ফ্লোরেনসিয়া – ১৩

চারপাশের অসংখ্য পাহাড় ছাপিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। আবছা আলো আবছা অন্ধকারে ইনায়ার গাঢ় ধূসর চোখজোড়া ঔজ্জ্বল্য হয়ে উঠে। ও আব্রাহামের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। আব্রাহাম অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ করে ওকে।

মেয়েটার দু’চোখের মনি দু’টো গাঢ় ধূসর রঙের। সুদীর্ঘ লালচে-সোনালি চুলগুলো পুরু বিনুনি হয়ে কোমর ছাড়িয়ে অনেকটা নিচে নেমে গেছে। থুতনিতে স্পষ্ট টোল বিদ্যমান। নিঃসন্দেহে মেয়েটা সুন্দরী। বুদ্ধিমতীও বটে। সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনন্য। আব্রাহাম ইনায়ার চারপাশে ঘুরতে শুরু করল। ইনায়া পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইল।

– এতো লম্বা চুল মেয়েটা সামলায় কি করে?___আব্রাহাম মনে মনে ভাবল।

তার দেওয়া কামড়ের দাগ এখনো ইনায়ার গলায় স্পষ্ট হয়ে আছে। দাগটার দিকে দৃষ্টি দিতেই আব্রাহামের ভয়ানক রক্তের তৃষ্ণা জাগল। ঘ্রাণেন্দ্রিয় ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল মিষ্টি মধুর রক্তের সুবাস। না চাইতেও তার ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। সে ইনায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎই মেয়েটার কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। ইনায়ার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই।

আব্রাহাম অমায়িক ভঙ্গিমায় হাসল। দু’জনের মাঝখানে থাকা দুরুত্ব মিটিয়ে ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে পুনরায় ঠোঁট চেপে ধরল। একজোড়া উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে ইনায়া সম্বিত ফিরে পেল। অদ্ভুত এক অজানা শিহরনে ওর সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠল। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল। আব্রাহামের একজোড়া ধারালো শ্বদন্ত ওর ঘাড়ের চামড়া ভেদ করে রক্তনালীতে গিয়ে পৌঁছাল। ইনায়া ব্যথাতুর কন্ঠে করুণ আর্তনাদ করে উঠল। আব্রাহাম চুকচুক করে রক্ত পান করল। ইনায়ার শরীর অবশ হয়ে এলো। দু’হাতের দূর্বল আঘাতে আব্রাহামকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু অসফল হলো। ওকে কাবু করে ফেলা শক্তপোক্ত শরীরটাকে একচুলও সরাতে পারল না ও।

ইনায়ার চেতনা আছে অথচ প্রচন্ড শরীর দুর্বল। যেন রক্ত নয় ওর শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছিল কেউ। অকস্মাৎ ইনায়া একটা অভাবনীয় কাজ করে ফেলল। দেহের অবশিষ্ট শক্তি প্রয়োগ করে আব্রাহামের পায়ে সজোরে আঘাত করে বসল।

– আহহ!

শব্দ করে পা ধরে আব্রাহাম কিছুটা দূরে সরে দাড়াল। রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বরে বলল,

– অ’সভ্য মেয়ে। আমাকে আঘাত করার দুঃসাহস কি করে পেলে?

ইনায়ার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। প্রগাঢ় নিদ্রায় ওর দু’চোখ বুজে আসে। আব্রাহাম হিংস্রাত্মক হয়ে ছুটে যায় ইনায়ার কাছে। ক্রুদ্ধ হয়ে ওর দেহের সমস্ত রক্ত চুষে খেতে চাইল। কিন্তু ইনায়া শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। আব্রাহাম নিজের পেশিবহুল দু’হাতের বাহুবন্ধনে ওকে আবদ্ধ করে নিল। চোখ বুজে থাকা ইনায়ার দু’গালে হালকা চাপড় দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,

– এই মেয়ে! হেলোওও, এই যে শুনতে পাচ্ছো?

– ম’রে গেলো নাকি?

