মুনতাহার সেদিনের দেওয়া স্বীকারোক্তির পুরো রেকর্ড’টা অরুণাকে শুনিয়েছিল অঙ্গন। প্রেরণাকে না শুনিয়ে অরুণাকে শোনানোর কারণ হচ্ছে, সে ঠাণ্ডা মাথায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। জমিদার বাড়ির বড়ো গিন্নি হিসেবে অরুণা বয়সে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, ধৈর্য্যে সবচেয়ে এগিয়ে। অলিওরের মৃত্যুর পর পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে শুরু করে গ্রাম এবং শহরের সকল ব্যবসায়িক কার্যক্রমও তার অনুমতি নিয়ে করা হয়৷ জন্মদাত্রী না হলেও পাঁচ ভাই’ই বড়ো আম্মা হিসেবে প্রচণ্ড সম্মান এবং ভালোবাসা দিতো অরুণাকে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সর্বপ্রথম তাকে জ্ঞাত করা হতো। সে নীতি মাথায় রেখেই মুনতাহা এবং মাজহারুলের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অরুণাকে সর্বপ্রথম জানানো হয়। সবটা জানার পর সে ঠিক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাতে সবটা সঠিক ভাবেই এগিয়েছে। তার জায়গায় প্রেরণা হলে কিছুই ঠিকঠাক এগুতো না৷ বরং ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো। হোক মাজহারুল ইসলাম তার বোনের স্বামী, হোক মুনতাহা ভাইয়ের মেয়ে। তৎক্ষনাৎ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো সে৷ প্রণয় ফিরে আসার পর ধীরেধীরে সমস্তটাই উন্মোচিত হলো। সব কিছু জেনে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠল প্রেরণা। মুখে কিছু না বললেও শাশুড়ির এই সিদ্ধান্তে সায় আছে শাহিনুরের। তার বুকের ভিতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রিয় মানুষটিকে এইরূপে দেখে যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে মা’য়ের দেওয়া সেই তলোয়ারটি দিয়ে মুনতাহার শরীর’টাকে ক্ষতবিক্ষত করে, নিষ্ঠুর হৃদয়টাকে বের করে আনতে! স্বামীর প্রতি এতই যখন ভালোবাসা যে অস্ত্রে স্বামীর জীবন গেছে, সে অস্ত্রে তারও প্রাণনাশ হোক। ইচ্ছেটাকে মাটি চাপা দিতে হলো। সেদিনের করা দু’টো হ’ত্যার জন্য আজ প্রণয়ের এই পরিণতি। তাকে ভালোবাসার বিনিময়ে মানুষটা সর্বস্ব হারালো। এ পৃথিবীতে কার পাপের বোঝা কে বয়ে বেড়ায় বোঝা বড়োই মুশকিল। প্রণয়ের এই পরিণতির পেছনে কার পাপ রয়েছে? তার পিতা জমিদার অলিওর চৌধুরী? ভাই পলাশ চৌধুরী? নাকি সে নিজেই! প্রশ্ন থেকে যায় অথচ উত্তর মেলে না। মানুষের জীবনে অহরহ জটিল প্রশ্ন থাকে যার উত্তর মেলানো সম্ভব হয় না। শাহিনুরের জীবনে তেমনি একটি প্রশ্ন, কে দায়ী তার প্রাণপ্রিয় অর্ধাঙ্গের এই পরিণতির জন্য?
সকল ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে মাজহারুল, মুনতাহাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য উন্মাদের মতো হয়ে গেল প্রেরণা। তাকে শান্ত করতে সকলেই ব্যর্থ হলো। সক্ষম হলো শুধু প্রণয়। বরাবরই জন্মদাত্রী’কে মানাতে বেশ পটু সে।
মাজহারুল দেশ ছেড়েছে কয়েকদিন আগে৷ রোমানার মৃত্যুর কারণ মাজহারুলকে জানানো হয়েছিল।প্রণয়কে দেওয়া রোমানার শেষ চিঠি পড়ে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। ভীষণ অনুতপ্তও হয়েছিলেন। ভাগ্যদোষে স্ত্রী, সংসার হারিয়েছেন বহুবছর আগেই৷ পুনরায় ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের স্বীকার হয়ে মানুষদের প্রতি সমস্ত ক্ষোভ কেটে যায়। প্রণয়কে রোমানা ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসার গভীরতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখার অবকাশ নেই। মেয়ের ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়ে, নিজের কর্মে লজ্জিত হয়ে প্রণয়ের বিরুদ্ধে করা সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়েছেন। আফসোস একটাই তার অনুতপ্ততা বদলে দিতে পারেনি কিছুই। তবুও সে চেষ্টা করছে যদি বদলানো যায়? নয়তো তার মেয়ে রোমানা পরকালেও তাকে ক্ষমা করবে না। কক্ষনো না!
