এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা – সিজন ২ | পর্ব – ৩৮

গ্রীস্মের প্রচন্ড উত্তাপে হাঁপিয়ে উঠেছে প্রকৃতি ।চারদিকে ভ্যাপসা গরম, উত্তপ্ত পরিবেশ,নাজেহাল অবস্থা মানুষ সহ সকল প্রাণীর।ভীষণ খরা, মাঠঘাট পানির অভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।তৃষ্ণায় ভুগছে সব কিছু।রোদের প্রচন্ড উত্তাপে সমস্ত প্রাণীকুল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।কাল বৈশাখীর আগমন ও শুরু হয়েছে।সময়ে অসময়ে আকাশ কালো করে মেঘ জমছে,সাথে সাথে মেঘের গর্জন ও শুরু হচ্ছে সেই সাথে বজ্রপাত।শুরু হচ্ছে প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া,প্রবল বেগে ঝড় ও উঠছে সেই ঝড়ে লন্ডভন্ড হচ্ছে সব কিছু,তছনছ হচ্ছে সব।বাইরে ঝড় উঠেছে ভীষণ ঝড়।মনের ঝড় কি বাইরে বেরিয়ে এসেছে।সকাল সাতটা থেকেই আকাশ কেমন ভারী থমথমে।যতটা থমথমে ছিলো ততটায় লন্ডভন্ড ঝড় শুরু হয়েছে।

সকালেই বিহান ভাই কোথায় একটা বেরিয়েছেন।এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে কোথায় গিয়েছেন উনি।চারদিকে এত বজ্রপাত ভীষণ ভয় লাগছে উনার জন্য।মনে মনে দোয়া পড়ছি উনি যেনো ঠিক থাকেন।মনের মাঝে ভীষণ খারাপ লাগছে।বাইরে বড় গাছ গুলো ভেঙে পড়েছে।শিউলি গাছের একটা ডাল ও ভেঙে পড়েছে প্রবল ঝড়ের হুংকারে।মারুফা খালা আর মামি বারান্দায় বসে চাল বাছছেন।দুপুর একটায় ভিজতে ভিজতে বাসায় প্রবেশ করলেন বিহান ভাই।এই ভীষণ ঝড় টা কি উনার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। উনি যে অনেক সময় ধরে ভিজেছেন সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।ভিজে চুপসে গিয়েছেন,হাত পায়ের আঙুলে টাস্কি লেগে গিয়েছে।ভিজে নেয়ে স্নিগ্ধ এক পুরুষ এসে দাঁড়িয়েছে মনে আঙিনায়।এমনিতেউ ফরসা মানুষ ভিজে হার পায়ের আঙুল একদম ই সাদা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।পকেট থেকে পলিথিন এ মোড়ানো ফোনটা বের করে মামির হাতে দিয়ে বললেন,আম্মু দেখোতো ফোন ভিজে গিয়েছে কিনা?

–মামি ফোন টা নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো দেখ তো দিয়া।এর পর উনাকে বললেন,বিহান তুমি ভিজেছো ক্যানো?তোমার না বৃষ্টি লাগলেই জ্বর আসে।

–আম্মু আর কত সময় বসে থাকবো বাইরে।ছাতা ও তো নেয় নি আমি।একদম ই বিরক্ত লাগছিলো তাই চলে এসছি।

–কারো কাছ থেকে একটা নিয়ে আসতে এইভাবে ভিজলে জ্বর আসবে তোমার।দ্রুত চেঞ্জ করে নাও।চেঞ্জ করে মাথায় একটু সরিষা তেল দাও।

–আম্মু কিচ্ছুই হবে না।একদম ই চিন্তা করো না।মারুফা খালা রান্না হয়েছে খেয়ে ঘুমোবো।

–হ্যাঁ বাবা! আজ দিয়া মা খিচুড়ি রান্না করতে বলেছে তাই খিচুড়ি হয়েছে।

–আমার ঘরে একটু দিয়ে যাও তাহলে।

আমি মামি আর মারুফা খালার সাথেই বসে ছিলাম।উনি একবার আমার দিকে তাকালেন।চাওনি তে কোনো গম্ভীর ভাব নেই আজ।উনার গায়ের সাদা শার্ট ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের আছে।শার্টের বোতাম দুইটা খোলা।চোখের পাপড়ি ভিজে লাল হয়ে গিয়েছে।হাল্কা খুড়িয়ে হাঁটছেন গতরাতে পা কেটে গিয়েছে উনার।

