একটা কাঁচা ডাল খুঁজে বের করেন।কাঁচা ডালটা দিয়ে আ’গুন জ্বলতে থাকা ডালগুলো খাঁচার নিচ থেকে সরিয়ে ফেলেন তিনি।অনেকগুলো ডাল।সবগুলো সরাতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়।ছেলেটা আ’গুনের উ’ত্তাপ থেকে র’ক্ষা পেয়ে অমায়িকভাবে হাসে।কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে,,,

-আমাকে আ’গুনে পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য,আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।এবার আমাকে এই খাঁচা থেকে মুক্ত করুন প্লিজ।

ছেলেটা চঞ্চল প্রকৃতির।তার কথা বলার ধরন দেখে বেশ বুঝতে পারেন ক্রিসক্রিংগল।এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।অহেতুক সময় নষ্ট করেন না তিনি।অন্য গাছের সাথে বেঁধে রাখা দড়ি খুলে ধীরে ধীরে কাঠের খাঁচাটা মাটিতে নামিয়ে আনেন।ছেলেটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।ক্রিসক্রিংগল খাঁচার দরজা খুলে দেন।ছেলেটা দাঁত বের করে হাসে।নিজের হাত দু’টো ঝেড়ে পরিধেয় পোশাকের উপর মুছে।ডানহাতটা ক্রিসক্রিংগলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,,,,

-হাই।আমি মার্কস গ্রোসিয়াস।আপনি?

ছেলেটার চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে উৎফুল্লতার রেশ।যেন কিছুক্ষণ আগে কিছুই হয়নি।ক্রিসক্রিংগল কোনো প্রত্যুত্তর দেন না।সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন।ছেলেটা বিস্মিত হয়।ক্রিসক্রিংগলের সাথে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে সে।চাঞ্চল্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,

-আপনি কি কথা বলতে পারেন না?

ক্রিসক্রিংগল বিরক্ত হন।কপট রা’গমিশ্রিত কন্ঠে বলেন,,,

-তুমি তোমার গন্তব্যের দিকে ফিরে যাও।আমার পেছনে কেনো আসছো?

-আমি জানিনা।আমি কোথায় যাবো।

ছেলেটার করুন কন্ঠস্বর।পা চালানো থামিয়ে দেন ক্রিসক্রিংগল।স’ন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,,

-মানে?

-মানে হলো,বন্ধুদের সাথে এই জঙ্গলে ঘুরতে এসেছিলাম।তারপর হঠাৎ ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আর রাস্তা হারিয়ে ফেলি।

-ফাঁদে আটকা পড়লে কিভাবে?___কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ক্রিসক্রিংগল।

-হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই হোঁচট খাই।তারপর খাঁচাটা ধপাস করে আমার মাথার উপর পড়ে।আমি আঁটকে যাই ফাঁদে।এরপর তিনজন লোক আসে।আমাকে গুপ্তচর অপবাদ দিয়ে খাঁচা ঝুলিয়ে,আ’গুন জ্বালিয়ে দেয় নিচে।আমি তাদের কতবার বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছিলাম,আমি কোনো গুপ্তচর নই।কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি।

-তাহলে আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো কেনো?___ক্রিসক্রিংগল স্পষ্ট গলায় বলেন।

-বিশ্বাস করুন।আমি খুব সহজ-সরল একটা ছেলে।জঙ্গলে হারিয়ে গেছি।বিপদে পড়েছি।কারো সাহায্য ছাড়া বাড়িতে ফিরে যেতে পারবো না।আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

-দুঃখিত।আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবো না।আমার পেছনে আসা বন্ধ করো।নিজের গন্তব্য খুঁজে নাও।

ছেলেটা হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে।ক্রিসক্রিংগল তার গন্তব্যের দিকে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করেন।ঝকঝকে ভোরের আলোয় একটু দুরেই সরু খালটা দেখতে পান।

_______

আরো একটি তুষার ঝরা সকালের সূচনা হয়।প্রচন্ড ঠান্ডায় উষ্ণ লেপের আদুরে স্পর্শে আরাম করে ঘুমায় আর্নি।মাস্টার নেই,তাই এই র’ক্ত হিম হয়ে যাওয়া কনকনে শীতের মধ্যে অনুশীলন করার মতো কোনো ঝামেলাও নেই।দেয়াল ঘড়িতে থাকা ঘন্টার কাঁটা’টা জানান দেয় সকাল সাতটা বেজে গেছে।

