এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ৪০

‘বিহান ভাই চোখ মুছে আমার দিকে তাকালেন।’

–উনার চোখে মুখে ভীষণ অসহায়ত্ত্ব,চক্ষুদ্বয় পানিতে ভিজে লাল রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে।মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের দেখার তৃষ্ণা উনার চোখে।এক ভাবে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।কি অদ্ভুত মায়া উনার চোখে।এত মায়া লুকিয়ে ছিলো উনার মাঝে,যা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে উনার চোখের গভীর চাওনিতে।এইভাবে আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে এই মায়ায় প্রেমের মরণ হবে আমার নিশ্চিত।

‘মামি আমার পাশেই বসা ছিলো,আর বিহান ভাই ফ্লোরে মামির কোলে মাথা দিয়ে বসে ।মামি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো,এখন কেমন লাগছে মা?শরীর ঠিক লাগছে তো।’

‘আমি মুখ ফুটে উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে বুঝালাম ভাল লাগছে।’

‘আমাদের কত চিন্তা হচ্ছিলো মা।এইভাবে বারবার বমি করছিলে বার বার জ্ঞাণ হারিয়ে ফেলছিলে। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেছিলাম।এত সময় তোমার মা -বাবা কাকা-কাকিরা সবাই ছিলো।কিছুক্ষণ আগেই বাসায় গিয়েছে আমি জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছি।সকালে আবার আসবে,তুমি ঘুমোচ্ছিলে বলে আর ডাকে নি।’

–বিহান ভাই ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসেই রইলেন।উনার দৃষ্টি আমার দিক থেকে কোথাও সরছে না।এত বড় ছেলে কিনা নিজের মায়ের কাছে তার ভালবাসার কথা জানালো।কি নি কি ভাবছেন মামি তার ঠিক আছে।নিজের মায়ের কাছে কেউ এইভাবে ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে।উনার মতো মানুষ এর দ্বারা এটা কিভাবে সম্ভব হলো।উনি তো নিজের কোনো কথা কারো সাথে শেয়ার করেন না।আর প্রেম ভালবাসার কথা এইভাবে প্রকাশ করলেন।আসলেই কি এটা বিহান ভাই।আই কান্ট বিলিভ দিস। বিহান ভাই আমাকে ভালবাসেন, উনি আমাকে ভালবাসেন।আমি যা শুনেছি আজ তা কি সত্য ছিলো নাকি আমার ঘুমের ঘরের দুঃস্বপ্ন ছিলো নাকি আমার রোজকার কল্পনা।আমি অবাক দৃষ্টি পানে নির্বিকার তাকিয়ে রইলাম উনার অশ্রুসিক্ত অসহায় চোখের পানে।যে কথাটা শুনবো বলে সেই ছোট বেলা থেকে অপেক্ষা করেছি,বিভিন্ন ভাবে শোনার চেষ্টা করেছি অনেক বার বকা খেয়েছি, অনেক বছর প্রতিক্ষা করেছি,অসংখ্য বার রাগ করেছি,কেঁদেছি,কষ্ট পেয়েছি,উনি অন্য কাউকে ভালবাসে ভেবে গভীর ক্ষত মনে নিয়ে ঘুরেছি। আমার সেই সারাজীবন ভালবেসে যাওয়া মানুষ টা আমাকে মানে আমাকেই ভালবাসতেন।নিমিষেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো আমার।মনের ভেতরে ডানা ঝাপটে মরা পাখিটা নিমিষেই উড়া শুরু করলো ভালবাসার আকাশে ডানা মেলে।উনার ভেতরে এত গভীর ভালবাসা সব আমার জন্য ই ছিলো।কিন্তু উনি আমাকে বুঝতেই দিলেন না।শ্বশুরের মেয়ের নামে বলে যাওয়া গভীর ভালবাসার প্রকাশ সব টায় আমার জন্যই ছিলো।মাঝে মধ্য ভেবেছি সে হয়তো আমি কিন্তু উনার গম্ভীরতায় সিওর হতে পারিনি ভয়ে।কারণ ওই মানুষ টাকে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

“মামি কে বললাম,তোমার ছেলের কি হয়েছে মামি।চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো?”