মুনতাহা পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে চিরজীবনের মতো বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু সে তার বাপের বাড়িতে যায়নি। রাস্তায় রাস্তায় দু’দিন ঘুরে বেড়িয়েছে।যেমনটি পথেঘাটে অসংখ্য পাগলেরা ঘুরে বেড়ায়৷ পাঁচফোড়ন গৃহের কেউ তার খোঁজ নেয়নি। বাপের বাড়ির সবাই জানতো সে শশুর বাড়িতে রয়েছে। তৃতীয় দিন বখাটেদের খপ্পরে পড়ে। রাস্তা থেকে জোর পূর্বক গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় বখাটেরা৷ দীর্ঘ তিনঘন্টা সময় পর যেখান থেকে তুলে নেয় ঠিক সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে চলে যায়। রাতের ঘটনা ছিল৷ সকাল হতেই স্থানীয়দের নজরে পড়ে। স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ মুহূর্তে সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ইতিমধ্যে মুনতাহার পরিবারের লোকজন পাঁচফোড়ন গৃহের প্রতিটি সদস্যের বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিয়েছে। কেস নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। মুনতাহার পরিণতি শুনেই অনেকের বুক ভারী হয়ে ওঠেছে। অস্বীকার করা যায় না মেয়েটা একসময় খুব ভালো ছিল! একেবারে মোমের মতো নরম মন ছিল তার। হায়রে নিয়তি! সকলের বুকচিরে তার জন্য শুধু আফসোস বেরিয়ে এলো। পাপিষ্ঠদের পরিণতি এতটাই ভয়াবহ হয় যে সে পরিণতি দেখে অন্য পাপাত্মারাও কেঁপে ওঠে!
___
নিদ্রাহীন আরো একটি রাত কাটলো। সারারাত বসে প্রিয়তমের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল শাহিনুর৷ তবুও যেন চোখের তৃষ্ণা মেটেনি৷ মাঝে অবশ্য মেয়েটা খুব জ্বালিয়েছে। কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা সুখ মিলেমিশে একাকার হয়েছে। শেষবার প্রণয় যখন জাগলো, দেখতে পেলো শাহিনুর মেয়েকে খাওয়িয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। মুচকি হেসে সে হাত বাড়িয়ে বলল,
-‘আমি ঘুম পাড়াচ্ছি তুমি শুয়ে পড়ো।’
ধ্যানমগ্ন থেকেই শাহিনুর মাথা দোলালো। প্রণয় মৃদু হেসে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। প্রগাঢ় চাহনিতে প্রিয়তমার দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘সারাজীবন পড়ে আছে একরাতেই দেখে শেষ করবে নাকি?’
একজোড়া তৃষ্ণার্ত চোখে এবার একরাশ লজ্জা এসে গেঁড়ে বসলো। নত মস্তকে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলল। ধরা পড়ে গেছে সে। এ আর নতুন কি? এর আগেও যে বহুবার এভাবে ধরা পড়েছে, স্বামী নামক ধূর্ত পুরুষটি এভাবেই লজ্জা দিয়েছে। মানুষটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে চেনে তাকে। ডাক্তারসাহেবের চন্দ্রকান্তা যে রাতের আঁধারের স্বল্প আলোতে ঘুমন্ত ডাক্তারসাহেব’কে দেখতে ভীষণ ভালোবাসে! এ খবর কারো অজানা নয়। এ খবর আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, নক্ষত্র, নির্জন, নিস্তব্ধ রাতের প্রকৃতি সকলেই জানে। পরিপূর্ণ রূপে বিশ্বাস করে।
লজ্জাবতী লতিকাটির মতো গুটিয়ে নেওয়া শাহিনুর’কে মুগ্ধতা ভরে দৃষ্টিপাত করল প্রণয়। বুকের ভিতরটা টনটনে করে ওঠল খুব। চোখের তৃষ্ণা অনেকটাই মিটেছে, বুকের তৃষ্ণা একটুও মেটেনি। চোখে আকুলতা, হৃদয়ে তরঙ্গ, সম্মুখে রক্তিমা ভরা শ্রীঅঙ্গ, তার পুরুষালী অনুভূতিরা চনমনে হয়ে ওঠল। হাত বাড়িয়ে মোহভরা কণ্ঠে হঠাৎই বলল,
-‘আমার হৃদয়ের রানি হৃদয়ের কথা কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?’
