অসম্ভব নিষ্ঠুর আর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই কেটে গেছে পাঁচদিন। হারিয়ে গেছেন ডিয়েটস। ফিরে আসেননি বাড়িতে। কে জানে তিনি বেঁচে আছেন কিনা। কান পাতলেই শোনা যায় উরসুলার হৃদয় বিদারক কান্না। সিয়া পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। খাবার খায় না। কারো সাথে কথা বলে না। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়ায় না। জ্ঞান ফেরার পর যখন জানতে পারে ডিয়েটসকে নিয়ে গেছে এদুয়ার্দো তখন থেকে ও সম্পূর্ণ অনুভূতিশূন্য। কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
ক্রিসক্রিংগল অনেক চেষ্টা করেছিলেন সিয়াকে পুনরায় স্বাভাবিক করে তোলার, কিন্তু তিনি পারেননি। বাড়ির সবাই চায় সিয়া একটু কাঁদুক। ওর অভ্যন্তরের যন্ত্রণা গুলো চোখের নোনাজল রুপে বাইরে বেরিয়ে আসুক। কিন্তু সিয়া কাঁদে না। ওর দু’চোখের দৃষ্টি ভয়াবহ শান্ত। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবে। ঘুম কাতুরে মেয়েটা দিনের পর দিন জানালার পাশে দাড়িয়ে অনায়াসেই রাত কাটিয়ে দেয়। নিটোল স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে এই পাঁচদিনে। চোখের নীচের গোলাপী আভা কেটে গিয়ে পুরু কালো দাগ পড়ে গেছে। চঞ্চল চোখ দু’টো বসে গেছে একেবারে। মেয়ের দিকে তাকালে ইলহামা অ্যালিয়েভের বুকের পাঁজর ভেঙ্গে আসে। গুনগুনিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। সিয়া সবই দেখে, কোনো কিছুই ওর চোখ এড়ায় না।
সিগ্ধ সকাল। অথচ উইজার্ড পরিবারের সদস্যদের বক্ষজুড়ে বয়ে যাচ্ছে বৈরী হাওয়া। বিছানার উপর দু’পা তুলে বসে আছে সিয়া। ওর চোখ দু’টো অত্যন্ত নির্জীব। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কিচের খাঁচার দিকে। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে সিয়া মনে মনে স্পেল আওড়াল। দু’হাতের ইশারায় বিছানায় বসে থেকেই খাঁচার দরজা খুলে দিল। দরজা খোলা পেয়ে কিচ বাইরে বেরিয়ে এলো। দৌড়ে গিয়ে সিয়ার কোলে চড়ে বসল। সিয়ার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। ও ভাবল। মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,
– এভাবে কি সেদিন আমার হাত পায়ের বাঁধনগুলো খোলা যেত?
সিয়ার আফসোস হলো। সাথে অপরাধবোধ হলো এটা ভেবে, প্রয়োজনের সময় কেনো উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেনি ও। কিন্তু সিয়া কি আর জানতো ওকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে শ’য়তানটা ওর দাদুকে তুলে নিয়ে যাবে?
সিয়ার ভাবনার মাঝেই কামরায় প্রবেশ করল ইনায়া। হাতে দু’বাটি স্যূপ। টেবিলের উপর স্যূপের বাটি দু’টো ঢেকে রাখল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনি তুলে নিল। সিয়ার পাশ ঘেঁষে বসে ওর এলোমেলো হয়ে যাওয়া বাদামী রঙা চুলগুলো আচড়ে বেঁধে দিল। অতঃপর কাঁধে হাত রেখে ম্লান কন্ঠে মৃদু স্বরে বলল,
– স্যূপটা অন্তত খেয়ে নাও সিয়া।
সিয়া অনুভূতিশূন্য বদনে তাকাল। নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল,
– কিচকে কিছু খেতে দাও। আমাকে খুব বিরক্ত করছে ও।
ইনায়ার দু’চোখে জল চিকচিক করে উঠল। ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
– তোমার সাথে খাবো বলে দু’বাটি স্যূপ নিয়ে এসেছি। তুমি না খেলে আমিও খাবো না।
সিয়া কথা বলল না। ইনায়া টেবিল থেকে একবাটি স্যূপ এনে চামচ নেড়ে অল্প একটু সিয়ার মুখের সামনে তুলে ধরল। সিয়া মুখ খুলল না। ইনায়া চোখের পানি ছেড়ে দিল। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে অনুরোধের সুরে বলল,
– অল্প একটু খাও। তোমার শরীর দূর্বল। এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। খেয়ে নাও না দয়া করে।
সিয়া মুখ খুলে চামচের স্যূপটুকু মুখে নিল। ইনায়া উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসল। সিয়া অকপটে ওকে জিজ্ঞেস করল,
– দাদু কি বেঁচে আছে ইনায়া? ওরা কি দাদুকে খেতে দিচ্ছে?