চিন্তিত হয়ে ইনায়ার নাকের কাছে হাত রাখল সে। নিঃশ্বাস পড়ছে। কিন্তু খুব ধীর গতিতে। আব্রাহাম ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। বিরবির করে বলল,

– বুড়োটার মতোই ওর নাতনিটাও বিপজ্জনক। আদৌও এটা কোনো মেয়ে মানুষ কিনা, তা নিয়ে আমার মনে বেশ সংশয় জাগে।

সহসা নিজের হৃৎস্পন্দনের ধুকপুক শব্দ শুনতে পেল সে। অদ্ভুত, অদম্য অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন। কখনো এরকম হয়নি আগে। কেমন জানি অন্যরকম অনুভূতি। নাম না জানা এই দুঃসাহসী মেয়েটার প্রতি ভীষন মায়া হচ্ছে। কেনো হচ্ছে এতো মায়া? বুঝতে পারল না আব্রাহাম। শুধুমাত্র তার অবচেতন মন বলে উঠে,

– মে’রো না। মে’রো না এই মেয়েটাকে। তাকে বাঁচিয়ে রাখো এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই তার পি’শাচ সত্তা বেঁকে বসে। তাকে উস্কে দিয়ে বলে,

– ও ডিয়েটসের নাতনি। আর ডিয়েটস তোমার বাবার খু’নী। মে’রে ফেলো ওকে। মে’রে ফেলো এখুনি।

আব্রাহামের পিশাচ সত্তা তাকে কাবু করে ফেলে। মুহূর্তেই প্রচন্ড আক্রোশপ্রসূত হয়ে উঠে। তন্দ্রাচ্ছন্ন ইনায়ার ঘাড়ে সজোরে কামড়ে ধরে। ইনায়া মৃদুমন্দ গোঙ্গানি দিয়ে উঠে ডাকে,

– মা!

আব্রাহাম সম্বিত ফিরে পায়। তৎক্ষনাৎ ইনায়ার মুখের দিকে নজর সরিয়ে নেয়। মেয়েটা যন্ত্রণায় চোখ ঠোঁট কুচকে ফেলেছে একেবারে। মুখখানা ভীষন অসহায় দেখায়। আব্রাহামের মায়া হয়। খুব মায়া হয়। কিন্তু তার পিশাচ সত্তা ফের তাকে উস্কে দিয়ে বলে,

– তুমি কি ভুলে যাচ্ছো তুমি একজন পি’শাচ? পি’শাচদের কখনো মায়া হয় না। তারা শুধুমাত্র মায়ায় ফেলে। কিন্তু ভুলবশতও মায়ায় জড়ায় না। তোমার পি’শাচ সত্তা কি এতোটাই দূর্বল যে একটা সাধারণ মেয়ের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে?

আব্রাহামের মন সায় দিল না। একটা দূর্বল হয়ে যাওয়া অচেতন মেয়েকে রক্ত চুষে মে’রে ফেলার মধ্যে কোনো বীরত্ব খুঁজে পেল না। সে ঘোর প্রতিবাদ জানাল নিজের পি’শাচ সত্তাকে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে ধমকে উঠে বলে,

– আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার দুঃসাহস দেখিয়ো না। অচেতন কোনো মেয়েকে মে’রে ফেলে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে বলছো? মুর্খ তুমি। আমি এরকম কিছুই করবো না। ওকে আমি মা’রবো ঠিকই। কিন্তু তখন, যখন ও সম্পূর্ণ সজ্ঞানে থাকবে। ওর মধ্যে আমাকে প্রতিহত করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

উচ্চশব্দে হাঁসতে শুরু করল তার পি’শাচ সত্তা। অবজ্ঞার স্বরে বলে উঠে,

– তাহলে সজ্ঞানে থাকতে দিতে। ওকে সম্মোহিত করেছিলে কেনো? কি ভেবেছিলে, ও সজ্ঞানে থাকলে তুমি নিজেই কাবু হয়ে যাবে? লোকে কি বলবে জানো? তুমি ভ্যাম্পায়ার নামের কলঙ্ক।

আব্রাহামের ক্রোধ বাড়ল। দু’চোখের মনি দু’টো যেন জলন্ত কয়লার ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠল। কিন্তু কোনো কথা বলল না। সময় গড়াল। চারদিক থেকে দলা দলা কুয়াশার মতো অন্ধকার নেমে এলো। ইনায়া আদুরে বিড়ালের মতো লেপ্টে রইলো আব্রাহামের দু’হাতের মাঝখানে। এরই মাঝে আব্রাহামের পাশ দিয়ে বাতাসের বেগে একটা অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি ছুটে গেলো।

– আরও একটা ভ্যাম্পায়ার!

