সিয়ার নিষ্প্রভ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে ক্রিস্তিয়ানের হৃদয় শিউরে উঠল। ওর কন্ঠস্বরটাও কেমন অনুভূতিশূন্য। ক্রিস্তিয়ানের মায়া হলো। ভীষণ মায়া হলো। সে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিয়ার মলিন মুখখানার দিকে। আর্নির দু’চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠে। ইনায়া ব্যতিব্যস্ত কন্ঠস্বরে বলে,
– এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো।
ক্রিস্তিয়ান একটা কাঠের টুল টেনে নিয়ে বসল। আর্নি দু’চোখের অশ্রু আঁটকে ঠোঁটের মাঝে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুলল। চাঞ্চল্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– সকালের খাবার খেয়েছিস সিয়া?
– হুম।___শীর্ণ স্বরে উত্তর দিল সিয়া।
ওর গাঢ় বাদামী চুলগুলো বেশ লম্বা হয়ে গেছে। যা রাবার ব্যান্ডের সাহায্যে পনিটেল করে বেঁধে দিয়েছে ইনায়া। সিয়া পি’শাচ তাড়ানোর সরঞ্জামগুলো খাটের নিচে গুছিয়ে রাখল। নির্জীব শরীরে কামরার মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরপায়ে হেঁটে টেবিলের সামনে থাকা টেয়ারটাতে গিয়ে বসল। একটা বই খুলে সেটা পড়তে শুরু করল। আর্নি ইনায়ার পাশ ঘেঁষে বিছানার উপর বসল। সিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করছিল। সিয়া বইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই রাশভারি কন্ঠস্বরে বলল,
– যা বলার জন্য অস্থির হয়ে আছিস তা বলে ফেল।
– সিয়া কি মন পড়তে পারে?______আর্নি মনে মনে ভাবল।
সিয়া বইয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আর্নির দিকে তাকাল। আর্নি ওর চাহনির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেল না। মেয়েটা আদি-অন্ত প্রাণহীন পুতুল যেন। মিষ্টি কালার জর্জেট কাপড়ের শর্টহাতার ফ্রক পরেছিল। গলায় ঝুলছিল সাদা রঙের স্কার্ফ। ক্রিস্তিয়ান অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করল ওকে। ফ্যাকাশে ঠোঁট আর চোখের নিচের পুরু দাগগুলো ওর চেহারার মাধুর্য ম্লান করে দিতে পারেনি। কিন্তু অনুভূতিশূন্য থাকায় ওকে নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে। ক্রিস্তিয়ানের বুক চিরে বেরিয়ে এলো যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘশ্বাস। আর্নি মেকি হাসল। মনের জোর বাড়িয়ে অবশেষে কথাটা বলে ফেলল,
– ভাবছি চারজনে মিলে বিকালে কোথাও ঘুরতে যাবো।
সিয়া পুনরায় বইয়ের দিকে তাকাল। শান্ত কন্ঠে বলল,
– ইচ্ছে করে না।
– কেনো ইচ্ছে করে না?________আর্নির অকপট প্রশ্ন।
– জানিনা। তোরা তিনজনে যাস। দয়া করে এসবের মধ্যে আমাকে জড়াস না।
– কেনো জড়াবে না? তুমি ছাড়া ঘুরতে যাওয়া আমাদের কাছে নিরানন্দ মনে হয়। বিন্দুমাত্র আনন্দ খুঁজে পাইনা।___প্রতিবাদী কন্ঠে কথাটা বলল ইনায়া।
– পুরনো দিনগুলো কি ভুলে গেছো? আমাদের চারজনের সম্মিলিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার কথা? তীর ধনুক হাতে একসাথে পাহাড়ি জঙ্গলে শিকারে যাওয়ার কথা? কত সুন্দর ছিলো দিনগুলো।____ম্লান স্বরে ক্রিস্তিয়ান বলে উঠল।
– সময় বদলায়। পরিস্থিতি বদলায়। সাথে বদলে যায় মানুষের জীবন। প্রিয়জন হারিয়ে যায়। মনের মাঝে থাকা সমস্ত অনুভূতি ম’রে যায়। এসবকিছুর ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো কি কখনো ফিরে পাওয়া যায়? নাকি পুনরায় খুঁজে পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনগুলোকে?