ইনায়া ডুকরে কেঁদে উঠল। সিয়া ওর দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হাতের দুই আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ইনায়ার দু’চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে বলল,
– কেঁদো না। আমাদের শক্ত থাকতে হবে। প্রস্তুতি নিতে হবে। আমার মন বলছে, ওরা আবারও আসবে। আমি যে আহত করেছি ওদের একজনকে। এখন মনে হচ্ছে শ’য়তান’টাকে একেবারে মে’রে ফেললেই ভালো হতো। কিন্তু তখন মনে হয়েছিলো ওদের অধিপতিকে আমার পরিবার থেকে দূরে থাকার হুমকি হিসাবে পি’শাচটাকে আহত অবস্থায় জীবিত ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সিয়ার বলা কথাগুলো শুনে দু’দিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ইনায়ার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
★
দিন দুই আগে। মাঝরাতে। সবাই যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন, আচমকা চোখ মেলে তাকাল সিয়া। তবে ও নড়ল না, স্থির হয়ে শুয়ে রইল নিঃশব্দে। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির পশ্চাদ্ভাগের উঠানে কারো উপস্থিতি টের পেল। সজাগ হয়ে উঠল ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। যন্ত্রমানবীর ন্যায় বিছানা থেকে দ্রুত নেমে পড়ল। শব্দহীন পায়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়াল। বাইরের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। এই কয়েকদিনে সিয়া অত্যন্ত সাবধানী হয়ে গেছে। চোখ আর কানের পাশাপাশি ওর ঘ্রাণেন্দ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রখর।
জানালার কাঁচ সামান্য ফাঁক করতেই একটা অচেনা গন্ধ এসে লাগল ওর নাকে। নিশ্চয়ই কোনো অপরিচিত ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে বাড়িতে। সিয়ার সজাগ, উৎকর্ণ কানে একটা মৃদু অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। আবছা আলোয় একটা অদ্ভুত প্রেতমূর্তি দেখতে পেল। সিয়ার মুখখানা কেমন কঠিন হয়ে গেল। ক্রোধের আগুনে ওর উজ্জ্বল বাদামী চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল। যেন দু’চোখের মনি থেকে ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
তড়িঘড়ি করে বিছানার তোষকের নিচ থেকে চকচকে ধারালো একটি ছুরি বের করে আনল। সেটা হাতে নিয়ে শব্দহীন পায়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। গন্তব্য ভাঁড়ার ঘরের দিকে। সিয়া দ্রুতপায়ে হাঁটছিলো। ভাঁড়ার ঘরে প্রবেশ করে কাঠের আলমারি খুলে অন্য হাতে এক খাবলা রসুন বাটা তুলে নিল। অস্পষ্ট ছায়া মূর্তিটা ততক্ষণে সিয়াদের বাড়ির দোতলায় উঠে এলো। সিয়া ব্যতিব্যস্ত পায়ে ডিয়েটসের কামরার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল, বাড়ির ভিতর যে শয়তানটা প্রবেশ করেছে তাকে আজ চরম শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে।
ডিয়েটস যে কামরায় থাকতেন অস্পষ্ট প্রেত ছায়াটা সেই দিকেই অগ্রসর হল। চোখের পলকে কেউ একজন সিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ লম্বা, ফ্যাকাশে চামড়ার চল্লিশোর্ধ্ব একজন লোক। কেমন প্রাণহীন দেখতে। অথচ মুখাবয়ব ভয়াবহ হিংস্র।