আব্রাহাম বিস্মিত হল। সে ছাড়া এ গ্রামে আরও একজন ভ্যাম্পায়ার থাকার কথা। সেটা কেবল অনারেবল ওভারলর্ড এদুয়ার্দো স্যাভেরিন। কিন্তু এদুয়ার্দো তাকে দেখেও কথা না বলে এভাবে চলে গেলো কেনো? বিষয়টা বেশ ভাবাল আব্রাহামকে। অকস্মাৎ ইনায়া নড়ে চড়ে উঠে। সে মনে মনে ভাবে,

– ভ্যাম্পায়ার’টার পিছু নেওয়া দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে এমন অর্ধমৃত রূপবতীকে কোথায় ফেলে রেখে যাবো? এতোক্ষণ সজ্ঞানে থাকলে কে জানে আমার শরীরে কতগুলো লাথি ঘুষি পড়তো!

প্রথমবার যেদিন ইনায়ার সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন আব্রাহামের চেহারা কালো কাপড়ে ঢাকা ছিলো। চোখগুলো ছিলো লাল টকটকে। তাই আব্রাহামকে চোখের সামনে দেখে চিনতে পারেনি ইনায়া। কিন্তু আজ যা হলো, তাতে আব্রাহামের সম্পূর্ণ সত্যি ওর কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলো। এরপর কি হবে? প্রণয় নাকি ভয়াবহ কোনো সংঘর্ষ?

– প্রণয়? একজন ভ্যাম্পায়ার আর মানুষের মধ্যে? তাও কিনা এই মেয়েটার সাথে! অসম্ভব। ও আমার শত্রুর পরিবারের মেয়ে। যদি আমাদের মাঝে কিছু হয়, তা কেবলই সংঘর্ষ।

আব্রাহাম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল। ইনায়াকে রাস্তায় ফেলে রেখে যাবে, নাকি বাড়িতে পৌঁছে দিবে? বাড়িতেই বা কিভাবে পৌঁছে দিবে? ডিয়েটস নিজের বাড়িতে সুরক্ষা ব্যারিয়ার দিয়ে রেখেছে। তাছাড়া আব্রাহামকে দেখেই সে চিনে ফেলবে। ভাবতে ভাবতেই অনেকক্ষণ সময় গড়িয়ে গেল। তন্মধ্যে কোনো মানুষের কন্ঠস্বর শুনতে পেল। জঙ্গলের দিক থেকে কারা যেন আসছে। ইনায়াকে রাস্তার একপাশে শুইয়ে দিয়ে ঝোপের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল সে।

চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। লন্ঠন হাতে একজন মহিলা আর পুরুষকে আসতে দেখা গেল। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে তারা হাঁটছে। পুরুষটার সাথে একজন মহিলাকে দেখে আব্রাহাম অনেকটা স্বস্তি পেল যেন। সে নিঃশব্দে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মানুষ দু’টো ধীরে ধীরে ইনায়ার কাছে চলে এলো। আচমকা রাস্তার পাশে তারা একটা মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখে ভীষণ চমকে গেলো। মহিলা ভয় পেলেন। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাতের লন্ঠন উচিয়ে ইনায়ার মুখের উপর ধরেন। পুরুষটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই ভীত-সন্ত্রস্ত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠে ডাকলেন,

– ইনায়া!

মহিলার আত্মা চকিত হলো। তার দিকে তাকিয়ে লোকটা ভীত স্বরে বললেন,

– সাসোলি! এই মেয়েটা আমাদের ইনায়া। কিন্তু ও এভাবে রাস্তার পাশে পড়ে আছে কোনো?