মাদাম ল্যারিকে রান্নার কাজে সাহায্য করে কামরায় প্রবেশ করে ইনায়া।সিয়া টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো।ওর লম্বা ভেজা চুলগুলো থেকে টুপটাপ করে পানি ঝড়ছে।চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে অনেকটা নিচে নেমে গেছে।একমাস ও হয়নি।সিয়া অহেতুক চুল কে’টে কাঁধ পর্যন্ত করা বন্ধ করে দিয়েছে।এরমধ্যে আগা কেটে সমান বা ছোটও করেনি।কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো,চুলগুলো একেবারে সমানভাবে বাড়ছে।সবসময়ই মনে হয়,এইমাত্র চুলগুলো কেটে সমান করা হয়েছে।ইনায়া ভাবুক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

-ওখানে ওভাবে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?___নিষ্প্রাণ কন্ঠে সিয়ার অকপট প্রশ্ন।অথচ ওর দৃষ্টি টেবিলের দিকে নিবদ্ধ।

-কিভাবে বুঝলে কামরায় এসেছি?আমিতো শব্দ করিনি,তুমিও পেছন ফিরে তাকাওনি।তাহলে?___একপা দু’পা করে সিয়ার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথাটা জিজ্ঞেস করে ইনায়া।

-তুমি কি জানো না?একজন যোদ্ধার সতর্ক দৃষ্টি আর প্রখর শ্রবণশক্তির পাশাপাশি তীব্র ঘ্রাণশক্তিও থাকা জরুরি। তোমার শরীর থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণ পেয়ে অনায়াসেই আমি তোমার উপস্থিতি বুঝে নিতে পারি।

-কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এরকম হয়না।___ইনায়ার বিস্মিত কন্ঠস্বর।

-তুমি হয়তো চেষ্টা করোনি। চেষ্টা করে দেখো। পারবে।

-ঠিক আছে। কিন্তু তুমি এখনো এই কুম্ভকর্ণকে ডেকে তুলোনি কেনো?

-ডেকেছিলাম একবার। শুনেনি।

ইনায়া মৃদু হাসে।বিছানার একপাশে বসে।জোর গলায় ডাকে,,,

-আর্নি উঠো।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

আর্নি কম্বল টেনে মুখ ঢেকে নেয়।অন্যপাশ ফিরে শোয়।ইনায়ার ডাকে সাড়া দেয় না ও।সিয়া ভরাট কন্ঠে বলে,,

-দাড়াও,আমি দেখছি।

টেবিলের উপর থাকা চিনামাটির জগ থেকে গ্লাসে কিছুটা পানি ঢেলে নেয়।ইনায়াকে বলে,,,

-ওর মুখ থেকে কম্বল সরাও।

-কি করতে চাইছো?পানি ঢালবে নাকি?এমন করো না।বিছানা ভিজে যাবে।_____ইনায়া শঙ্কিত গলায় বলে।ওর বারন শুনে না সিয়া।একহাতে আস্তে আস্তে আর্নির মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে নেয়।মেয়েটা গভীর ঘুমে মগ্ন।ওর দু’চোখের উপর অল্প একটু পানি ঢেলে দেয় সিয়া।আর্নি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।চেঁচিয়ে উঠে বলে,,,

-এটা কি হলো?

-সাত’টার বেশি বেজে গেছে।একাডেমিতে নয়টা থেকে ক্লাস। সে খেয়াল আছে তোমার?

আর্নির মুখখানা ভীষণ করুন দেখায়।বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায়না ও।কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ায়।দ্রুতপায়ে হেঁটে আলমারির দিকে যায়।পোশাক বের করে বলে,,

-একেবারে গোসল সেরে আসি।

আর্নি চলে যায় গোসলখানার দিকে।সিয়া টেবিলের কাছে চেয়ার টেনে বসে।হালকা চাপিয়ে রাখা দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়।ওপাশ থেকে ডেকে উঠেন ফ্রাঙ্কলিন,,,,

-সিয়া,ইনায়া!