মুহূর্তেই ভড়কে গেল সিয়া। তবে নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিতেও ওর বিন্দুমাত্র দেরি হল না। মাঝরাতে চুপি চুপি কারো বাড়িতে প্রবেশ করা ব্যক্তিটা নিশ্চয়ই ভালো কেউ হতে পারে না। সিয়া কোনো প্রশ্ন ব্যতীতই রসুন বাটা থাকা মুষ্টিবদ্ধ হাতে লোকটার চিবুক বরাবর সজোরে আঘাত করল। লোকটা দোতলার রেলিং টপকে নিচতলায় গিয়ে পড়ল। এতো শক্তি ছিলো আঘাতটায়? সিয়া বিষয়টা নিয়ে ভাবল না। এই মুহূর্তে ও ভাবল, মনের শক্তিই সবথেকে বড় শক্তি। যা যেকোনো যুদ্ধে যে কাউকে জিতিয়ে দিতে পারে।
সিয়া দৌড়াল। এক দৌড়ে রেলিংয়ের উপর পা রেখে লাফ দিয়ে নিচ তলায় নেমে দাঁড়াল। কিভাবে সম্ভব হলো এটা? ও জানে না। যেন হুশে নেই সিয়া। মনে হলো, ওর মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি জেঁকে বসেছে। লোকটা ত্বরিত উঠে দাঁড়াল। তার মুখাবয়ব পূর্বের তুলনায় মাত্রারিক্ত হিংস্র দেখাল। দু’চোখের মনি দু’টো লাল টকটকে হয়ে ছিলো। পুরু ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বিশ্রি আর ভয়ংকর দেখতে দু’টো শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো।
সিয়ার কাঁধে থাকা ক্রুশ চিহ্নটা জ্বলতে শুরু করল। ও অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করল। হঠাৎ লোকটা হাওয়াই মিলিয়ে গেল। সিয়া চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলাল। সহসা পিছন থেকে বিদ্যুৎ বেগে ওর দিকে আক্রমন ধেয়ে এলো। একটা শক্ত আঘাতের দাপটে তাল সামলাতে না পেরে উল্টে পড়ল সিয়া। তখনো ওর হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ ছিল। একহাতে শক্ত করে ধরে আছে ধারালো ছুরি। অন্যহাতে রসুন বাটা।
হঠাৎই বাকিরা ঘুম ভেঙ্গে চমকে জেগে উঠল। নিচতলা থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। যেন আসবাবপত্র উল্টে পড়ার আওয়াজ হচ্ছিল। ইলহামা অ্যালিয়েভের আত্মা চমকে গেল। তিনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালেন ক্রিসক্রিংগলের দিকে। ক্রিসক্রিংগল দেয়ালে টানিয়ে রাখা ঢাল থেকে সশব্দে তরবারিটা খুলে নিলেন হাতে। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তার পেছন পেছন ইলহামা অ্যালিয়েভ। ইনায়া দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলায় নেমে গেল। বৃদ্ধা উরসুলা বিছানার পাশে টেবিলের উপর নিজের চশমা খুঁজতে লাগলেন।
একে একে সবাই এক সময় নিচতলায় নেমে এলো। প্রথমেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করল সিয়া। বারান্দার মাঝখানে সোফাসহ উল্টে পড়ে আছে ও। টেবিল আর কিছু জিনিসপত্র এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিলো। সব মিলিয়ে যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। সিয়ার সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। যার চোখ দু’টো লাল টকটকে হয়ে গেছে। লোকটা র’ক্তচোষা পি’শাচ সেটা বুঝে নিতে সময় লাগল না কারো। ইলহামা অ্যালিয়েভ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন। এরই মাঝে উরসুলা ভনডারলেনের রাগান্বিত কন্ঠস্বর শোনা গেল,
– এই র’ক্তপিপাসুটা যেন এখান থেকে জীবিত ফিরে যেতে না পারে।