“বিহান ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,আম্মু তোমার ছেলের বউ কে বলে দাও সে যেনো তার বাবার বাড়ি চলে যায়।তোমার এই জেদী খারাপ ছেলেটার সাথে আর থাকতে হবেনা।ফুপ্পির আদরের মেয়ে না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে ফুপ্পি সেটা সহ্য করতে পারবে না।আমি চাই না আমার জন্য কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ুক।অপরাধী হয়ে বেঁচে থাকতে কষ্ট হচ্ছে,ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু।”

“মামি হালকা হেসে বললেন,দুজন কে আর ঝগড়া করতে হবে না।ঝগড়া অনেক হয়েছে।এখন অনেক রাত হয়েছে।আর দিয়া যদি কখনো দেখেছি না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়েছিস না পিটিয়ে সোজা করবো।শোন মা সম্পর্কে মান অভিমান রাগ এগুলো থাকবেই।পানির মতো কোনো সম্পর্ক চলে না মা।মান অভিমান থাকবে তাই বলে কি না খেয়ে থাকতে হবে।বিহান তোর ফুপ্পিকে কল দিয়ে দিয়ার সাথে কথা বলিয়ে দাও।আর এখন আমি যাচ্ছি টেবিলে খাবার রাখা খেয়ে নিও দুজনে।
মামির চোখ মুখে দেখে ক্লিয়ার বুঝলাম যে মামি আমাকে আর বিহান ভাই কে একা ছেড়ে দিলেন।আম্মু বাবা নিশ্চয়ই এইজন্যই বাড়ি ফিরে গিয়েছে আমি আর বিহান ভাই এক সাথে সময় কাটাতে পারি।সবাই আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কত ভাবে।বিহান ভাই আম্মুর নাম্বারে কল দিয়ে আমার কানে দিলেন।

‘ওপাস থেকে আম্মু বললো,এখন কেমন লাগছে মা।’

‘আম্মু এখন ভাল লাগছে।’

‘তোমার বাবা আমি আবির সবাই চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।হঠাত কি হয়েছে মা।’

‘জানিনা আম্মু।হঠাত কি হলো বুঝলাম না।’

‘বিহান কোথায় দিয়া।’

‘আমার পাশেই আছে আম্মু।’

‘বিহানের সাথে ভাল ভাবে কথা বলো মা।তোমার অসুস্হতায় বিহান নিজেকে অপরাধী ভাবছে। আমার হাত ধরে কেঁদেছে বিহান।বিহান তো কাঁদার মতো ছেলে না মা।যা হয়েছে ভুলে যাও মা।এখন ঘুমিয়ে যাও আর রাত জেগো না।’

ফোন টা কেটে দিয়ে বিহান ভাই এর হাতে দিয়ে দিলাম।

–চুপচাপ বসে রয়েছেন বিহান ভাই।কিছুক্ষণ পরে উঠে গিয়ে আস্তে করে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলেন।দুজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই।উনার মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব।উনি চেয়ার টেনে বেডের সাইডে বসলেন।কি বলবো বুঝতে পারছি না,উনিও কিছু বলতে গিয়েও পারছেন না।উনার চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি পড়লো গড়িয়ে।উনার চোখে পানি দেখে আমি ব্যাস্ত হয়ে উঠে বসতে গিয়ে কাত হয়ে পড়তে যেতেই উনি আমাকে ধরে বসলেন।মিহি কন্ঠে বললেন আস্তে দিয়া,পড়ে গেলে ব্যাথা লাগতো এক্ষুনি।

–আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,আপনার চোখে পানি কেনো বিহান ভাই।?

