এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা | পর্ব – ২১

জন্মদিন মানেই বিশেষ একটি দিন।সে দিন টা যদি আবার হয় প্রিয় জনের তাহলে সেই দিন টা বিশেষ এর থেকেও বিশেষ হয়।আজ রাত বারোটা বাজলেই বিহান ভাই এর জন্মদিন।কিন্তু উনি তো এলেন না।এই দিনে উনাকে সামনে থেকে উইশ করতে মন চাইছে আমার।কিন্তু কোথায় পাবো এখন উনাকে।সারাদিন ইউটিউব দেখে কেকে বানানো ভিডিও দেখেছি আর কেক ও বানিয়েছি।অত টা সুন্দর না হলেও খারাপ হয় নি।কেক এর উপর শুভ জন্মদিন বিহান ভাই লিখে রেখেছি।রুমময় পায়চারী করছি ফোন নিয়ে। উনাকে কি এখন ফোন দিবো।ফোন দিতেও ভয় লাগছে দেখা গেলো অনেক গুলা বকাঝকা শুরু করলো।

বিভোর ভাই,রিয়া,শুভ ভাইয়া,তিয়াস ভাইয়া,তোহা আপু সবাই মিলে প্লান করেছে বিহান ভাই এর জন্মদিন সেলিব্রেশন করবে পদ্মবিলে গিয়ে।নড়াইলের ইছামতি বিলে এ সময়ে প্রচন্ড পদ্ম ফুল ফোটে।প্রকৃতির এক মনোরম দৃশ্য শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে।কেউ ফোন দিয়ে সে মানুষ টাকে পায় নি।কেউ তাকে বলে নি তার জন্মদিন বলে আসতে বলা হয়েছে সবাই চাইছিলো সে আসলে একটা সারপ্রাইজ দিবে মানে বিশাল আকারের সারপ্রাইজ।কিন্তু সে মানুষ বেপাত্তা।

মামি আমাকে বলছিলো দিয়া তুই একটু বলে দেখ না।তুই বললে আসতে পারে।অথচ এরা কেউ জানেই না সে আমাকে সব থেকে বেশী বকবে।সবাই তাকে ফোন দিলেও আমি ফোন দেই নি তাকে।ইচ্ছা করেই দেয় নি মন চাইছিলো সে নিজে থেকে আসুক।এত দিন হয়ে গিয়েছে তার আমাকে একবার ও দেখতে ইচ্ছা হয় নি।মনে মনে হাজার খানিক অভিমান জমা করে বসে রইলাম।

ঘড়িতে রাত বাজে এগারো টা ছাপ্পান্ন তার নাম্বার টা ডায়াল করলাম।দুইবার রিং হতেই ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো, ‘কি রে এত বার ফোন দিচ্ছিস কেনো?’কন্ঠে তার রাগ স্পষ্ট ছিলো।আচ্ছা মধ্যরাতে কারো প্রেমিকা ফোন দিলে এমন ব্যবহার করে কেউ।

‘উনার এমন কথা শুনে মন টা খারাপ হয়ে গেলো আমার।দুঃখি দুঃখি মন নিয়ে বললাম কোথায় আপনি?’

‘তোর বাবা আর শ্বশুরের আমার জন্য বরাদ্দ করা বিল্ডিং এ। ‘

‘মানে। ‘

‘মানে মাঝ রাতে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছিস কোথায় আমি?আমি কোথায় থাকার কথা জানিস না তুই।’

‘জানলেও কি মানুষ প্রশ্ন করে না।ফোন দিয়ে কি মানুষ জানতে চায় না কুশলাদী।’

‘আমি এখন আজাইরা প্যাচাল এর মুডে নেই দিয়া।আর ফোনে অযাযিত প্রশ্ন করা আমি পছন্দ করি না।আমার সময়ের অনেক দাম।সো যা বলার দ্রুত বল। আই এম সো ফেড আপ’

‘আজ আপনার জন্মদিন না তাই ফোন দিয়েছিলাম।’

‘হুম জন্মদিন তাতে কি হয়েছে।প্রতিটা মানুষের একটা জন্মের দিন থাকে। তাই আমার ও আছে।এটা নিয়ে বলার কি আছে। ‘

‘এখন কয়টা বাজে বিহান ভাই।’