ভয়ানক রেগে গেল সিয়া। ত্বরিত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। হাতে পায়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু সেসবের পরোয়া করল না। চোখের পলকে দৌড়ে গিয়ে লোকটার বুকে লাথি মারল। লোকটা পুনরায় ছিটকে পড়ল দূরে। সবাই যেন অন্য এক সিয়াকে দেখতে পেল। ওর চোখজোড়া অসম্ভব রক্তবর্ণ হয়ে ছিলো। সিয়ার মাঝে ভয়ংকর অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল। এটা কোন সিয়া? জানা নেই কারো। ক্রিসক্রিংগলের উদ্দেশ্যে শঙ্কিত কন্ঠে ইলহামা জিজ্ঞেস করলেন,
– আমার সিয়াও পি’শাচে পরিণত হয়ে যায়নি তো? ও যে একরাত র’ক্তচোষা পি’শাচের কবলে ছিলো।
ক্রিসক্রিংগল কোনো উত্তর দিলেন না। স্থির নেত্রে সিয়ার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন। তিনি বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। অকস্মাৎ লোকটা উঠে দাঁড়াল। ক্রুদ্ধ কন্ঠে হিংস্র গরগরে আওয়াজ করে তেড়ে গিয়ে একহাতে সিয়ার গলা চেপে ধরল।
ক্রিসক্রিংগল দৌড়ে গেলেন। কিন্তু তার আগেই লোকটাকে পেছন থেকে ইনায়া আঘাত করে বসল। লাফ দিয়ে কিছুটা উঁচুতে উঠে লোকটার ঘাঢ় বরাবর কনুই দিয়ে সজোরে আঘাত করল। লোকটা সিয়াকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎই যেন হাওয়াই মিলিয়ে গেলো। অদৃশ্য হয়ে উচ্চ শব্দে হাসতে শুরু করল। বাকিরা সতর্ক দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকাল।
সিয়া উৎকর্ণ কানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আচম্বিতে ওর পেছন দিক থেকে একটা আক্রমণ ঘনিয়ে এলো। সিয়া নেত্রচ্ছদ বন্ধ করে নিল। শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ রেখে হাতের ছুরিটার ধারালো অংশ মুষ্টির নিম্নাংশে রেখে শক্ত করে ধরল। ছুরিটা গেঁথে দিল পেছনে। তৎক্ষনাৎ একটা বীভৎস চিৎকার শোনা গেলো। সবাই ভীত দৃষ্টিতে সিয়ার পেছনে তাকাল। ও ছুরি বসিয়ে দিয়েছে র’ক্তচো’ষা’টার বুকের ডানদিকে।
উপস্থিত প্রত্যেকের চোখগুলোতে যেন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটল। তারা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। যেন নড়চড় করার ক্ষমতা টুকুও নেই। শুধুমাত্র উরসুলা ভনডারলেন কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। তার জ্বলতে থাকা পোড়া হৃদয় একটুখানি সুশীতল হলো। ধীরে ধীরে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলেন।
সিয়া এখানেই থামল না। অন্য হাতে থাকা রসুন বাটা রক্তচোষা টার মুখে পুড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরল। লোকটা দু’কদম পিছিয়ে গেল। সুযোগ বুঝে ইনায়া লোকটার পেছনে গিয়ে দাড়াল। শক্ত করে দু’হাত চেপে ধরল। রক্তচোষাটার পালিয়ে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ করে দিল। সিয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– আমার দাদু কোথায়? তোরা কি করেছিস তার সাথে?
লোকটা মৃদু গোঙ্গানি দিয়ে উঠল। সিয়া তার মুখ ছেড়ে দিল।লোকটা কাতর কন্ঠে বলল,
– আমি জানিনা।
সিয়ার ক্রোধ বেড়ে গেল। হাতের ছুরিটা আরো শক্ত করে পি’শাচ’টার বুকে চেপে ধরল। লোকটা ভয়াল চিৎকার করতে শুরু করল। এমনিতেই রসুনের প্রভাবে তার মুখ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। সিয়া পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করল,
– উইজার্ড ডিয়েটস কোথায়?