নিচ তলার কমন ওয়াশ রুম দুইটা,একটা গোসলের জন্য।উনি নিচ তলার ওয়াশ রুম থেকে গোসল করে টাওয়াল পরে আজ উপরেই গেলেন।আমি বেশ অবাক হলাম এ ক’দিন উনি উপরেই যান নি।মনে হচ্ছে রাগ কমে এসেছে অনেক খানি।উনি উপরে গিয়ে মামিকে ডাকছেন,

আম্মু আমার ব্লু এ্যাশ কালারে শার্ট টা কোথায়?পাচ্ছি নাতো খুজে।

মামি আমাকে বললো দিয়া যাতো এগিয়ে দিয়ে আয়।

–আমাকে বকবেন উনি মামি।

–বকুক যাতো তুই।

–না মামি তোমার ছেলে বকবে।

–বকবে না তোকেই যেতে হবে।

–মামির জোরাজোরিতে নিচ তলা থেকে উপরতলায় গেলাম।উনার পরনে সাদা টাওয়াল।ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে পায়ে কিছু লাগাচ্ছেন।উনি ড্রেসিন টেবিলের মাঝেই আমাকে দেখেছেন।ড্রেসিন টেবিলের আয়নায় পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।আমি আলমারি থেকে উনার শার্ট বের করে বিছানায় রাখলাম।

–উনি শার্ট হাতে নিয়ে দুই ভ্রু উচিয়ে বললেন,আর প্যান্ট?

–বেশ অবাক লাগলো,উনি আমার কাছে প্যান্টের কথা জিজ্ঞেস করলেন।নিমিষেই যেনো মনের উপর থেকে কয়েক মন ভারী কিছু নেমে গেলো।

প্যান্ট নিয়ে উনার হাতে দিতেই উনি শান্ত ভাবেই তাকালেন আমার দিকে।

আর কোনো কথা বললেন না। আমি উনার ফোন টা দিয়ে বললাম এই যে আপনার ফোন।উনি তাকিয়ে দেখলেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

–উনি শার্ট আর প্যান্ট আমার সামনেই পরলেন।তবে নিশ্চুপ আছেন কোনো কথা বলছেন না।

–আমি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আকস্মিক আমার কাঁন্নার শব্দে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

–আমি বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললাম,আমাকে ক্ষমা করে দিন বিহান ভাই।এই এম সরি।আমি আর কোনদিন মিথ্যা বলবো না।আমাকে যা শাস্তি দিতে হয় দিন তবুও কথা বলুন আমার সাথে।আমি এইভাবে আর থাকতে পারছি না।প্লিজ বিহান ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমি বুঝতে পেরেছি আমি অন্যায় করেছি,ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়।তবুও আমায় ক্ষমা করুণ আপনি।এই কয়েকদিনে আমার কষ্ট হয়েছে ভীষণ কষ্ট হয়েছে।দুলাভাই মাইন্ড করে যদি বিভা আপুকে কথা শোনায় তাই আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম।কথা না বলার মতো শাস্তি নেই।আপনি এতদিন যেসব শাস্তি দিয়েছেন সেসব এই কথা না বলার কাছে কিছুই না।

উনি এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন,”আমার কথা বলায় কার কি আসে যায়।আমি তো বিরক্ত করি সবাইকে।”

“যায় আসে, ভীষণ যায় আসে।আমার বিরক্তই এখন ভাল লাগে।আপনি বোঝেন না।”

“ভ্রু উচিয়ে বললেন,রিয়েলি?উনি যেনো ভীষণ অবাক হয়েছেন।চোখে মুখে বিস্ময়।আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ও ভ্রু উচিয়ে বললেন,চোখের পানি মুছে ফেলার রিকুয়েষ্ট করছি মিস দিয়া। এটা আমি দেখতে পারি না।চোখের পানি সহ্য হয় না আমার।”

উনি হাচি দিচ্ছেন ঘন ঘন।এক টানা কয়েক দিন ভিজেছেন উনি।একটা রাত ও ঘুমোন নি।ছাদে বসে কাটিয়েছেন।খাবার দুই একবার মুখে তুলে পানি ঢেলে দিয়েছেন।

আমি আবার ও কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“বিহান ভাই আপনি কেনো নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছেন?এই যে রেগুলার ভিজছেন,ঠিক ভাবে খাচ্ছেন না।ঘুমোচ্ছেন না।আমাকে যা খুশি বলুন তবুও নিজেকে কষ্ট দিবেন না প্লিজ।”