সাসোলি কুরী দৌড়ে গেলেন। ইনায়ার পাশে দপ করে বসে পড়লেন। ওর মাথাটা কোলো তুলে নিলেন। নাকের কাছে আঙ্গুল রেখে বললেন,

– ওর নিঃশ্বাস পড়ছে। হয়তো অচেতন হয়ে গেছে।

– কিন্তু ও এখানে অচেতন হয়ে পড়ে আছে কেনো?__অকপটে জিজ্ঞেস করলেন স্ট্রিকল্যান্ড কুরী।

– সেটাতো ওর জ্ঞান ফেরার পরই জানা যাবে। ধরো, ওকে টেনে তুলতে সাহায্য করো।

অচেতন হয়ে ইনায়ার শরীরের ওজন যেন দ্বিগুন বেড়ে গেছে। দুশ্চিন্তায় আর ভয়ে সাসোলি কুরীর হাত পা মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করে। একা হাতে ইনায়াকে টেনে তুলতে পারছিলেন না। স্ট্রিকল্যান্ড ইনায়ার একহাত ধরে সাসোলিকে সাহায্য করলেন। অতঃপর ওকে কোলে তুলে নিলেন। দু’জনে মিলে ইনায়াকে সাথে নিয়ে সিয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন। ঝোপের আড়ালে থেকে আব্রাহাম সবটাই দেখে। মানুষগুলো চলে যেতেই সে জঙ্গলের দিকে ছুটে।

★★

কামরার চারপাশে চারটে লন্ঠন ঝুলছে। মাঝখানে থাকা ঝাড়বাতিতে কতগুলো মোম জ্বলছে। ডিয়েটসের কামরায় মেঝেতে বসে থেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে আর্নি। কাঁদতে কাঁদতে গলা বসে গেছে, তবুও কান্না থামছে না ওর।

বিছানার উপর অচেতন হয়ে পড়ে আছেন ইলহামা অ্যালিয়েভ। তার মাথায় ক্রমাগত পানি ঢালছেন উরসুলা ভনডারলেন। পরপর কতগুলো দুর্ঘটনায় বৃদ্ধা যেন একেবারেই হিতাহিত বোধশূন্য। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। থেকে থেকে বুক চিরে বেরিয়ে আসছে শুধু যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘশ্বাস। মেয়ের শোকে জ্ঞান হারিয়েছেন ইলহামা অ্যালিয়েভ। ক্রিসক্রিংগল খুঁজতে গেছেন ইনায়াকে। সন্ধ্যার পূর্বে সিয়ার খোঁজে আর্নিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল ও।

ডিয়েটসের মুখাবয়ব অসম্ভব কালো দেখাচ্ছিল। দুশ্চিন্তায় তার মাথা ফেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু ধৈর্যচ্যুত হলেন না। আলমারি খুলে কিসব যেন বের করে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো আর্নি। বনিফেসিও পাহাড়ে সিয়া ভয়ংকর এক রক্তচোষা পিশাচের হাতে বন্ধী, আর এখানে বসে বসে বুড়ো করছে টা কি?

উইজার্ড পরিবারের অবস্থা মারাত্মক শোচনীয়। প্রত্যেকের মন মস্তিস্ক এলোমেলো। শুধু ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় হয়ে আছেন ক্রিসক্রিংগল। যেন বৃদ্ধ বাবাকে বাঁচাতে ছোট মেয়েকে উৎসর্গ করে দিচ্ছেন। তার বাবার সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে এই গ্রামের মানুষগুলোকে পি’শাচদের কবল থেকে মুক্ত করবে কে?