‘দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ‘আমাকে বিরক্ত করতে ফোন দিয়েছিস এই মাঝ রাতে।তুই জানিস কত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি আমি।এনি ওয়ে বারোটা বাজে এখন।’

‘শুভ জন্মদিন বিহান ভাই।বলেই ফোন টা রেখে দিলাম।’

মনের মাঝে একরাশ কষ্ট জমা হলো।কিন্তু অতটা সরিয়াসলি নিলাম না।আমি জানি উনি রেগে গেলে একমাত্র আমার সাথেই রাগ দেখান বেশী।আমার সাথে রাগ দেখাতে নাকি উনার ভালো লাগে।তাই এটাকে ভালবাসা বলেই গ্রহন করে নিয়েছি।এইরাগের পরেই উনি ভীষণ ঠান্ডা হয়ে যান।আমার অভিমান ভাঙাতে কত দুষ্টুমি করেন।

“প্রেমে পড়েছে এ মন
প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় ভালবেসেছে
সে যেনো আমায় ডাকে
দেখিনা কোথাও তাকে
ভালবাসায় জড়িয়ে সে আমায় নিয়েছে।”
দোলনায় দোল খেতে খেতে গান টা গাইছি আমি।

দুই সুপারি গাছে দড়ি বেঁধে বাচ্চারা দোল খাচ্ছে।বিশেষ করে দোলনা টা আয়রার জন্য ই বানানো।আয়রা কে উঠিয়ে দিয়ে দোলনায় দোল খাচ্ছি আমি।আর গুন গুন করে গান গাইছি।রিয়া পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে আমায়।দোল খেতে খেতে আনমনে তাকে ভাবছি।সেদিন এর সেই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার কথাটা।মন টা সেদিন সেই যে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে আর ফিরে আসে নি।আজ দুই মাস হয়ে গিয়েছে সেই মানুষ টার দেখা নেই।সেই যে দু’মাস আগে গিয়েছে আর কোনো খোজ নেই।

-আচ্ছা মানুষ টা এমন কেনো আমাকে ডিরেক্ট বলতে পারে না যে সে আমাকে ভালবাসে।তার আচরণে এটাই বোঝা যায় যে আমাকে ভালবাসে। কিন্তু মুখ ফুটে তো বলে না। আচ্ছা উনার কি ভাল লাগে আমাকে এই দো’টানায় রাখতে।এবার আসলে আমি নিজেই বলবো আমার মনের কথা।আজ যে তার জন্মদিন সেই খেয়াল কি তার আছে।কাল রাতে যা তা ভাবে আমাকে অপমান করেছেন।কি জানি ঢাকায় গিয়ে প্রেয়সী কে পেয়ে হয়তো আমাকে আর সহ্য করতে পারছে না।

-হঠাত দেখি রিয়ার কোনো সাড়াশব্দ নেই।আমি যে রিয়াকে ডেকেই যাচ্ছি কোনো পাত্তা নেই।হঠাত মনে হলো আমার কাঁধে কারো হাত।হাত টা রিয়ার বলে মনে হচ্ছে না।অথচ দোল দিয়েই যচ্ছে।পেছনে তাকিয়ে দেখেই চমকে গেলাম আমি।এ কি বিহান ভাই উনি।

-পরনে ব্লু জিন্স গায়ে এশ কালার শার্ট ঘাড়ে ব্যাগ ঝোলানো।উনি কি কেবল ই এসছেন।উনাকে দেখেই দৌড় মারার প্লান করলাম।এক নিমিষেই আমার কচি হাত উনার শক্ত হাত দিয়ে আটকে ফেললেন।ছড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম লাভ হলো না।উনার দিকে রাগি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললাম ছাড়ুন আগে ছাড়ুন বলছি।আপনি কোন সাহসে আমার হাত ধরেছেন।আমার মুখে এমন কথা শুনে বিহান ভাই রিতীমত অবাক হয়ে গেলেন।”ভ্রু কুচকে বললেন,আয় হায় পুচকি বলে কি। তোর হাত ধরতে সাহসের প্রয়োজন হলো ঠিক কবে থেকে দিয়া।”

“আপনি আমার হাত ছাড়ুন আগে নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।”

“এই রাজাকারের বংশধর, আয়রা কে দোলনা থেকে নামিয়ে তুই দোল খাচ্ছিস কেনো?বাচ্চারা হলো ফুলের মতো তুই তাদের সাথে অন্যায় করছিস এগুলা ঠিক না।শুনেছি রাজাকার দের সাথে মিশে তোর দাদা অনেক শিশু অত্যাচার করেছে।”

“শিশু অত্যাচার করেছে মানে।”

“মানে তোর দাদী একটা পুচকি ছিলো তাকে বিয়ে করে জোর জবরদস্হী রোমান্স করতো তোর দাদা এটাও তো এক প্রকার অত্যাচার তাইনা?”