সহসা মাথা তুলে তাকাল শাহিনুর। দৃষ্টিজোড়া ঝাপসা হয়ে ত্বরিতগতিতে প্রণয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আলতো হেসে তাকে সামলে নিয়ে প্রণয় বলল,
-‘ধীরে সুখের লেগে যাবে।’
শাহিনুর কথা শুনলো না। লোমশেঘেরা শ্যামবর্ণীয় সুঠাম বুকটায় নাক ডুবিয়ে চিরচেনা ঘ্রাণে মাতাল হয়ে পড়ল। ক্ষণে ক্ষণে ভেজা ঠোঁটে চুমু দিয়ে উষ্ণ বুকটা আর্দ্র করে তুলল। প্রণয় কৌশলে তাকে সামলে নিলো। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলো তার হৃদয়ের রানিকে। তুলতুলে নরম শরীরটা নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়ে বিড়াল ছানার মতো বুকে পড়ে রইল। একেকটা আদুরে স্পর্শে তার চোখ বেয়ে সুখের নোনাপানি ঝড়তে শুরু করল। সে নোনাপানির স্পর্শে প্রণয়ের বুক ভেসে গেল। সুক্ষ্ম ব্যথা বুকের গভীরে কামড়ে দিতেই চমকে ওঠল সে। দু’হাতের আঁজলে সিক্ত কোমল কপোলদ্বয় আঁকড়ে ধরে আদুরে কণ্ঠে বলল,
-‘কাঁদলে চলবে? কাঁধে যে অনেক বড়ো দায়িত্ব।’
শাহিনুর ডুকরে ওঠে বলল,
-‘সব সামলে নেবো শুধু আপনি পাশে থাকুক। কাছে থাকুন। আপনি আমার শক্তি, আপনার ভালোবাসা আমার সাহস।’
তৃপ্তিময় হাসলো প্রণয়। ধীরে ধীরে তার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরল শাহিনুরের সিক্ত অধর। এ যেনো বহুকাল অনাবৃষ্টির পর ধরণীর বুকে একমুঠো বৃষ্টির ছোঁয়া। বৃষ্টিহীন এক বৃষ্টিস্নাত ভোরের আগমন ঘটলো প্রণয়, শাহিনুরের জীবনে। প্রেমের বর্ষণে ভিজে ওঠল দু’জোড়া তৃষ্ণার্ত ঠোঁট। যে বর্ষণের সমাপ্তি নেই। আছে শুধু প্রণয়। শাহিনুর শালয়ার জীবনে স্বামী, সন্তান, প্রেম প্রীতিই শেষ ঠিকানা।
[১১৯]
সকালবেলা প্রণয়’কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে স্নানাগারে নিয়ে গেল শাহিনুর৷ ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে প্রণয়ের হাতে দিতেই প্রণয়ের নির্নিমেষ চাহনিতে আঁটকে গেল। মুচকি হেসে প্রণয় বলল,
-‘বেশ সামলেছ তো!’
প্রশান্তিদায়ক শ্বাস ফেলে শাহিনুর বলল,
-‘আমার মানুষ তাই বেশ করেই সামলাচ্ছি।’
-‘পাক্কা গিন্নি! বড়ো হয়ে গেছো!’
-‘সে তো কবেই হয়েছি। আপনার সুখের মা’য়ের ছোটো থাকলে চলবে?’