বেশ কয়েকটা বইয়ের মধ্যে একটি সোনালী রঙা প্রচ্ছদে মোড়ানো বই নজর কাড়ল আর্নির। সাথে চকচকে সাদা রঙের একটা পাথর। হঠাৎ আর্নির কান্না থেমে গেল। ও কৌতুহল নিয়ে ডিয়েটসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিছু অদ্ভুত জিনিসপত্র দিয়ে একটি মাঝারি আকারের কাঠের বাক্স ভর্তি করছিলেন তিনি। অকস্মাৎ কামরায় প্রবেশ করলেন ক্রিসক্রিংগল। কোলে ইনায়ার অচেতন দেহপিঞ্জর। আর্নি চমকাল। ওর ঠোঁট দু’টো কিঞ্চিৎ পৃথক হয়ে গেলো।

– ইনায়ার কি হয়েছে?______শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন উরসুলা ভনডারলেন।

তার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ডিয়েটস দরজার দিকে তাকালেন। বিচলিত ভঙ্গিতে উঠে দাড়িয়ে পড়লেন। দ্রুত পায়ে হেঁটে ইনায়ার কাছে চলে গেলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– কি হয়েছে ওর?

ক্রিসক্রিংগল নিশ্চুপ, নির্বাক। ইনায়াকে সোফার উপর শুইয়ে দিলেন। মেয়েটার স্নায়ূ দুর্বল। মুখখানা রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল। ডিয়েটস ওর ঘাড়ের কাছে স্পষ্ট দু’টো ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেলেন। তার বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না বিধায় দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করলেন না। ইনায়ার কাছে গিয়ে একবার নাড়ি পরীক্ষা করে দেখলেন।

আতঙ্কিত চেহারায় কামরায় প্রবেশ করলেন স্ট্রিকল্যান্ড আর সাসোলি কুরী। কান্নারত আর্নিকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে আরও আতঙ্কিত হলেন। দু’জনেই নিজেদের মেয়ের কাছে ছুটে গেলেন। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

– তোমার এরকম বিধ্বস্ত অবস্থা কি করে হলো?

আর্নি কোনো কথা বলল না। পুনরায় কাঁদতে শুরু করল। অসামান্য অপরাধবোধে জর্জরিত হলো। সাসোলি কুরী একনজর বিছানায় শুয়ে থাকা ইলহামার দিকে তাকালেন। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন কিছুতো একটা অঘটন ঘটে গেছে আবার। কিন্তু সেটা কি?

সম্পূর্ণ কামরায় চোখ বুলিয়ে সিয়াকে কোথাও দেখতে পেলেন না। অকপটে জানতে চাইলেন,

– সিয়া কোথায়?

এবার আর আর্নি চুপ থাকতে পারল না। জাপ্টে ধরল নিজের মাকে। হুহু শব্দ তুলে কান্না করে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল তাকে।

– তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত আছো? মনে রেখো, আমার অবর্তমানে সবদিক তোমাকেই সামলাতে হবে।_ক্রিসক্রিংগলকে উদ্দেশ্য করে শান্ত কন্ঠে কথাটা বলে উঠলেন ডিয়েটস।

– আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিবো না। যদি যেতেই হয়, তবে আমি একা যাবো।______ক্রিসক্রিংগলের সুদৃঢ় কন্ঠস্বর।

– জেদ করো না। হাতে সময় নেই। জানিনা সিয়া কেমন অবস্থায় আছে। তুমি ওখানে গেলে হিতে বিপরীত হবে। একজনের জায়গায় তখন দু’জন প্রিয়জন হারাবে। বোঝার চেষ্টা করো। আমি সিয়াকে নিয়ে খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো। ভরসা রাখো।

– আমি আপনাকে এভাবে মৃ’ত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারিনা।

ক্রিসক্রিংগল অবাধ্য হয়ে উঠেন। কিছুতেই ডিয়েটসকে একা ছাড়তে চাইলেন না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন দু’জনেই একসাথে বনিফেসিও পাহাড়ে যাবেন।

________★★________

নিষক কালো অন্ধকারে ঢাকা ভয়ংকর জঙ্গল। জঙ্গলের দানবাকৃতির গাছগুলোকে অতিক্রম করে তীব্র বেগে ছুটছিল দু’জন র’ক্তপিপাসু। অন্ধকারে ধকধকিয়ে জ্বলে উঠল চারটে রক্তলাল চোখ। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে খুঁজতে শুরু করল নিজেদের শিকার। অন্ধকার যত গাঢ় হয়, ওদের দৃষ্টিশক্তি হয়ে উঠে ততটাই প্রখর। ছুটতে ছুটতে ওরা একটা হরিণ শাবকের দেখা পেল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে প্রিন্সেস ইজাবেল বলল,