-জ্বি দাদু।ভেতরে আসুন।___প্রত্যুত্তর দেয় ইনায়া।

দরজা ঠেলে কামরায় প্রবেশ করেন ফ্রাঙ্কলিন।হাতে কতগুলো মোটা কাগজ।সিয়া চেয়ার থেকে উঠে দাড়ায়।কাঠের তৈরী ভারি চেয়ারটা ফ্রাঙ্কলিনের পাশে রেখে শীর্ণ কন্ঠে বলে,,,

-বসুন।

সিয়ার ম্লান মুখখানার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন ফ্রাঙ্কলিন।মেয়েটার চেহারাজুড়ে কত মায়া।যেন সৃষ্টিকর্তা অতি সযত্নে বানিয়েছে ওকে।কিন্তু ওর জ্বলজ্বলে বাদামী চোখের মনিগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে আছে।নেই কোনো দুঃখ,বেদনা,হাসি,কান্নার রেশ।ফ্রাঙ্কলিন যন্ত্রণাদায়ক অতল গহ্বরে ডুবে যান।তার দু’চোখের কোণে জল চিকমিক করে উঠে।নিজের অজান্তেই কাতর কন্ঠে বলেন,,,,

-তুমি ঠিক তোমার মায়ের মতো দেখতে।

-আপনি আমাদের মা’কে দেখেছিলেন?___কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইনায়া।

ফ্রাঙ্কলিন সম্বিত ফিরে পান।হাতের কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে মলিন হেসে বলেন,,

-হ্যাঁ। দেখেছিলাম। তোমাকে আর তোমার মাকে সাথে নিয়ে তোমার বাবা একবার ইম্যুভিলে এসেছিলো।

-আমাদের সাথে সিয়া ছিলো না তখন?

-না। থাক এসব কথা। মানচিত্র আর নকশাগুলো রেখে যাচ্ছি। কিন্তু এগুলো দিয়ে তোমাদের কি কাজ?

-ইম্যুভিলে নতুন এসেছি।যেহেতু আমাদের এখানেই থাকতে হবে।জায়গাগুলো চিনে নেওয়া দরকার।পরে যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বি’পদে না পড়ে যেতে হয়।তাছাড়া হঠাৎ করে যদি হারিয়ে যাই,রাস্তা চিনে যেন বাড়ি ফিরে আসতে পারি।

-হ্যাঁ। তা ঠিক বলেছো। আচ্ছা,আমি তাহলে আসি। তোমরা ক্রিস্তিয়ানের সাথে সময় মতো একাডেমিতে চলে যেও।

চেয়ারে বসেননি ফ্রাঙ্কলিন।দাড়িয়ে থেকেই কথা বলছিলেন।নিজের কথা শেষ করে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।কিন্তু পেছন থেকে সিয়ার কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন,,,,

-দাদু,বাবা কেনো শহরে গেছেন?কবে ফিরে আসবেন?আপনি কি কিছু জানেন?

পুনরায় পেছন ঘুরে দাড়ালেন ফ্রাঙ্কলিন।ভারী কন্ঠে বললেন,,

-একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে গেছে ক্রিসক্রিংগল।দুশ্চিন্তা করো না।দ্রুত ফিরে আসবে।

নিশ্চুপ হয়ে যায় সিয়া।দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করে না।যেন গুনে গুনে কথা বলে ও।ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ইনায়া ম্লান কন্ঠে বলে,,,,

-আপনি তো সবই জানেন।আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত,অনাকাঙ্ক্ষিত ভ’য়ংকর সব দুর্ঘটনার কথা।কাস্ত্রোরুজ ছেড়ে ইম্যুভিলে চলে আসার কারণ।ভ’য় করছে।নিশ্চিন্তে থাকতে পারছি না।যদি বাবার কোনো বিপদ হয়?যদি র’ক্তপি’পাসুগুলো তার কোনো ক্ষতি করে দেয়?