– আমি সত্যিই কিছু জানিনা।___লোকটা করুন আর্তনাদ করে উঠে বলল।
সিয়া আক্রোশপ্রসূত কন্ঠস্বরে বলল,
– আমি জানি তুই এভাবে ম’রবিনা। আমি চাইও না তোকে মা’রতে। তোর মনিবকে গিয়ে সাবধান করে দিস। আমার পরিবারের দিকে যেন চোখ তুলে না তাকায় সে। যদি তাকায় তাহলে পরিণাম ভালো হবে না। নিজের পরিবারকে বাঁচাতে আমি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবো। বিন্দুমাত্র সুযোগ দিবো না।নিমিষেই ধ্বংস করে দিবো তাকে।
ইনায়া আর সিয়া লো’কটাকে ছেড়ে দিল। বুকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থাতেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ক্রিসক্রিংগল অসম্ভব বিস্মিত হলেন। সিয়াকে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু সিয়া দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। উপস্থিত প্রত্যেকে নিশ্চল দৃষ্টিতে কেবল ওর চলে যাওয়া দেখল।
★
সেদিন সিয়ার মধ্যে এতো সাহস আর শক্তি কিভাবে এসেছিলো উইজার্ড পরিবারের সদস্যদের জানা নেই কারো। তবে তারা এতুটকু জানেন, সিয়া পুরোপুরি বদলে গেছে। বেশ বুঝতে পেরেছিলেন চোখের পলকেই যেন অষ্টাদশ বছর বয়সী মেয়েটা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে। যার মাঝে হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা বা কোনো প্রকার যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি নেই। বিশেষ করে যখন ও খাবার খায়না, রাতে ঘুমায় না তখন ইলহামা অ্যালিয়েভের মনে থাকা সন্দেহটা গাঢ় হয়ে যায়। তিনি প্রতিবার শঙ্কিত কন্ঠস্বরে ক্রিসক্রিংগলকে জিজ্ঞেস করেন,
– আমাদের সিয়া র’ক্তচোষা পি’শাচ হয়ে যায়নি তো?
ক্রিসক্রিংগল দীর্ঘশ্বাস টেনে নেন। ইলহামা কেমন অবুঝের মতো হয়ে গেছেন। ভয়াবহ আতংক থেকেই তার এই শঙ্কা। ক্রিসক্রিংগল তাকে আশ্বস্ত করেন। ম্লান কন্ঠে বলেন,
– না, মানসিকভাবে ভীষন আঘাত পেয়েছে ও। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
পরিবারকে বিপদের সম্মুখে ফেলে ডিয়েটসের খোঁজে কিয়েভ অভিমুখে যেতে পারেননি ক্রিসক্রিংগল। কে বলতে পারে যদি পুনরায় এ বাড়িতে কোনো ভ্যাম্পায়াররা আক্রমন করে বসে?
________★★_______
খারকিভ, ওয়াভেল কোট।
আসন্ন সন্ধ্যা। দুর্গের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারের রুফটপে দাঁড়িয়ে ছিলো এদুয়ার্দো। তার পেছনে খানিকটা দূরে সামনে দু’হাত বেঁধে দাড়ানো অ্যাভোগ্রেডো। সে এদুয়ার্দোকে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারল না ভয়ে।
– কিছু বলতে চাও অ্যাভোগ্রেডো?___এদুয়ার্দো অকপটে জিজ্ঞেস করে।
অ্যাভোগ্রেডো আমতা আমতা করতে শুরু করল। তার গলা শুকিয়ে এলো। সে জানে না কথাটা জানার পর তার ওভারলর্ড কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তবুও মনের মধ্যে পর্যাপ্ত সাহস সঞ্চার করল। ভীত ভীত কন্ঠস্বরে সবিনয়ে বলল,
– অনারেবল ওভারলর্ড।
এতটুকু বলে থেমে গেল অ্যাভোগ্রেডো। ভয়েরা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল যেন। এদুয়ার্দো তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– নির্ভয়ে বলো।
অভয় পেয়ে বলতে শুরু করল অ্যাভোগ্রেডো,
– খারকিভের কোজিনকা এবং গোরা-পদল গ্রামের পাশাপাশি রুশভাষী অঞ্চল লুহানস্ক, পূর্বাঞ্চলীয় সেভেরোদোনেৎস্ক থেকেও অগণিত মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু এর থেকেও মারাত্মক বিষয় হলো কিয়েভের আশে পাশে থাকা সবগুলো গ্রামে প্রতিনিয়ত একাধিক রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। যাদের ঘাড়ে ভ্যাম্পায়ারদের দেওয়া কামড়ের দাগ স্পষ্ট দেখা গেছে। সমগ্র কিয়েভে ছেয়ে গেছে র’ক্তচোষাদের আতংক।
– এসবের পেছনে কে?_____ থমথমে ভরাট কন্ঠে প্রশ্ন করল এদুয়ার্দো।
– এখনো জানা যায়নি।___কথাটা বলে অপরাধীদের মতো মাথা নত করে নিল অ্যাভোগ্রেডো।
– মাথা উঁচিয়ে সোজা হয়ে দাড়াও।
এদুয়ার্দো বলল। অ্যাভোগ্রেডো ভড়কাল। সে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল। এখনো উল্টো দিকে ঘুরে আছে এদুয়ার্দো। তাহলে সে জানলো কি করে অ্যাভোগ্রেডো মাথা নত করে নিয়েছিলো?