কথার ফাঁকে মাথার ঘোমটা ফেলে চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। চোখের ইশারায় প্রণয়কে দ্রুত ব্রাশ করতে বলল। প্রণয় দাঁতে ব্রাশ লাগালো ঠিকি কিন্তু তার দৃষ্টি শাহিনুরেতেই স্থির রইল। এমন একজন সঙ্গী পেলে এ জীবনে সত্যি আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না।তারও প্রয়োজন নেই। এবার জমিয়ে সংসার করবে দু’জনে। একসঙ্গে, একে অপরকে আঁকড়ে বাঁচবে। বাচ্চা মানুষ করবে। সুদুরপ্রসারি ভাবনায় তলিয়ে যেতেই কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে ওঠল। সুখ কাঁদছে। তার মেয়ে কাঁদছে! মেয়েটা কাঁদলেই কেমন কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে। শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল,
-‘কী আশ্চর্য এতদিন মেয়ের মায়ের কান্নায় বুকের ভিতর যন্ত্রণা হতো, এখন মেয়ের কান্না কলিজাতে আঘাত করে!’
কথাগুলো বলতে বলতে হুইলচেয়ার ঠেলতে শুরু করল। শাহিনুর বাঁধা দিলো। বলল,
-‘আমি দেখে আসছি আপনি অস্থির হবেন না। ঘুম ভেঙেছে তাই কাঁদছে, কাছে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
ধীরপায়ে শাহিনুর কক্ষে যেতে যেতেই প্রেরণার আগমন ঘটলো। দরজা খোলা, সুখ কাঁদছে তাই সরাসরি ঢুকেই সুখকে কোলে তুলে নিলো। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
-‘আমার বুবু ওঠে পড়ছে! না না কাঁদে না আমার বুবুটা কত ভালো, কাঁদে না।’
শাশুড়ির আগমনে স্বস্তি পেলো শাহিনুর। বলল,
-‘আপনি একটু ওকে রাখুন আম্মা।’
প্রেরণা শাহিনুরকে দৃষ্টিপাত করে হতাশ স্বরে বলল,
-‘তা রাখি। প্রণয়ের নাস্তা তৈরি, গিয়ে নিয়ে আসো। শরীরটা ভেঙে পড়ছে অনেক। যত্নআত্তি ঠিকভাবে করো।’
শাহিনুর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। প্রেরণা চলে যেতে উদ্যত হয়েও থেমে গেল। পেছনে ঘুরে নিচু কণ্ঠে বলল,
-‘যদি পারো বুঝিয়ে শুনিয়ে চিঠিতে লেখা মাজহার ভাইয়ের কথাগুলো জানিও৷ তুমি বললে রাজি হতেও পারে।’
প্রেরণা চলে গেল। শাহিনুর কয়েক পল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার প্রতি প্রণয়ের ভালোবাসার কমতি নেই, ঠিক। তার জন্য মানুষটা সব পারে সব। তবুও পুরুষ মানুষ। ব্যক্তিত্ব ভয়াবহ রকমের শক্ত। সবার বিশ্বাস সে মানাতে পারবে মানুষটাকে। কিন্তু শাহিনুরের বিশ্বাস নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একটুও নড়বে না প্রণয়। তবুও একবার চেষ্টা করবে যদি সফল হয়?
নাস্তা শেষে কফির আবদার করল প্রণয়৷ শাহিনুরও এক মুহূর্ত অন্য কাজে অপচয় করল না। রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানালো। কফির মগ হাতে সে যখন নিজের কক্ষে যাচ্ছিল হঠাৎ স্বপ্ন’কে কোলে নিয়ে সখিনা এসে তার সামনে দাঁড়াল। বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বলল,
-‘ভালোই যত্নআত্তি করতাছেন সেজো ভাবি। তা এই যত্নআত্তি কয়দিন থাকব? আজকাল কি কেউ পঙ্গু স্বামীর ঘর করে ? আহারে ভাবলেই খারাপ লাগে, কত ভালোবাসতো আপনাকে। সব কেমন হয়ে গেল!’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সখিনা৷ শাহিনুর দাঁতে দাঁত চেপে চোখ,মুখ শক্ত করে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। বলল,
-‘স্বপ্ন কোলে ছিল বলে ছেড়ে দিলাম। নয়তো পরপর থাপ্পড় লাগিয়ে যে মুখ দিয়ে আমার ডাক্তারসাহেব’কে পঙ্গু বলেছিস সে মুখ থেঁতলে দিতাম।’
শাহিনুরের হাত কাঁপছে ফলে কফির মগটাও কাঁপছে। সখিনা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলল,
-‘সত্য কথা কইলে এত গা’য়ে লাগে ? এত ভালো মানুষি দেখাই লাভ কী? কয়দিন পর এইসব থাকব? ‘
-‘আমাকে নিয়ে একদম মাথা ঘামাবি না। নিজের সংসার নিজের অধিকার টিকিয়ে না রেখে আমার পেছনে পড়ে থাকলে তোর ক্ষতি বৈ কি লাভ হবে না। ভালোবাসা জিনিসটা তুই বুঝবি না৷ তুই তো শুধু পুরুষদের ভোগের সামগ্রী হয়েছিস, কলঙ্ক মুছতে একজন আদর্শ পুরুষকে তোর সন্তানকে পিতৃপরিচয় দিতে বাধ্য করেছিস। তুই কীভাবে ভালোবাসা বুঝবি? আমার বাচ্চার বাবা বেঁচে আছে। একটা হালাল সম্পর্কে থেকে হালাল সন্তান নিয়ে আমরা সংসার করছি। তোর মতো চুনোপুঁটি কী করে আমার অনুভূতি বুঝবে?’
