রাত সাড়ে এগারোটার পরে বিহান ভাই ধীর গতিতে প্রবেশ করলেন বাসরঘরে।উনাকে দেখেই এক অজানা ভয় বাসা বাঁধলো ভেতরে।এই মধ্যরাতে উনি কি আমায় ঘর থেকে বের করে দিবেন,নাকি অন্য ছেলেদের মতো স্বামির অধিকার ফলাবেন।বিছানায় বসে উনার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছি আমি,বুকের মাঝে সাউন্ড হচ্ছে দুরুম দুরুম।উনাকে তো চেনা মুশকিল হয়তো এসে বলবেন বেরিয়ে যা এক্ষুণি আমার রুম থেকে।কিন্তু আমিও তো এখানে আসতে চাই নি,এক প্রকার জোর করেই আমাকে রেখে যাওয়া হয়েছে এখানে।এতক্ষণে একটা ছবি দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। উনার পড়ার টেবিলের উপর একটা বড় ছবি টাঙিয়েছেন উনি।ছবি টাতোএর আগে দেখি নি আমি।আমি হাসছি আর উনি আমার নাক টিপে ধরে রেখেছেন এমন ই একটা ছবি।ছবিটা আরো তিন বছর আগের ই হবে।আমরা মেহু আপুদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।আমি কিছু একটা নিয়ে হাসছিলাম খুব,আর উনি কোথা থেকে এসে আমার নাক টেনে ধরেছিলেন।আর বিভোর ভাই ছবি উঠিয়েছিলেন।ছবি টা নিয়ে সবাই তখন সমালোচনা করেছিলো।ছবিটা নাকি জীবন্ত উঠেছিলো।বিহান ভাই সেই ছবিটা উনার ওয়ালে টাঙিয়েছেন।উনার মুখেও ভীষণ মিষ্টি হাসি।
ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আবার ও দরজার দিকে তাকালাম।
বিয়ের আগে মেহু আপু, তোহা আপু, রিয়া আমাকে বাসর ঘর নিয়ে অনেক কিছু এডভান্স বলে দিয়েছে।আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি বাসর ঘরে ঢুকে আমার সাথে ঘনিষ্ট হতে চাইছেন সেকথা বুঝবো কিভাবে।
মেহু আপু বলেছে,শোন দিয়া রোমাঞ্চ এর আগে ছেলেরা প্রথমে ঘরে প্রবেশ করেই সিটকিনী লাগিয়ে গায়ের কাপড় খুলতে শুরু করে।তার পর ধীরে ধীরে তোর দিকে আগাবে।এগিয়ে খাটের কাছে যাবে।তারপর তোর দিকে ঝুঁকে গিয়ে শুরু হবে রোমান্স।
বিহান ভাই এর দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করছি উনার মতিগতি কিরুপ হতে পারে।উনি সেরওয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে প্রবেশ করবেন ভেতরে প্রবেশ করলেন।সেরওয়ানির বোতাম খুলতে দেখে নিজের ভেতরে হার্টবিট আরো গতিতে চলতে শুরু করলো৷ উনার বোতাম প্রায় সব গুলো খোলা হয়ে গিয়েছে।এক হাতে বোতাম খুলছেন অন্য হাতে ঘরের সিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।সিটকিনীর শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি।ভেতরের ভয়টা আরো তীব্র হতে শুরু করলো।
উনাকে বললাম আ”’আপনি এখানে এইঘরে৷ কেনো?