– অ্যাভোগ্রেডো! ওটা আমার শিকার।

– প্রথমে যে আক্রমণ করতে পারবে শিকারটা তার।

অ্যাভোগ্রেডো বাতাসেরর গতিতে ছুটে গেল। ইজাবেল তার পিছু নিল। শাবকটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। অ্যাভোগ্রেডো নিঃশব্দে পা টিপে টিপে হাঁটছিল। স্যাঁতস্যাঁতে কর্দমাক্ত মাটিতে পা পিছলে পড়ে গেল হঠাৎ। খিলখিল করে হেঁসে উঠল ইজাবেল। ঠোঁটের মাঝে হাসিটুকু বজায় রেখে বলল,

– বেশ হয়েছে।

– প্রিন্সেস! আমার কোমর ভেঙ্গে গেছে। উঠে দাঁড়াতে পারছি না।

ইজাবেলের হাসি মিলিয়ে গেল। সে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। সাত পাঁচ না ভেবে অ্যাভোগ্রেডোর দিকে নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

– অ্যাভোগ্রেডো! অ্যাভোগ্রেডো আমার হাত ধরে উঠে এসো।

অ্যাভোগ্রেডো তার একহাত টেনে ধরে কাদায় ফেলে দিলো। অতঃপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। ইজাবেল রেগে গেল। দু’হাতে এলোপাথাড়ি মা’রতে শুরু করল। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। অভিযোগ করে বলল,

– মিথ্যা বললে আমায়? এখন এই কাদায় মাখামাখি পোশাকে ক্যাসলে ফিরে যাবো কি করে?

– ফিরে যাওয়ার কি দরকার? আমার সাথে অন্ততকাল ধরে এই জঙ্গলেই থেকে যান না।

– মজা করছো?_____ইজাবেল অকপটে জিজ্ঞেস করলো।

কথাটা অ্যাভোগ্রেডো মন থেকে বলেছিলো। কিন্তু ইজাবেল মজা ভেবে নিলো। হয়তো সে অ্যাভোগ্রেডোর মনের গভীরে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো বুঝতে পারল না। অ্যাভোগ্রেডো প্রসঙ্গ পাল্টালো। উঠে দাড়িয়ে পড়ল। সহজ সাবলীল কন্ঠস্বরে বলল,

– চলুন আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।

– কোথায়?

– প্রথমে চোখ বন্ধ করুন।

ইজাবেল নিজের চোখ দু’টো বন্ধ করে নিল। অ্যাভোগ্রেডো তার একহাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। সর্তক করে বলল,

– চোখ মেলে তাকাবেন না কিন্তু।

ইজাবেল সম্মতি সূচক মাথায় নাড়াল। বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যাভোগ্রেডো। ইজাবেলের উদ্দেশ্যে বলল,

– চোখ খুলুন।

ইজাবেল চোখ মেলে তাকাল। মুহূর্তেই সে আনন্দে পুলকিত হল। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠল। অবিশ্বাস্য কন্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল,

– কিভাবে সম্ভব?

অ্যাভোগ্রেডো মিষ্টি করে হাসল। মন্ত্রমুগ্ধ কন্ঠস্বরে বলল,

– জঙ্গলের এই জায়গাটা সবসময় অসংখ্য জোনাকি পোকায় আলোকিত হয়ে থাকে। যেন জোনাকি পোকার রাজ্য। শুধু এই জায়তাটুকুতেই। রাতের অন্ধকারে যা প্রকৃতির ভয়ংকর অপার্থিব সৌন্দর্যের মতো লাগে। স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এই জায়গাটুকু সবসময়ই জ্বলন্ত। এ এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। জোনাকিগুলো যখন আকাশের দিকে উড়ে যায়, তখন মনে হয় আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। যা রাতের অন্ধকারে গভীর অরণ্যে এনে দেয় এক অকাল দিপাবলি। আপনি চাইলেই স্পর্শ করতে পারবেন এই জোনাকি পোকাগুলোকে।