সিয়ার কথাগুলো শুনে ইনায়া আহত হয়। অস্বাভাবিক রকম বুকে ব্যথা করে ওর। আর্নি আর ক্রিস্তিয়ান করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। সহসা দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা গেল। দরজা ঠেলে কামরায় প্রবেশ করলেন ক্রিসক্রিংগল। উপস্থিত চারজোড়া চোখ তার মুখের দিকে তাকাল। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। প্রথমেই ক্রিসক্রিংগলের দৃষ্টি পড়ল ক্রিস্তিয়ান আর আর্নির দিকে।
– ভালো আছো তোমরা?____দু’জনকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন ক্রিসক্রিংগল।
– জ্বি মাস্টার। আপনি কেমন আছেন?___জিজ্ঞেস করল ক্রিস্তিয়ান।
– ভালো।
– কিছু বলতে চান বাবা?________জানতে চাইল ইনায়া।
– হ্যাঁ। আজ বিকালে তৃণভূমিতে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হবে। আমি চাই তোমরা সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করো।
– কিন্তু বাবা……।
সিয়ার কথা শেষ করতে দিলেন না ক্রিসক্রিংগল। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
– তোমাদের কারো মতামত চাইনি। আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।
সিয়া ব্যতীত বাকি তিনজনের মুখাবয়ব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই সুযোগে সিয়াকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে। ভাবতেই মৃদু হাসল ইনায়া।
– তৈরী থেকো। আমিও তোমাদের সাথে তৃণভূমিতে যাবো। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে ষোলো থেকে পঁচিশ বছর বয়সী ছেলে মেয়েরা। যেখানে অনেক দক্ষ ঘোড়সওয়ার থাকবে। যারা কেউবা তোমাদের থেকে বয়সে ছোট, আবার কেউবা বড়। কিন্তু আমি চাই ছোট বড় সবাইকে হারিয়ে তোমাদের চারজনের মধ্যে কোন একজন প্রথম স্থান অধিকার করে নিবে। আশা করি আমি নিরাশ হবো না।
– আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করবো মাস্টার।____দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বলে উঠল ক্রিস্তিয়ান।
– ঠিক আছে। তোমরা গল্প করো।
বলে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন ক্রিসক্রিংগল। আর্নির চোখ দু’টো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। ক্রিস্তিয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসল।
________★★________
খারকিভ, ওয়াভেল কোট।
বেলা দ্বিপ্রহর। এদুয়ার্দো বসে ছিলো নিজের কামরায়। মেজেতে কতগুলো র’ক্তের বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সবগুলো খালি পড়ে আছে। এদুয়ার্দো মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবল। টেবিলের উপর বেশকিছু কাগজ চাপা দিয়ে রাখা পেপার ওয়েট টাকে পাঁচ আঙ্গুলের সাহায্যে ঘোরাচ্ছিল। নিজের বিশ্বস্ত ভ্যাম্পায়ার সেনাগুলোকেও তার সন্দেহ হলো। কেউ একজন আছে যে কিনা এদুয়ার্দোর সকল পদক্ষেপ সম্পর্কে তার শত্রুকে জানিয়ে দিচ্ছিল। ভাবতে ভাবতেই তার পুনরায় র’ক্তের নেশা জাগল। বরফ দিয়ে রাখা ঠান্ডা রক্তে তার তৃষ্ণা মিটবে না। এই মুহূর্তে এদুয়ার্দোর প্রয়োজন গরম তাজা রক্ত। সে ত্বরিত উঠে দাঁড়াল। গন্তব্য পাহাড়ি কোনো একটা জঙ্গল, যেখানে সে পছন্দানুযায়ী শিকার খুঁজে পাবে।
গতকাল রাতে উদ্ধার করা মেয়েগুলোকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল অ্যাভোগ্রেডো। প্রত্যেকেই অ্যাভোগ্রেডোর কাছে ভীষন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলো। তাদের জিজ্ঞেস করে জানা গেছে একেক জনকে একেক জায়গা থেকে অচেতন করে তুলে নিয়েছিলো কারা যেন। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর ছ’জনই নিজেকে মুখসহ হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফিটনে আবিষ্কার করেছিলো। মাঝখানের সময়টুকুতে কি ঘটেছিলো কারোরই কিছু মনে নেই।
আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি আসবে বোধহয়। গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে অ্যাভোগ্রেডো লনে বসে ছিলো। মেয়েগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো সূত্র খুঁজে না পাওয়ায় বেশ হতাশ হয়েছিল। তখন থেকে মন বিষন্ন। একটু একটু করে সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ’ই তার পেছনে ইজাবেল এসে দাঁড়াল। মিষ্টি স্বরে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল,
– উহুম, উহুম।
অ্যাভোগ্রেডো সম্বিত ফিরে পেল। চমকে পেছনে তাকালো। ইজাবেলকে দেখে বসা থেকে দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মাথা ঝুকিয়ে সম্মান জানাল তাকে। অতিশয় ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– প্রিন্সেস! কখন এসেছেন?