-দুশ্চিন্তা করেই কি লাভ হবে বলো?বরং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো।নিজের কাজ শেষ করে যেন দ্রুত ফিরে আসতে পারে।

তার কথার মাঝখানেই কামরায় উপস্থিত হন মাদাম ল্যারি।একগাল হাসি উপহার দিয়ে বলেন,,,

-কোথায় যাচ্ছেন?টেবিলে খাবার সাজিয়েছি।সবাই মিলে একসাথে বসে খাবেন।

সহসা আর্নি কাঁপতে কাঁপতে কামরায় প্রবেশ করে।সবাইকে একসাথে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে সিয়া অনুচ্চস্বরে বলে,,,

-তুমি তো এখনো গোসল শেষ করোনি।

-গোসল শেষে রান্না করেছি।যাতে গোসলখানায় লাইন না পড়ে যায়।

আর্নি মাথায় বেঁধে রাখা তোয়ালে টা খুলে বারান্দায় টানানো রশিতে মেলে দেয়।বিছানার উপর থেকে শীতবস্ত্র তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয়।ইনায়া আর্নির ভেজা চুলগুলোর পানি মুছে হাত দিয়েই তা পরিপাটি করে দেয়।মাদাম ল্যারি মুগ্ধ চোখে দেখেন।মেয়েটা সব দিকেই খেয়াল রাখে।কয়েক পল তাকিয়ে থেকে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলেন,,,,

-তাড়াতাড়ি চলো।সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।খাবার টেবিলে ক্রিস্তিয়ান আর স্ট্রিকল্যান্ড তোমাদের অপেক্ষায় আছে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে কামরায় ফিরে আসে ওরা।তড়িঘড়ি করে তৈরি হয় একাডেমিতে যাওয়ার জন্য।ঠিক আটটার দিকে ক্রিস্তিয়ান কামরার সামনে এসে দাড়ায়।দরজার ওপাশ থেকে ব্যস্ত কন্ঠে ডাকে। জিজ্ঞেস করে,,,

-তৈরী হয়েছো তোমরা?

-ভেতরে এসো ক্রিস্তিয়ান।

টেবিলের সামনে দাড়িয়ে খারকিভের মানচিত্র দেখছিলো সিয়া।ক্রিস্তিয়ানকে ডেকে বাকি নকশাগুলোও খুলে খুলে দেখতে শুরু করে ও।ক্রিস্তিয়ান দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করে।সিয়ার দিকে তাকাতেই থমকে যায় সে।

-এদিকে এসো।____সিয়া পুনরায় ডাকে।

ক্রিস্তিয়ানের হুশ ফিরে আসে।নিঃশব্দে পা ফেলে সিয়ার পাশে গিয়ে দাড়ায়।ইনায়া আর আর্নি ততক্ষণে প্রস্তুত হয়ে গেছে।ওরাও সিয়ার পাশে টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ায়।সিয়া শান্ত গলায় বলে,,,,

-রাস্তায় ফিটন দাড়িয়ে আছে।পৌঁছাতে আধ ঘন্টার মতো সময় লাগবে।ভাবলাম এগুলো একটু খুলে দেখি।

বাকিরা মনোযোগ দিয়ে শুনে।সিয়া খারকিভ ওব্লাস্টের মানচিত্রটা দেখিয়ে বলে,,,

-এইখানে দেখো। খারকিভ শহরের পশ্চিমে,প্রথমে ইম্যুভিল।তারপর প্রাসকোভিয়া। জঙ্গলটা ইম্যুভিলের পশ্চিম-দক্ষিণে। এই জঙ্গলটি মুলত ইম্যুভিলের দক্ষিণ দিকেই অবস্থিত। কিন্তু ইম্যুভিলের পশ্চিমে এর কিছুটা অংশ বিস্তৃত বিধায় কাস্ত্রোরুজ থেকে ইম্যুভিলে আসার পথে আমাদের প্রাসকোভিয়া জঙ্গল অতিক্রম করতে হয়েছিলো। ইম্যুভিলের উত্তর-পূর্বে শুধু সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত আর বেশ কয়েকটা জঙ্গল। এই পাহাড়ি জঙ্গলগুলো খুব ভয়ংকর আর বিপদজনক হওয়ায় ওদিকে কোনো মানুষের যাতায়াত হয়না। ইম্যুভিলের দক্ষিণ-পূর্বাংশে কিছু ছোট-বড় গ্রাম এবং পূর্বদিকে খারকিভ শহর।

-হ্যাঁ। তোহ?____বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে আর্নি।

-তেমন কিছু না। এই মানচিত্রে থাকা সবগুলো জায়গা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।বিশেষ করে ইম্যুভিলের চারদিকে থাকা স্থানগুলো সম্পর্কে।

-তোমার মাথায় কি চলছে?___সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ইনায়া।

-সবে ছক কষছি।পরে সবটা জানাবো।সময় হয়ে গেছে।এখন আমাদের বেরিয়ে পড়া উচিত।

সিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটে।ইনায়ার ভয় হয়।মনে মনে ভাবে,,,

-কি করতে চায় ও?