উনি আমার কথা শুনে মিনিট দুয়েক আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,”ফুলসজ্জা করতে এসেছি।”
উনার কথা শুনে আরেকটু কৌতুহল নিয়ে বললাম,”কিসের ফুলসজ্জা।”
“আমার আর আমার বউ এর ফুলসজ্জা।”
কৌতুহল নিয়ে বললাম,”কি বলছেন এসব।”
“উনি কপাল কুচকে বললেন,পুচকি টা বিবাহিত ভাবা যায়।সে এখন ফুলসজ্জার খাটে স্বামির জন্য অপেক্ষা করছে।”
“উনার কথা শুনে খানিক টা লজ্জা পেয়ে বললাম,, আমি কোনো বিবাহিত টিবাহিত কিচ্ছুই না।শুনুন বিহান ভাই আমি বিয়ের আগেই বলেছিলাম আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।তবুও আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন।বিয়ে করেছেন ভালো কথা আমি আপনার সাথে এক ঘরে কিছুতেই ঘুমোবো না।না মানে না। আর এই বিয়ে আমি জীবনেও মন থেকে মেনে নিবো না।”
“উনি আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, এসব কথা আমাকে শুনিয়ে লাভ কি?আমার তো শ্বশুরের মেয়ে আছে।তুই আমাকে মানলেই বা কি আর না মানলেই বা কি।যা আছে মনের মাঝে রাখলেই তো হয়।আমাকে ষাড়ের মতো চিৎকার করে জানিয়ে লাভ আছে কিছু।আমার মনে কি আছে আমি কি তোকে জানিয়েছি কখনো।”
“শ্বশুরের মেয়ে যখন আছে তাহলে আমাকে বিয়ে করতে গিয়েছেন কিজন্য।আর আপনি আমাকে ষাড় বলছেন কেনো?আপনার তো চরিত্রের ই ঠিক নেই চোখে মুখে অগ্নিবর্ষণ আমার।”
“এই পিওর ভার্জিন ছেলেকে কিনা এক পুচকি চরিত্রের সমস্যা বলছে।দিয়া আজ কিন্তু রাগ কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করছি।সো তুই উল্টাপাল্টা না বলে মুখ টা অফ রাখ।এখন কিছু বললে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে বাড়িসুদ্ধ মানুষ এক জায়গা করে ছাড়বি।এই নিয়ে বাড়ির সবাই আমাকে ভুল বুঝবে।সবাই ভাববে তোকে আমি কি না কি করেছি।”
“তো তাহলে সেরওয়ানি খুলছেন কেনো আপনি!”
“তাহলে কি আমি সারারাত এই পোশাক পরে ঘুমোবো।লাইক সিরিয়াসলি।বিয়ে করেছি বলে কি বিয়ের পোশাক আজন্ম ক্যারি করতে হবে আমাকে।”
“না মানে আমি ভেবেছি… ”
“এই কারণে বিবাহিত মহিলাদের সাথে কথা বলতে নেই,সব সময় চার লাইন বুঝে বেশী।এমনি তেই এই পোশাক পরে প্রচন্ড আনইজি লাগছে আমার।জীবনে এসব ও পরতে হবে ভাবতে পারিনি আমি।তোদের এইসব বিয়েশাদীর ধান্দায় আজ সারাদিন এই সেরওয়ানি পরতে হয়েছে আমার।তোর কাকা নতুন তাল বাহানা করেছে আমাকে নাকি সেরওয়ানি পরতে হবে।এই শীতের মাঝেও আজ আমি সারাদিন ঘেমেছি খুব।ডিজগাস্টিং।”
–মাত্র আজ ই আমার বিয়ে হয়েছে আর উনি কিনা বলছেন আমি বিবাহিত মহিলা আশ্চর্য ব্যাপার।
–গায়ের সেরওয়ানি খুলে আলনায় রেখে একটা সাদা টি-শার্ট আর একটা কালো ট্রাউজার বের করলেন আলমারি থেকে।ওয়াশ রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এলেন।চোখে মুখে পানির ফোঁটা মুক্তার মতো চিক চিক করছে উনার।চুলের এক গোছা কপালে এসে পড়েছে উনার।চুল গুলো উচিয়ে দিতে দিতে বললেন,এই ভারী শাড়ি আর কত সময় পরে থাকবি।তোর সুটকেস থেকে যা বের করবি কর। আর ওয়াশ রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নে।গো ফাস্ট আমার ঘুম পাচ্ছে।
–বিছানা থেকে নেমে সুটকেস থেকে একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলাম।আজ নতুন বিয়ে হয়েছে তাই শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু সাথে দেয় নি।এই শাড়ি কিভাবে পরবো বুঝতে পারছি না।ওয়াশ রুমে গিয়ে শাড়ির সেফটিন খুলছি।এটা কি শাড়ি খুলছি নাকি সেফটিনের রাজ্য খুলছি নিজেও জানিনা।শাড়ির পেছনের সেফটিন কিভাবে খুলবো সেটাও বুঝছি না।আমি তো নাগাল ই পাচ্ছি না।এর ই মাঝে ফ্লোরে পড়ে থাকা সাবানে পা পিছলে বালতি ভরা পানি নিয়ে পড়ে গেলাম ফ্লোরে।কতক্ষণের পানি সেটা জানিনা মনে হচ্ছে ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে পানি।উহু করে শব্দ করতেই বিহান ভাই দ্রুত এগিয়ে এলেন।উনি এসে বিরক্ত হয়ে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন,ষ্টুপিড ই থেকে গেলি তুই।উনি দ্রুত আমাকে টেনে তুললেন।ঠান্ডায় কাঁপছি আমি ভীষণ ভাবে।
“উনি একটু গম্ভীর কন্ঠেই বললেন,দ্রুত চেঞ্জ করে নে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি একভাবে।”
“উনি বললেন কি হলো দিয়া।কথা কানে যাচ্ছে না।”
“আমি সেফটিন খুলতে পারছি না বিহান ভাই।”
“উনি এগিয়ে এসে পেছনের সব সেফটিন গুলো খুলে দিতে দিতে বললেন এসব ভারী শাড়ি পরার কি দরকার।এইটুক পিচ্চি মানুষ কি এইসব সামলাতে পারে।”
“সেফটিন খোলা হলে বললেন,কোথায় লেগেছে দিয়া?”