কথাগুলো শেষ করে অত্যন্ত দাম্ভিকতার সঙ্গে চরণদ্বয় ফেলে চলে গেল শাহিনুর। সঙ্গে সঙ্গে সখিনার সামনে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধতার সঙ্গে এসে দাঁড়াল অঙ্গন। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘কোন সাহসে তুই নতুন ভাবির সঙ্গে এভাবে কথা বলিস?’
কেঁপে ওঠল সখিনা৷ অঙ্গন ওর কোল থেকে স্বপ্ন’কে নিয়ে হুংকার ছাড়লো,
-‘সমাজের চোখে তুই আমার বউ হলেও আমার চোখে সামান্য এক ভৃত্য ছাড়া কিছুই না। খুবই অল্প সময় এবং শেষ সুযোগ দিলাম। নিজেকে শুধরে নে। নয়তো এ বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় দেবো তোকে। তোর মতো ছোটোলোক ঘরের মেয়ের গর্ভে এ বাড়ির সন্তান এসেছে এটা আমাদের দূর্ভাগ্য। সেই দূর্ভাগ্যকে সৌভাগ্য করতে বেশি সময় লাগবে না। পিতৃহীন সন্তানকে যেমন পিতা দেওয়া হয়েছে তেমন মাতৃহীন শিশুকে মাতা দেওয়াও বা’হাতের খেল। আবারও বলছি, নিজেকে শুধরে নে। নতুন ভাবির পা ধরে আজি ক্ষমা চাবি। তাহলে যতটুকু পেয়েছিস তা চিরকাল অব্যাহত থাকবে। অন্যথায় এ বাড়িতে, স্বপ্নের জীবনে তোর স্থান শেষ!’
__
-‘বহুদিন পর তোমার হাতে এটা পাচ্ছি।’
কফির মগ সামনে ধরতেই আলতো হেসে বলল প্রণয়। কফির মগে ধীরগতিতে চুমুক দিলো। তৃপ্ত চোখে তাকিয়ে কয়েক পল তা দেখল শাহিনুর। হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে ত্বরান্বিত হয়ে বিশাল কাঠের আলমারির সামনে গিয়ে কপাট খুলল। হাতের চুরি, কানের দুল, গলার হার, পুনরায় প্রণয়ের কাছে এলো। বসলো সামনে৷ কফির মগে চুমুক দিতে দিতে চোখ তুলে তাকাল প্রণয়৷ বাচ্চাদের মতো বায়না ধরার ভঙ্গিতে শাহিনুর বলল,
-‘পরিয়ে দিন।’
ভ্রু উঁচু করে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কফিতে আরেক চুমুক দিলো সে। শাহিনুর লজ্জা পেয়ে মাথা নত করল। আলতো হেসে কফির মগটা পাশে রাখল প্রণয়। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে চুরি দু’টো হাতে নিতেই শাহিনুর দু-হাত এগিয়ে দিলো। প্রণয় এক পলক তাকিয়ে পুনরায় হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করল। গোলাপী ফর্সা হাতের কব্জি দুটোতে সুক্ষ্ম ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার অবর্তমানে নিজের প্রতি একটুও যত্ন নেয়নি শাহিনুর৷ কব্জিগুলোতে পাতলা চামড়া ব্যাতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ স্বাস্থ্যের অবনতি কতটা হয়েছে সচক্ষেই দেখলো সে। টুনটুনি দাদির বাড়িতে থাকাকালীন যেসব খাবার খেয়েছে, বাইজি গৃহে থেকে ঠিক সেসবই খেয়েছে। যত ভালো খাবারই পাঠানো হোক সে ছুঁয়েও দেখেনি। কারণ তার স্বামী কীভাবে আছে, কোথায় আছে, কী খাচ্ছে সেসব কিছুই জানে না সে। তাই স্বার্থপরের মতো বিলাসী জীবন, রাজকীয় আহার সে গ্রহণ করতে পারবে না। ঘোষণা করে দিয়েছিল৷ প্রণয় চৌধুরীর বউয়ের জেদ টলানোর সাধ্যি কার? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
-‘ভালোবেসে আমি কচু খেয়েছি বলে তুমি আমিষ ছাড়বে!!! ইটস ভেরী ব্যাড।’
চমকে ওঠল শাহিনুর৷ প্রণয় কথার ফাঁকেই চুরি দু’টো পরিয়ে দু’হাতের উল্টে পিঠে বেশ শব্দ করে দুটো চুমু খেল। শাহিনুরের মুখটা থমথম করছে। প্রণয় সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কানের দুল জোড়া পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
-‘একদম উচিৎ হয়নি।’
-‘আপনি যে স্বার্থপরের মতো আমার সব খবর রেখেছেন। আর আমাকে একটা খবরও দেননি তার বেলায়?’