ক্রিস্তিয়ানও কিছু বুঝতে পারে না।আর্নি কেনো কিছু বোঝার চেষ্টা টুকুও করে না।সিয়ার পেছন পেছন কামরার বাইরে বেরিয়ে যায়।

_______

মার্শাল আর্ট একাডেমি।

দীর্ঘসময় অনুশীলনের পর দুপুরের দিকে বিরতি দেওয়া হয়।যে যার মতো বিশ্রাম নেয়।কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে গল্প করে।কেউ বা কথার মাঝখানে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে।এটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের ক্লাস।অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেনী।বিশাল ক্লাসরুমের মেঝেতে নীল রঙের কার্পেট বিছানো ছিলো।সামনে বিস্তর ফাঁকা জায়গা।ওখানেই প্রশিক্ষকেরা স্টুডেন্টদের শৈলী শিখিয়ে দেন।শিক্ষার্থীরা দুরত্ব বজায় রেখে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে মাস্টারদের দেখানো শৈলী অনুসরণ করে।

সহসা শ্রেণীকক্ষে প্রিন্সিপাল প্রবেশ করেন।এক হাতের উপর আরেক হাত রেখে মুষ্টিবদ্ধ করে নত মস্তকে তাকে সম্মান জানায় ছাত্র-ছাত্রীরা।প্রিন্সিপাল উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলেন,,,,

-ডিয়ার স্টুডেন্ট’স।তোমাদের একটা চমৎকৃত বিষয় জানানোর ছিলো।আজ থেকে কিছুদিন তোমাদের তিন শ্রেনীর সকল স্টুডেন্টদের একসাথে একটা বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।ক্লাসের ব্রেক টাইম শেষ হলে সবাই মিলনায়তন ভবনে চলে যাবে।

-জ্বি প্রিন্সিপাল স্যার।___চিৎকার দিয়ে সমস্বরে বলে উঠে সবাই।

হাসি হাসি মুখে শ্রেণীকক্ষের বাইরে বেরিয়ে যান প্রিন্সিপাল।সিয়া ইনায়া আর আর্নি ক্লাসের কারো সাথে কথা বলেনি এখনো।নতুন বলে সবাই ওদের প্রথম থেকেই এড়িয়ে যাচ্ছিলো।কেউ কেউ হাসি তামাশাও করেছে ওদেরকে নিয়ে।কিন্তু ওরা নিশ্চুপ ছিলো।ইনায়া আর আর্নি নিজেদের মধ্যে টুকিটাকি কথা বললেও সিয়া পুরোপুরি নিরব ছিলো।ও সবসময়ই কিছু একটা ভাবে।ইনায়া খেয়াল করে।প্রশ্ন করলে বিষয়টা এড়িয়ে যায় ও।

ব্রেক টাইম শেষ হয়।ছাত্র-ছাত্রীরা দল বেঁধে মিলনায়তনের দিকে যায়।সিয়া,ইনায়া আর আর্নি ওদের অনুসরণ করে।বিশাল জায়গা জুড়ে মিলনায়তন ভবন।বিস্তৃত কামরা।অনেকগুলো ছাত্রছাত্রী।সারিবদ্ধ ভাবে সবাই কামরায় প্রবেশ করে।পরপর দুরত্ব বজায় রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা।প্রথম সারিতে সবার প্রথমে দাড়িয়ে ছিলো আর্নি।তারপর সিয়া।ওর পেছনে ইনায়া।কামরায় দাড়ানো দু’জন মাস্টার।যাদের পরনে ছিলো কালো বেল্টের সাথে সাদা রঙের পোশাক।হঠাৎই একজন মাস্টার স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বলেন,,,