– বেশ কিছুক্ষণ হলো। তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু তুমিতো বুঝতেই পারোনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে কি এতো ভাবছিলে?
– তেমন কিছু না।____দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিল অ্যাভোগ্রেডো।
তার মুখখানা ভীষণ করুণ দেখাল। ইজাবেল আন্দাজ করে নিল। কিছুতো একটা গন্ডগোল আছে। যা’ই ঘটুক না কেনো অ্যাভোগ্রেডোকে সে মন খারাপ করে থাকতে দিবে না। কিন্তু মন ভালো করবে কি করে? ইজাবেল ভাবল। ভাবতে ভাবতেই অ্যাভোগ্রেডোর একহাত ধরে ফেলল। হাটটা নিজের কপালে রেখে বলল,
– দেখোতো আমার জ্বর এসেছে কিনা?
অ্যাভেগ্রেডো চমকাল। তার বক্ষস্থলে বেসামাল বেনামী ঝড় বয়ে গেল। ভয়াবহ গলা শুকিয়ে এলো। যেন সারা শরীরে দুর্দমনীয় শিহরণের বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছিল। ক্ষণকাল সময় লাগল বুঝতে। যখন বুজতে পারল ঠোঁট ছড়িয়ে মুচকি হাসল। ইজাবেলের কৃষ্ণকালো চোখজোড়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। একজন অনিন্দ্য সুন্দর যুবকের হাসি দেখে হৃদয় জুড়িয়ে গেল। এই হাসিমাখা মুখখানায় সে দেখতে চেয়েছিলো। আচমকা অ্যাভোগ্রেডোর হাত ছেড়ে দিল। কিঞ্চিৎ মন খারাপের সুরে বলল,
– আমার জ্বর এসেছে শুনে তুমি হাসছো?
– হাসবো না? আপনার জ্বর এসেছে শুনলে দুগ্ধপোষ্য শিশুগুলোও খিলখিল করে হাসতে শুরু করবে।
– কিন্তু কেনো?_____ইজাবেলের অকপট প্রশ্ন।
– কারন আপনি ভ্যাম্পায়ার রাজকন্যা। ভ্যাম্পায়ারদের কখনো জ্বর আসে না।
– ওহ হ্যাঁ, তাইতো। আমার জ্বর আসবে কি করে? আসলে মানুষের মাঝে থাকতে থাকতে এখন আর আমার নিজেকে ভ্যাম্পায়ার বলে মনেই হয়না। চলো, একসাথে হাঁটি।
ইজাবেলের সাথে অ্যাভোগ্রেডো হাঁটতে শুরু করল। দু’জনে একে অপরের সাথে টুকিটাকি কথা বলল। খারকিভের একটি মার্শাল আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হয়েছে ইজাবেল। অ্যাভোগ্রেডো তার একাডেমির ব্যাপারে জানতে চাইল। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– হঠাৎ মার্শাল আর্টের প্রতি এতোটা আগ্রহী হলেন কিভাবে?