জাবাব দিলো না প্রণয়৷ ইশারা করল পিছন ঘুরে বসতে৷ বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনল সে। শাড়ির আঁচল সরিয়ে সযত্নে হার পরিয়ে দিলো প্রণয়। কোঁকরানো চুলের বড়োসড়ো ক্ষোপাটার পাশ দিকে মুখ এগিয়ে কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াল। শিউরে ওঠল শাহিনুর। প্রণয়ের ঠোঁটজোড়া আরো গভীর করে স্পর্শ করল তাকে। মুহূর্তেই ঘুরে বসে স্পর্শের মালিক’কে জড়িয়ে ধরল শাহিনুর। ডুঁকরে ওঠে বলল,
-‘আমি কী করে সেই সব দিন ভুলে যাই? আমার জন্য যে মানুষটা আহার পর্যন্ত ত্যাগ করেছে। সেই মানুষটার অস্তিত্ব যখন অনিশ্চয়তায় ছিল তখন কী করে আমি সুখ ভোগ করি ? কী করে আপনার প্রিয় প্রিয় খাবারগুলো খাই। আপনি ছাড়া আমি কী করে সুখে থাকি বলুন?’
-‘ স্বাদে কি বলি তুমি আমার বোকাসাহসী? বোকার মতো কাঁদছ নুর। চুপ করো।’
প্রণয়ের কণ্ঠে দৃঢ়তা। শাহিনুর শান্ত হলো। ধীরে ধীরে সরে বসলো। তার অশ্রুসিক্ত কপোলদ্বয় আদুরে স্পর্শে মুছে দিলো প্রণয়৷ সে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-‘রোমানা আপার বাবা আপনাকে একটি চিঠি দিয়েছে।’
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
-‘কীসের চিঠি?’
চিঠি এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘পড়ে নিন।’
চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর স্বরে প্রণয় বলল,
-‘তুমি পড়ো আমি শুনছি।’
আদেশ পেয়ে ধীরে ধীরে পুরো চিঠি পড়ে শেষ করল শাহিনুর৷ মাজহারুল তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়৷ বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে কৃত্রিম পা লাগিয়ে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করতে চায়। সে যেন রাজি হয় তাই বিভিন্ন ভাবে প্রতি লাইনে বুঝিয়েছে। বার বার ক্ষমা চেয়েছে। সবটা শুনে, বুঝতে পেরে প্রণয়ের দৃষ্টিজোড়া কঠিন হয়ে এলো। সে দৃষ্টি দেখে শাহিনুর ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। প্রণয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অত্যন্ত কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-‘আমায় নিয়ে তোমার সমস্যা হচ্ছে?’