–উনি চোখ মুছে আমাকে বালিশ হেলান দিয়ে বসিয়ে বেডের সাইডে বসলেন।আমার দুই হাত উনার দুই হাতের মধ্য মুষ্টিবদ্ধ ভাবে ধরে আছেন।উনার চোখের পানি আবার ও গড়িয়ে পড়লো। উনি কাঁন্না ভেজা কন্ঠে বললেন,আই এ্যাম স””সরি দিয়া।আমি তোর সাথে মিসবিহেভিয়ার করে ফেলেছি অনেক।আমি খুব খারাপ দিয়া।অনেক খারাপ আমি রাগী,জেদী,। বাট আমি কি করবো বল,আমার রাগ আমি কন্ট্রোল করতে পারিনা।মাঝে মাঝে খুব বেশী রুড বিহ্যাভ করে ফেলি তোর সাথে।পরে ততটায় খারাপ লাগে আবার কিন্তু বোঝাতে পারিনা।আমি কথা বলিনি তোর সাথে কেনো জানিস তোর কাছে আমার গুরুত্ব বুঝতে। আমার কথা না বলায় তোর কষ্ট হয় কিনা বোঝার চেষ্টা করেছি ব্যাস এটুকুই।তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি আমি ভাবতেও পারিনি।আমি ইডিয়ট না হলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারতাম মিস্টার বিহান এর ইগনোরিং এ মিসেস বিহান কতটা কষ্ট পাবে।

“আমি ভেবেছিলাম আপনি আর কখনো কথা বলবেন না আমার সাথে।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো বিহান ভাই।আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না পুরা জীবন আমি কিভাবে কাটাবো আপনি কথা না বললে।”

“তুই কবে বোঝা শিখবি দিয়া আর বড় হবি বা কবে।কবে বুঝবি যে বিহানের সেই ক্ষমতা নেই তোর সাথে সারাজীবন কথা না বলে থাকে।রাত নেই দুপুর নেই ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি কেনো এসেছি দিয়া।এই শহর আমাকে চুম্বক এর মতো টেনেছে।এই শহরের সেই চুম্বক টায় তুই।যার টানে আমি ঢাকা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।জানিস দিয়া মাঝে মাঝে মধ্য রাতে অস্হিরতা বিরাজ করেছে আমার মাঝে।হঠাত ঘুম ভাঙতেই মনে পড়তো তোর কথা।তোকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করতো।মনে পড়ার মতো অনেক কিছুই ছিলো তবুও আমার মনে পড়তো তোর কথা।সেই মধ্যরাতে কফির মগ হাতে নিয়ে ভাবতাম কেনো ওই পুচকির কথা মনে পড়ে বার বার।বিষাক্ত তিতো কফি খেয়ে হজম করে ফেলতাম তোর ভাবনায় বুঝতেই পারতাম না কি খাচ্ছি।খাওয়ার মধ্য মনে পড়েছে তোর কথা, খাবারে পানি দিয়ে উঠে গিয়েছি।আর ভেবে চলেছি ওই পুচকি আমার মস্তিষ্কে কি প্রভাব ফেলে দিয়েছে সব কিছুতে ওর কথায় মনে পড়ে।ছুটে এসেছি ঢাকা থেকে উস্কো খুসকো ভাবে।তোকে ভেবে ঘুমহীন কয়েক টি রাত পার করার পর অস্হির হয়ে ছুটে এসেছি, তোকে দেখার পর নড়াইল এসে শান্তিতে ঘুমিয়েছি।এত কিছুর পরেও বুঝিস নি তুই আমার মানসিক শান্তি।তোকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়।”

“সরি বিহান ভাই,।আমি আর কখনো মিথ্যা বলবো না।ক্ষমা করে দিন আমায়।সব ভুল আমার।আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি।এক আকাশ আবেগ নিয়ে কেঁদে কথা গুলো বললাম উনাকে।”

ক্ষমা করবো এক্ষুণি খাবার খেতে হবে।দু’দিনের মাঝে সুস্থ হয়ে আগের মতো কিচির মিচির করতে হবে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।