– ভীষণ ভালো লাগে। রণকৌশলগুলো যেন আমাকে টানে। আকর্ষিত করে। আমি মুগ্ধ হয়ে মার্শাল আর্টের সব চমৎকার শৈলী দেখি। তাছাড়া একাডেমিতে থাকা সময়টুকুতে বেশ আনন্দ উপভোগ করি। নিজেকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো মনে হয়। তাদের সাথে মিশতে ভালো লাগে।
– আচ্ছা। তবে মনে রাখবেন, আমার সুপারিশেই ওভারলর্ড আপনাকে একাডেমিতে ভর্তি করে দিয়েছেন। আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলে নিমিষেই আমার প্রাণ নিয়ে নিবেন।
অ্যাভেগ্রেডোর কথা শুনে ইজাবেল খিলখিল করে হাসল। অকস্মাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল।
– প্রিন্সেস তাড়াতাড়ি চলুন।
অ্যাভোগ্রেডো ইজাবেলকে তাগাদা দিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল। কিন্তু ইজাবেল দাঁড়িয়ে পড়ল। অ্যাভোগ্রেডো বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। ইজাবেল প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলে উঠল,
– তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার খুব ইচ্ছে ছিল। আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে?
অ্যাভেগ্রেডো থমকাল। ততক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ইজাবেল তার উত্তরের অপেক্ষা করল না। দু’দিকে দু’হাত মেলে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। চোখের পাতা বুজে বৃষ্টি বিলাস করল। ধীরে ধীরে গভীর নিঃশ্বাস টেনে নিল। অ্যাভোগ্রেডো বিমুগ্ধ নয়নে দেখল। সাথে ইজাবেলের এই ইচ্ছেটার গভীরতা খুঁজল।
_________★★_________
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
সুদীর্ঘ করিডোর দিয়ে হাঁটছিলো ভিক্টোরিয়া। গন্তব্য পিদর্কা স্যাভেরিনের কামরা। প্রিয় অর্ধাঙ্গের বিরহে ব্যাকুল ভিক্টোরিয়া হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই হোঁচট খেল। কিন্তু তাকে ত্বরিত ধরে ফেলল কেউ। আতংকে ভিক্টোরিয়ার চোখ মুখ কুঁচকে গেল। আচম্বিতে নিজের পাতলা দেহখানা কারো বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। মুহূর্তেই অসম্ভব আনন্দিত হলো। পুলকিত নয়নে অনুচ্চস্বরে ডাকল,
– জ্যাসন!
জ্যাসন মিকারলি ভিক্টোরিয়ার প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গ। দু’বছর হয়েছে তাদের বিয়ের। কিন্তু একে অপরের সাথে সময় কাটিয়েছে অল্প কিছুদিন। বর্তমানে আব্রাহামের অনুপস্থিতিতে স্লোভাকিয়ার ভ্যাম্পায়ারদের নেতৃত্ব দেয় সে। দুর্গ আর সাম্রাজ্যের দেখাশোনা করে। আব্রাহাম তার উপর ভরসা করে নিশ্চিন্তে স্বাধীন জীবন-যাপন করছে। কিন্তু হঠাৎই কোন সংবাদ না দিয়ে জ্যাসন স্যাভেরিন ক্যাসলে কেনো এসেছে? ভিক্টোরিয়া মনে মনে ভাবল। বেদনার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
– তুমি কি সত্যিই এসেছো? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?
– আমি এসেছি ভিক্টোরিয়া।___নেশালো কন্ঠে উত্তর দিল জ্যাসন মিকারলি।
ভিক্টোরিয়ার বিশ্বাস হলো না। সে চোখ বন্ধ করে পুনরায় চোখ মেলে তাকাল। স্বপ্ন নয় সত্যি।
– অনারেবল এমপ্রেস চিঠি পাঠিয়ে শীঘ্রই দেখা করার কথা জানিয়েছিলেন। আমি একমুহূর্তও দেরি করিনি। চিঠি হাতে পাওয়া মাত্রই রওনা দিয়েছি।
– মা কেনো ডেকে পাঠিয়েছেন হঠাৎ?