চমকে ওঠল সে। ভীতিকর চোখে একবার তাকাল সুখের আব্বুর দিকে। পুনরায় আবারো কঠিন কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠল,
-‘বলো আমাকে নিয়ে তোমার সমস্যা হচ্ছে? একবার বলো, শুধু একবার উচ্চারণ করো তুমি তোমার পঙ্গু স্বামী’কে মেনে নিতে পারছো না। ‘
প্রণয় খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ আঁতকে ওঠে সহসা প্রণয়কে জড়িয়ে ধরল শাহিনুর। কম্পিত কণ্ঠে বার বার করে বলতে লাগলো,
-‘অমন করে বলবেন না, অমন করে বলবেন না। আপনি বেঁচে আছেন, আমি আপনার মুখ দেখতে পারছি, আপনার বুকে মাথা রাখতে পারছি এই অনেক। আর কিছু চাই না আমার। একটুও সমস্যা হচ্ছে না আমার। আমি শুধু আপনাকে ভালোবাসতে চাই, ভালো রাখতে চাই বিশ্বাস করুন। কে বলেছে আপনার পা নেই? কে বলেছে আপনি পঙ্গু? স্ত্রী যদি স্বামীর অর্ধেক অঙ্গ হয় তাহলে আমার দুটো পা কি আপনার পা নয়? এক অঙ্গ অঁচল হয়েছে তো কী হয়েছে আরেক অঙ্গ দিব্যি সচল রয়েছে। ওভাবে বলবেন না, ক্ষমা করুন আপনি আমায়।’
চোখ বন্ধ করে হাঁপ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল প্রণয়। দু’হাতে শাহিনুরকে বুকের গভীরে জড়িয়ে ধরল। অত্যন্ত ভাড়ী কণ্ঠে বলল,
-‘তাহলে এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।’
শাহিনুর মাথা নাড়াল, না বোঝালো। বার বার বলতে লাগলো,
-‘আর বলবো না, একটুও মাথা ঘামাবো না।’
প্রণয়ও শান্ত হলো। মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
-‘যেখানে তোমার সমস্যা নেই সেখানে আমারও কৃত্রিম পা’য়ের প্রয়োজন নেই।’
শাহিনুর কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘আরো একটি কথা ছিল!’
কাঁপা কণ্ঠ শুনে প্রণয় তাকাল ওর মুখের দিকে। ভালোবাসাময় একটি স্পর্শ এঁকে দিলো ঠোঁটজোড়ায়। স্মিত হেসে আদুরে কণ্ঠে বলল,
-‘গলা কাঁপে কেন? স্বাভাবিক হয়ে কথা বলো। তুমি আমাকে ভয় পেলে আরো বেশি রাগ হবে আমার।’
শাহিনুর চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল,
-‘আপনার যেসব সার্টিফিকেট বাতিল করা হয়েছে ওগুলো নিয়ে উপরমহলে আলোচনা করতে চান খালুজান।’
প্রচণ্ড ক্রোধে চোয়ালজোড়া ফুলে ওঠল। তবুও শাহিনুর’কে শান্ত কণ্ঠে বুঝিয়ে বলল,
-‘হারানো সম্মান কখনো ফিরে পাওয়া যায় না। সম্মান বাজারে কিনতে পাওয়া কোন পণ্য নয়। এটা বেচাকেনার জিনিস নয়। এটা হচ্ছে অর্জন করার জিনিস। সবচেয়ে বড়ো কথা আমার জীবনে ঐ কাগজগুলোর মূল্য সবচেয়ে বেশি ততদিন ছিল, যতদিন তুমি আমার জীবনে ছিলে না। যেদিন থেকে তুমি নামক মূল্যবান সম্পদটুকু পেয়েছি সেদিন থেকে সবচেয়ে মূল্যবান বলতে এক তোমাকেই বুঝি। এরপর না কাউকে পরোয়া করি, আর না কিছু কে পরোয়া করি। ঐ কাগজগুলোতো অতি নগন্য বিষয়। তাছাড়া পরপারে ঐ কাগজগুলো আমার পাশে থাকবে না, তুমি থাকবে। যা হারিয়েছি তা ফিরে পেতে চাই না। কেউ আমার সম্মান কেঁড়ে নিয়ে আবার ফেরত দেবে আর তা আমি সাদরে গ্রহণ করব! তোমার স্বামীটি অমন ব্যক্তিত্বের নয় নুর।’
লেখকের কথা: শেষ পর্ব অনেক বড়ো হতো। কয়েকজন পাঠক জানালো, বেশি বড়ো পর্ব তাদের পড়তে অসুবিধা হবে। তাই আর বাড়াইনি এই পর্বে। যেভাবে পাঠকদের সুবিধা হয় সেভাবেই দেবো। সকল পাঠকদের ভালোবাসা রইল। ❤