“আমি মাথা নেড়ে বললাম কোথাও লাগে নি।”
“তাহলে চেঞ্জ কর দ্রুত! ঠান্ডা বসে যাবে।আমি বাইরে যাচ্ছি।”
শাড়ি পরার ই অভ্যাস নেই তাই কোনভাবে শাড়িটা পেচিয়ে ঘরের ভেতরে আসতেই উনি একনজরে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।আমি চুল মুছে, চুল গুলো ছেড়ে কাঁপছি ঠান্ডায়।
“উনি রুমের লাইট অফ করে দিলেন।”
“লাইট অফ করতে দেখে বললাম,আপনি রুমের লাইট অফ করলেন কেনো?”
“তাহলে কি লাইট অন রেখে ঘুমোবো।”
“আপনি কোথায় ঘুমোবেন।এই ঘরে।”
“এই ঘরে ছাড়া কোথায় ঘুমোবো,আজ না আমার বাসর রাত মিসেস বিহান।”
“বাসর ঘর মানে?”
“উনি ভ্রু উচিয়ে বললেন,বাসর ঘর মানেও জানিস না।ওকে ফাইন বলছি তোর সুবিধার জন্য সোহাগ রাত।যে রাতে বউ কে প্রচুর সোহাগ করতে হয়।কাম ফার্স্ট মিসেস বিহান।দ্রুত বিছানায় এসো।”
“অসম্ভব,আমি আপনার সাথে কিছুতেই এই খাটে ঘুমোবো না।কোনো বাসর টাসর হবে না।আপনি এমন সব কথা ও বলতে পারেন বিহান ভাই।আপনি এত অসভ্য কথা শিখেছেন।”
“দিয়া এই ঘরে এসেছি থেকে শুনছি তোর উদ্ভট সব কথা।তোর কিভাবে মনে হলো তোর সাথে আমি ফুলসজ্জা করবো।অনেক বার বাজে কথা বলেছিস আমি কিছুই বলি নি।আজ আমি ভীষণ ক্লান্ত ঘুম নিড আমার।এখন আমি ঘুমোবো,আমাকে যদি একটুও ডিস্টার্ব করিস আরেক বার ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে আসবো তোকে।চুপচাপ ঘুমোতে মনে চাইলে ঘুমো মনে না চাইলে যা ইচ্ছা কর বাট ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!তুই যদি চাস বাংলা সিনেমায় নায়কাদের মতো ঘরের বাইরে গিয়ে ঘুমোবি তাহলে ঘুমোতেই পারিস।আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু সামনের যে শিউলি গাছ টা আছে ওখানে পা দুলিয়ে সাদা কাপর পরে কে যেনো রোজ রাতে বসে কাঁদে।দেখিস তোর ঘাড় ধরে যেনো তুলে নিয়ে না যায়।
আর রইলো সোফা ওখানেও ঘুমোতে পারিস,বা ফ্লোরেও ঘুমোতে পারিস।শিউলি গাছের ওইটার কথা ভুলে যাস না যেনো।এই বিছানাতেই শুধু আসে না সে।এবার তোর ইচ্ছা। গুড নাইট।”
গুড নাইট বলেই উনি কম্বল মুড়ি দিয়ে সুয়ে পড়লেন।
ডিসেম্বর মাস মানেই ঠান্ডার কোনো কমতি নেই কোনো দিকে।প্রচন্ড কাঁপছি আমি ঠান্ডায়।সোফাতেই সুয়ে পড়লাম কিছুই না ভেবে।কিছুক্ষণ পরেই মনে হচ্ছে শিউলি গাছের ভুত টা আমার আশে পাশে আছে।চোখ বুজলেই ভুতের কথা মনে হচ্ছে।সোফা থেকে এক লাফে উঠেই বিছানায় গেলাম।কম্বলের নিচে বিহান ভাই এর সাথে একদম মিশে সুয়ে পড়লাম।ভূতের কথা মনে হতেই উনার বুকে মুখ লুকালাম ভয়ে,আষ্টে পিষ্টে উনাকেই জড়িয়ে ধরলাম।