“তবুও আমার দাদা ভাল মানুষ ছিলো।মানুষের মতো রাক্ষস ছিলো না।”

“আমি যদি তোর দাদাকে ফলো করি তাহলে আমার শ্বশুরের মেয়ে আমাকে বলবে আমি আস্ত একটা চরিত্রহীন।”

“আপনার এসব আজেবাজে কথা শোনার মুড নেই।এসছেন বাড়ি যান এখানে কি?”

“তোদের বংশে দেখছি সব গুন ই আছে।জামাই এর উপর ও অত্যাচার করে।।না মানে এ বাড়িতে জামাই এলে কি তাড়িয়ে দেওয়া হয়।এই নিউজ আজ ফেসবুকে লাইভে গিয়ে ভাইরাল করবো যাতে এ রাজাকার বংশে কেউ বিয়েই না করে।”

“খবরদার বলে দিচ্ছি আর একবার ও বাংশ তুলে কথা বলবেন না আপনি।”

“-আরে শোন না দিয়া কাল কি হয়েছিলো,হুট করেই খুব মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।সারাদিন অপেক্ষা করেছি কেউ একজন ফোন দিয়ে আমায় ডাকুক আজ তোমার জন্মদিন তোমাকে দেখতে চাই।তুমি এসো।তোমাকে অনেক দিন দেখি না।কিন্তু সে আশা তো পূরণ ই হলো না।বাট হাজার টা কল এসছে আর সবাই জন্মদিন উইশ করেছে।সিরিয়াসলি বলছি দিয়া আমার একদম ই ভাল লাগছিলো না ওই নির্দিষ্ট একটা মানুষের কল ছাড়া।যত মানুষ কল দিয়েছে আমি বার বার ভেবেছি এই বুঝি তার ফোন কিন্ত তার ফোন ই আর আসে নি।অবশেষে ম্যাডামের কল পেয়েছিলাম সে সকালে ফোন দিতে পারতো তাহলে আমি গতকাল ই চলে আসতাম।কিন্তু সে দিন গড়িয়ে গিয়ে রাতে ফোন দিয়েছে।আমি তো আর রোবট না তখন ই চলে আসবো।তখন আসার জন্য ছটফট করছিলাম আসতে পারছিলাম না বলে আরো রাগ হচ্ছিলো। বুঝিস না ক্যান পুচকি।জানিস দিয়া নির্দিষ্ট কারো মায়ায় আটকে গেলে আর বের হওয়া যায় না।উফফ তার ওই পিচ্চি মুখে শুভ জন্মদিন শুনেই সব রাগ মাটি হয়ে গেছিলো।”

উনার মুখপানে তাকিয়ে ছিলাম আমি।যতবার আমাকে বকা দিয়েছে ততবার ই গভীর ভালবাসার উদাহরণ দেখিয়ে গিয়েছে।বিহান ভাই এর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।যাওয়ার সময় আমার হাতে দিয়ে গেলেন এক প্যাকেট ডংডং চিপস।

প্রতিবছর ই কাজিন দের জন্মদিনে আমরা কয়েকজন কাজিন মিলেই সেলিব্রেশন করি।দুই একজন ফ্রেন্ড সার্কাল থাকে।

মামি বিরিয়ানি রান্না করছে,পায়েস রান্না করেছে,কয়েক রকমের পিঠা বানিয়েছে হাতে হাতে সাহায্য করছে বিভোর ভাই এর আম্মু।আমরা ছাদে অনেক গুলা বেলুন দিয়ে সাজিয়ে ফেললাম।আজ বিহান ভাই এর দেওয়া সেই শাড়ি চুড়ি গাজরা পরেছি।বিহান ভাই ও আজ ব্লু পাঞ্জাবী পরেছেন।উফফ উনাকে জাস্ট অসাধারণ লাগছে।

ছাদে শুরু হয়েছে আমাদের কাজিন দের আড্ডা।তোহা আপুর দৃষ্টি সোজা বিহান ভাই এর দিকে।কি জানি কত ভোল্টেজ এর ক্রাশ খাচ্ছে।মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার।তোহা আপু বিহান ভাই কে বলে উঠলো,বিহান ভাই কাল কতবার কল করলাম রিসিভ করেন কেনো?’