– আমি তোমার গতিবিধি জানি। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় এসবের পেছনে কোনো একজন ভ্যাম্পায়ার আছে? নাকি একাধিক ভ্যাম্পায়ার?
– অবশ্যই একাধিক। কিন্তু এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে কোন একজন।_____অ্যাভোগ্রেডো দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল।
– হুম। এতোদিনেও যেহেতু তোমরা অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারলে না। তাহলে বিষয়টা কি আমাকেই দেখতে হবে?
পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু উঁচিয়ে কথাগুলো বলে উঠল এদুয়ার্দো। অ্যাভোগ্রেডো ইতস্ততবোধ করল। সে জ্বি অথবা জ্বিনা এই দু’টোর মধ্যে কোনোটাই বলতে পারল না। দোটানায় ভুগল।
– প্রথমে কোন জায়গা’টা থেকে অনুসন্ধান করলে ভালো হবে বলে তোমার মনে হয়?
অ্যাভোগ্রেডোর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলল,
– কোজিনকা এবং গোরা-পদল।
– উমহু। প্রথমে সেভেরোদোনেৎস্ক। তৈরী থেকো। আজ রাতে অন্বেষণে যাবো।
এদুয়ার্দো দ্রুতপায়ে রুফটপ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। অ্যাভোগ্রেডো স্থির নয়নে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। বরাবর এদুয়ার্দো এরকমই করে। প্রথমে অ্যাভোগ্রেডোর থেকে পরামর্শ চায় তারপর নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। তাহলে সে বেচারা অ্যাভোগ্রেডোকে কেনো জিজ্ঞেস করে? বুঝে উঠে না অ্যাভোগ্রেডো। তবুও সে হাসে। কারন সে তার ওভারলর্ডকে ভীষণ ভালবাসে। সর্বোচ্চ সম্মান করে। এদুয়ার্দোর সবকিছুতেই অ্যাভোগ্রেডো বিমুগ্ধ হয়। সর্বদা নিজের আইডল মনে করে।
_________★★_________
ওডেসা, দুভিল কোট।
একসপ্তাহের বেশি সময় পর দুভিল কোটে ফিরে এসেছে রুলার আব্রাহাম স্যাভেরিন। তার ফিরে আসার খুশিতে দুর্গে প্রীতিভোজের আয়োজন করেছে তার বড় বোন হ্যারিয়েট স্যাভেরিন। হলরুম সাজানো থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়ার সমস্ত তদারকির দায়িত্ব ম্যাক্সিমিলিয়ান এবং মাদাম কামালির। আব্রাহামের সব বন্ধুরাও আজ দুর্গে উপস্থিত ছিল। এর আগেও তারা বহুবার এই এই দুর্গে এসেছিলো, সেই সুবাদে হ্যারিয়েট সবাইকে খুব ভালোভাবে চিনে।
সন্ধ্যা শেষে রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসতেই প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান শুরু হল। মেয়েদের পরনে ছিলো ভিন্ন ভিন্ন রঙের ওয়েস্টার্ন ফ্রক। এমিলিগ্রিন কালো পাথরের কারুকার্য খচিত কালো কুচকুচে রঙের হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ওয়েস্টার্ন ফ্রক পরেছিল। বেলাডোনা পরেছে নীল রঙা ফ্রক। শুধু বিশেষভাবে সেজেছে হ্যারিয়েট স্যাভেরিন। লাল টকটকে রঙের কাঁধ খোলা লম্বা গাউন পরেছে সে। ঠোঁটে গাঢ় করে দেওয়া লাল রঙা লিপস্টিক। ধবধবে ফর্সা শরীরে লাল রঙটায় যেন আরও আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে তাকে। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধীরেপায়ে হলরুমে প্রবেশ করল সে। তার সুদীর্ঘ লম্বা গাউনের নিচের অংশটুকু ধরে আছে অন্য একটা মেয়ে। হলরুমে প্রবেশ করে সকলের উদ্দেশ্য প্রথমেই বলে উঠল,