ইজাবেল ছুটল সেদিকে। জোনাকি পোকাগুলোকে ছুঁয়ে ছুয়ে দেখল। ঠোঁট ছড়িয়ে অমায়িক হাসল। যা এক প্রেমিক হৃদয়ে অনবদ্য প্রেমের ঝংকার সৃষ্টি করল। অ্যাভোগ্রেডো নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। গহীন অরণ্যের মাঝে জোনাকি পোকার রাজ্যে এক ভ্যাম্পায়ার রাজকন্যা খিলখিল করে হাসল। তাকে দেখতে আরও বেশি সুন্দর লাগছিল। অ্যাভোগ্রেডোর হৃদয় জুড়িয়ে গেল। সে মনে মনে চাইল সর্বদা এমনই হাসিখুশি থাকুক তার প্রাণপ্রিয় ইজাবেল।

________★★_______

কাস্ত্রোরুজ থর্প।

প্রায়ান্ধকার গুহায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ছিলো সিয়া। দুর্দমনীয় রাগে ওর শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরা জ্বলছে। ওকে বেঁধে রেখে এদুয়ার্দো কোথাও একটা গেছে। প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেল এখনো ফিরে আসেনি সে। সিয়া শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পেছনের হাত দু’টো মোচড়ামুচড়ি করে মোটা রশ্মি দিয়ে বেঁধে রাখা হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। অসফল হয়ে উচ্চস্বরে এদুয়ার্দোকে গালিগালাজ করে,

– নিকৃষ্ট জা’নোয়ার। সাহস থাকলে আমার বাঁধন খুলে দে। তোর এতো ক্ষমতা তাহলে আমাকে বেঁধে রেখেছিস কেনো? এখনই খুলে দে আমার হাত পায়ের বাঁধন।

বলতে না বলতেই ঝড়ের বেগে ওর সামনে এসে দাড়িয়ে পড়ল এদুয়ার্দো। চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রক্তবর্ণ হয়ে ছিলো। মিলিয়ে গেছে এমারেল্ড সবুজ রঙ। ভয়াবহ হিংস্র অথচ শান্ত চাহনিতে সিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ষনকাল তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। গুহার চারপাশে নজর বুলিয়ে কিছু একটা খুঁজল। খুঁজে না পেয়ে রাগ বেড়ে গেল। চোখের পলকে সিয়ার সামনে বসে পড়ল। শক্ত হাতে ওর গাল চেপে ধরে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

– মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে খাবো।

সিয়া মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করতে শুরু করল। এদুয়ার্দো ওর গাল ছেড়ে দিল। সিয়া গর্জে উঠে বলল,

– একবার হাতের বাঁধনটা খুলে দে শ’য়তান।

এদুয়ার্দোর ধৈর্যচুত্যি ঘটল। এক মুহূর্তও আর সহ্য করতে পারল না এই বে’য়াদব মেয়েটাকে। এখানে থাকলে যে কোনো সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। এদুয়ার্দো গুহার দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। সিয়া পেছন থেকে উচ্চস্বরে বলল,

– কা’পুরুষ।

শব্দটা যেন ভয়াবহ আঘাত হেনে এদুয়ার্দো মস্তিষ্কে বাড়ি খেল। আক্রোশে দু’চোখে অন্ধকার দেখল। সহসা হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। হঠাৎই ভয়ংকর দেখতে কতগুলো বাদুড় উড়ে এলো। ডানা ঝাপ্টে সবগুলো সিয়াকে আক্রমন করে বসল। সিয়া ভয় পেল। একসাথে এতোগুলো বাদুড় আক্রমণ করায় ও অবিরত চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। এদুয়ার্দো আনন্দ পেল। যেন তার জলন্ত হৃদপিণ্ড শীতল হলো। ডিয়েটসের প্রানপ্রিয় নাতনিকে এভাবে কষ্ট দিয়ে সে অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব করল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।