– জানিনা। ক্যাসলে প্রবেশ করে প্রথমেই তোমার কাছে ছুটে এসেছি।
দু’জনের কথার মাঝেই ক্যারলোয়েন চলে এলো। জ্যাসনকে দেখে বেশ অবাক হলো। অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– আমি যা দেখছি, তা কি সত্যি?
ক্যারলোয়েনের কন্ঠ শুনতে পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল দু’জন। ভিক্টোরিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। অসম্ভব লজ্জা পেল। তার ফর্সা গাল দু’টো আরক্তিম হয়ে উঠল। সলজ্জিত হেসে বলল,
– হুম। সত্যি।
ক্যারলোয়েন দু’জনের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরল। ব্যঙ্গ করে বলল,
– ঠিক আছে, প্রেম করো দু’জনে। আমি আসি। মা ডেকে পাঠিয়েছেন।
কথাটুকু বলে ক্যারলোয়েন হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠল জ্যাসন,
– ক্যারলোয়েন দাড়াও। আমরাও এমপ্রেসের কাছে যাবো। প্রথমে বলো, কেমন আছো তুমি?
– খুব ভালো। আপনি?
– নিজের সুন্দরী অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে এখন বেশ ভালো আছি।
ভিক্টোরিয়া লজ্জা মিশ্রিত হাসল। যেন তার মুখ থেকে সমস্ত কথা সরে গেল। হাঁটতে হাঁটতে তিনজনে পিদর্কা স্যাভেরিনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ক্যারলোয়েন দরজায় করাঘাত করল। ভেতর থেকে পিদর্কা স্যাভেরিনের কন্ঠস্বর শোনা গেল,
– এসো।
দরজা খুলে কামরায় প্রবেশ করল ক্যারলোয়েন। পেছনে ভিক্টোরিয়া আর জ্যাসন। জ্যাসন প্রথমে পিদর্কা স্যাভেরিনকে নতমস্তকে সম্মান জানাল। সবিনয়ে বলল,
– অনারেবল এমপ্রেস, আশা করি ভালো আছেন।
– তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।_____হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথাটা বললেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
কামরায় আরও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলো। উড্রো উইলসন, অ্যালিস, ব্রাংকো, স্যান্ড্রি, শ্যারন এবং কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখা আরও একজন। কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার পাশাপাশি কালো রঙের হুডিযুক্ত জ্যাকেট পরে আছে সে। মুখোশধারী এই ব্যক্তি ব্যতীত বাকি সবার হাতে রক্তের গ্লাস ছিল।
– বসো।____জ্যাসনকে উদ্দেশ্য করে বললেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
একটা খালি সোফা দেখে বসে পড়ল জ্যাসন। ক্যারলোয়েন আর ভিক্টোরিয়াও তার পাশে গিয়ে বসল।
– খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা কাজে তোমাদের সবাইকে একত্র করেছি আমি।
স্পষ্ট গলায় কথাটা বললেন পিদর্কা স্যাভেরিন। বাকিরা মনোযোগী হয়ে নড়েচড়ে বসল। পিদর্কা তার বক্তব্য শুরু করলেন,
– আমি মনে করি তোমরা সবাই আমার ভীষণ বিশ্বস্ত। আমার অনুগত এবং সকল কাজে পারদর্শী। উইলসন, অ্যালিস, ব্রাংকো, স্যান্ড্রি, শ্যারন, ক্যারলোয়েন, ভিক্টোরিয়া, জ্যাসন তোমরা সবাই আজ আমার সাথে কাস্ত্রোরুজ থর্পে যাবে।
– ওখানে গিয়ে কি হবে?____কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ভিক্টোরিয়া।
পিদর্কা স্যাভেরিন উপস্থিত সবাইকে নিজের পরিকল্পনার কথা বললেন। প্রত্যেকে মনোযোগ দিয়ে শুনল। এরই মাঝে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ক্যারলোয়েন,
– বুড়োটাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন মা?