– গুড ইভিনিং এভ্রিওয়ান।
প্রত্যুত্তরে উপস্থিত প্রত্যেকেই তাকে সাদরে শুভেচ্ছা জানাল। এরই মাঝে হলরুমে প্রবেশ করল আব্রাহাম স্যাভেরিন। পরনে আকাশী রঙা শার্ট আর ধূসর রঙের প্যান্ট। শার্টের উপর ধূসর রঙের ব্লেজার পড়েছে সে। হ্যারিয়েটের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সবাই এবার আব্রাহামের দিকে তাকাল। অভ্যাসবশত তার বিশ্বস্ত সেবকগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে বুকে হাত রেখে নতমস্তকে সম্মান জানাল। আব্রাহাম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। সেবকগুলো নিজেদের সম্বিত ফিরে পেলো। হঠাৎই একটা মেয়ে এসে আব্রাহামের পাশ ঘেঁষে দাড়াল। আব্রাহামের পোশাকের সাথে মিলিয়ে আকাশি রঙের ওয়েস্টার্ন ফ্রক পড়েছে সে। সলজ্জিত হেঁসে মেয়েটা আব্রাহামের একহাত আঁকড়ে ধরল। আব্রাহামের লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়ার হাসি মিলিয়ে গেল। সে পাশ ফিরে তাকাল। রাগান্বিত কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বলল,
– অলিভার! হাত ছেড়ে দাও আমার।
– এস্টীম রুলার পারলে ছাড়িয়ে নিন।
আব্রাহাম নিলসোনকে ইশারা করে কিছু একটা বোঝাল। মহামান্য রুলারকে এমন অবস্থায় দেখে নিলসোনের দমফাটা হাসি পেল। কিন্তু সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে হাসি আঁটকে নিল। বেলাডেনা কিছু একটা আচ করতে পেরে পামেলার দিকে এগিয়ে গেল। মিষ্টি করে হেঁসে হাত বাড়িয়ে দিল। পামেলা ভীষণ খুশি হল। আব্রাহামের হাত ছেড়ে দিয়ে বেলাডোনার হাত ধরল।ধীরপায়ে হেঁটে একপাশের সোফায় গিয়ে বসল। আব্রাহাম তার বন্ধুদের পাশে গিয়ে দাড়াল। স্টুয়ার্ড তার কাঁধে চাপড় দিয়ে উঠে বলল,
– মেয়েদের চোখ ঝলসে দিলি ভাই। কিন্তু আমারও চোখ ঝলসে গেছে, তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে। কি নাম ওর?
– অলিভার পামেলা। তুই আঠার মতো ওর পেছনে লেগে থাক। কাজ হয়ে যাবে।___দুষ্টু হেসে কথাটা বলল আব্রাহাম।
– হয়ে যাবে বলছিস?______পরনে থাকা ব্লেজারের কাঁধ ঝেড়ে সগর্বিত কন্ঠে কথাটা বলল স্টুয়ার্ড।
– একদম।
সহাস্যে বলল আব্রাহাম। হেসে হেসেই চোখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। কিন্তু হঠাৎই কতগুলো মেয়ের মাঝে সে ডিয়েটসের সাংঘাতিক নাতনিকে দেখতে পেল। তার ভাষায় যে মেয়েটা দাদুর মতোই বিপদজ্জনক। আব্রাহাম স্তম্ভিত হয়ে গেল। নাম না জানা মেয়েটার দিকে তার নীলাভ নেত্রের দৃষ্টি আঁটকে রইল।