“থ্যাংক ইউ সো মাস আমার ব্যাপার এত কিছু ভাবার জন্য।নাউ ইউ লিভ আমি ঘুমোবো।”

“খাবেন না”

“খাবার না দিলে কিভাবে খাবো।”

“এরই মাঝে মারুফা খালা খাবার দিয়ে গেলো।আমি টেবিল এর বই এক কোনায় সরিয়ে রেখে মারুফা খালাকে খাবার রাখতে বললাম।খালা খাবার রেখে চলে গেলো।বিহান ভাই চেয়ার টেনে বসে খাবার খেতে খেতে বললেন,না খেয়ে চোখ মুখের এ অবস্থা করার মানে টা কি?শরীর খারাপ হলে নিজের ই কষ্ট হবে।আই থিংক খেয়ে সুস্থ থাকাটায় বেটার।”

“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেনো বিহান ভাই।আগের মতো কি আর কথা বললেন না।”

“আগের কথা ভুলে যাওয়াটায় বেটার।কথা এটুকুও বলার ইচ্ছা ছিলো না।বাট চোখ মুখ শুকনো রোগাটে দেখা যাচ্ছে তাই।দেখতে নিজের কাছেই খারাপ লাগছে তাই।”

“তার মানে আপনি আর কথা বললেন না?আপনি কি আর আমার সাথে থাকতে চাইছেন না।”

“উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,অযাযিত প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার থেকে পাওয়া যাবে না।আর কোচিং যাওয়া হচ্ছে না কেনো?”

“আমার কিছুই ভাল লাগে না, আপনি কথা না বললে।”

“আমি এমন কোনো ইমপর্টেন্ট মানুষ না যে আমার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হবে।আমাকে অবহেলা করাটায় হবে মিস দিয়া।আই থিংক আমি সেটার ই যোগ্য।”

“কথা না বললে আজ আমি কোচিং থেকে আর ফিরবো না বিহান ভাই।ফিরবো না মানে না।আপনাকে আর বিরক্ত করবো না আমি।আমার একটা অন্যায় ক্ষমা করতে পারছেন না আপনি।আমি আপনার চোখের সামনে থাকলেও আপনার রাগ হয় আমি বুঝি।আর আপনাকে জালাবো না আমি।”

“উনি শান্ত কন্ঠেই বললেন,আমি কি এসব বলেছি।নিজে থেকে এসব ভাবার কারণ কী?”

আমি কোনো কথা না বলে মন খারাপ করে বেরিয়ে এলাম।বিকালে বৃষ্টি শেষ হলে রিয়াকে কল দিয়ে দুজনে কোচিং এর জন্য রওনা হলাম।আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার তবে রাস্তাঘাট ভেজা,গাছ থেকে পানি পড়ছে হালকা বাতাস হলেই।কোচিং এর সাইডেই ফুচকার দোকানে মেহু আপু আর ভাইয়াকে দেখলাম।ভাইয়া ফুচকা খাইয়ে দিচ্ছে মেহু আপুর গালে তুলে।রিয়া আর আমি অবাক হয়েই দেখলাম কাহিনী কী?তবে ওদের সামনে গেলাম না।রিয়া কে বললাম আজ পড়বো না রিয়া আমার ভাল লাগছে না।মাথা প্রচন্ড ঘুরছে।

রিয়া বললো সকালে খেয়েছিস।

আমি মৌন রইলাম।রিয়া বুঝতে পারলো আমি খায় নি।

–শরীর হঠাত কেমন দূর্বল মনে হচ্ছে।চোখে কেমন ঝাপসা দেখছি।রিয়া আমাকে নিয়ে কলেজের ভেতরে গিয়ে সিড়িতে বসালো।ক্রমশ আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো।মাথার উপর দিয়ে যেনো পুরো পৃথিবী ঘুরছে।রিয়া দ্রুত একটা কেক এনে আমাকে খাইয়ে দিয়ে বললো কিছু খেলে ভাল লাগবে দিয়া।

–কেক একটু খেতেই বমি শুরু হলো ভীষণ বমি।

–রিয়া বেশ ভয় পেয়ে গেলো কি করবে বুঝে উঠতে পারে নি।

–বমি করতে করতে সেন্সলেস হয়ে কলেজের মাঠেই পড়ে গেলাম।

রিয়া অনেক ডাকাডাকি করেও কিছু করতে পারলো না।অবশেষে বিহান ভাই কে কল করলো।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।