– হ্যাঁ।
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে কথা বলায় বিরক্ত হলেন পিদর্কা স্যাভেরিন। ক্যারলোয়েন পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করল,
– কিন্তু কেনো?
– সেটা তোমার না জানলেও চলবে।
– বুড়োটা চাইলে প্রথমেই ব্যবস্থা নিতে পারতো। তাহলে এতো সহজে কারাবরণ করে নিলো কেনো?
– ওর জাদুবিদ্যা শুধু অশুভ শক্তি বা ভ্যাম্পায়ারদের উপর ফলে। সাধারণ মানুষের উপর না। ওকে পাহারা দেওয়ার জন্য কাল কুঠুরিতে অসংখ্য পাহারাদার নিয়োগ করেছি। তোমরা কি তোমাদের মাকে নির্বোধ মনে করো?
– তবুও। বুড়োটা ভীষণ বিপদজ্জনক। যদি পালিয়ে যায় কোনোভাবে?
– পালাবে কি করে? কাল কুঠুরির গোলকধাঁধায় ফেঁসে যাবে। রাস্তা খুঁজে পাবে না। তবুও আমি কোনো প্রকার ঝুঁকি নেইনি। প্রতিনিয়ত ওর খাবারে এমন এক ধরনের ঔষধ মিশিয়ে খাওয়াচ্ছি, যা ধীরে ধীরে ওর সম্পূর্ণ শরীর অসাড় করে দিবে। হাত, পা নাড়ালোর সামর্থ থাকবে না। শুধু কথা বলতে পারবে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ওকেও মে’রে ফেলবো।
ক্যারলোয়েন আর কোনো প্রশ্ন করল না। নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
– ওকে সহজ মৃত্যু দিবেন না। আমি ওর দেহের সমস্ত রক্ত শুষে খাবো।______আক্রোশ প্রবণ কন্ঠে কথাটা বলে উঠল উড্রো উইলসন।
কামরায় কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করল। অতঃপর আলোচনা শেষ করে যে যার কামরায় ফিরে গেলো।
_______★★_______
কাস্ত্রোরুজ থর্প।
বেশকিছুক্ষন বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। যখন বৃষ্টি নেমেছিলো সিয়া ভেবেছিলো ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হবে না হয়তো। কিন্তু অকস্মাৎ বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। সিয়া আর ইনায়ার পরনে মেয়েদের ট্রেঞ্চ কোট। পায়ে নী লেন্থ বুট। ধীরপায়ে হেঁটে দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এলো। সিয়ার মন সায় দিল না। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন ওকে সাবধান করে বললো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যদি রক্তচোষা পি’শাচরা চলে আসে?
ভাবলেশহীন ভাবে হেঁটে সিয়া বারান্দায় নেমে আসে। পাশে ইনায়া। ইলহামা অ্যালিয়েভ নিজের মেয়ে দু’টোকে দু’চোখে ভরে দেখলেন। মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে মেয়েদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সিয়ার কপালে সশব্দে চুমু খেলেন। সিয়া করুন দৃষ্টিতে তাকাল। ব্যথাতুর ম্লান কন্ঠে বলল,
– মা আমি যাবোনা। বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলুন না। আমি এমনিতেও হে’রে যাবো। তাহলে অযথা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কি লাভ?