‘বিহান ভাই অবাক হয়ে বললেন কোন নাম্বার তোমার?তোহা আপু আরো আশ্চর্য বনে গিয়ে বললো,বিহান ভাই আমার নাম্বার সেভ করেন নি আপনি।বিহান ভাই এর কথায় স্পষ্ট ক্লিয়ার সে তোহা আপুর নাম্বার ই সেভ রাখে নি।এমন কি সে কোনো মেয়ের নাম্বার ই সেভ রাখে না।’

এমন সময় মেহু আপু বলে উঠলো, বিহান ভাই তোহা কিন্তু আপনার নাম্বার মাই ক্রাশ দিয়ে সেভ রেখেছে।

বিহান ভাই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলেন ক্রাশ মানে ছেলেদের চোখ দিয়ে ধর্ষণ করা। ছিঃতোহা ছিঃ এই ছিলো তোমার মনে।আমার বউ জানলে তো মহা সমস্যা।

বিহান ভাই সব সময় এমন আধ্যাতিক কথায় বলে থাকেন।বিভোর ভাই বলে উঠলেন রিয়া আমার নাম্বার কি দিয়ে সেভ রেখেছো বাচপান কা পেয়ার।

রিয়া হেসে দিয়ে বললো বাচপান কা দুশমন।আপনি আর তিয়াশ ভাই আমার ইজ্জত রাখলেন না।ক্লাসের কাউকে প্রপোজ করতে বাদ দিয়েছেন শুনি।

বিহান ভাই বলে উঠলেন রিয়া তোমাদের ক্লাসের বাচ্চাদের ও এই বুইড়া খাটাস মফিজ রা প্রপোজ করে।এরা কিন্তু জীবনে দাঁত ব্রাশ করে না সাবধান।আমার যত বিবাহিত বান্ধবী সবাই কে এরা প্রপোজ করেছে।আমি ইজ্জতের ভয়ে বলি না যে তারা আমার ভাই হয়।প্রেজটিজ বলে কিছুই থাকবে না।তিয়াস ভাই বললো,বিহান ভাই তাহলে কি বলেন আমাদের কথা। বলি হবে কোনো নাপিত টাপিত কিছু।

রিয়া বলে উঠলো,ঠিক ই বলেছেন বিহান ভাই ব্রাশ করে না।আগের দিন বিভোর ভাই এর মুখের বিশ্রি গন্ধে আমি বাসে উনার গা ভরে বমি করে দিয়েছিলাম।

রিয়া আর বিহান ভাই এর কথায় সবাই হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছিলো।

“মেহু আপু বললো বিহান ভাই আমরা এতবার আসতে বললাম আসলেন।হুট করেই এলেন যে।।”

“আসতাম ই না তোমাদের ভাবি রাত বারোটায় ফোন দিয়ে বললো আমাকে অনেকদিন দেখে না।তার মুখের কথা কি আমি ফেলতে পারি।সে যখন ই ফোন দিয়েছে বিহানের মন এখানে হাজির।”

“তাহলে বিহান ভাই ভাবি কি নড়াইল এর ই।”

“সেটা বলা যাবে না।হতেও পারে।”

“আপনি ভাবির কথার এত গুরুত্ব দেন।তাহলে তো আপনি ভাবিকে মারাত্মক ভালবাসেন।আপনার শ্বশুর মনে করেন ভিলেন হয়ে দাঁড়ালো বললো অমুক চৌধুরীর মেয়ের যোগ্য না তুমি যেমন সিনেমায় রাজিব বলে।তখন কি করবেন?”

“সিনেমায় শুধু চৌধুরী না খাঁন ও থাকে।”

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বললেন,”সেই জন্যই তো ডাক্তারি পড়া আমার।বলবো শ্বশুর মশাই আপনার মেয়ের অবস্থা ভালো না। আই সি ইউ তে আছে আপনার জামাই কে ছাড়া বাঁচবে না।আমার হাতে তুলে দিন।”

উনার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হলাম।এই মানুষ টার মাথায় এত সুন্দর সুন্দর আইডিয়া কিভাবে আসে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।