-শিক্ষার্থীগন।তোমরা কেউ কোনো কথা বলবে না।কোনো ধরনের শোরগোল করবে না।তোমাদের ক্লাস নিবে একজন বিশেষ মাস্টার।যিনি পাঁচ বছর আগে ইউক্রেনের একজন বেস্ট ফাইটার হিসাবে মার্শাল আর্টের শিরোপা জিতেছিলেন।তিনি ভীষণ গম্ভীর আর সুশৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষ।কোনো প্রকার শোরগোল পছন্দ করেন না।

এতটুকুই শুনেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা শোরগোল শোনা যায়।দ্বিতীয় সারির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইজাবেল অসম্ভব আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে।ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে যায় অনবদ্য প্রাণোচ্ছল হাসি।সবাইকে থামানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষক বিরক্ত কন্ঠে উচ্চস্বরে বলেন,,,

-থামো সবাই।অনেক কষ্টে তাকে রাজি করানো হয়েছে।তোমরা এমন শোরগোল করতে থাকলে,তিনি দ্বারপ্রান্ত থেকেই ফিরে যাবেন।

কামরা পুনরায় নিস্তব্ধ হয়ে যায়।ইজাবেল ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে।মনে মনে বলে,,,

-আমি জানতাম।আপনি আসবেন।অনারেবল ওভারলর্ড।

সবাই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চিফ মাস্টারের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে।ক্ষণকাল সময় গড়ায়।সহসা কামরায় প্রবেশ করে একজন বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন যুবক।শিক্ষার্থীরা তাকে সম্মান জানাতে ভুলে যায়।স্তব্ধ দৃষ্টিতে নিষ্পলক চোখে দেখে।কামরায় উপস্থিত থাকা অতি সুদর্শন যুবকের লাল টুকটুকে ঠোঁট আর এমারেল্ড সবুজ দু’চোখের তীক্ষ্ণ চাহনিতে প্রত্যেকের দৃষ্টি আঁটকে থাকে।

আজ আর নিকাব দ্বারা নিজেদের মুখশ্রী ঢেকে রাখেনি ওরা।এদুয়ার্দোর দু’চোখের দৃষ্টি ইজাবেলের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানার দিকে স্থির।অথচ কামরায় সে আরও দু’টো পরিচিত মেয়ের উপস্থিতি টের পায়।আর্নি আর সিয়া।ইনায়াকে চিনেনা এদুয়ার্দো।দেখেওনি কখনো।

সিয়ার পায়ে সাদা রঙের বুট জুতো।পরনে রেশমি সুতার পোশাক।অনেক হালকা আর মসৃন কাপড়ের কালো রঙের শর্ট গাউন পরেছে ও।লম্বা চুলগুলো পনিটেল করে বাঁধা।কর্ণ লতিকায় লেপ্টে ছিলো সাদা পাথরের দুল।এদুয়ার্দো’কে দেখে ক্রোধের আধিক্যে ওর গোলাপী রঙা ঠোঁটজোড়া মৃদুমন্দ কাঁপতে শুরু করে।উজ্জ্বল বাদামী চোখজোড়া হঠাৎই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে।অসামান্য আক্রোশ ওকে কাবু করে নিতে চায়।একটু একটু করে চোখের সাদা অংশগুলো ঈষৎ লালবর্ণ ধারণ করে।

এই মুহূর্তে সিয়া যেন গভীর রাতের গহীন অরণ্যে সদ্য ফোঁটা কালো গোলাপ।এই গোলাপ কোনো সাধারণ গোলাপ নয়,প্রাণনাশক তীব্র বিষাক্ত গোলাপ।যার স্পর্শ আর সুবাসেও মৃ’ত্যুর আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়।

-শান্ত হও।তোমাকে শান্ত থাকতে হবে।____বাতাসে ভেসে আসে অদৃশ্য মেয়েটার কন্ঠস্বর।

সিয়া শান্ত হয়।ধীরে ধীরে ওর মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলা হাত দুটো হালকা হয়ে আসে।শীতল হয়ে আসে দু’চোখের দৃষ্টি।এদুয়ার্দোর ঠোঁটের কোণে খেলে যায় পৈশাচিক মৃদু হাসি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।