ইলহামা পুনরায় সিয়ার মাঝে অনুভূতি খুঁজে পেলেন। তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। এইতো তার মেয়ে কি সুন্দর আবদার করছে তার কাছে। তিনি আদুরে স্পর্শে সিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দৃঢ় চিত্তে আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বললেন,
– তুমি পারবে সিয়া। তোমাকে জিততেই হবে। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। তুমি বিজয়ী হয়ে ফিরবে।
সিয়া বিষণ্ণ বদনে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। ইলহামা ফের সিয়ার কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
– শুধু ওকেই আদর করবেন। আমাকে আদর করবেন না?____ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল ইনায়া। ইলহামা মেয়ের বাচ্চামি দেখে হাসলেন। কপালে আদর মেশানো স্পর্শ এঁকে দিলেন। মেয়েদের দু’হাতে জাপ্টে ধরে শব্দহীন চোখের অশ্রু ঝরালেন। তিনি তার মেয়ে দু’টোকে সবসময়ই হাসিখুশি দেখতে চাইলেন।
ক্রিসক্রিংগল তাগাদা দিয়ে বললেন,
– সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এসো।
ইলহামা অ্যালিয়েভ মেয়েদের ছেড়ে দিলেন। সিয়ার পা যেন চলতে চায় না। ওর চোখ দু’টো বারান্দায় বসে থাকা উরসুলার দিকে তাকাল। উরসুলা দু’চোখের পলক ফেলে কিঞ্চিৎ ম্লান হাসলেন। অভয় দিলেন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করার জন্য। সিয়া একবার ইলহামা অ্যালিয়েভের দিকে তাকাল তো একবার উরসুলা ভনডারলেনের দিকে। ইনায়া ওর একহাত শক্ত করে ধরে নিল। ক্রিসক্রিংগলের পেছন পেছন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
পশ্চাদ্ভাগের উঠানে গাছের সাথে তিনটা ঘোড়া বেঁধে রাখা ছিল। বকলস টেনে ধরে ঘোড়ায় চেপে বসলেন ক্রিসক্রিংগল। সিয়া শেষ বারের মতো বাড়ির দিকে তাকাল। অতঃপর ঘোড়ায় চড়ে বসল। শক্ত করে লাগাম টেনে ধরে তীব্রবেগে ঘোড়া ছুটাল ও। পনের থেকে বিশ মিনিটের মধ্যে তিনজনে তৃনভূমিতে গিয়ে পৌঁছাল। আর্নি আর ক্রিস্তিয়ান আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলো।
বিস্তৃত ম্যাথস তৃণভূমিতে অগণিত মানুষের ঢল। ঘোড়দৌড় শুরু হবে বিকাল চারটায়। ম্যাথস তৃণভূমি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে হ্যানস নামক একটি পাহাড়ে লাল কাপড়ের নিশান টানানো আছে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সেই লাল নিশানটা নিয়ে প্রথমে যে ফিরে আসতে পারবে সেই বিজয়ী ঘোষিত হবে। সময় দুই ঘন্টা। যেহেতু একটি সুস্থ ঘোড়া ঘন্টায় সর্বোচ্চ আটাশি কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। সুতরাং একজন অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারের পক্ষে বিজয়ী হওয়া বেশ সহজ।
ষোলো থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে মোট ত্রিশজন প্রতিযোগী অংশগ্রহন করল। একজন ব্যক্তি সাদা কাপড়ের নিশান উড়াতেই ঘোড়দৌড় শুরু হলো। সাদা কাপড়ের ইঙ্গিত মানে যাত্রা শুভ হোক। ত্রিশজন অশ্বারোহীর ঘোড়াগুলো হ্যানস পাহাড়ের দিকে তীব্রবেগে ছুটতে শুরু করল। সিয়া, ইনায়া, ক্রিস্তিয়ান এবং আর্নি সবার পেছনে ছিল। ওরা শক্ত করে নিজেদের ঘোড়াগুলোর লাগাম টেনে ধরল। সবগুলো ঘোড়ার সামনে এগিয়ে ছিলো একটি সাদা রঙের ঘোড়া। ঘোড়সওয়ার যেন বাতাসের থেকেও দ্রুত ছুটছে। তার পরনে হুডিযুক্ত ছাইরঙা ট্রেঞ্চকোট। হুডি মাথায় দেওয়ায় মুখখানা দেখা যাচ্ছিল না। তার পেছনেই একটি লাল রঙের ঘোড়া ছিল। এই ঘোড়সওয়ারের পরনেও নীল রঙের হুডিযুক্ত ট্রেঞ্চকোট। হঠাৎ সামনে থাকা ঘোড়সওয়ার পেছনের ঘোড়সওয়ারকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বলল,
– নিলসোন, তুমি কখনোই জিততে পারবে না।